বরাবরের মত বাস আজকেও সময় মত এল না। আজকে মিনিট দশেক দেরি। শহরটা ছোট, সীমিত, সবুজ। মূলধারার আমেরিকান শহর। হলিউডি চমক-জমক নেই এখানে। ঘামের শহর, নামের নয়। লোকসংখ্যা খুব একটা বেশি না। লাখ তিনেকের মত হবে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এখানে খুবই দীন। তবে কারণটা মানুষের সংখ্যা নয়, মানুষের ধরন। সাদা আর কালো। বেশি বেশি কালো, কম কম সাদা। কারও হাতে বেশি বেশি সম্পদ, কারও হাতে একেবারেই কম। সম্পদশালীরা শুধুই সাদা। দুস্থরা শুধুই কালো। পাবলিক তাই কালো। পাবলিক ট্রান্সপোর্টও তাই। বাসগুলো যেন সভ্যতার চিড়িয়াখানা। দারিদ্র্যের ভ্রাম্যমান যাদুঘর। যারা চড়ে তারা আমার মত। ঠিক যেমন আমিও আর সবার মত।
ডিপ সাউথের শহর। দুর্বলতম অঙ্গরাজ্য। দুই মহা-হারিকেনের দ্বৈত দাপটে অধুনা তারকাখ্যাতি পাওয়ার পরও বদলায়নি লুইজিয়ানার কোন কিছুই। এর রাজধানিতে রাজা আছে, ধন নেই। তবু পাথরের বুক চিরে পানি আনার কড়কড়ে সবুজ নেশায় আমিও চড়লাম বাসে। বরাবরের মত শেষের এক কোণায়। নিরাপদ দূরত্বে বসে মানব দেখে মানস চেনার অক্ষম চেষ্টা। সংখ্যালঘুর অবসর। ঘন্টাখানেক অনেক সময়। একে একে বাসে চড়লো অনেকে। কেউ বানর, কেউ বিড়াল, কেউ বেজি। মানুষের পূর্বপুরুষ সবাই, কিন্তু কেউ মানুষ না।
বানরটা ব্যাস্ত বেশ। ঝুলে পড়া জিন্সের হাফপ্যান্ট এক হাতে মুঠ করে ধরা। গায়ে হাতাকাটা গেঞ্জি। মাথায় বারান্দাওয়ালা টুপি। মুখে ললিপপ। হাঁটুর নিচের পকেটে ঝুনঝুন করছে খুচরা পয়সা। পায়ে দুধের মত সাদা কেডস। ঝুলছে অনেক। দুর্বোধ্য হিপহপের সাথে সাথে আওয়াজ দিচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ। পাশের লোকটার দিকে ফিরে কিছু বললো। ইবনিক্স। ভাষার দাস্ত থেকে জন্মানো দুর্বোধ্য কিছু ধ্বনিমালা। আলাপন শেষে বিশেষ অঙ্গভঙ্গি ছাড়া এর অর্থ পূর্ণ হয় না। উল্টা দিকে বসা বাচ্চা ছেলেটার সাথে জমেছে মনে হয় বেশ। বাচ্চাটা বাসের ফ্লোরে গড়াচ্ছে, বানর উৎসাহ দিচ্ছে, বাচ্চার বাপ গর্বিত চোখে ছেলের কীর্তি দেখছে।
বিড়ালটার সাজ অনেক। রাঙ্গানো নখ, বাঁধানো দাঁত, পাঁকানো চুল। নকল নখের উপর টকটকে লাল পলিশ। দাঁতে পিতলের আচ্ছাদন। চুলগুলো লালচে, রুক্ষ। জিভে আংটি। হাতে ছয়টা। একেক কানে চারটে করে ছিদ্র অলংকৃত হয়ে আছে বিবিধ আকারের ধাতুতে। এর উপরই ঠেসে ধরে আছে মোবাইলটা। তারস্বরে বকছে কাউকে। ঐ প্রান্তের হতভাগা কী পাপ করেছিলেন বোঝার জো নেই। তবে এটুকু জানা গেল যে ঐ প্রান্তে পুরুষ কেউ এবং তার জন্মপরিচয় কিছুটা ধোঁয়াশা। লোকটার মা তেমন সুবিধার মহিলা নন। কয়েদি ও নাবিকদের লোকটার সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত। পরবর্তী দেখায় লোকটার তোবরানো গাড়িটা তার পশ্চাৎদেশ দিয়ে প্রবেশ করানো হবে। এহেন আরো অনেক অনাহূত তথ্যে ভেসে গেলাম চোখের পলকে। বড় জাঁদরেল বিড়াল।
