Thursday, January 24, 2008

অপঘাত ও কিছু বানরের কীর্ত্তন

১.
সাদ্দামের দুই পুত্রকে মনে আছে? উদে ও কুসে। আনাড়ি হাতের কসমেটিক সার্জারির পর মোটামুটি ভদ্রস্থ চেহারার এই দুই পশুর মরদেহ দেখতে দেওয়া হয়েছিল মিডিয়াকে। এক ভাইয়ের বুকে লোহিত সাগর তো আরেক ভাইয়ের মুখের উপর দিয়ে রাজধানী এক্সপ্রেস। কাফনের কাপড় পড়ানো অবস্থায়ও মানচিত্রসুলভ বিভিন্ন আঁকিবুকি ছিল তাদের দেহে। একেকটি ক্ষত দেখে নিশ্চিত ভাবে বলে দেওয়া যায় তাদের আহত হবার ধরন ও কারণ।

পত্রিকার রিপোর্টের এক কোণায় ছোট্ট করে লেখা ছিল মৃত্যুর সময় তাদের সাথে থাকা বিভিন্ন জিনিসের তালিকা। একটি করে বন্দুক, সুগন্ধী, ব্যবহৃত কন্ডম, বাড়তি মোজা। জ্বী, আমিও ঝাকি খেয়েছিলাম। কোথায় যেন পড়েছিলাম, একজন মানুষ মৃত্যুকালে তার সাথে কী কী পাওয়া যায়, তা দিয়ে তার সারা জীবনের মানচিত্র খুব সহজে এঁকে ফেলা যায়। অব্যর্থ প্রমাণ পেয়ে গেলাম যেন।

২.
অপঘাতের ক্যাম্পাস হিসেবে ভার্জিনিয়া টেকের বেশ সুনাম হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। এই শরৎ পর্যন্ত পরপর তিন সিমেস্টার ধরে ক্যাম্পাসে কোন না কোন অপঘাতের ঘটনা ঘটলো। আমেরিকার সবচেয়ে নিরাপদ দশটি শহরের একটি হিসেবে বিশেষ গর্ব ব্ল্যাক্সবার্গের। সেখানে আচমকা এমন শনি লাগার কারণ কী কে জানে।

শুরুটা ছিল ২০০৬’এর শরতে। এক পাগলা খুনি জেল ভেঙে পালিয়ে গেল। মনে তার অসীম অশান্তি। শান্তি আর জ্ঞানের আলোর টানেই সম্ভবত সেই ব্যক্তি এসে ঘাপটি মেরে বসে থাকলো ক্যাম্পাসে। একাকিত্ব ঘোচানোর চেষ্টায় আরো কিছু মানুষকে জড়িয়ে ফেললো তার এই প্রয়াসের সাথে। ফলাফল, ক্যাম্পাস লকডাউন করে এই উন্মত্ত সিরিয়াল-কিলারকে খুঁজে বেরানো।

এর পরের ঘটনা জগৎ-বিখ্যাত। সাং-হুই চো নামে এক বিপ্লবী ব্যক্তি সাম্যের বাণিতে আদিষ্ট হয়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিলেন। বড়লোক বাপের বখে যাওয়া ছেলেপুলের বাড়াবাড়ি নিয়ে আমাদের সবার চাপা ক্ষোভ ও হিংসাকে অসামান্য নৈপুন্যের সাথে চো সামনে নিয়ে এলেন। শুইয়ে দিলেন ৩১ জনকে। কিছু সুন্দরীর ছবি দেখে মনে হচ্ছিল, বেকুবটা শোয়াতেও জানে না! হয়তো বাচ্চা মেয়েদের দিকে ব্যারেল-বুলেট তাক করার খুব আক্ষরিক অর্থ করে ফেলেছিল বেচারা। রাগলেও কিছু করার নেই। আমার অচল মস্তিষ্ক এগুলোই করে দিনভর। পরেরটুকুর জন্য নাহয় শক্তি জমিয়ে রাখুন।

৩.
তৃতীয় ঘটনা এই শরতেরই। আমার দুইটা হোমওয়ার্ক এক সপ্তাহের ওভারডিউ। দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে ফিফা ২০০৮ খেলছিলাম তুমুল উৎসাহে। এরই মধ্যে আমার রুমমেট ফোন করলো। ব্রাদার, সুইসাইড কেইস। লাফ দিসে নাকি লাউঞ্জ থেকে। চ্যাটকায় গেসে কিনা জানি না। দেখতে যাবা?

মুহূর্তের মধ্যে ঘরের সবাই যে যেই অবস্থায় আছি দৌঁড়ে বের হলাম। সাকুল্যে ৫ জন। তাজ্জব ব্যাপার হল, প্রত্যেকেই কোন না কোন কারণে দরজা থেকে ফিরে ঘরে গিয়েছিলাম। মৃত্যুর সাথে সাক্ষাৎ বলে কথা। জরুরী কিছু কি ফেলে গেলে চলে? আমরা পঞ্চ-বান্দর আমাদের যক্ষের ধন সমেত সেই ডর্মের কাছে গেলাম মিনিট পাঁচেকের মাঝেই। জানতে পারলাম যে মৃত্যুর পেছনে আত্মহত্যা, নাকি অসাবধানতা দায়ী তা নিশ্চিত করে জানার উপায় নেই এই মুহূর্তে। তবে বিশেষ কসরত ছাড়া ঐ লাউঞ্জ দিয়ে বের হওয়া দুষ্কর। জানলাম যে ১৯৯০’এর দশকে এরকম বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল। সম্ভবত একটি বছরে তিন জন ছাত্র এক কাতারে না হলেও কাছাকাছি সময়ে ঝাপ দিয়েছিল।

৪.
মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে পরের দিনগুলোয় পত্রিকা মারফত জেনেছিলাম কিছু। অপঘাতের হ্যাটট্রিক নিয়ে বেশ গর্বিত ছিলাম সবাই। এর মাঝেই খেয়াল হল বানরকূলের শেষ লাফগুলোর কথা। যদি ঠিক সেই অবস্থায় মারা যেতাম আমরা, তাহলে অচেনা কারো চোখে আমাদের জীবনের মানচিত্র কেমন হত?

