– কালকে কোরবানির মাংস নিয়ে যেও।
: হু, আমাকে না দিলে কিন্তু গরীবের হক আদায় হবে না।
– থাপ্পড় খাবি। আত্মীয়ের ভাগ হতে পারে না? ফালতু কথা শুধু।
: ঐ হল। এবার কোথায় দিলেন কোরবানি?
– ঘন্টা দুয়েকের পথ হবে এখান থেকে। যাওয়া-আসা একটা ঝক্কি। একবার গরু বাছাই করতে যাও, একবার টাকা দিতে যাও, একবার মাংস আনতে যাও। কোরবানির মাংস, তাই প্রত্যেকেরই যেতে হল।
: কেষ্ট পেতে একটু তো কষ্ট করতেই হবে, কিন্তু তাই বলে সবার যেতে হবে কেন?
– মাস্লা আছে কী যেন একটা। কোরবানির মাংস নাকি যারটা তার আনতে হবে। নাহলে তো একজন গিয়েই সব নিয়ে আসতে পারতো।
: ব্যাপার না। আমার কাছে সব সমান। খাওয়া পেলেই হল। কারো মাফ নেই, সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসবো নে।
– এবারে বলেছি কিছু মাংস আলাদা করে রাখতে। সবার ভাগ থেকে একটু একটু করে। সেই মাংস দিয়েই বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে।
: বুদ্ধি খারাপ না। আপনাদের ভাগেই তো রান্না পড়বে। আফসোস অন্য জায়গায়। শুধু তরতাজা রান্না খাচ্ছি। দেশের মত শুকনো, ঝুরঝুরা মাংস খাওয়া হয় না আজকে ঠিক ছয় বছর হয়।
– হ্যাঁ, এই ছোট ছোট ব্যাপারগুলোই প্রবাস জীবনকে কষ্টকর করে দেয়। পত্রিকায় দেখলাম, এই দুর্মূল্যের বাজারেও লোকে অনেকগুলো করে গরু কোরবানি দিচ্ছে। কারও কারও গরু তো উটের সমান বড়। অথচ গ্রামে গিয়ে দেখেছিলাম, গরু নেই দেখে মানুষে হাল টানছে।
: এটাই তো সমস্যা। ল’ আর স্পিরিট অফ ল’-এর মধ্যে পার্থক্যটুকু আমরা বুঝি না। আমরা ধর্মকে একেবারে আক্ষরিক ভাবে নেই, কেউ ধর্মের নির্যাসটুকু বুঝতে চাই না। ওহির মর্ম ঠিক মত বুঝলে কোরবানির গরু কিনে মানুষ গ্রামের গরীব কৃষকদের দিতো। বদলি হজ্জ হয়, বদলি কোরবানি কেন হতে পারবে না?
– সবার মনে শুধু আক্ষরিক চিন্তা, বুঝলে? সীমিত কিছু অক্ষর লেখা আছে, সেগুলো মুখস্ত করে বসে আছে অর্ধশিক্ষিত কিছু মোল্লা। আমরা শিক্ষিত লোকেরাও তাদেরই কাছে যাই উপদেশ নিতে।
: এখানেই সমস্যা। ইসলাম ধর্ম নিয়ে আমরা গর্ব করে বলি যে এটা সবচেয়ে আধুনিক ধর্ম। সেই ৫ম শতাব্দিতে যেই ইসলাম নাজিল হয়েছিল, সেটা শিক্ষা আর অনুশাসনের দিক থেকে ১৫শ সালের জন্যও আধুনিক ছিল। দাসত্বের যুগে মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হয়েছিল, সব রকম ধর্মমতের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে আমাদের উচিত ছিল এই আধুনিকতা, এই অধিকারবোধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
– বলা হয় ইসলাম একটা পরিপূর্ণ জীবনবিধি। এখানেই ঝামেলাটা। এই সুবিধা নিয়ে নিজের মত করে সবাই ধর্মের ব্যাখ্যা করে, নিজের জীবনধারা চাপিয়ে দেয় অন্যের উপর। শুধু তাই না, খুব তীব্র এক ধরণের চরমপন্থা ঢুকে যায় মনের মধ্যে। আমিই ঠিক, আমার মত অনুসরণ করলেই স্বর্গে যাওয়া যাবে, অন্যথায় নরকবাস – এমন একটা চিন্তা মানুষের মনে স্থান করে নেয়।
