১. “নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্র”
আমার নানা প্রচন্ড রকম সাহিত্যপ্রেমী মানুষ। কন্যা রাশির জাতক, মায়ার শরীর তাই। শান্ত, নিভৃতচারী, এবং নিজের ব্যাপারে বেখেয়াল হলেও প্রিয় মানুষগুলোর তুচ্ছতম খেয়ালের ব্যাপারেও অনুকরণীয় রকম মনোযোগী। ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি, নানা মানেই একা একা পেশেন্স বা ব্রিজ খেলা, নয়তো প্রমাণ সাইজের একটা বই বুকের উপর নিয়ে নিঃশব্দে পড়ে চলা। গল্প আর কবিতার আসরে অবাধ বিচরণ তার। ঘরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকতো টাইম, রিডার্স ডাইজেস্ট, আর দেশ পত্রিকা। ৮০’র দশকে হরদম বিভিন্ন বিদেশী পত্রিকা নিষিদ্ধ হয়ে যেত। খুঁজে-পেতে সেগুলোও যোগাড় করে ফেলতো আমার নানা। নানার শাস্তিগুলো ছিল তার পছন্দগুলোর মতই। বড় বড় কবিতা ধরিয়ে দিয়ে বলা হত মুখস্ত করতে। ডাল ফেলে দেওয়ার শাস্তি হিসেবে ‘দেবতার গ্রাস’ মুখস্ত করতে হওয়ার মত গল্প বহু শুনেছি মায়ের কাছে।
অধুনা নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনার হিড়িক দেখে নানার সেই শাস্তিগুলোর কথাই মনে পড়ছে শুধু। কবিতা বা রবীন্দ্রনাথ যতই উচ্চমার্গ আর প্রশান্তির হোক না কেন, আমার মা বা মামার তা হজম হয়নি। তারা দু’জনেই অগ্নির জাতক। একজন মেষ, আরেকজন ধনু। অস্থিরমতি মাথাগুলোয় জোর করে কবিতার মর্ম ঢোকানো যায়নি। সংস্কারের শিলাবৃষ্টির যুগে তাই নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্রের দিকে সময় থাকতেই সচেতন ভাবে নজর দেওয়া উচিত মনে হয়। নইলে অকারণ হট্টগোলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপার হারিয়ে যাবে।
আমাদের একটি নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্র দরকার, এই সত্য আমি মেনে নেই নিঃসংকোচে। মন ও মানুষ সংশ্লিষ্ট কোন কিছুই ওয়ান-সাইজ-ফিট্স-অল নয়। গৃহপালিত সুশীল সমাজ ও বাংলার মার্কাস অরেলিয়াস সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের এই দাবির সাথে আমি একমত যে আমাদের শাসনব্যবস্থায় কিছু সংস্কার প্রয়োজন। তবে প্রথমে আমাদের বর্তমান শাসনকাঠামোর মুখ্য ত্রুটিগুলো দেখা দরকার, আমাদের নিজস্ব ধাঁচটা চেনা দরকার, এবং অতীতের ভূলের পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর বুদ্ধিবৃত্তিক সমাধান যোগাবে।
২. মধ্যবর্তী নির্বাচন ও রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ঐতিহাসিক নিরাপত্তা
আমার দেশের মানুষগুলো তো আমারই মত। বিশ্বাস আর আবেগ তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অনুশাসন আর উচ্চশিক্ষার পরও আমি ভুল করি। সাড়ে চৌদ্দ কোটি মানুষের দেশটায় আমার মত সুযোগ-সুবিধার মাঝে বড় হয় হয়তো লাখে জনা পঞ্চাশেক। তবু এই আমিও স্রোতে গা ভাসিয়ে দেই। ইতিহাস বলে, দেশ ও দশ প্রায়ই বিবিধ হুজুগে মেতে বড় বড় ভুল করে বসে, যার মাশুল গুণতে হয় অনেক গুলো দিন ধরে। ব্যক্তিজীবনে ভুলগুলো খুব ছোট, নিতান্তই নির্বিষ। যেমন, ভাবতে লজ্জা লাগে যে আমি কোন কালে ব্যাকস্ট্রিট বয়েজ শুনতাম, হাসানের খ্যানখ্যানে গলার ছ্যাঁক খাওয়া গান শুনে কাবু হতাম। রাষ্ট্রের বেলায় এহেন বেওয়াকুফি খুব দুঃখজনক এবং সুদূরপ্রসারী। তবু ভুল হয়, তবু আমরা পুরো জাতি মিলে হুতাশ করি।