দামাল ক্রিকেটার হাইব্যা মৃত্যুর পূর্বে বান্ধবীর কাছে তিন হাত ঘুরিয়ে একটি সাংকেতিক বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ঘরে ফিরে সাপ্লাই-ডিমান্ডের অন্যায্য স্থিতির কারণে বঞ্চিত হবার ভয়ে তিনি ভনেজের একটি ফোন সেট হাতে নিয়ে বের হয়ে আসেন। তার পরণে ছিল থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট ও স্যান্ডো গেঞ্জি। ইয়ো! লাশদর্শনের পর আড়ষ্ট হয়ে যাবার ভয়ে তিনি কিছু ব্যাক্তিগত কাজ দ্রুত সেরে নেন।

কুদ্দুস বের হবার আগে বক্সিং গ্লাভস না নিলেও চুল আঁচড়াতে ভোলেননি। উপরে উপরে কোলেস্টরেলের দোহাই দিলেও তিনি সম্ভবত ভিন্নতর কোন কারণে মাত্র চার মাসে ৫০ পাউন্ড ওজন কমানোর মত মহাযজ্ঞে মেতেছিলেন। বহুকাল পর ডর্মের সামনে যাওয়া এবং সেখানে ভেকেটেড অবস্থায় অপ্রস্তুত বসনে সজ্জিতা নারী হয়তো তার এই শেষ প্রসাধনে উপসর্গের ভূমিকা পালন করে থাকবে। স্বাভাবিক অবস্থায় স্যান্ডেলনির্ভর কুদ্দুসকে এদিন কেডস পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়।

অ্যাজমারোগী মোখলেছ প্রথমাবস্থায় উৎসাহের আতিসজ্যে জুতা-স্যান্ডেল ছাড়াই রওনা দিয়ে ফেলেছিলেন। পরবর্তীতে তাকে স্তূপ থেকে জুতা ও জ্যাকেট বের করতে দেখা যায়। এসময় তার কাছে ইনহেলার না থাকলেও একটি ফোন সেট ছিল। ধারণা করা যায় যে তিনিও বিশেষ কারণে দেশের সাথে প্রচুর যোগাযোগ বহাল রাখেন। তার হাতে একটি লাঠি পাওয়া গেলেও কোন উল্লেখযোগ্য পূর্ব-বেদনা দেখা যায়নি।

গাঞ্জুট্টির সাথে গাড়ির চাবি থাকলেও মোবাইল ফোন কিংবা ওয়ালেট ছিল না। তার ঊর্ধাঙ্গে ছিল একটি সাদা গেঞ্জি, আর নিম্নাঙ্গে ছিল একটি লাল বক্সার। গালে অনিঃশেষ দাড়ি থাকলেও তার পায়ে ছিল লেডিস চপ্পল। গাড়ির চাবির সাথে রিট্র্যাক্টেবল লাইটার থেকে ধারণা করা যায় তিনি বায়ুর পূজারি। তার হাতে একটি হ্যান্ডিক্যাম ছিল যাতে বিভিন্ন পার্টিতে তোলা নিরুদ্দেশ ভিডিওর সম্ভার মেলে।

বিল্লাল তাঁর লাল-নীল স্কোয়্যারবিশিষ্ট শার্টটি পরিধান করে সারতে পারেননি। রান্নার গন্ধের কাছে আস্ত একটি জ্যাকেট সঁপে দিলেও তিনি এই শার্টটিকে আগলে রেখেছিলেন। বাম পায়ে সজোরে বেঁধে রাখা পট্টি বিশেষ ইঙ্গিত করে যে তিনি মৃত্যুর কিছুকাল আগে পায়ে আহত হয়েছিলেন। খাবার সময় তিনি প্রচুর পানি পান করতেন, নয়তো পাহারাদার পুলিশ-কন্যা তাঁকে ব্যাপক মাত্রায় আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করেছিলেন। তার পকেটে অস্বাভাবিক পরিমাণ কিটক্যাট পাওয়া যায়। তাঁর ডান হাতের কিছু আঙুল অতিব্যবহারে বেঁকে থাকলেও বাম হাতে একটি পাঠ্যবই ও একটি কলম ছিল। মৃত্যুকালে তিনি ছোট ডায়েরি, কলম, চ্যাপস্টিক, রুমাল, ওয়ালেট, ফোন, চশমা, নকল দাঁত সহ অনেক হাবিজাবি বহন করলেও কোন টাকাপয়সা বহন করছিলেন না।

চ্যাটকানো মগজের অনুপস্থিতি, লাশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, এবং ঘটনাস্থলের বেশ অনেক গজের মধ্যে কাউকে ঢুকতে না দেওয়া সহ বিবিধ কারণে প্রাথমিক উদ্যোক্তা লিয়াকত তাঁর বান্ধবীর হোমওয়ার্কে পুনরায় মনোনিবেশ করাই উত্তম বলে বিবেচনা করেন।

No comments: