Saturday, June 21, 2008

নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্রঃ ৫

৫. স্টেট-এল্ডার বনাম পার্টি-এল্ডার
নিজেকে আমি মূলধারার বাঙালিদের একজন বলেই মনে করি। সরকারী চাকুরে বাবার মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম, বাংলা মাধ্যমের স্কুল-কলেজে পড়ে বড় হওয়া, বাটা স্যান্ডেল পায়ে ঘোরা, সন্ধ্যা হলে বিটিভি দেখে বিনোদনের চাহিদা মেটানো, স্বরলিপি না জানলেও নিয়মিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা, এই ছিল জীবনধারা। অনেকটা আচমকাই প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে চলে আসি ২০০৪-এ। আমেরিকা আসার পর দিনগুলো কেটেছে খুব কষ্টে। দক্ষিণের কৃষ্ণাঙ্গঅধ্যুষিত এলাকায় খুব কাছ থেকে দেখেছি মূলধারার আমেরিকাকেও। মিলগুলো অবাক করে, তফাৎগুলো ভাবায়।

দেশে চাকরি খুঁজতে গেলে তদবির করাটাই যথেষ্ট ছিল। মামা নেই তো শুকতলি খয়ে যাবে, ছিঁড়ে যাবে জামা। এখানেও অনেকটাই তাই, তবে সাথে রেজুমে নামক বিচিত্র একটা কাগজ দিতে হয়। দেশে চাকরির জন্যও লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়, এদিকে ক্যারিয়ার সার্ভিস নয়তো স্বদেশী বড় ভাই, নয়তো স্কুলের কোন অ্যালামনাই কানেকশন লাগে। স্রেফ নিজের যোগ্যতায়ও চাকরি জোটে প্রচুর। রিলিজিয়াসলি খুঁজলে নাকি অগতিরও গতি হয়ে যায়। তবে ব্যাপারটা তামাশার পর্যায়ে চলে যেতে দেখেছি এক পাকিস্তানি-চাইনিজ দম্পতির খাবারের দোকানে কামলা খাটার জন্য রেজুমে দিতে হওয়ায়। ভ্যাবলা বনে গিয়েছিলাম পুরো, কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম এর ভাল দিকও আছে। খুচরা ব্যাপারেও এদেশে খুব মেথোডিক্যাল সবকিছু। মূল কথাটা খুব সাধারণ, ইফ ইট এইন্ট ব্রোকেন, ডোন্ট ফিক্স ইট।

বিশাল আরেক তফাৎ দেখি বাচ্চা-কাচ্চা বড় করার বেলায়। আমার মা আজও হাজিরা নেয় প্রতি রাতে। বিস্তারিত বিবরণে জানাতে হয় চুলার আগুন থেকে খাবারের মেনু পর্যন্ত সবকিছু। অথচ গোরা বাবা-মায়েরা তিন দিনের বাচ্চাকেও আলাদা বিছানায় ঘুম পাড়ায়। এক কালে ভাবতাম এদের দিল’এ কোন রহম নাই। চামড়ার খায়েশ পুরো হয় না বাচ্চা কাছে থাকলে। স্বাধীন ভাবে গড়ে তোলার নামে বিযুক্ত পরিবার তৈরি করছে অযথা। এমনি এমনি তো ছেলেপুলে বুড়ো বাপ-মাকে ফেলে যায় না বুড়ো বয়সে। আমাদের প্রথাগুলো কত ভাল। কেউ স্বার্থপর না, প্রতিদিনই বাবা- বা মা-দিবস এখানে।

মুক্তমনার দেশ, উন্মুক্ত যৌনাচারের দেশ, সমকামী বিবাহের দেশ, ইত্যাদি অনেক সুনাম আছে আমেরিকার। বাইরের দুনিয়া যা ভাবে ভাবুক না কেন, মূলধারার পশ্চিম অনেক বেশি রক্ষণাত্মক। সমাজ ও রাজনীতিসংশ্লিষ্ট কিছু ব্যাপারে খুবই সনাতন এরা। সেই দিকে আলোকপাত করতেই পূর্ব-পশ্চিমের কিছু পার্থক্যের কথা বলা। লালন-পালনের প্রথার পার্থক্যগুলো এদেশের মানুষকে গড়ে তোলে অনেক স্বাধীন করে, যার প্রভাব দেখা যায় প্রায়োগিক দিকগুলোয়।

প্রাচ্যে আইন রচিত হয় বিধিনিষেধ দিয়ে। এই বেলা এটা করা যাবে তো ঐ বেলা সেটা করা যাবে না, এর সামনে দিয়ে হাঁটলে জুতা খুলতে হবে তো ওর হুকুমের অন্যথা করা যাবে না, শ্রাবণে এটা খাওয়া যাবে তো পৌষে ওটা বলা যাবে না। ঔপনিবেশিকতাকে খুব সহজেই দায়ী করা যায় এই অবস্থার জন্য। ব্রিটিশ রাজের উদ্দেশ্য ছিল শুধু ভারতবাসীকে শৃঙ্খলার নামে নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে শোষন করা। আইন প্রণয়নের পেছনে মুখ্য তাগিদ ছিল কনভিনিয়েন্স, এনলাইটেনমেন্ট নয়। সে-কারণেই ধর্মযাজকের লেবাস ধরে আসা ফিরিঙ্গিরা প্রথম দিকে ভারতবাসীর জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষাকে পাথেয় করেছিল, অথচ অতিশিক্ষায় সচেতন হয়ে যাবার পর এই শিক্ষাই হয়ে দাঁড়ায় বড় পাপ। আমরা এর ফলে খুব একটা দুঃখিত বোধ করিনি কখনই, কারণ ইংরেজপূর্ব আমলের অবস্থাও খুব একটা ভিন্ন ছিল না। পাল-সেন থেকে মুঘল আমল পর্যন্ত কর্তার ইচ্ছাই ছিল আইন। আইন প্রণয়নের জন্য যে আলোকিত মানুষ হতে হয়, এই ধারণার সাথেই আমাদের পরিচয় ছিল না কোন কালে।

পশ্চিমের দেশগুলোয় একেক রকম মূলনীতি কাজ করেছে আইন প্রণয়নের পেছনে। আগে এসেছে নীতি, পরে এসেছে সেই নীতির আলোকে আইন প্রণয়ন। ফ্রান্স বেছে নিয়েছে স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব, ও প্রগতি। ব্রিটেন বেছে নিয়েছে অনির্ধারিত, অলিখিত আইনের রীতি, যা সমাজবর্জিত না হবার বিশ্বাসের বন্ধনে আবদ্ধ। আমেরিকা পুরো পৃথিবীকে পথ দেখিয়ে গেছে মাত্র দুই পৃষ্ঠায় লিখিত সংবিধানে। দুর্মুখের তোয়াক্কা না করে সরাসরি ঘোষনা দিয়েছে, এ-সত্য আমরা শাশ্বত বলে মেনে নেই যে প্রতিটি মানুষ জন্মগতভাবে সমান, তারা তাদের স্রষ্টার আশীর্বাদে জীবন, স্বাধীনতা, আর আনন্দের সন্ধানের মত কিছু অবিচ্ছেদ্য অধিকার উপভোগ করে (উই হোল্ড দিজ ট্রুথস টু বি সেলফ এভিডেন্ট, দ্যাট অল মেন আর ক্রিয়েটেড ইকুয়্যাল, দ্যাট দে আর এনডাওড বাই দেয়ার ক্রিয়েটর ওয়িথ সার্টেন আনএলিয়েনেবল রাইটস, দ্যাট অ্যামং দিজ আর লাইফ, লিবার্টি, অ্যান্ড দ্য পার্সুট অফ হ্যাপিনেস)। আমাদের কি এমন কোন নীতি আছে? আমরা কি বলতে পারি দু-চারটি আপ্তবাক্য যা আমাদের সম্মিলিত মনন ও মানবিক প্রতিশ্রুতির নির্যাস হিসেবে ব্যবহার্য? মনে হয় না।

অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার মূল্যায়নের অন্যতম উপায় হিসেবে মুরুব্বিতন্ত্র বিভিন্ন দেশে প্রচলিত। এর অবশ্যই বিভিন্ন রকম সুফল আছে। এই মুরুব্বিরা দেশের হবেন, নাকি দলের, এটাই বিবেচনার বিষয়। উদাহরণ হিসেবে দুটি দেশের দিকে তাকানো যায়, ইরান ও আমেরিকা। ইরানে আছে আয়াতুল্লাহ খোমেনির মত স্টেট-এল্ডারেরা, যাদের পরম ও অসীম ক্ষমতার কাছে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী অসহায়। বাকি বিশ্বের কাছে গালাগালটুকু প্রেসিডেন্ট আহমেদিনেজাদ শুনলেও বাস্তবে তিনি ইরানের তৃতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি, প্রথম নন। উলটো দিকে তাকানো যাক যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির দিকে। প্রাক্তন ও অভিজ্ঞ সব নেতারা দলের বিভিন্ন উচ্চপদে আছেন এবং সেই অবস্থান থেকে সংকট নিরসনে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে প্রাথমিক নির্বাচনের পর তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য মনোনীত প্রার্থীর ভূমিকা ও ক্ষমতা। বড় বড় কর্পোরেশনের টাকা না নেওয়ার অঙ্গীকার করে বারাক ওবামা মনোনীত হয়েছেন। মনোনয়নের পরদিনই তিনি পার্টি-এল্ডারদের রাজি করিয়েছেন দলের তহবিল থেকে প্রায় এক লাখ ডলারের ডোনেশন ফিরিয়ে দিতে, তাঁর ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত মেসেজ অনুযায়ী পার্টির চাঁদা তোলার বিধিমালা সংশোধন করতে।

তালে হোক আর গোলে হোক, শেখ হাসিনা একটি ভাল কাজ করেছেন এবং একটি ভাল কথা বলেছেন গত দেড় বছরে। তিনি গ্রেফতারি পরোয়ানা সত্ত্বেও দেশে ফিরতে চাওয়ার কারণে ব্যারিস্টার মঈন ও সেনাসরকারের প্রকৃত রূপ বের হয়ে এসেছিল, শেষ হয়েছিল সুডো-মিলিটারি সরকারের রাজনৈতিক মধুচন্দ্রিমা। আইসিসি ট্রফিতে হল্যান্ডের বিপক্ষে আকরাম খানের হাফ সেঞ্চুরির ধারে-কাছে রাখি আমি শেখ হাসিনার এই কাজটিকে। তবে ভাল কথাটির গুরুত্ব আরো বেশি। দলে প্রাণসঞ্চারণের জন্য শেখ হাসিনা বলেছিলেন ষাটোর্ধ্ব সকল রাজনীতিকের অবসর গ্রহনের কথা। বলেছিলেন দলের উচ্চপদস্থ উপদেষ্টা হবার কথা, দেশ শাসনের জন্য নির্বাচনের ভার নবীনদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কথা। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে হোক, পিঠের ছাল বাঁচাতে হোক, কিংবা শুধুই দেশপ্রেম থেকে হোক, সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল কিছু স্টেট-এল্ডার বা জাতীয় মুরুব্বি তৈরির করা। এলেমদার লোকের এই ছোটখাটো সমাবেশ বিভিন্ন অবস্থায় আমাদের রক্ষা করবেন, এটাই কামনা। আমার সবিনয় মতামত, এতে করে রাষ্ট্র অযথা গতিশীলতা হারাবে। তারচেয়ে ভাল হয় যদি দলীয় মুরুব্বিতন্ত্রকে সীমিত ও নিয়মতান্ত্রিক করা যায়।

দল ও দেশের নেতৃত্বে যে একই ব্যক্তি থাকতে পারবেন না, এই মৌলিক সংস্কারটি অবধারিত বলে এর ধার দিয়ে যাচ্ছি না। পাশ্চাত্য রীতির সরাসরি অনুকরণ করে আমাদের দেশেও দুইবারের বেশি সরকারপ্রধান থাকতে না পারার করা বলা হচ্ছে। আমার মতে, এই ঊর্ধ্বসীমাটি সরকারের বদলে রাজনৈতিক দলে প্রয়োগ জরুরী বেশি। উন্নয়নশীল দেশের মারদাঙ্গা রাজনীতির মধ্য দিয়ে একজন সুযোগ্য নেতা উঠে আসার পথ খুবই বন্ধুর। মাহাথির বিন মোহাম্মদ বা জ্যোতি বসুর মত যাঁরা এই অসাধ্য সাধন করেছেন, তাঁরা যথাক্রমে ২২ ও ২৩ বছর ধরে ক্ষমতাশীর্ষে থাকতে না পারলে নিজ প্রজ্ঞা ও ধ্যানধারণা অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করতে পারতেন না। অতএব, যোগ্য নেতা যদি পাওয়াই যায়, তাঁকে জোরপূর্বক হটাবার চিন্তা একান্তই আত্মঘাতী।

যে-সব দেশে রাষ্ট্র- বা সরকার-প্রধানের ভূমিকায় দুই বারের বেশি অবতীর্ণ হওয়া যায় না, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব সতত পরিবর্তনশীল। পক্ষান্তরে, প্রাচ্যের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধানেরা ক্ষমতাকেন্দ্র হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকেন। একারণেই এটা কোন মতেই কাকতালীয় নয় যে ব্রিটেনে টোনি ব্লেয়ার প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় দলের ভেতর নেতৃত্ব বদল হয়ে গর্ডন ব্রাউন উঠে আসেন, আর ভারতে সোনিয়া গান্ধী আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রিত্ব বর্জন করেও ক্ষমতার নাটাই হাতে নিয়ে বসে থাকেন। শুরুতে উল্লেখকৃত পার্থক্যদুটি দেখতে পাওয়া যায় এখানেই। স্বাধীনচেতা মানুষের মুক্ত মত প্রকাশের জন্য দলের ভেতরেই রয়েছে উপযুক্ত পন্থা। কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই পদ্ধতিগুলো ভাঙেও না, রাস্তায় আন্দোলন করে এগুলো বদলাতেও হয় না।

একারণেই আমাদের রাজনীতিতে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমা ধার্য করে দেবার বদলে দলীয় নেতৃত্ব বদলের রীতি চালু করা উচিত। একজন শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া বা লেজেঅবহুমো এরশাদ যতদিন দলের প্রধান থাকছেন, ততদিন আমরা পুতুল সরকারের চেয়ে উন্নত কিছু পাবো না।

নিজস্ব ধাঁচের গণতন্রঃ ৪

৪. নির্বাচনের খরচ রাষ্ট্রীয়ভাবে যোগানো এবং রান-অফ ইলেকশন
প্রবাসে অনেকেই দেশের কথা ভাবেন, দেশের জন্য কিছু করতে চান, দেশের রাজনীতির পরিবর্তন চান। ডলার-দিনার-পাউন্ডে উপার্জন শুরু করার পর দেশদরদী হওয়া খুব সহজ। পরিকল্পনার চেয়ে ভালবাসা অনেক সহজ। দূরে বসে দেশকে ভালবাসতে স্রেফ ডিশ নেটওয়ার্কে এনটিভি-চ্যানেল আই, হালাল মাংস, আর চেক বুক লাগে। অথচ বিদেশী শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালিদের সত্যিকার দায়িত্ব তাঁদের জ্ঞানকে কাজে লাগানো, প্রকৌশল থেকে চিকিৎসা বা ব্যবসা পর্যন্ত সবকিছু নিয়ে লব্ধ জ্ঞান দেশে পাঠানো। সবাই শুধু স্কুলে কম্পিউটার দেন, নয়তো মাইক্রোক্রেডিটে টাকা ঢালেন। ফিতরা-যাকাতের যুগ পেরিয়ে এসে প্রবাসী বাঙালি আজ এক ধাপ আধুনিক। ওভারসিজ চ্যারিটির নতুন নাম তাই মাইক্রোক্রেডিট।

কার্যকর উন্নয়নের পেছনে বস্তুগত অবদান রাখতে নারাজ বাঙালি দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি অনেক আগেই। সবাই শুধু স্যানিটারি ল্যাট্রিন বা ধানমণ্ডিতে অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে টাকা পাঠায়। বাড়তি জামা-জুতা কিনতে কারো বাধে না, কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য সরাসরি সরকারী তহবিলে দশ-পনের ডলার অনুদান পাঠানোর কথা বললে গরিমসির শেষ নেই। সেই হতাশার মাঝেই অনেকটা আলোর মত ঠেকলো এক বড় ভাইয়ের কথা। দেশ নিয়ে কথা বলতে বলতে এক সময় জানালেন তাঁর পরিকল্পনার কথা। চাকরি-বাকরি করে কিছু টাকা জমাতে পারলে তিনি দেশে কিছু সৎ রাজনীতিককে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করবেন। মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকালীন আদর্শগুলোর প্রতি অনুগত থাকার মত কিছু মৌলিক শর্ত ছাড়া আর কোন খবরদারিই থাকবে না। কাগজ-কলম নিয়ে হিসেব করতে বসেই মনে হচ্ছিল কত বেশি সহজ এরকম কিছু করে ফেলা।

জাতীয় সংসদের প্রতিটি আসনে বর্তমান ব্যায়সীমা ৫ লক্ষ টাকা। বাস, ব্যানার, পোস্টার, বিরিয়ানি, আর মীরপুর এলাকায় কামাল মজুমদারের নেতৃত্বে নারী-মিছিল বাদ দিলে এর চেয়ে বেশি খরচের প্রয়োজনও নেই। ১৫ কোটি মানুষের বাংলাদেশে প্রতি আসনে গড় লোকসংখ্যা ৫ লক্ষ। এর অর্ধেক ভোটার হলেও ভোটার সংখ্যা আড়াই লক্ষ। দিনে আড়াই হাজার মত ভোটারের কাছে পৌঁছতে পারলে তিন মাসের মধ্যেই প্রত্যেক ভোটারের সাথে পরিচিত হওয়া যায়। আমেরিকার মত বিশাল দেশেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য মাত্র শ’পাঁচেক পেশাদার প্রচারকর্মী আছেন। বাকি সবাই স্বেচ্ছাসেবক। ৫০০ স্বেচ্ছাসেবক দিনে ৫০ জন ভোটারের কাছে দেখা করলেই হয়ে যায়। কাজটা কঠিন নয়, তবে ভীতিকর। সাহস করে নেমে পড়লে অস্ত্র ও অর্থের প্রভাব ছাড়া এভাবেই নতুন কোন প্রার্থীর পক্ষে স্বল্প খরচে তৃণমূল পর্যায়ে প্রচারাভিযান চালানো সম্ভব।

যদু-মধুদের নির্বাচনে দাঁড়িয়ে সরকারের টাকায় মোচ্ছব করা রোধ করতে মনোয়নপত্রের সাথে হাজার পঞ্চাশেক ভোটারের সাক্ষর সম্বলিত একটি পিটিশন জমা দেবার বিধান করা যায়। আপাতদৃষ্টে ছেলেমানুষি মনে হলেও হরতালের মত ধুম-ধাড়াক্কা রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রতিরোধের উপায় হিসেবে নাগরিকদের কাছে যাওয়া ও তাদের সমর্থন-প্রতিবাদের চিহ্নস্বরূপ সাক্ষর নেওয়ার সংস্কৃতি দাঁড় করানো যায় এভাবে। আইন করে হরতাল বন্ধ করে কোন লাভ নেই। রাজনীতিকদের যত বেশি ভোটারদের প্রতি মুখাপেক্ষী করা যাবে, ততই বাড়বে ভোটারের ইচ্ছার প্রতি সচেতনতা।