বাংলাদেশের জন্মের সময়ের মূলনীতিগুলো আমরা বিনাপ্রশ্নে বিসর্জন দিয়ে আজকে সাঁইত্রিশ বছর পর মাথা চাপড়াচ্ছি। বঙ্গবন্ধু যখন বঙ্গবুদ্ধুর মত এক শাসন ব্যবস্থা থেকে আরেকটায় লাফ-ঝাঁপ দিচ্ছিলেন, তখন তাঁকে বিরত করার কোন পন্থা ছিল না আমাদের শাসনব্যবস্থায়। ১৯৭৫-পরবর্তী আইয়ামে জলপাইয়াতকে নাহয় বাদই দিলাম। শুধু সমাজের উপরতলাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমরা সাধারণ মানুষও লজ্জাজনক সব ভুল করেছি। উদ্ভ্রান্তের মত দল বেঁধে জামাতিদের নির্বাচিত করেছি এই কিছুদিন আগেও। তার আগে নিঃশব্দে মেনে নিয়েছি রাজাকার পুনর্বাসন।
আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো কর্পূরের মত উবে যাওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ ক্ষমতার তাৎক্ষণিক ও আকস্মিক হাতবদল। গরীব বলে আমরা টাকার হাতছানিতে ভুলে যাই সহজেই। কোন কিছুর পাবার জন্য দাঁত কামড়ে পড়ে থাকতে অভ্যস্ত না বলে আপাতদৃষ্টে বীভৎস অনেক ধ্যান-ধারণাও আমরা গিলে ফেলি সহজে। প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ২০০১ সালের নির্বাচনের দিকে তাকানো যায়। ১৯৯৯ থেকে ২০০১ পর্যন্ত উন্নত-অবনত নির্বিশেষে পৃথিবীর সব নির্বাচনে কট্টরপন্থীরা জনগণের ভোটেই ক্ষমতায় এসেছে। কৌতূহলের ব্যাপার হল, এই সময়টায় বিশ্বময় অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা মলিন হলেও সামাজিক পরিস্থিতি মন্দ ছিল না। ডট কম বাব্ল ফেটে যাওয়াই ছিল এই সময়ের মুখ্য মন্দা। সনাতন অর্থনীতি যেসব ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলে, তার কোনটাই দুর্গতিতে পড়েনি। খাদ্য ঘাটতি ছিল না, উৎপাদন ঘাটতি ছিল না, কাঁচামালের ঘাটতি ছিল না। ভয় ছিল, এবং সেই ভয়টাই শেষতক ভয়ের কারণ হল। আমেরিকা থেকে ফ্রান্স, জার্মানি, বা ভারত হয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রেই এই বক্তব্য খাটে।
সংসদের সকলে আসনের নির্বাচন একই সময়ে হওয়া এর অন্যতম কারণ বলে মনে হয় আমার কাছে। এই দুর্গতি ঠেকাতে সাধারণ নির্বাচনে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ আসনে নির্বাচন করা যায়। অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশে মধ্যবর্তী নির্বাচন করা যায়। এতে করে একদিকে যেমন আবেগের আতিশয্যে ভেসে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তেমনি শাসনকালের মাঝামাঝি সময়ে সরকারের প্রতি সমর্থন বা অসমর্থনের প্রকাশ ঘটানো সম্ভব। ব্যক্তিগত ও সামাজিক ভাবে আমরা আরো স্থিতধী জাতি হবার আগে বর্তমানের বাইনারি ক্ষমতাবদল কোন সুফল দিতে পারার সম্ভাবনা খুব কম। মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারকে প্রয়োজনে হলুদ কার্ড দেখানোর নীতি অনুসরণ করা যায় ততদিন।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment