Wednesday, June 11, 2008

নীড়ে ফেরাঃ উড়াল পর্ব

আই ডোন্ট ড্রাইভ ফাস্ট, আই জাস্ট ফ্লাই লো। বছর খানেকের মধ্যেই রেকলেস ড্রাইভিং এর জন্য তিন তিনটা টিকেট খাওয়া আজমীরের উক্তি এটা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই টিকেটগুলোর একটা রীতিমত এরোপ্লেন থেকে তাড়া করে, রাস্তা ব্যারিকেড করে, গাড়ি থামিয়ে দেওয়া! আমাদের সফরের একটা অনেক বড় অংশ কেটেছিল পথে পথে, উড়ে উড়ে। মাত্র পাঁচ দিনে ২৬০০ মাইলের বেশি ঘুরে বেড়ানো ট্রিপের এক পর্যায়ে এই উক্তিই হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। স্পিডিং কাহাকে বলে, উহা কত প্রকার, ও তার শাশুড়ির নাম কী, তা জানা হয়ে গিয়েছিল যাত্রাপথে।

আমার জন্য সাউথের সিধা, সরল, সিরাতুল মুস্তাকিমের মত পথঘাটে ফিরতে পারা ছিল বিশাল ব্যাপার। ভার্জিনিয়া এসে অবধি পাহাড়ে পাহাড়ে আঁকাবাঁকা পথে ড্রাইভ করে কেটেছে। পুরো আমেরিকায় ট্রাফিক আইন নিয়ে ভার্জিনিয়ায় কড়াকড়ি সবচেয়ে বেশি। এরা পারলে কফ-থুথু ফেললেও শপাঁচেক টাকা জরিমানা করে। স্পিডিং মানে তো কম করে হলেও হাজার খানেক টাকা। সর্বোচ্চ গতিসীমা মাত্র ৬৫ মাইল, রেডারের পাশাপাশি হেলিকপ্টার দিয়েও নজরদারি করা হয়। তার ওপর আমি নিজে স্পিডিং এর দায়ে ছয় মাসের প্রোবেশনে থাকায় জুত মত গাড়ি চালাতে পারছিলাম না আগের মাসগুলোয়। শেষতক গুরু মার্ক নফলারের পরামর্শ অনুযায়ী থ্রোয়িং-কশন-টু-দ্য-উইন্ড করে আমি আর আজমীর স্রেফ দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম এক্সিলারেটরের উপর। এরই চূড়ান্ত নিদর্শন ছিল দুই ড্রাইভারের মধ্যে একাধিকবার হাতবদলের পরও ব্যাটন রুজ থেকে অবার্ন পর্যন্ত ৪২০ মাইল মাত্র ৪ ঘন্টায় পাড়ি দেওয়া। আরো দ্রুত আসতে না পারার সম্পূর্ণ দায় ভাড়া করা পন্টিয়্যাক গ্রাঁ প্রি টার। নামেই স্পোর্টি গাড়ি, কাজের বেলায় ১০৮ মাইলের বেশি স্পিড ওঠেই না! তার উপর শক্ত সিটে টানা বসে থেকে সপ্তাহ খানেক বিব্রতকর সব জায়গায় ঠান্ডা-গরম মালিশ করতে হয়েছে ফিরে এসে।

জগতের আর সব কুকাজের মত স্পিডিং এরও কিছু গ্রামার আছে। অনেকেই পুরো সময় নিয়ম মেনে চালিয়ে মুহূর্তের উত্তেজনায় ১০-১২ মাইল স্পিডিং করে টিকেট খেয়ে বসেন। পুরোটাই গ্রামার না মেনে স্পিডিং এর ফল। স্পিডিং এর তিলমাত্র ইচ্ছে থেকে থাকলে প্রথম কাজ হল সেই এলাকার পুলিশের গাড়ির রঙ চিনে নেওয়া। স্টেট পুলিশ, শেরিফ, হাইওয়ে পেট্রল, ইত্যাদি একেক ধরনের পুলিশের গাড়ির রঙ একেক রকম। বলা বাহুল্য, যেসব স্টেটে পুলিশের গাড়ি কালো, সেগুলোয় একটু সতর্ক থাকতে হয়।

দ্বিতীয় কাজ হল পুলিশের গাড়ির মেক ও মডেল চিনে নেওয়া। প্রায় সব স্টেটেই পুলিশ ফোর্ড টরাস গাড়ি ব্যবহার করে ফ্লিট ভেহিকল হিসেবে। এছাড়া শেভি ইম্পালা ও ডজ চার্জার পুলিশের গাড়ি হিসেবে বহুল ব্যবহৃত। মোটের উপর পুলিশ আর রেন্টাল কার মানেই আমেরিকান গাড়ি। তবে সমস্যা হয়ে যায় অ্যাটলান্টা বা নর্দার্ন ভার্জিনিয়া বা টেক্সাস রেঞ্জারদের গাড়ি নিয়ে। নিসান মুরানো, টয়োটা ক্যামরি, বা হোন্ডার ট্রাকও দেখা যায় এসব জায়গার পুলিশকে ব্যবহার করতে। শুনেছিলাম ক্যালিফোর্নিয়ায় নাকি ল্যাম্বর্গিনির আধিপত্যের কারণে পুলিশকে করভেট দেওয়া হয়েছে।