: পরিপূর্ণ জীবনচরিত বলে প্রচার করাটাই সমস্যা। ধর্মে তো ধর্মের শিক্ষা অনুযায়ী কালের আলোকে নতুন বিধি তৈরির সুযোগও আছে। এই দিকটায় ফতোয়াবাজদের একচ্ছত্র আধিপত্য হয়ে গেছে। কেউ বলে না যে ধর্মের অনুসারী হিসেবে, সমাজের অংশ হিসেবে আমাদেরও অধিকার আছে ধর্মের আধুনিকায়নে।
– আরেকটা ঝামেলা হল রাজনীতি ঢুকে যাওয়া। নিজের ধর্মকে ভালবাসা মানেই অন্য ধর্মকে ঘৃণা করা নয়। এটা ভুলে যাই আমরা। রাজনীতির স্বার্থে এটা অনেক ভাবে অপব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের বেলায় এই আবেগ কাজ করে বেশি। আমরা যতই ভুলে থাকার চেষ্টা করি না কেন, বাস্তব এটাই যে আমাদের সংস্কৃতিতে মিল আছে। ধর্মের অজুহাতে আমরা সংস্কৃতিকে আঘাত করি।
: কথাটা প্রায়ই বলি, বাঙালি স্বর্গে যাওয়ার জন্য আরবি ভাষায় নাম রাখে। অন্য দেশের মুসলমানেরাও ইসলামিক নাম রাখে, কিন্তু অন্তত নিজের ভাষা-সংস্কৃতির সাথে মিলিয়ে নেয় কোন ভাবে। আমাদের তো ওসবের বালাই নেই।
– একেবারে ওভাবেও দেখার কিছু নেই। ধর্ম অনেকের কাছে একটা সংস্কৃতি, সেটাও মনে রাখতে হবে।
: ধর্ম হল ধর্ম। বিশ্বাস, পরকাল, পাপ-পুণ্য, এগুলোর ভেতর সংস্কৃতি ঢোকানো ঠিক না।
– সংস্কৃতি কী তাহলে? আমরা যেভাবে খাই, ঘুমাই, চিন্তা করি, কথা বলি, সেগুলোই তো? সেখানে কি ধর্মের প্রভাব নেই? ধর্মকে কেউ সংস্কৃতি হিসেবে নিতেই তো পারে, কারণ ধর্মেও নির্দিষ্ট কিছু ধরন-ধারণ আছে এগুলো নিয়ে।
: চাইলেই করতে পারে, কিন্তু করতে হবে কেন? নিজের শেকড়ের সাথে সম্পর্ক নেই, এমন কিছু কখনও স্থিতিশীল, কার্যকর হতে পারে না।
– সোশাল ডারউইনিজম হয়ে গেল না? একই রকম তো চিন্তা হিটলার করেছিল। তাকে দোষ দেওয়া যায় কীভাবে তাহলে? সব সংস্কৃতির সমান অধিকার দেওয়া হলে, এবং মানুষকে স্বাধীন ভাবে নির্বাচন ও অনুসরণের অধিকার দিলে কিন্তু ধর্মের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। কেউ স্বাধীন ভাবে ধর্মের পথে যেতে চাইলে, তাকে সংস্কৃতি হিসেবে নিতে চাইলে দিতে হবে।
: ডারউইনিজম আসে অস্তিত্বের সংকটের প্রশ্ন এলে। নিজের দেশ, নিজের ভাষাকে সবাই শ্রেষ্ঠ ভাবে। নিজের মতাদর্শ সবাই প্রচার করতে চায়। এতে দোষের কিছুই নেই। এতে হারাবার বা হারিয়ে যাবারও কিছু নেই। কিন্তু ধর্মকে এর ভেতর ঢুকিয়ে ফেললে এলিমেন্ট অফ ফিয়ার ঢুকে যায়। শাস্তির ভয় চলে আসে। সংস্কৃতি তো ভালবাসার অভ্যস্ততা, ভয়ে ত্রস্ততা না।
– তুমি কি অস্তিত্ব হারানোর ভয়েই সংস্কৃতির কথা বলছো না? বাংলাকে ছড়িয়ে দেওয়ার আর্জির পেছনে কি হারানোর ভয় নেই?
: আছে, তবে সেটা অস্তিত্ব হারানোর ভয় না। আমিত্ব হারানোর ভয়ে আমি সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরার কথা বলছি। স্বাধীন ভাবে নির্বাচন করার সুযোগ নিশ্চিত না করলে কোন সংস্কৃতি কালোত্তীর্ণ হয় না। সেজন্যই সীমানা রুদ্ধ করে ভিন্ভাষা দূরে রাখার চেয়ে নিজের ভাষাকে শক্তিশালী করা জরুরী। ধর্ম তো এই সুযোগ দেয় না। এখানে মানলে বেহেশত, না মানলে দোযখ।
– তবে কি ধর্ম অচল?
: মোটেই না। আমার ভাবতে ভাল লাগে যে আমাকে তৈরি করা হয়েছে কোন একটি মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে। দুর্বল মুহূর্তে আমার ভাবতে ভাল লাগে যে আমার একটি আশ্রয় আছে। ভাবতে ভাল লাগে যে আমার অনুচ্চারিত আর্তিগুলো কেউ শুনছে অন্তরাল থেকে। ধর্ম না থাকলে এই শান্তিটুকু পেতাম না। তবে এটা আমার বিশ্বাস, আমার সংস্কৃতি না। আমার সংস্কৃতি ধর্ম দিয়ে প্রভাবিত হতে পারে, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। এর পেছনে বড় কারণ হল, ধর্ম নিজেই তো আজকে আর স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণে নেই!
– একটা ব্যাপার জানো, আমরা মুসলমানেরাও কিন্তু পৌত্তলিক। এই দিক থেকে ভণ্ডামিটা খুব কষ্ট দেয় আমাকে।
: হাজারে আসওয়াদে চুমু খাওয়া কি পৌত্তলিকতার পর্যায়ে পড়ে? অবশ্য, চাইলে সেভাবে দেখা যেতেও পারে।
– না, আমি সেই অর্থে বলছি না। আমরা বলি যে খোদা নিরাকার, সর্বময়। তাঁর কোন অঙ্গ নেই, চাহিদা নেই। আমরা বলি যে আমাদের খোদা কোন মূর্তির গণ্ডিতে আবদ্ধ না। অথচ তাঁকে আমরা ঠিকই আটকে ফেলি বিশেষণের গণ্ডিতে।
: বিশেষণ তো বর্ণনার জন্য, এর ভেতর বন্দিত্ব আসবে কেন?
– ভেবে দেখো, আমরা বলি যে খোদা দয়ালু, ন্যায়বান, সর্বদ্রষ্টা, ইত্যাদি। এভাবে কিন্তু মানবসৃষ্ট বিশেষণের মধ্যেই তাঁকে বন্দী করে ফেলছি আমরা। গণেশের মত শুড় নেই হয়তো, কিন্তু তাই বলে আমাদের খোদাও খুব একটা মুক্ত না। একটি শিশু কি তার চেনা বিশেষণের বাইরে খোদাকে কল্পনা করতে পারবে? খোদার সর্বময়তা কি সে কোনদিন উপলব্ধি করতে পারবে?
: ভেবে দেখার মত। অবয়ব না দিয়েও উপাসনা হয়ে যাচ্ছে ঠিকই। হয়তো একারণেই ধর্মের বক্তব্যটুকু হারিয়ে যায় এত সহজে।
– এই সীমিত সংজ্ঞায়নের পাকে পড়েই কিন্তু আমরা ভয় থেকে স্রষ্টার আরাধনা করি। অথচ উচিত ছিল হিতাহিত জ্ঞান থেকে আরাধনা করা। এটা মনকে অনেক মুক্ত করতো, সহনশীল করতো।
: ঝামেলাটা অন্য জায়গায়। আমরা খোদাকে অনেক কিছুই বলি। লিঙ্গ নেই বলেও তাঁকে পুরুষ হিসেবেই সম্বোধন করি, আবার ম্যারাডোনার গোলকে আলঙ্করিক ভাবে ঈশ্বরের হাত বললে এর মধ্যে বিধর্মিতা খুঁজি। মোনাফেকির ভয়ে বলি খোদার নামের সাথে জড়িয়ে কোন প্রকার ভৌত কথা বলতে না। সবকিছুই করি আমরা, শুধু খোদাকে বুদ্ধিমান বলি না। এত জটিল পৃথিবী যিনি বানালেন, তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, হি মাস্ট বি ড্যাম স্মার্ট। আমরা শিক্ষিত লোকেরা ভুলে যাই যে স্রষ্টা আমাদের চেয়েও বুদ্ধিমান। তাঁকে তাই ডাকা উচিত বুদ্ধি ব্যবহার করেই। উলটো আমরা বিশ্বাসের গতি-জড়তায় ভেসে গিয়ে নির্বোধের মত কিছু মুখস্ত ইবাদত করি।
– কাইনেটিক ইনারশিয়া অফ ফেইথ… নিউটন, ব্রুনো, ডারউইনরা কিন্তু স্রষ্টায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁরা নিজের ক্ষুদ্রতা দিয়ে ঈশ্বরের মহত্ব প্রকাশ করতেন। দেয়ার ইজ আ রিজন হোয়াই দে আর গ্রেট, অ্যান্ড আই জাস্ট ড্রাইভ আ কার।
Wednesday, May 06, 2009
Subscribe to:
Posts (Atom)