প্রতি আসনে ৩ জন করে প্রার্থীকে সরকারী তহবিল থেকে অনুদান দিলেও খুব সহজেই নির্বাচনের খরচ যোগানো সম্ভব। ৩০০ আসনে খরচ হবে মাত্র ৪৫ কোটি টাকা। যতদূর মনে পড়ে, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর অধ্যাপক আবুল বারাকাতের একটি লেখায় পড়েছিলাম সেই নির্বাচনে হাজার দশেক কোটি টাকা খরচ হবার কথা। হিসেবে খাতায় গোলমাল হয়ে যদি পাঁচ গুণ বেশি খরচ হয়, তবুও নির্বাচনী খরচ অনেক সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সকল প্রার্থীর জন্য নির্বাচনের আগে রেডিও-টেলিভিশন সহ প্রচার মাধ্যমগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া যায়। টাউন হল গুলোয় ইস্যুভিত্তিক তুলনামূলক অবস্থান স্পষ্ট করে রচিত প্রচারণার ব্যবস্থা করা যায়। পরবর্তীতে প্রার্থী মনোনয়নের খরচ বহন, নির্দিষ্ট সমাবেশস্থল দেওয়া, পরিকল্পিত ভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব মিডিয়াকে ব্যবহার, ইত্যাদি খুঁটিনাটি সংযোজন করা সম্ভব প্রয়োজন মত।

জর্জ বার্নার্ড শ’ গণতন্ত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একটি দুর্দান্ত উদাহরণ দিয়েছিলেন। ধরুন কোন নির্বাচনে চার জন প্রার্থী যথাক্রমে ১, ২, ৩, ও ৪ ভোট পেল। প্রথাগত গণতন্ত্রে সেই ব্যক্তিই নির্বাচিত হবেন, যিনি ৪ ভোট পেয়েছেন। অথচ বাস্তবতা এটাই যে অর্ধেকের বেশী ভোটার তার প্রার্থিতার বিপক্ষে। আপাতদৃষ্টে বেশি কচলানো বা ত্যানা প্যাঁচানো মনে হলেও এই ধরনের ছোট ছোট ব্যাপারগুলোই অনেক বড় বাটারফ্লাই ইফেক্টের জন্ম দিতে পারে। শুধু ভেবে দেখুন আমেরিকার ২০০০ সালের নির্বাচনের কথা। রালফ নেডার নাম পার্টি-ক্র্যাশার, সুপ্রিম কোর্টের নগ্ন পক্ষপাত, কিংবা গণনাযন্ত্রের ত্রুটির পর শেষতক মাত্র ৭০০ ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন জর্জ বুশ জুনিয়র ওরফে ডাবইয়া। অধিকাংশ ভোটার নিশ্চিত ভাবে অ্যাল গোর বা রালফ নেডারের পক্ষে না থাকলেও খুব দৃঢভাবে জর্জ বুশের বিপক্ষে ছিলেন। রান-অফ নির্বাচন হলে ইরাক যুদ্ধ হয় না, তিন হাজার মার্কিন সেনা ইরাকে মারা যায় না, লক্ষ লক্ষ ইরাকি নিজ দেশে পরাধীন হয়ে দিনাতিপাত করে না, এবং সাদ্দাম হোসেনকে অনভ্যস্ত দাড়ির চুলকানি থেকে বাঁচতে ফাঁসিতে ঝুলতে হয় না।

অতএব, কোন আসনে জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি শতকরা ৫ ভাগের কম ব্যবধানে হলে কিংবা বিজয়ী প্রার্থী অর্ধেকের কম ভোট পেলে সেখানে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত দুই প্রার্থীর মধ্যে পশ্চিমা ধারায় রান-অফ ইলেকশনের প্রচলন করা যায়। ফলশ্রুতিতে অন্যতম উপজাত হিসেবে কিছুটা এলাকাভিত্তিক ঐক্যেরও দেখা মিলবে। যে-ব্যক্তি দুই দুই বার নির্বাচনে জিতে আমার এলাকার প্রতিনিধিত্ব করবে, আমার সাথে মতে অমিল থাকলেও আমি তাকে আমার নেতা হিসেবে মেনে নেবো। কারণ দিনের শেষে একটি নির্বাচনের সফলতা নিরূপিত হয় বিজিত পক্ষ নিজেদের পরাজয় কীভাবে নিচ্ছেন তা দিয়ে, বিজয়ী পক্ষের জয়ের ব্যবধান দিয়ে না।

নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্রঃ ৩

৩. জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ বনাম দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ
দেশটা বড় ভয়ে আছে। চারিদিকে শকুনের ছড়াছড়ি। দেশটাকে খাবলে খেতে চায় শুধু। যা-কিছু জাতীয়, তার প্রতিই খুনে দৃষ্টি এদের। নিজের বলে যদিও বা কিছু আছে, আপন বলে কিছু নেই আর। এরকম অবস্থায় ‘মাই ডিয়ার কান্ট্রিমেন’ কিংবা ‘দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থরক্ষায় ক্ষমতা গ্রহনে বাধ্য হচ্ছি’র মত আইয়ুবীয় বক্তব্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে উঠে এসেছিল একটি কথা, ‘এই সেনাবাহিনী পাকিস্তান আমলের সেনাবাহিনী নয়, এটা বাংলাদেশের সেনাবাহিনী’। ক্ষমতা নেবার নাকি কোনই খায়েশ নেই আজকের আর্মির। শুনে আমিও টোপ গিলেছিলাম আরো অনেকের মত।

প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব ডঃ ইয়াজুদ্দিন আহমেদকে দেবার নীলনকশা যে ডঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে হটাবার সময় থেকেই তৈরি, সেটা দেরিতে বুঝতে পেরে মউদুদ-তারেক-হারেস-বাবরদের কূটচিন্তার প্রশংসা না করে পারিনি। পরোক্ষ সেনাশাসনের দেড় বছরের মাথায় এসে আরো একবার অবাক হয়ে স্বীকার করে নিচ্ছি আমার দৃষ্টির সংকীর্ণতা, প্রশংসা করতে বাধ্য হচ্ছি সেনাশাসকদের কূটকৌশলের। গৃহপালিত সুশীল সমাজ আর আজ্ঞাবহ সংবাদপত্র থাকলে আইয়ুব শাহীও এযুগে গান্ধী হয়ে যেতেন। পাকিস্তানের সেনাশাসকেরা নিজের দেশ দখল করে, নিজের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতে তারকার সংখ্যা বাড়ান। এবারেও তেমনি ভাবে জনগণকে চূড়ান্ত বোকা বানাবার পর সেনাপ্রধান নিজেকে চতুর্থ তারকাটি দিয়ে পুরস্কৃত করলেন। সেলুকাস, এক জলপাই সংবিধানকে মুসলমানি দেয়, তো আরেক জলপাই বুকের উপর আতশবাজি নিয়ে ঘোরে!

আমার মত বেকুব জনগণের বৃহত্তর স্বার্থরক্ষায়ই নাকি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ প্রয়োজন। আলুর জিলাপি খেতে না পেয়ে মরে যাওয়া সাধারণ মানুষের মৃতদেহের উপর শকুনের উৎসব ঠেকাতেই নাকি এই পরিষদ। প্রস্তাব মতে এই পরিষদে থাকবেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যবৃন্দ, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানবৃন্দ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, বিরোধীদলের নেতা, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীবৃন্দ, প্রমুখ। সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রপতি নাকি প্রজাতন্ত্রের পিতা। তাঁর উপস্থিতিতে যা-কিছু ঘটে, তার সবকিছুরই তিনিই কর্তা। প্রধানমন্ত্রীশাসিত গণতন্ত্রের নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান তবে কে হবেন? শুধু তাই নয়, প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানদের যদি সংযুক্ত করতেই হয়, তাহলে কি দেশের চূড়ান্ত সংকটের মুহূর্তে আমাদের তাকাতে হবে এরশাদের মত পতিত স্বৈরাচারীর দিকে? নাকি শিফন-বনাম-জর্জেট ঝগড়া দেখবো খালেদা-হাসিনার মধ্যে? অন্ধকারতম সময়ে যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতেই হয়, তাহলে এ কেমন গণতন্ত্র? শুধু তাই নয়, যেকোন সচেতন রাষ্ট্রপ্রধান তো নিজে থেকেই এঁদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন দুর্যোগমুহূর্তে। তবে কেন ঘটা করে নতুন একটি পরিষদ গঠন?

অধমের মত আধা-শিক্ষিত তড়িৎপ্রকৌশলীকে অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন করতে দিলে যা হবে, তাই হচ্ছে আর কি। আমি কাজের মধ্যে জানি শুধু ম্যাটল্যাবে সিমুলেশন তৈরি করতে। রোগী মারা যাবার উপক্রম হলেও আমি প্রথমে বিভিন্ন রকম মডিউল সহকারে একটি সিমুলেশন দাড় করাবো। এতে রোগীর ওজন থেকে ছুরির ধার পর্যন্ত সব কিছুই নানান রকম প্যারামিটার দিয়ে প্রকাশ করা হবে। সবশেষে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট লিখিত হবে লেটেক-এ। কোন কালে যুদ্ধে জড়াবার ভয় না থাকলেও কিংবা মানুষ মরে লাশ হয়ে যাবার পর তাকে শকুনের হাত থেকে বাঁচাবার প্রয়োজন না থাকলেও দিব্বি বলে বেড়ানো হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ তৈরির কথা। ঐ যে, ছাগল দিয়ে হালচাষ করানো। হুমকি দিয়ে বাজার রুদ্ধ করে রেখে কিংবা উৎপাদনের দিকে নজর না দিয়ে জোর করে দাম নির্ধারণ করে দিয়ে যে অর্থনীতিকে সচল রাখা যায় না, সেটা ছুঁচো পর্যায়ের রাজনীতিক জানলেও উচ্চপদস্থ সেনাকর্তাদের অজানা। অতঃপর রক্ত দেখার ভয়ে সিমুলেশনের পর সিমুলেশন।

ক্ষমতায় যদি ভারসাম্য আনতেই হয়, তাহলে আমার মতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যায়। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের ধারণার মত এটিও একক স্বেচ্ছাচারিত্ব রোধ করবে, তবে ক্ষমতায় থাকবেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ। নিম্নকক্ষ থাকতে পারে বর্তমান সংসদ ব্যবস্থার মতই। অর্থসংশ্লিষ্ট যেকোন প্রস্তাবে নিম্নকক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচ্য করা যায়। জনগণের টাকা দিয়েই সরকারের টাকশাল গঠিত। এই তহবিলের যাতে কোন রকম তছরুপ না হয়, তা দেখার জন্যই প্রত্যক্ষ ভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে এর ভার দেওয়া। চাষা থেকে স্কুল শিক্ষক পর্যন্ত যে-কেউ তাঁর এলাকার মানুষের মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে পারেন, পারেন সরকারী অর্থের সুবন্দোবস্ত নিশ্চিত করতে।

রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের মতের প্রতিফলন থাকা যেমন জরুরী, জনগণকে নতুন পথ দেখানো ও নিত্যনতুন স্বপ্ন দেখানোও তেমনি জরুরী। উচ্চকক্ষের হাতে দেওয়া যায় আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের বিধান। নিম্নকক্ষে নির্বাচিত হবার ক্ষেত্রে বয়স ও নাগরিকত্ব ছাড়া কোন বিধিনিষেধ রাখার প্রয়োজন নেই। ‘সংবেদনশীল’ জনপ্রতিনিধি হতে তেমন কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে না। পক্ষান্তরে অনেক বছর ধরেই অনুভূত ‘শিক্ষিত’ জনপ্রতিনিধি পাবার আশার প্রতিফলন ঘটানো যায় উচ্চকক্ষে নির্বাচিত হবার বেলায় কিছু শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিয়ে। অর্থসংশ্লিষ্ট নয়, এমন যেকোন আইন সরাসরি বাস্তবায়নের অধিকার দেওয়া যায় উচ্চকক্ষকে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় অল্পদিন আগে বাতিলকৃত অভিনয় নিয়ন্ত্রন আইনের কথা। এই ধরণের ঔপনিবেশিক আইনের ছড়াছড়ি আছে আমাদের আইনের বইগুলোয়।

অক্ষরজ্ঞানহীন গুন্ডাদের হাত থেকে এভাবে হয়তো আইনকে রক্ষা করা যাবে, হয়তো কোন ভাবে ছুঁড়ে ফেলা যাবে ঔপনিবেশিক আমলের জড় আইনগুলো। শতকরা ৪০ ভাগ নেতিবাচক ভোটের শর্তে উচ্চকক্ষে প্রণীত কোন আইনের সরাসরি বাস্তবায়নের অধিকার রোধ করতে পারে নিম্নকক্ষ।

নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্রঃ ১,২

১. “নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্র”
আমার নানা প্রচন্ড রকম সাহিত্যপ্রেমী মানুষ। কন্যা রাশির জাতক, মায়ার শরীর তাই। শান্ত, নিভৃতচারী, এবং নিজের ব্যাপারে বেখেয়াল হলেও প্রিয় মানুষগুলোর তুচ্ছতম খেয়ালের ব্যাপারেও অনুকরণীয় রকম মনোযোগী। ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি, নানা মানেই একা একা পেশেন্স বা ব্রিজ খেলা, নয়তো প্রমাণ সাইজের একটা বই বুকের উপর নিয়ে নিঃশব্দে পড়ে চলা। গল্প আর কবিতার আসরে অবাধ বিচরণ তার। ঘরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকতো টাইম, রিডার্স ডাইজেস্ট, আর দেশ পত্রিকা। ৮০’র দশকে হরদম বিভিন্ন বিদেশী পত্রিকা নিষিদ্ধ হয়ে যেত। খুঁজে-পেতে সেগুলোও যোগাড় করে ফেলতো আমার নানা। নানার শাস্তিগুলো ছিল তার পছন্দগুলোর মতই। বড় বড় কবিতা ধরিয়ে দিয়ে বলা হত মুখস্ত করতে। ডাল ফেলে দেওয়ার শাস্তি হিসেবে ‘দেবতার গ্রাস’ মুখস্ত করতে হওয়ার মত গল্প বহু শুনেছি মায়ের কাছে।

অধুনা নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনার হিড়িক দেখে নানার সেই শাস্তিগুলোর কথাই মনে পড়ছে শুধু। কবিতা বা রবীন্দ্রনাথ যতই উচ্চমার্গ আর প্রশান্তির হোক না কেন, আমার মা বা মামার তা হজম হয়নি। তারা দু’জনেই অগ্নির জাতক। একজন মেষ, আরেকজন ধনু। অস্থিরমতি মাথাগুলোয় জোর করে কবিতার মর্ম ঢোকানো যায়নি। সংস্কারের শিলাবৃষ্টির যুগে তাই নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্রের দিকে সময় থাকতেই সচেতন ভাবে নজর দেওয়া উচিত মনে হয়। নইলে অকারণ হট্টগোলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপার হারিয়ে যাবে।

আমাদের একটি নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্র দরকার, এই সত্য আমি মেনে নেই নিঃসংকোচে। মন ও মানুষ সংশ্লিষ্ট কোন কিছুই ওয়ান-সাইজ-ফিট্‌স-অল নয়। গৃহপালিত সুশীল সমাজ ও বাংলার মার্কাস অরেলিয়াস সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের এই দাবির সাথে আমি একমত যে আমাদের শাসনব্যবস্থায় কিছু সংস্কার প্রয়োজন। তবে প্রথমে আমাদের বর্তমান শাসনকাঠামোর মুখ্য ত্রুটিগুলো দেখা দরকার, আমাদের নিজস্ব ধাঁচটা চেনা দরকার, এবং অতীতের ভূলের পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর বুদ্ধিবৃত্তিক সমাধান যোগাবে।

২. মধ্যবর্তী নির্বাচন ও রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ঐতিহাসিক নিরাপত্তা
আমার দেশের মানুষগুলো তো আমারই মত। বিশ্বাস আর আবেগ তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অনুশাসন আর উচ্চশিক্ষার পরও আমি ভুল করি। সাড়ে চৌদ্দ কোটি মানুষের দেশটায় আমার মত সুযোগ-সুবিধার মাঝে বড় হয় হয়তো লাখে জনা পঞ্চাশেক। তবু এই আমিও স্রোতে গা ভাসিয়ে দেই। ইতিহাস বলে, দেশ ও দশ প্রায়ই বিবিধ হুজুগে মেতে বড় বড় ভুল করে বসে, যার মাশুল গুণতে হয় অনেক গুলো দিন ধরে। ব্যক্তিজীবনে ভুলগুলো খুব ছোট, নিতান্তই নির্বিষ। যেমন, ভাবতে লজ্জা লাগে যে আমি কোন কালে ব্যাকস্ট্রিট বয়েজ শুনতাম, হাসানের খ্যানখ্যানে গলার ছ্যাঁক খাওয়া গান শুনে কাবু হতাম। রাষ্ট্রের বেলায় এহেন বেওয়াকুফি খুব দুঃখজনক এবং সুদূরপ্রসারী। তবু ভুল হয়, তবু আমরা পুরো জাতি মিলে হুতাশ করি।

বাংলাদেশের জন্মের সময়ের মূলনীতিগুলো আমরা বিনাপ্রশ্নে বিসর্জন দিয়ে আজকে সাঁইত্রিশ বছর পর মাথা চাপড়াচ্ছি। বঙ্গবন্ধু যখন বঙ্গবুদ্ধুর মত এক শাসন ব্যবস্থা থেকে আরেকটায় লাফ-ঝাঁপ দিচ্ছিলেন, তখন তাঁকে বিরত করার কোন পন্থা ছিল না আমাদের শাসনব্যবস্থায়। ১৯৭৫-পরবর্তী আইয়ামে জলপাইয়াতকে নাহয় বাদই দিলাম। শুধু সমাজের উপরতলাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমরা সাধারণ মানুষও লজ্জাজনক সব ভুল করেছি। উদ্ভ্রান্তের মত দল বেঁধে জামাতিদের নির্বাচিত করেছি এই কিছুদিন আগেও। তার আগে নিঃশব্দে মেনে নিয়েছি রাজাকার পুনর্বাসন।

আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো কর্পূরের মত উবে যাওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ ক্ষমতার তাৎক্ষণিক ও আকস্মিক হাতবদল। গরীব বলে আমরা টাকার হাতছানিতে ভুলে যাই সহজেই। কোন কিছুর পাবার জন্য দাঁত কামড়ে পড়ে থাকতে অভ্যস্ত না বলে আপাতদৃষ্টে বীভৎস অনেক ধ্যান-ধারণাও আমরা গিলে ফেলি সহজে। প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ২০০১ সালের নির্বাচনের দিকে তাকানো যায়। ১৯৯৯ থেকে ২০০১ পর্যন্ত উন্নত-অবনত নির্বিশেষে পৃথিবীর সব নির্বাচনে কট্টরপন্থীরা জনগণের ভোটেই ক্ষমতায় এসেছে। কৌতূহলের ব্যাপার হল, এই সময়টায় বিশ্বময় অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা মলিন হলেও সামাজিক পরিস্থিতি মন্দ ছিল না। ডট কম বাব্‌ল ফেটে যাওয়াই ছিল এই সময়ের মুখ্য মন্দা। সনাতন অর্থনীতি যেসব ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলে, তার কোনটাই দুর্গতিতে পড়েনি। খাদ্য ঘাটতি ছিল না, উৎপাদন ঘাটতি ছিল না, কাঁচামালের ঘাটতি ছিল না। ভয় ছিল, এবং সেই ভয়টাই শেষতক ভয়ের কারণ হল। আমেরিকা থেকে ফ্রান্স, জার্মানি, বা ভারত হয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রেই এই বক্তব্য খাটে।

সংসদের সকলে আসনের নির্বাচন একই সময়ে হওয়া এর অন্যতম কারণ বলে মনে হয় আমার কাছে। এই দুর্গতি ঠেকাতে সাধারণ নির্বাচনে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ আসনে নির্বাচন করা যায়। অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশে মধ্যবর্তী নির্বাচন করা যায়। এতে করে একদিকে যেমন আবেগের আতিশয্যে ভেসে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তেমনি শাসনকালের মাঝামাঝি সময়ে সরকারের প্রতি সমর্থন বা অসমর্থনের প্রকাশ ঘটানো সম্ভব। ব্যক্তিগত ও সামাজিক ভাবে আমরা আরো স্থিতধী জাতি হবার আগে বর্তমানের বাইনারি ক্ষমতাবদল কোন সুফল দিতে পারার সম্ভাবনা খুব কম। মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারকে প্রয়োজনে হলুদ কার্ড দেখানোর নীতি অনুসরণ করা যায় ততদিন।