Saturday, May 03, 2008

এক একটা দিন...

১.
আজ সত্যজিতের জন্মদিন

ব্যস্ততা কমেনি তিল পরিমাণ তবু শুধু এটুকু লেখার জন্য ব্লগে পোস্টানো হাজার টুকরায় ছড়িয়ে থাকা জীবনের এক একটা দিন কেটে যাচ্ছে এমনি এমনি হোমওয়ার্ক, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রোজেক্ট, আর পরীক্ষার ভারে চিড়ে-চ্যাপ্টা অবস্থা সিমেস্টারের জঘন্যতম সময়টা কাটছে শেষ কবে রান্না হয়েছে ঘরে, খেয়াল নেই নুডুলস, চিপস, আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের উপর চলছে দুনিয়া ঘুমের অপর নাম বিলাসিতা, চায়ের অপর নাম জীবন বেশ অনেক দিন হয় পাখির ডাক না শুনে ঘুমানো হয়না কিছু পাখি ঠিক ৬ টা নাগাদ ডাকে এরপর কিছুক্ষণের বিরতি আধা ঘন্টা মত পরে পরের দফা ডাকাডাকি শুরু হয় মাঝের সময়টা আমি গুনগুনাই আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে, শাখে শাখে পাখি ডাকে, কত শোভা চারিপাশে এরপর দ্বিতীয় দফার ডাকাডাকি শুনতে শুনতে ঢুলে পড়ি ঘুমে

বাসের জন্য বসে ছিলাম রাত জেগে গুল-তাপ্পি মেরে প্রোজেক্ট রিপোর্ট দাঁড় করিয়েছি কোন রকমে পাতা উল্টাতে উল্টাতে ভাবছিলাম, আমার হাত দিয়ে বের হওয়া কাজগুলো অযত্ন নয়তো অসম্পূর্ণতায় ভোগে যা-কিছুই করি না কেন, সব খানেই এই এক সমস্যা একবার দেখলে দ্বিতীয়বার দেখতে ইচ্ছে করে না একবার পড়ে সারতেই ঘাম ছুটে যায়, দ্বিতীয়বার পড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না এমন সময় বাজ পড়ার মত করেই মনে পড়ে গেল, আজ সত্যজিতের জন্মদিন! আহা রে, যদি সত্যজিতের মত লিখতে পারতাম

২.
১৯৯২ সালটা খুব মনে পড়ে ইমরান খানের বছর ওয়াসিম আকরামের বছর ইমরানের অবসরের পর শচীনাসক্ত হবার বছর তবু ১৯৯২-কে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে সত্যজিতের মারা যাবার বছর হিসেবে রাতের খাবার খাচ্ছিলাম ১০টার ইংরেজি সংবাদে সত্যজিৎ মারা যাবার খবর দেখলাম মাত্রই কিছুদিন আগে টিনটোরেত্তোর যীশু কিনেছিলাম চুরি যাওয়া চিত্রকলা খুঁজের বের করবে-করবে করছে ফেলুদা পড়তে পড়তেই খাচ্ছিলাম সেই বইটা হাতে নিয়েই পুরো রাত কেঁদেছিলাম ২৩ এপ্রিল, ১৯৯২

মায়ের খুব শখ ছিল ছবি আঁকা শেখাবে কালে নানার মত ডাক্তার বানানোর ইচ্ছা ছবি আঁকার হাত থাকলে পরে হয়তো বায়োলজিতে সাপ-ব্যাঙ আঁকতে কষ্ট কম হবে, এই ছিল চিন্তা আমি শুধু এক কোণায় বসে নদী, বাড়ি, কলা গাছ, আর দিগন্তে ডুবে যাওয়া সূর্য আঁকতাম আমার গুণের নমুনা দেখেই হয়তো দুই দুইটা আর্ট স্কুল ব্যবসা গুটিয়ে উঠে গেছিলো ভূতের গলি মসজিদের সামনের ডাস্টবিনের সামনে দিয়ে প্যাঁক-কাদা পাড়িয়ে আর্ট স্কুলে যেতে হত না এই বিষম আনন্দের পাশেই ছিল সাদা কাগজ পেলেই সত্যজিতের মত করে স্কেচ করার চেষ্টা চোখা একটা থুতনি, একটু বাম দিকে স্পষ্ট সিঁথি, পরিপাটি চুল, আর পোর্ট্রেইট ফুটিয়ে ওঠানোর জন্য অদ্ভুত সুন্দর ছায়ার কাজ আন্তরিক চেষ্টা ছিল, পারলাম না

৩.
সত্যজিতের প্রথম বই নানা কিনে দিয়েছিল অ্যাডিনয়েড গ্লেন্ডে অপারেশনের আমি তখন হাসপাতালে গড়াচ্ছি নানা এসে বললো, তার ছাত্রের দোকান থেকে একটা চাচা চৌধুরী আর একটা সত্যজিৎ এনেছে আমার জন্য পাঠক সমাবেশের সাথে সেই থেকেই পরিচয় সেই দিনগুলোর নস্টালজিয়া থেকেই অনেক দিন পর নানাকে ফোন করলাম চিরাচরিত সূচনা নানা, আমি অভি শরীর কেমন? নানার জবাব, শরীর বাদামি, পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি হেসে গড়াগড়ি দিলাম, লিভারপুল-চেলসি নিয়ে কথা বললাম সত্যজিতের কথা কেন যেন মুখে আসলো না একেবারে অচেনা-অজানা একটা মানুষ এত প্রভাব রাখতে পারে, ভাবতে অবাক লাগছিল নিজেরই

সোনার কেল্লা অনেক পরে হাতে পেয়েছি আমার শুরু ছিল মনে হয় কৈলাসে কেলেঙ্কারি দিয়ে এরপর কখনো রয়েল বেঙ্গল রহস্য পড়ে ভয়ে কেঁপেছি, কখনো প্রফেসর শঙ্কুর মত কাল্পনিক অ্যানাইহিলেটর গান দেগেছি ডানে-বামে, কখনো তাড়িণীখুড়োর গল্পের মত ডুয়েল লড়েছি লখনৌয়ে আহ, সেই সব দিনগুলি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে এভাবে কলমের খোঁচায় স্বপ্ন দেখানোর মত স্রষ্টা আর ক’জন আসবে কে জানে

৪.
পাইলট, পুলিশ অফিসার, আইসক্রিম-ওয়ালা থেকে ফায়ার-ফাইটার হয়ে রোমান্টিক স্বপ্নগুলো এসে চলচ্চিত্রকার হওয়ায় এসে ঠেকেছে বেশি বয়সে এসে এই ভূত মাথায় ঢুকবার কারণ শুধু এবং শুধুই সত্যজিৎ বহুদিন পর এই সেদিন আবার বৃষ্টিতে ভিজলাম জানালার পাশে বসে কাজ করছিলাম আলোর ঝলকানি, বিকট শব্দে বাজ পড়ার আওয়াজ, আর বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টিপাত মুহূর্তেই দৌঁড়ে রাস্তায় নেমে গেলাম গাছের নাচ, বাতাসের ডাক, আর আকাশের হাঁক শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, ইন্টারস্টেটটার জায়গায় যদি একটা ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে যাওয়া ট্রেন থাকতো!
ব্যাগ-বই-ছাতা-জামা দিয়ে সবাই মাথা ঢাকছে, আর আমি স্রোতের বিপরীতে হেঁটে যাচ্ছি খালি পায়ে, টুটা-ফাটা টি-শার্ট পড়ে

ঘরে ফিরে ভেজা শরীরেই বসে পড়লাম কম্পিউটারের সামনে খুঁজে-পেতে বের করলাম অপুর সংসার নিত্যদিন চোখে ভাসা দৃশ্য দুটো বের করে দেখলাম সদ্যবিবাহিত অপু রাতে বৌয়ের আঁচল জামায় বেঁধে রেখেছে, ওদিকে চোখ খুলে অপু দেখে সিগারেটের প্যাকেটে লেখা, প্রতিদিন একটা করে, কথা দিয়েছো চামড়ার আতিশয্য এড়িয়ে অনুভূতির গভীরতার কী দুর্দান্ত প্রকাশ অন্য দৃশ্যটি ছেলের সাথে অপুর পুনর্মিলনের বড় বড় চোখ করে নিগৃহীত পুত্রের নিষ্পাপ প্রশ্ন, বাবা কাকে বলে?

এক একটা দিন এভাবেই মনে পড়ে সত্যজিৎকে আজ সেই সত্যজিতের জন্মদিন

(মে ০২, ২০০৮)