বেজির হাতে একটা ব্যাগ। তাতে দুটো গোলাপি টুপি, কয়েক ফাইল মাথাব্যাথার ওষুধ, চার হাত লম্বা কিছু টি-শার্ট, মাছের আঁশের মত ডিজাইনের একটা হাতব্যাগ, ডজন খানেক সিগারেটের প্যাকেট। লজেন্সও আছে কিছু। সাধছে এক মহিলাকে। মানা করায় ক্ষেপে গেল খুব। যেন সাধিবামাত্র কিনিতে বাধ্য থাকিবে। না, মহিলা তবু কিনছে না। নিজেই সাবার করে দিল এবার লজেন্সটা। খোসাটার ঠিকানা হল পাশের সিট, আর মুখের গামটা লেগে গেল সিটের নিচে। উঠে গিয়ে আরেক জনের পাশে বসলো। এবারে সফল। এক শিশি টাইলানল। দামটা বেশি মনে হল একটু। কে জানে, শিশিতে কী বেঁচলো। দাওয়াই, নাকি রোগ।
আমার দিকেই আসছে। কিছু বলবে মনে হয়। কিছু বললো মনে হয়। কিছু শুনবার অপেক্ষায় মনে হয়। প্রথম নিয়ম খাটে না এরকম অবস্থায়। চলন্ত বাসের ভেতর আটকা। দুঃখিত বলে দ্রুত হেঁটে চলে যাবার পথ নেই। দ্বিতীয় নিয়মও অচল। জনসমাবেশে নিরাপত্তা খোঁজার অবস্থা নেই এখানে। সেফটি ইন নাম্বারস কথাটা খাটে না এই চিড়িয়াখানায়। অগত্যা তৃতীয় নিয়ম। ফেস ইওর ফিয়ার উইথ এ গ্রেশাস স্মাইল। স্থিরদৃষ্টে চেয়ে রইলাম বেজির চোখের দিকে। আলতো করে মাথা দুলিয়ে বললাম, নো থ্যাংকিউ। আরেক পশলা ইবনিক্স। আমার ভাণ্ডার থেকে বেজির জন্য আরও কিছু স্মিত হাসি। হাত মেলাতে চায়। যাক, নিরীহ বেজি। কিছু উপদেশ দিয়ে গেল। ইউ বি গুড ছাড়া কিছু উদ্ধার করতে পারলাম না। দূর থেকে ইশারা করছে। জবাবের ভঙ্গি জানা নেই। হাসিই সই।
বিদীর্ণ ঘরবাড়ি, সতের ইঞ্চি সাইজের কাস্টম হুইল, আর বুক কাঁপানো বেজ। কাল্লুপাড়ায় এসে গেছি। ভরে গেল বাসের সবটা। আমার পাশের সিটটা খালি থাকলেই হয়। সবার গায়ে কাজের পোশাক। সবার হাতে ফোন। সবার আলগা নখ। সবার নিম্নার্ধ্ব কুশ্রী রকম মোটা। প্রতি তিনজনে একজন হাসলে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে পিতলের সূর্যে। ছেলেগুলো সবাই যেন বিড়ালটার প্রতিবিম্ব। কারও হাতে ওয়েলফেয়ারের টাকায় কেনা ঘড়ি। কেউ বাস্কেটবল খেলছে ছায়ার সাথে।
মেয়েটার রং বেশ সুন্দর। কিছু কালোর গায়ের রং সাদাদের মত হয়। তাই বলে এতটা? নাহ, সাদাই তো। চুল পরিপাটি করে বাঁধা। জুতার ফিতে বাঁধা। জামাটা প্যান্টে গোঁজা। কিন্তু এই মেয়ে এখানে কেন? বুঝলাম ফ্রি কান্ট্রি, তাই বলে এই এলাকায় সাদা মেয়ে কেন? ব্যাগটা দেখে মনে হচ্ছে না তেমন অবস্থাসম্পন্য। ভাড়া কম দেখে এখানে থাকে হয়তো। এভাবে দেখা ঠিক না। বাইরের দিকে চেয়ে সুর ভাজি কোন কিছুক্ষণ। মেয়েটার চুলে সিঁথি ছিল। ক্লিপ দিয়ে আটকানো ছিল। প্যান্টটা কি পরিষ্কার ছিল, নাকি ময়লা? ময়লা হলে এপাড়ায় বিবাহিত, পরিষ্কার হলে ভাগ্যাহত। টিকেট কি প্রিপেইড কার্ডে পাঞ্চ করলো, নাকি কয়েনে দিল? কার্ডে দিলে এখানেই থাকে, কয়েনে হলে কোন কাজে এসেছিল।
পাশে গিয়ে বসলেই পারি। আড়চোখে দেখে নেওয়া যাবে। চাই কি বৃত্তান্ত জেনে নেওয়াও যেতে পারে। পুরো বাস ভরা হলেও মেয়েটার পাশের সিটটাও খালি।
2 comments:
Ki bolobo, Songshkritichitro? Bahoba! More like this! Words to na, rolling culture-watch!
thanks, dosto. :)
Post a Comment