Thursday, October 16, 2008

আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও বাঙালি ভোট

১. আমেরিকায় বাঙালি ভোট ও রাজনৈতিক মানচিত্রে তার গুরুত্ব
বাঙালি স্বভাবগত ভাবেই রাজনীতিমগ্ন জাতি। আমেরিকায় বসবাসকারী বাঙালিরাও এর ব্যতিক্রম নন। আমেরিকার ইতিহাসে স্মরণকালের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তেজনাপূর্ণ নির্বাচনের প্রাক্কালে তাই বাঙালিরাও অনেকাংশে নির্বাচন-জ্বরে আক্রান্ত। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন রকম বিশ্লেষণ চলছে এই নির্বাচন গিরে। আমেরিকায় বসবাসকারী ভোটারদের নির্বাচন ভাবনার কিছু দিক সেই আলোচনায় উহ্য রয়ে যায়, এবং পৃথক বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

অভিবাসীর দেশ আমেরিকায় আইরিশ, ইতালীয়, বা হিসপ্যানিকদের তুলনায় বাঙালিদের বসবাস অনেক কম সময় ধরে। সময়ের আবর্তে ইতালি, আয়ারল্যান্ড, জার্মানি, জাপান, ভিয়েতনাম, বা মেক্সিকো থেকে আগত অভিবাসীরা মূলধারার মার্কিন সমাজে মিশে গেলেও বাঙালিরা কিছুটা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পছন্দ করেন। সুযোগ পেলেই দেশি গান, খাবার, পোশাকে হারিয়ে যাওয়ার তাড়না বাঙালির যাবার নয়। অপরাপর জাতিগুলো এক শব্দে ‘আমেরিকান’ হলেও বাঙালিরা ততটা নয়। আমেরিকায় স্থায়ী ভাবে বসবাসকারী বাঙালিদের রাজনৈতিক চেতনা তাই মূলধারার আমেরিকার সামাজিক ও আঞ্চলিক উপাদানগুলোর চেয়ে বৈশ্বিক উপাদান দিয়ে চালিত বেশি। এ-কারণে বাঙালিরা সংখ্যায় প্রচুর হলেও আমেরিকার রাজনৈতিক মানচিত্রে উল্লেখযোগ্য কোন অংশ নয়।

ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা এদিক থেকে অনুকরণীয় রকম ভিন্ন। মাত্র ক’দিন আগেই আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম কনিষ্ঠ গভর্নর নির্বাচিত ববি জিন্ডাল ভারতীয় বংশোদ্ভূত। শুধু তাই নয়, তিনি নির্বাচিত হয়েছেন লুইজিয়ানার মত রক্ষণশীল অঙ্গরাজ্যে এবং রিপাবলিকান দলের সমর্থনপুষ্ট হয়ে। মুদ্রার অন্যপিঠে আছেন বাঙালিরা, যাঁরা প্রবাসে বসেও দেশের রাজনীতিরই লেজুড়বৃত্তি করেন। ইসরায়েলের পর তাই আমেরিকার অন্যতম মিত্র হিসেবে ভারত উঠে আসছে, ইহুদিদের পর সবচাইতে সুবিধাভোগী হিসেবে ভারতীয়রা জায়গা করে নিচ্ছেন, পেছনে পরে থাকছে বাঙালিরাই।

পরিহার্যতার পীড়াদায়ক বাস্তবতার কারণে বাঙালিরা মূলধারার তুলনায় ভিন্নতর প্রণোদনায় রাজনৈতিক ভাবে উদ্বুদ্ধ বোধ করে থাকে। আমেরিকার ইস্যুভিত্তিক রাজনীতির উপাদানগুলোর মধ্যে সাস্থ্যসেবা বাঙালিদের কাছে মুখ্য বিবেচ্য। উচ্চমূল্যের কারণে চিকিৎসাবঞ্চিত থাকা থেকে বেরিয়ে আসতে চান তারা সবাই। সাস্থ্যসেবার পাশাপাশি শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক নীতির কারণে ডেমোক্রেটিক পার্টিই গড়পড়তা সব বাঙালির পছন্দ। এই ইস্যুগুলোর পাশাপাশি উদারপন্থা ও অভিবাসীদের প্রতি সহনশীলতার কারণে ডেমোক্রেটিক পার্টি আমেরিকার অধিকাংশ অভিবাসীর ঠিকানায় পরিণত হয়েছে। বাঙালিরা তাই প্রার্থী নির্বিশেষে ডেমোক্রেটিক পার্টির নিষ্ঠাবান ভোটিং ব্লক।

সাদা চোখে দেখলে বারাক ওবামা ও জন ম্যাকেইনের দ্বৈরথে বাঙালি ভোটারদের অবস্থান এটুকুতেই সমাপ্ত। মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাঙালিমাত্রেই নীল পতাকাধারী ডেমোক্রেটিক দলের গাধা মার্কায় ভোট দেবেন। প্রশ্ন হল, কতজন বাঙালি ভোট দেবেন, কেন ভোট দেবেন, কতটা উচ্ছ্বাসের সাথে ভোট দেবেন, এবং সেই ভোট কতটুকু মূল্য পাবে।

২. বাঙালি ভোট অবহেলিত হবার কারণ
আমেরিকায় বাঙালি ভোট তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ না হওয়ার একটি বড় কারণ অবস্থানগত। বাঙালিরা যেসব অঙ্গরাজ্যে বসবাস করেন, সেগুলো দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলের কোন না কোনটির নির্ভরযোগ্য ঘাঁটি। নিউ ইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, অরিগন, ম্যাসাচুসেটস, বা ওয়াশিংটনে বাঙালিরা নীলের সাগরে বিলীন। অন্যদিকে টেক্সাস, ওকলাহোমা, বা অ্যারিজোনায় বাঙালিরা রক্ষণশীলদের দুর্গে বন্দী।

এই প্রান্তিক পরিস্থিতির বিপরীত অবস্থানে আছে তথাকথিত ‘সুইং স্টেট’ গুলো। এই স্টেটগুলো তুলনামূলক ভাবে জনবৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়ায় এগুলো নির্দিষ্ট কোন দলের ঘাঁটি নয়। এই গোটা দশেক ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট’-এই নির্ধারিত হয় মার্কিন নির্বাচন। নিউ জার্সি কিংবা ফ্লোরিডার মাত্র কয়েক হাজার ভোটের ব্যবধানে নির্বাচনের ফলাফল ঘুরে যেতে পারে বলে দুই দলই এসব এলাকায় ভোটারদের তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে। নিউ জার্সির একাংশের শ’খানেক ‘ইহুদি’ ভোটার, ফ্লোরিডার ‘সিনিয়র সিটিজেন’ ভোটার, বা ওহায়োর ‘ইভ্যাঞ্জেলিক্যাল’ ভোটারেরা তাই উভয় পক্ষ থেকেই ঈর্ষণীয় মনোযোগ পাচ্ছেন। অন্যদিকে সংখ্যায় অনেক বেশি হয়েও অনেক এলাকায় ভোটারেরা নির্বাচনের দামামা তেমন একটা শুনতে পাচ্ছেন না।

বিশ্বস্ত ভোটার হওয়া সত্ত্বেও বাঙালিরা ডেমোক্রেটিক দলের কাছ থেকেও তুলনামূলক ভাবে কম সমাদর লাভ করে থাকে। সংখ্যালঘু হলেই ডেমোক্রেটিক দলের পক্ষে ভোট দিতে হবে, এই রীতি থেকে বাঙালিরাও বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে একটু একটু করে। এক্ষেত্রে ‘সুইং ভোটার’-এর মর্যাদা লাভের চেয়ে ডেমোক্রেটিক দলের প্রতি অসম্মতির ভূমিকা বেশি। বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে একটি সমান্তরাল উদাহরণ এ-ব্যাপারটি পরিষ্কার করতে সাহায্য করবে।

অপেক্ষাকৃত সহনশীল ও মধ্যবামপন্থী দল হওয়ার কারণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ধারাবাহিক ভাবে জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের ভোট পেয়ে এসেছে। অনায়াসে পেয়ে যাওয়ায় এই ভোট কখনই যথাযথ মূল্য পায়নি, ভোটারদের প্রয়োজনগুলো দল বা সরকারের কাছে প্রাধান্য পায়নি। এই নিষ্ঠার জন্য ধর্মীয় ও জাতিগত ভাবে সংখ্যালঘুদের প্রতি মনোযোগী না হয়ে বরং তাদের ভুলে গেছে। অল্প কিছু উগ্র ধর্মান্ধ ও জাতীয়তাবাদীর ভোটের লোভে তাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরে আসতে পেরেছে অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে সরব ও অনড় অবস্থান থেকে।

সাম্প্রতিক সময়ে ডেমোক্রেটিক দলের ব্যাপারে বাঙালিদের কিঞ্চিৎ আশাভঙ্গের কারণটিও অনুরূপ। রিপাবলিকান দলের নিরন্তর আক্রমণের মুখে ডেমোক্রেটিক দল নিজেদের শক্তিশালী ও দৃঢ় হিসেবে জাহির করবার প্রয়োজনে তাদের অনেক মৌলিক নীতির সাথে আপোষ করেছে। সেপ্টেম্বর ১১-র সন্ত্রাসী আক্রমণের পর এটি কিছুটা রাজনৈতিক প্রয়োজন থেকে করা, কিছুটা নেতৃত্বের ব্যর্থতা। তালেবান সরকারের পতন ঘটাতে আফগানিস্তান আক্রমণ বিশ্বের অনেকেই সমর্থন করলেও ইরাক যুদ্ধের পেছনে তেমন কোন কারণই ছিল না। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ একক ভাবে বিশ্বের চোখে খলনায়ক হলেও বাস্তব এটাই যে ডেমোক্রেটিক দলও সেই আক্রমণের সমর্থনে সিনেট ও কংগ্রেসে ভোট দিয়েছে। বাংলাদেশের খেলাফত মজলিশের মত আমেরিকার‌ কট্টর ডানপন্থী ইভ্যাঞ্জেলিক্যালদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেছে ডেমোক্রেটিক দল। এর সাথে আছে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির প্রশ্নে ইসরায়েলের পক্ষে নিঃশর্ত সমর্থন, ইত্যাদি। নির্বাচন জয়ের জন্য অল্প কিছু ভোটের সন্ধানে ডেমোক্রেটিক দল এভাবেই পেছনে ফেলে গেছে তার অনেক পুরনো সমর্থকদের।

৩. ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমর্থন – বিল ও হিলারি ক্লিনটন
ইংরেজ ধাঁচের গণতন্ত্রগুলোর সাথে আমেরিকার সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে। আভিজাত্যের প্রভাব আমেরিকায় নেই বললেই চলে। এদেশে উদয়াস্ত পরিশ্রম করলে যে-কেউ একটি সচ্ছল জীবন যাপন করতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও ভাষার মানুষের মিশেল হওয়ায় এখানে সামাজিক সহনশীলতা ব্যাপক। আমেরিকার রাজনৈতিক কাঠামোর ব্যাপারেও কথাগুলো সত্য। এখানে ইংরেজ ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোর মত বহু বছর ধরে দলের হয়ে কাজ করে একটু একটু করে উঠে আসতে হয় না। মানুষকে আকর্ষণ ও আস্বস্ত করবার মত গুণাবলি থাকলে যে-কেউ দলের নেতৃস্থানীয় অবস্থানে উঠে আসতে পারেন খুব সহজেই। নির্বাচিত হওয়ার বছর খানেক আগেও তেমন কেউ জিমি কার্টার নামে জর্জিয়ার অঙ্গরাজ্যের গভর্নরের নাম জানতেন না। তাঁকে হারিয়ে দুই দফার জন্য রাষ্ট্রপতি হওয়া রনাল্ড রেগান ছিলেন হলিউডের ডাকসাইটে নায়ক।

দ্রুত জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতা অর্জনের পথটির কারণে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি পদে অধীষ্ঠিতরা তাই প্রায়ই চুম্বক ব্যক্তিত্বের অধিকারী হন। তাঁরা নির্বাচিত হবার পর নিজের নীতি ও বিশ্বাস প্রচার করে একটি সুনাম রেখে যাওয়ার চেষ্টা করেন। নীতির বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দলের সমর্থন ও প্রতিনিধি পরিষদের দলীয় সাংসদদের ভূমিকা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই মূল কৃতিত্বের ভাগিদার হন শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতি। একই বাস্তবতা অজনপ্রিয় কাজের বেলায়ও প্রযোজ্য। সাম্প্রতিকতম দুই রাষ্ট্রপতির দিকে তাকালেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হবের ইরাক যুদ্ধ, দুর্বল অর্থনীতি, কট্টর ডানপন্থা, ইত্যাদির দায় মাথায় নিয়ে জর্জ বুশ পৃথিবীময় ঘৃণিত। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য শান্তিচুক্তি, আফ্রিকায় ত্রাণ সহায়তা, ও বর্ধনশীল অর্থনীতির কারণে বিল ক্লিনটন সবচেয়ে আদৃত নামগুলোর একটি।

এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালিরা মূলত বিল ও হিলারি ক্লিনটনের একান্ত অনুসারী। বয়োজ্যেষ্ঠ বাঙালিরা, যাঁরা বছর দশেকের বেশি সময় ধরে আমেরিকায় আছেন, তাঁরা অর্থনৈতিক স্বর্ণযুগের কারণে বিল ক্লিনটনকে স্মরণ করেন প্রতিদিন। বিল ক্লিনটনের প্রথম শাসনামলে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করার জন্য হিলারি ক্লিনটনের প্রয়াসের কথাও তাঁরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। সেই সাথে হিলারি ক্লিনটন বাঙালিদের মুখ্য বসত নিউ ইয়র্কের সিনেটর, এক কালে বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন, ডঃ ইউনুস সহ অনেক বাঙালির পরিচিত, বাংলাদেশের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে সরব হয়েছেন, বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষায় সহায়তা করেছেন। সব মিলিয়ে আমেরিকার রাজনীতিতে বাঙালিদের পছন্দের শীর্ষে আছেন বিল ও হিলারি ক্লিনটন।

ডেমোক্রেটিক দলের প্রাইমারি নির্বাচনের সময় বারাক ওবামা ও হিলারি ক্লিনটনের মধ্যে হাড্ডা-হাড্ডি লড়াই হয়। বিভিন্ন সময়ে তিক্ততার জন্ম দেওয়া সেই লড়াইয়ের পর আমেরিকা জুড়ে অনেক হিলারি-সমর্থকই বারাক ওবামাকে সমর্থন করা থেকে বিরত আছেন। কেউ কেউ রিপাবলিকান প্রার্থী জন ম্যাকেইনের পক্ষে ভোট দেওয়ার কথাও বলছেন প্রকাশ্যে। বাঙালিদের মধ্যে তেমন প্রবণতা না থাকলেও প্রৌঢ়দের মধ্যে এক ধরণের নির্লিপ্ততা চোখে পড়বার মত। এঁদের অনেকেই প্রথম বারের মত ভোটার হয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার আশায়। বারাক ওবামার পক্ষে হয়তো তাঁরা তবু ভোট দেবেন, তবে দল বেঁধে বা উচ্ছ্বাসের সাথে নয়। তাঁরা ওবামার চৌকষ উপস্থাপনা ও স্থিতধী চিন্তায় মুগ্ধ হলেও মন থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না হিলারির বিপরীতে প্রাক-নির্বাচনী লড়াইয়ের সময়ের তিক্ততা।

৪. বাঙালির চোখে ব্যক্তি বারাক ওবামা
এব্রাহাম লিংকনের অঙ্গরাজ্য ইলিনয় থেকে নির্বাচিত সিনেটর বারাক ওবামা পুরো আমেরিকার কাছেই এক নতুন ব্যক্তিত্ব। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে অন্যতম কনিষ্ঠ প্রার্থী, মাত্র দু’বছর আগে সিনেটে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। এর আগে তিনি বছর সাতেক ইলিনয়ের স্টেট সিনেটে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বারাক ওবামার জাতিগত পরিচয় এখন অনেকেই জানেন। ওবামার বাবা ছিলেন কেনিয়া থেকে আগত, তাঁর মা শ্বেতাঙ্গ, তাঁর জন্ম হাওয়াই অঙ্গরাজ্যে, তিনি শৈশবে কিছু বছর ইন্দোনেশিয়ায় কাটিয়েছেন। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রার্থী হিসেবে তিনি মূলধারার আমেরিকানদের কাছে সংশয়ের, আর বাঙালিদের কাছে ভয়ের। অনেক বাঙালিই ভয় পান ওবামা আসলেই নির্বাচিত হতে পারবেন কিনা, নির্বাচনে ভোট পেলেও কারচুপিতে হেরে যাবেন কিনা, ভোটে জিতলেও তাঁকে বেঁচে থাকতে দেওয়া হবে কিনা, ইত্যাদি ভয়ের কথা শোনা যায় বাঙালি আলোচনাগুলোয় কান পাতলে।

ওবামার ব্যাপারে প্রৌঢ় বাঙালিদের এই সংকোচের মধ্যে একটি প্রজন্মগত বৈশিষ্ট্যও লক্ষ করা যায়। হিলারি ক্লিনটন ও বারাক ওবামার প্রাইমারি নির্বাচনের সময় উভয়েই ১৮ মিলিয়নের কিছু বেশি ভোট পেয়েছিলেন। উল্লেখযোগ্য দিক হল, হিলারি পুরনো ডেমোক্রেট ও বয়োজ্যেষ্ঠদের ভোট পেয়েছিলেন। এই ভোটে বখরা বসানোর চেষ্টা না করে ওবামা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জড়িত করেছেন নতুন ভোটারদের। সদ্য ইউনিভার্সিটিতে প্রবেশ করা ছেলেমেয়েরা তাঁর হয়ে প্রাণান্ত খাটুনি করেছে। দেশ নিয়ে ভেবেছে, রাজনীতিতে জড়িত হয়েছে। এই ‘আর্মি অফ নিউ ভোটারস’ দিয়েই ওবামা হারিয়েছেন হিলারিকে। প্রৌঢ় বাঙালিদের হিলারির প্রতি সমর্থনের কারণ ও ধরণ মূলধারার আমেরিকান ভোটারদের সাথে মিলে যায় এক্ষেত্রে। দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালি কিংবা অপেক্ষাকৃত কম বয়সী ভোটারদের মাঝে ওবামার ব্যাপারে আমেরিকান তরুণ-তরুণীদের অনুরূপ উচ্ছ্বাস ও উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। এই দিক থেকে প্রজন্মগত পছন্দের বিভেদ অনেক প্রকট।

সবশেষে আছে ধর্মের প্রসঙ্গ। হাজার উদারতা সত্ত্বেও আমেরিকায় ধর্মীয় অনুভূতি অন্য যেকোন পশ্চিমা দেশের চেয়ে গভীর। দুই প্রান্তের দুই মহাসমুদ্রের তীরের অভিবাসী-অধ্যুষিত অংশগুলো বাদ দিলে এদেশ অত্যন্ত ধর্মভীরু ও কট্টর। দুঃখজনক বাস্তবতা এটাই যে এদেশে খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বি নন, এমন কারও জন্য রাষ্ট্রপতি পদের মত ক্ষমতাধর কোন অবস্থানে আরোহন দুষ্কর। বারাক ওবামার পুরো নাম বারাক হুসেইন ওবামা। ধর্মবিশ্বাস মতে খ্রীষ্টান হওয়া সত্ত্বেও পিতৃদত্ত এই মুসলিম নামটি তাঁকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। রিপাবলিকান দল ভোটারদের ভীত করার জন্য বারাক ওবামাকে মুসলিম বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে আসছে বহুদিন ধরে। এই মিথ্যা আক্রমণের বিপরীতে এক পর্যায়ে বারাক ওবামা সাংবাদিক সম্মেলনে নিজের ধর্মের কথা খোলামেলা ভাবে বলেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি অনেক কালের মধ্যে প্রথম ডেমোক্রেটিক প্রার্থী যিনি গীর্জায় গিয়ে ইভ্যাঞ্জেলিকালদের সাথে দেখা করেছেন, মৌলিক বিভেদগুলো মেনে নিয়ে দেশের কারণে এক হতে বলেছেন। যেকোন ডেমোক্রেটিক প্রার্থীর চেয়ে তিনি তাঁর ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারে সরব। ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মকর্ম নিয়ে কোন মাথা-ব্যাথা না থাকলেও গুজব প্রতিহত করতে গিয়ে ওবামার বলা কিছু কথা বাঙালি ও মুসলিম ভোটারেরা কিছুটা মনক্ষুন্ন। তাঁরা আশা করেছিলেন বারাক ওবামা সরাসরি প্রশ্ন করবেন তিনি মুসলিম হলেও কেন তা তাঁকে অযোগ্য করবে। ওবামা তেমনটা না করা রাজনৈতিক ভাবে সমীচিন হলেও এটি অনেকের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে।

৫. বাঙালির চোখে ব্যক্তি জন ম্যাকেইন
বারাক ওবামার প্রতিদ্বন্দ্বী জন ম্যাকেইন দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে অ্যারিজোনা থেকে নির্বাচিত সিনেটর। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় তাঁর যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হলে তিনি আরও অনেকের সাথে যুদ্ধবন্দী হন। জন ম্যাকেইনের পিতা সে-সময় নেভির অ্যাডমিরাল ছিলেন। বাবার ক্ষমতার সূত্রে তাঁর মুক্তির বন্দোবস্ত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সহযোদ্ধাদের ফেলে একা যাবেন না বলে তিনি দীর্ঘ চার বছর থেকে গিয়েছিলেন যুদ্ধবন্দীদের ক্যাম্পে। সে-সময় ‘সলিটারি কনফাইনমেন্ট’ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম শাস্তি পেতে হয়েছিল তাঁকে। যুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি যোগ দেন রাজনীতিতে।

নীতির প্রশ্নে আপোষহীন থাকার একটি সুনাম জন ম্যাকেইনের অনেক দিনের। রিপাবলিকান দলের সমর্থক নন, এমন সবার মাঝেও তাঁর ভাবমূর্তি একজন নিপাট ভদ্রলোকের। আমেরিকার শাসনব্যবস্থায় নিম্নকক্ষ বা কংগ্রেসের হাতে যাবতীয় ব্যয়ভারের দায়িত্ব অর্পণ করা আছে। বাজেট থেকে শুরু করে ছোট ছোট ‘স্পেন্ডিং বিল’ গুলোও কংগ্রেসের হাত ঘুরে আসতে হয়। জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের এলাকার উন্নয়নের জন্য এসব বিলের মধ্যে অনেক রকম প্রকল্প ঢুকিয়ে দেন। রাজনীতির পরিভাষায় এগুলোকে ‘ইয়ারমার্ক’ বলা হয়, আর অপচয়ের কারণে কথ্য ভাষায় বলা হয় ‘পর্ক-ব্যারেল’ (শূকরের মাংস আর মদের ব্যারেল নিয়ে উৎসবে মেতে ওঠার জন্য বাড়তি টাকা বোঝাতে)। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে জন ম্যাকেইন এ-ধরণের অপচয়ের বিরুদ্ধে অনেক শক্ত অবস্থান নেওয়ার কারণে বিখ্যাত।

রিপাবলিকান দলের নেতা হলেও জন ম্যাকেইন মূলত অর্থনৈতিকভাবে রক্ষণশীল। গর্ভপাত বা সমকামিতার ব্যাপারে সামাজিক ভাবে রক্ষণশীল হলেও তিনি জর্জ বুশ বা মিট রমনি বা মাইক হাকাবি-র মত কট্টর নন। অ্যারিজোনা অন্যতম ‘বর্ডার স্টেট’ হওয়ায় তিনি অবৈধ অভিবাসন নিয়েও কাজ করেছেন। অত্যধিক ব্যয়, অভিবাসন নীতি, ইত্যাদি বিষয়ে নিজের দলের বিপক্ষে তিনি অপ্রিয় অবস্থান নিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। এতে করে বহু বছর ধরে জন ম্যাকেইন একজন প্রথাবিরোধী বা ম্যাভরিক হিসেবে নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন।

বর্ণিল ক্যারিয়ার ও চারিত্রিক গুণাবলির কারণে জন ম্যাকেইন বাঙালিদের চোখেও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। ২০০০ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী অ্যাল গোর তাঁর ‘রানিং মেট’ হিসেবে বাছাই করেছিলেন জো লিবারম্যানকে। ইসরায়েল ও ইহুদি অধিকার প্রসঙ্গে আমেরিকার অন্যতম কট্টর এই ব্যক্তিকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ায় বাঙালি সহ অনেক মুসলমানের ভোটই হারিয়েছিলেন অ্যাল গোর। সেই বছরও রিপাবলিকান দলের মনোনয়নের জন্য প্রতিযোগিতা করেছিলেন জন ম্যাকেইন। প্রথম দিকের কিছু নির্বাচনে তিনিই জিতেছিলেন, জর্জ বুশ নন। দক্ষিণা অঙ্গরাজ্য সাউথ ক্যারোলিনার প্রাইমারি নির্বাচনের আগে গুজব রটানো হয়েছিল যে জন ম্যাকেইনের একটি জারজ সন্তান আছে। বাস্তবে সেই কন্যা সন্তানটি বাংলাদেশ থেকে দত্তক নেওয়া ব্রিজিট ম্যাকেইন। জর্জ বুশ ও কার্ল রোভের নোংরা কৌশল ও চরিত্রহননের হাতে ধরাশায়ী হলেন জন ম্যাকেইন।

রাজনীতির প্রয়োজনে জন ম্যাকেইন এরপর দিনে দিনে আরো বেশি ডানপন্থী হতে থাকেন। বিভিন্ন রকম ইস্যুতে তিনি নিরলস সমর্থন দিয়ে গেছেন রিপাবলিকান প্রশাসনকে। বাঙালি ও অন্যান্য অভিবাসীদের মধ্যে জন ম্যাকেইনের যেই শক্ত অবস্থান ছিল, তা সেই সময়টা থেকেই লোপ থেকে থাকে। ইরাক যুদ্ধের পক্ষে থাকা, দলত্যাগী জো লিবারম্যানকে সাথে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা করা, প্রচারনার কাজে জর্জ বুশের আমলের ব্যক্তি ও কৌশল নিয়োগ, আপোষহীনতার নীতি থেকে সরে আসা, এবং মোটা দাগে একজন রিপাবলিকান হওয়ার কারণে জন ম্যাকেইন শুধু বাঙালি নয়, সবার কাছেই কম-বেশি অসমর্থনের পাত্র।

৬. কেমন যাচ্ছে নির্বাচনী প্রচারণা
বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এই মুহূর্তে বারাক ওবামা জনপ্রিয়তায় বেশ খানিকটাই এগিয়ে। আমেরিকার ভোটাররা সাধারণত জাতীয় নিরাপত্তার চিন্তা করলে রিপাবলিকানদের ভোট দেন, আর অর্থনীতির চিন্তা করলে ডেমোক্রেটদের। সেই সাথে যোগ হয়েছে গত আট বছরের দুঃশাসনের ফলে রিপাবলিকানদের প্রতি জমে ওঠা বিদ্বেষ। সব রকম নির্দেশক ডেমোক্রেটদের পক্ষে হওয়া সত্ত্বেও ওবামা বনাম ম্যাকেইন প্রতিযোগিতা বেশ কাছাকাছি ছিল কিছুদিন আগ পর্যন্ত। ওবামা কৃষ্ণাঙ্গ, তরুণ, ও স্বল্পপরিচিত হবার ফলে এরকমটা হয়েছে বলে অধিকাংশ বিশ্লেষক মত ব্যক্ত করতেন।

আমেরিকার নির্বাচন পদ্ধতিতে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের কিছু ‘ইলেক্টোরাল ভোট’ থাকে তার জনসংখ্যা অনুযায়ী। সে-কারণেই আকারে অনেক বড় হওয়া সত্ত্বেও মন্টানার ভোট সংখ্যা ৩ এবং নিউ জার্সির ভোট সংখ্যা ১৫। ৫০টি অঙ্গরাজ্য মিলিয়ে ইলেক্টোরাল ভোট ৫৩৮টি। ২০০৪ সালের নির্বাচনে জর্জ বুশ জিতেছিলেন ২৮৬-২৫১ ব্যবধানে। ভোর পর্যন্ত সিদ্ধান্ত ঝুলে ছিল ওহায়োর ২০টি ইলেক্টোরাল ভোটের উপর। ঠিক যেমন ২০০০ সালে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ফ্লোরিডার ২৭টি ভোটে।

এবছর এখনও পর্যন্ত বারাক ওবামা ডেমোক্রেটিক দলের ঘাঁটিগুলো ধরে রেখেছেন। স্পষ্ট ব্যবধানে যেসব অঙ্গরাজ্যে এগিয়ে আছেন, তাতে তাঁর পক্ষে ২৬৪ ভোট মোটামুটি নিশ্চিত। বিজয়ের জন্য দরকার আর ৬ টি ভোট, জিততে হবে ৭টি অঙ্গরাজ্যের যেকোন একটি। এগুলোর সবই ২০০৪ সালে জর্জ বুশের পক্ষে গিয়েছিল। একমাত্র ইন্ডিয়ানা বাদে বাকি ৬টিতেই (ফ্লোরিডা, ওহায়ো, কলোরাডো, নেভাডা, ভার্জিনিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা) ওবামা এগিয়ে আছেন। শেষ তিন সপ্তাহ এই অগ্রগতি ধরে রাখতে পারলে তিনি স্মরণকালের ব্যাপকতম ব্যবধানে জিততে পারেন। তবে এক্ষেত্রে গলার কাঁটা হয়ে আছে ‘ব্র্যাডলি এফেক্ট’ বলে একটি ঘটনা।

১৯৮২ সালে টম ব্র্যাডলি নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ নেতা ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনের আগে সব জরিপে তিনি বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন, অথচ নির্বাচনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরাজিত হন। পরবর্তীতে দেখা যায়, প্রাক-নির্বাচন জরিপের সময় ব্র্যাডলিকে ভোট দেবার কথা বললেও কৃষ্ণাঙ্গ বলে অনেকেই তাঁকে ভোট দেননি। এই ঘটনা এবারেও ঘটতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। শেষ মুহূর্তে ভোটিং বুথে ঢুকে অনেকে হয়তো বারাক ওবামাকে তাঁর বর্ণের কারণে ভোট না দিতে পারেন। অন্যদিকে অনেকে ‘রিভার্স-ব্র্যাডলি এফেক্ট’ এর কথাও বলছেন, আশাবাদ ব্যক্ত করছেন যে অনেকে হয়তো ভোটিং বুথে গিয়ে ওবামাকেই ভোট দেবেন, শুধু মুখে বলছেন না আগে থেকেই। এছাড়া আছে সময়ের আগেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যাবার ভয়। বারাক ওবামার সামনের পথটুকু কেমন, তা সময়ই বলে দেবে। তবে আপাতত তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিজের হাতেই।

‘কী ব্যাপার ইশতি, আমার খবর নাও না যে?’

গিয়েছিলাম কামলা খাটতে। ফেরার পথে বাসের ভেতর জালাল ভাইয়ের ফোনের আওয়াজ টের পাইনি। নেমেই দেখি ভয়েসমেইল। ভাঙা ভাঙা সিগনালে শুধু “জুবায়ের ভাই” আর “সাতটা বিশ” শুনতে পেলাম। নানান কারণে ব্লগে অনিয়মিত হলেও জুবায়ের ভাইয়ের খবরটা দেখে যেতাম প্রতি রাতে। কাল রাতে আপডেটগুলোয় চোখ বুলাতে গিয়ে মনে কেমন যেন কু-ডাক দিচ্ছিল একটা। ভয়েসমেইল শুনে ছ্যাৎ করে উঠলো তাই। জালাল ভাইকে ফোন করলাম, বাসায় এসে সচলায়তনে দেখলাম জুবায়ের ভাইয়ের সেই ছবিটা।

নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কাঁদবো না। প্রথম ফোঁটা দুটো এইতো সবে গড়াচ্ছে। অনেক বেশি অপরাধবোধ কাজ করছে মনের মধ্যে। কানে বাজছে ফোন করেই জুবায়ের ভাইয়ের অনুযোগ, “কী ব্যাপার ইশতি, আমার খবর নাও না যে?”

সচলায়তনে প্রথম দিকে নিজের মত এক কোণে থাকতাম। বড় লেখা দেখলে পড়তাম না, মন্তব্য করলেও ভয়ে ভয়ে করতাম। তখন ‘চুপকথা’ প্রকাশিত হচ্ছে কিস্তিতে। ধারাবাহিক উপন্যাস বলেই দূর দিয়ে যেতাম। একদিন কোন কুক্ষণে ভুল করে ঢুকে পড়েছিলাম একটি পর্বে। সেই থেকেই জুবায়ের ভাইয়ের লেখার সাথে পরিচয়। জুবায়ের ভাই কিছু লিখলেই প্রথমে মনে মনে কিছুক্ষণ বকে নিতাম তাঁকে। জুবায়ের ভাইয়ের লেখাগুলো যত বড়ই হোক, পড়তেই হত। না পড়লে ঘুম আসতো না, কেমন যেন একটা অস্বস্তি লাগতো। সপ্তাহের শুরুতে ফোনে বলতাম আমার লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে হলেও ছোট ছোট লেখা দিতে, আবার সপ্তাহের শেষে এই আমিই বলতাম লেখা দিচ্ছেন না কেন।

ব্লগের বাইরে জুবায়ের ভাইয়ের সাথে কথাবার্তার শুরু জানুয়ারির মাঝামাঝি। সচলায়তনেই ব্যাক্তিগত মেসেজ পাঠিয়ে জুবায়ের ভাই ধন্যবাদ দিয়েছিলেন ‘অবিনাশী গান’ এর সাথে তাঁকে একটা পোস্ট কার্ড দেবার জন্য। সামর্থ্যের অভাবে আট আনার পোস্টকার্ড, আর লজ্জার আধিক্যে শুধু ‘প্রিয় লেখককে শুভেচ্ছা’। সন্ধ্যা থেকে চেয়ে আছি সেই সামান্য অভিনন্দনটুকুর জবাবে জুবায়ের ভাইয়ের দেওয়া আন্তরিক মেসেজটার দিকে। একটা জায়গায় লিখেছিলেন, “লেখক হওয়ার বাসনা সত্যিই ছিলো, হলো না এ জীবনে, তবু প্রিয় লেখক হলাম কী করে? তারপরও মনে হয়, এইসব ছোটো ছোটো ভালো লাগা আছে বলে জীবন এতো সুন্দর।” হায় সে বিনয়, হায় সে জুবায়ের ভাই।

তার ক’দিন পরেই আবার মেসেজ দিয়েছিলেন। ফোন নম্বর নিশ্চিত করে বললেন সপ্তাহান্তে চমকে দেবেন। সেই শনিবারেই ছিল জুবায়ের ভাইয়ের সাথে প্রথম কথা। “ইশতি, আমি বর্গীয়-জ জুবায়ের!”। ঘুম জড়ানো চোখে সালাম-পর্ব সেরে আলাপচারিতায় যেতেই বললেন, “আপনাকে চমকে দেবো বলেছিলাম না? এখানে আরও একজন জুবায়ের আছেন। অন্তস্থ-য যুবায়ের।” বলেই ফোন দিয়েছিলেন সুবিনয় মুস্তফীকে। যুবায়ের ভাইয়ে অনেক বেশি হিংসা হচ্ছে আজকে, জুবায়ের ভাইয়ের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন তাই।

সেই থেকে প্রায়ই ফোন করতেন। অনেক আপত্তির পরও আপনি করে বলতেন। বলতেন, অহেতুক কাউকে কষ্ট দিতে চান না, সবাইকে সম্মান দেখাতে চান। আপনি করে ডাকলে আর কথা না বলার হুমকির পর অবশেষে তুমিতে নেমেছিলেন। আমার দ্বিগুণেরও বেশি বয়সী হয়েও আশ্চর্য রকম উদার ভাবে কথা বলতেন, আমার মত জানতে চাইতেন। প্রবাসজীবন নিয়ে কথা হত, লুইজিয়ানার গরম নিয়ে কথা হত, মা-ভাই কেমন আছে তা নিয়ে কথা হত, আর অনেক বেশি কথা হত বাংলাদেশ নিয়ে।

আমি লেখক নই, ইতিহাসবেত্তা নই, সমাজবিজ্ঞানী নই। আমি স্রেফ হাতুড়ে প্রকৌশলী। রাজনীতি, দর্শন, সমাজ, বা ইতিহাস নিয়ে লিখতে তাই আমার হাত কাঁপতো অনেক। জুবায়ের ভাই একদিকে ধাঁরালো সমালোচনা করতেন, আরেক দিকে সাহস দিতেন। আমি বলতাম যে তাঁর মাপের একজন মানুষের সাথে কথা বলতেই বুক দুরুদুরু করে আমার। তিনি জবাবে বলতেন, বিশ্বাস অটল থাকলে তো এটা হবার কথা নয়।

জুবায়ের ভাইকে আমি ‘সচলায়তনের হেডমাস্টার’ ডাকতাম। একমাত্র তিনিই সরাসরি ভুল ধরিয়ে দিতেন। শুনেছি কটূ কোন ভুল ধরা পড়লে ব্যাক্তিগত মেসেজ পাঠিয়ে সেটা জানান দিতেন। আমার সময় রাত ১১ টার দিকে জুবায়ের ভাই সাধারণত সচলায়তনে আসতেন। আমার লেখাগুলোয় প্রথম দিকের মন্তব্যকারী হতেন সব সময়। অল্পবিস্তরে অনেক গভীর সমালোচনা রেখে যেতেন। মনটা কোন রাতে জুবায়ের ভাইয়ের মন্তব্যের অপেক্ষা করতো, কোন রাতে লেখার। কিছুদিন আগে জুবায়ের ভাই খেলাপীর খাতায় আমার নাম তুলে দিয়ে গিয়েছেন। ‘হারিকেন, ফুটবল, ও কিছু মানুষের কথা’ নিয়ে বলেছিলাম, লেখায় ছেদ পড়ে গেছে দেখে আর দেইনি। সেই ছিল জুবায়ের ভাইয়ের কাছে প্রথম ধমক খাওয়া। তুমি থেকে আবার আপনিতে উঠে গিয়েছিলেন। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম শেষ করবো। জুবায়ের ভাই শেষ হয়ে গেলেন, আমি শেষ করতে পারলাম না। নিজেকে বলছিলাম শক্ত থাকবো। লেখাটা আজই সেরে পোস্ট করে দেবো। পারলাম না। মন মানলেও চোখ আর মানলো না।

দেশ আর রাজনীতি নিয়ে অনেক গল্প হত। জুবায়ের ভাইয়েরই গুঁতাগুঁতিতে ‘নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্র’ লেখা শুরু করেছিলাম। তাঁরই ধমকে সেটা শেষ হয়েছে। অখণ্ড পিডিএফ কপি ডাউনলোড করে জুবায়ের ভাই কথা দিয়েছিলেন, পুরোটা আবার পড়ে জানাবেন তাঁর মত। পারলেন না। আমি বারাক ওবামার ভক্ত, তাই আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন ওবামার মধ্যপন্থা সম্পর্কে আমার মতামত। ফোনে বলার পরে বলেছিলেন, “এবার এগুলো লিখে ফেল দেখি।” হল না।

সেলিম আল দীনের মৃত্যুর পর জুবায়ের ভাই হাত দিয়েছিলেন ‘আমাদের বাতিঘরগুলো ও আসন্ন দিন’ সিরিজে। দুরন্ত সেই সিরিজে লিখে চলছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের কথা। ষষ্ঠ পর্বের পর আটকে যায় সিরিজটি। জুবায়ের ভাই একদিন ফোন করে বললেন, “আমি তো ফেঁসে গেছি, ইশতি! এত বড় কাজে যে হাত দিয়েছি সেটা তো আগে বুঝিনি।” সে-দফা ভূমিকা বদলে গিয়েছিল। সবিস্তারে আলোচনা হচ্ছিল ইতিহাস নিয়ে, সিরিজ এরপর কোনদিকে যেতে পারে তা নিয়ে। জুবায়ের ভাইকে বলেছিলাম, আপনার লেখা এই সিরিজের লিংক আমি এ-প্রজন্মের অনেকের কাছে বিলিয়েছি, তাদের জন্য হলেও আপনাকে শেষ করতে হবে। জবাবে বলছিলেন বিভিন্ন জায়গায় গল্প-উপন্যাস লেখার কথা। ঠান্ডা গলায় বলেছিলাম, এমন কোন গল্প আপনি লিখবেন না যেটা আর কেউ বছর দশেক পর লিখতে পারবে না, তবে আমাদের ইতিহাস নিয়ে আপনার বিশ্লেষণের দায়িত্বটুকু আর কেউ পালন করতে পারবে না। জুবায়ের ভাই কথা দিয়েছলেন শেষ করবেন। বিনিময়ে আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন, সিরিজশেষে ফোনে প্রকাশ করা মতটুকু আমি পোস্ট আকারে দেবো।

একবার বায়না করার মত করেই জুবায়ের ভাই বলেছিলেন গল্প লেখার কথা। গল্পে গল্পে বললে বোধগুলো অনেক তরল অবস্থায় মানুষের মনের মাঝে ঢুকে যায়। বিশ্লেষণী প্রবন্ধ এই দিকে অনেক কাঠখোট্টা। বলেছিলাম যে আমাকে দিয়ে গল্প হয় না। নাম বানাতে পারি না, প্রথম পুরুষ ছাড়া লিখতে পারি না। জুবায়ের ভাই উপদেশ দিয়েছিলেন কিছু। কথা দিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের উপর একটা গল্প লিখবো। জুবায়ের ভাইয়ের সেটা দেখে দেওয়ার কথা ছিল। হল না।

এইতো সেদিন সচলায়তন নিষিদ্ধ হওয়া নিয়ে লেখার পর ফোন করে সাহস জুগিয়েছিলেন। শহীদ জননীকে নিয়ে লেখা পোস্টের আকার আরো বড় হতে পারতো বলেছিলেন। লেখার আকার দেখে পাঠক ভাগার ভয়ের কথা শুনে নিজের মত লিখে যাবার কথা বলেছিলেন। সেদিনই মাত্র তানভীর ভাইয়ের পোস্টে জুবায়ের ভাই আমার কথা বলেছেন জেনে লজ্জা আর আনন্দে ডুবে গেছি। লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ততায় ডুবেছিলাম কিছুদিনের জন্য। ফিরতাম অচিরেই। অথচ আজকে নাকি জুবায়ের ভাই নেই!

আমার কানে সেই সন্ধ্যা থেকে ভেসে আসছে একটাই কথা, “কী ব্যাপার ইশতি, আমার খবর নাও না যে?”

হুদাই...

অলস রবিবার কাটছিল। সপ্তাহের প্রতিটা দিনই অলসতায় কাটে, তবু রবিবার বিকেলটা কেন জানি সবচেয়ে মন খারাপ করা সময়। অন্তর্জালে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে বিডিব্রডকাস্টে এসে হাজির হলাম। উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে গেলাম তিশমার অনুষ্ঠানে ফুয়াদের সাক্ষাৎকার। ইদানিংকার ভাষায় যাকে তাব্দা খাওয়া বলে, সেই হাল হল প্রথমবার শুনে। আবার ছাড়লাম, ভাবলাম এবার গুণে দেখি সাড়ে সাত মিনিটের সাক্ষাৎকারটিতে সাকুল্যে বাংলা শব্দ কয়টি।

আড়াই মিনিট পর্যন্ত পেলাম তিশমার মুখে ৭১টি বাংলা শব্দ, আর ফুয়াদের মুখে ৫০টি। হুম, কি, আচ্ছা, ভাইয়াস-আপুস জাতীয় শব্দগুলো সহ, অবশ্যই।

এই সময়কালে মাত্র ৭টি বাক্য পেলাম যেগুলোয় কোন ইংরেজি শব্দ নেই। এই সাতটির মধ্যে ২টি বাক্য "ভাল।" এবং হ্যাঁ?"।

কারো হাতে যদি আমার চেয়েও বেশি ফালতু সময় থেকে থাকে, তাহলে গুণে দেখতে পারেন পুরোটুকু।

তিশমা ও ফুয়াদের সাক্ষাৎকার

সাক্ষাৎকারে ফুয়াদের মুখে বাণিজ্যিক গান করবার ব্যাপারে ৫ লাখ শ্রোতা থাকার কুযুক্তি শুনে বেকুব বনে গেলাম স্রেফ। বড় অবস্থান ও জনপ্রিয়তা মানুষকে কিছু দায়িত্ব দেয়, যা এ-কালে কেউ স্বীকার করতে চায় না। টাকাই সব, হায়!

ফুয়াদের গান নিয়ে সমালোচনাগুলো নাকি অপপ্রচার। যাঁদের মতামত মান্য, তাঁরা সবাই নাকি তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। অনেক কষ্টেও মনের মধ্যে ফুয়াদের জন্য কোন দিওয়ানা ভাব আনতে না পেরে নতুন দিনের মিছিলে নাম লিখিয়ে তিশমাদর্শনেই নামলাম।

মনের বদ অংশ বলে, মেয়েটার গলার জিনিসটা কি দুষ্টু ছবিতে দেখা কোন কিছুর মত?

আধুনিকতার ভীড়ে পাত্তা না পেয়ে ভেসে যাওয়া আরেকটা অংশ বলে, চোখ-মুখের কালি মুছে চুলটা খোঁপা করে দিলে মেয়েটাকে অন্য রকম লাগতো। সাথে কিছুটা ঢিলেঢালা কাপড় সহ, অবশ্যই!

হুদাই টাইম লস...