নিয়মের তালিকায় এরপর আসে ঢাল বা বাঁকে সমঝে চালানো। পুলিশমাত্রই দৃষ্টির অন্তরাল থেকে উঁকি-ঝুঁকে দিতে পছন্দ করে। এইতো সেদিনই ফ্লোরিডার এক পুলিশ বরখাস্ত হল ড্যাশবোর্ডের ক্যামেরায় জুম করে বেড়ার ফাঁক দিয়ে স্নানরত বালিকা দেখতে গিয়ে। এদেশের হাইওয়েগুলোর এক্সিট প্রায়ই প্রধান হাইওয়ের উপর দিয়ে অন্য পাশে নিয়ে যায় রেস্ট এরিয়ায়। এরকম কালভার্ট-সদৃশ যেকোন সারফেস রোডের নিচ হল মামুদের খুব প্রিয় জায়গা। কপাল খুব ভাল হলে দুটি গাড়ি উলটো দিকে মুখ করে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকবে। এই অবস্থায় মামুরা প্রায়ই নিজ নিজ ল্যাপটপে দুষ্ট ছবি দেখে থাকে বলে দুর্মুখেরা বলে থাকেন।

চতুর্থ নিয়মটা সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পাসিং (সোজা বাংলায় আমরা যাকে ওভারটেক করা বলি) করার প্রয়োজন না হলে বামের লেনে উঠতে নেই। স্পিডগান বামের লেনেই আগে তাক করা হয়। শুধু তাই নয়, আগে-পিছে গাড়ি থাকলে দূর থেকে দেখতে পাওয়া কষ্টসাধ্য। নিউ জার্সির দিকে গেলে সমস্যা অন্য। ওখানে রেডার দিয়ে এক পুলিশ ডিটেক্ট করে, আর সামনে থেকে আরেকজন এসে থামায়। কোথাও কোথাও তো কিছুটা দূরত্বে দুজন বসে থাকে, স্রেফ কেউ প্রথম জনকে পেরিয়েই খুশি মনে স্পিড বাড়ালে ধরবার জন্য।

আমেরিকার অনেক শহরের মুখ্য আয় ট্রাফিক টিকেট থেকে আসে। এই শহরগুলোর কাছে এলেই আচমকা স্পিড লিমিট ১০-১৫ মাইল কমে যায়। আদর করে এগুলোকে টিকেট সিটি ডাকি আমি। এগুলো, কিংবা বড় কোন শহরের আউটস্কার্টে এলেই পুলিশের উৎপাত বেড়ে যায়। এদেশে স্টেট পুলিশদের এক্তিয়ার নেই অন্য কোন স্টেটে যাওয়ার। তবুও স্টেট বর্ডারগুলো স্পিডিং এর জন্য খুব বিপজ্জনক।

সবশেষে দরকার ভাল একজন ওস্তাদ ও অনুগত এক বা একাধিক সাগরেদ। জেট প্লেনের মত উড়ে আসা কোন গাড়ি দেখলেই এক পাশে সরে যান, এবং তার আধা মাইল দূরত্বে থেকে মনের সুখে স্পিড করে যান। এরকম সময় পেছনেও আরো কিছু দ্রুতগামী গাড়ি পেলে তো কথাই নেই। দ্রতগামী গাড়িটি যদি মার্সিডিজ বা বিএমডব্লিঊ হয়, তাহলে তাকে একবার ওভারটেক করুন। এই গাড়িগুলোর মালিকের বোধহয় ইগো অনেক বেশি হয়। দুই-একবার উৎপাত করলেই এরা মোটামুটি শ'খানেক মাইলে গাড়ি চালানো শুরু করে দেয়। এখানে অবশ্য কিছু ব্যতিক্রমও আছে। লাক্সারি গাড়ি হলেও লেক্সাস, জ্যাগুয়ার, কিংবা মাস্ট্যাং, স্পোর্টি বিএমডব্লিঊকে উষ্কে লাভ নেই। এগুলোর মালিক সাধারণত খুব শীতল রক্তের হয়।

যাক, এগুলো ও আরো কিছু গ্রামারের মেনে চলার প্রত্যক্ষ সুফল ছিল ঝড়ের ভয়ে ঝড়ের বেগে ব্যাটন রুজ থেকে অবার্ন চলে আসা। মজার ব্যাপার হল, এই উড়াল পর্বের পরও সবার মন পড়ে ছিল অন্য কোথাও। পাশ থেকে সাই-সাই করে সরে যাওয়া গাছ বা গাড়ি নয়, গাড়ির ভেতরের মানুষগুলো আর তাদের জীবনই ছিল মুখ্য।

ব্যক্তিজীবনে মানুষমাত্রই পলায়নপর। কোন কিছু লুকানোর সবচেয়ে ভাল উপায় নাকি চোখের সামনে রেখে দেওয়া। আমি অন্তত নিজেকে সেভাবেই লুকাই। ঢাকে বাড়ি পড়ার আগেই নাচুনে বুড়ির মত কিছু তিড়িং-বিড়িং করে এসে নিভৃতে নিজের দুঃখগুলোয় ডুবে থাকি। একই রকম আড়ালে অধিকাংশ মানুষই লুকিয়ে থাকেন। বড় কোন ভ্রমণে বের হওয়ার সমস্যা হল, এই এস্কেপ গুলো সহসা পাওয়া যায় না। দিনের পর দিন একই সাথে থাকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে তাই সহযাত্রীর অনেক গোমর ফাঁস হয়ে যায় লম্বা সফরে।

যাত্রা শুরুর আগে কেউ প্রকৃতির কাছে দেহের কোন অংশ গচ্ছিত রাখতে ভুলে গেলে তা প্রচন্ড দুর্গন্ধের সাথে প্রতীয়মান হয়ে যায় আধা ঘন্টা নাগাদ। কারো বিড়ি-সিগারেট খাবার অভ্যাস থাকলে সেটা দেড় ঘন্টার মধ্যে বের হয়ে আসতে বাধ্য। কারো পা ঘামার ব্যামো থাকলে দুঘন্টা। ভোজনরসিক কেউ থাকলে প্রতি তিন ঘন্টা অন্তর বড়সড় একটা বিরতি দরকার পড়ে। দ্বিতীয় দিনে জানা যায় কার হজমশক্তি কেমন। দ্বিতীয় রাত নাগাদ ষড়রিপুর অন্তত দুটির উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। তৃতীয় দিনে ত্রুটি আড়ালের অভিনয়দক্ষতা জানা যায়। চতুর্থ দিনে দেখা যায় নীরব থেকে পৃথিবীকে উপেক্ষা করার সামর্থ্য। পঞ্চম দিনে প্রতিটি মানুষের জীবন খোলা বইয়ের মত হয়ে যায় আশেপাশের মানুষের কাছে। ব্যাটন রুজ থেকে অবার্নের পথটুকু ছিল আত্মগোপনের অক্ষম অপচেষ্টার যাত্রা। আমরা পাঁচ ভাই কাতর ছিলাম যার যার ব্যক্তিগত বেদনায়। পালাক্রমে দীর্ঘশ্বাসের সাথে সাথে বের হয়ে আসছিল গোপনতম কষ্টগুলো।

কারো আদরের প্রতীক্ষিতা তাকে ব্যবহৃত ডায়াপারের মত ফেলে রেখে চলে গেছে আর কারো কাছে। ছন্নছাড়া, নিরামিষ জীবন নিয়ে সেই কূলে শুধুই হুতাশ। দুনিয়াটা সকালে তেতো তো রাতে অসীম।

কেউ একেবারেই উলটো। সুশৃঙ্খল, নামাযী, হাসিখুশি। মাত্রই করাত আগে বান্ধবী মায়ের বকা-ঝকায় ভয় পেয়ে ছেড়ে চলে গেছে তাকে। এই কূলে শুধুই হাসি। আর কিছুক্ষণ পরপর একটাই কথা। আমি ঠিক আছি, ভাল হয়েছে, সব ঠিক আছে।

কারো এক দশক আগে হারানো প্রেয়সী আজ অন্য কারো ঘরণী। মাঠ-ঘাট পেরিয়ে প্রায়ই ছুটে যায় দূর থেকে এক পলক দেখে আসতে। মানুষ থেকে মানুষে শুধু খুঁজে বেড়ায় চিরচেনা কোন মুখের ছায়া।

কেউ ভাবে সেই সব দিনের কথা, যখন পেট বাঁচাতে ধর্ম ছাড়তে হয়েছিল। প্রবাসে নিঃস্ব, ক্ষুধার্ত অবস্থায় কোন এক কালে পড়শী মেয়ের দেওয়া শূকরের মাংস খেয়ে জীবন বাচাঁতে হয়েছে। আজ অর্থ ও খাদ্য আছে প্রচুর, মাঝখান থেকে স্রষ্টা কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন।

কেউ বা একের পর এক বিপত্তি হাসিমুখে বরণ করে নেয়, এক যুগ পুরনো এক প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান দেখাতে। এই প্রতিশ্রুতিটুকুই ক্যান্সারের কাছে হারানো প্রিয়াকে নিজের মাঝে অনুভব করার একমাত্র নৈমিত্তিক উপায়।

মাত্র পাঁচ দিন। ২৬০০ মাইল। ভেবেছিলাম বেড়াচ্ছি। বাস্তব হল, জীবন থেকে পালাচ্ছিলাম আমরা সবাই।

No comments: