Thursday, October 16, 2008

‘কী ব্যাপার ইশতি, আমার খবর নাও না যে?’

গিয়েছিলাম কামলা খাটতে। ফেরার পথে বাসের ভেতর জালাল ভাইয়ের ফোনের আওয়াজ টের পাইনি। নেমেই দেখি ভয়েসমেইল। ভাঙা ভাঙা সিগনালে শুধু “জুবায়ের ভাই” আর “সাতটা বিশ” শুনতে পেলাম। নানান কারণে ব্লগে অনিয়মিত হলেও জুবায়ের ভাইয়ের খবরটা দেখে যেতাম প্রতি রাতে। কাল রাতে আপডেটগুলোয় চোখ বুলাতে গিয়ে মনে কেমন যেন কু-ডাক দিচ্ছিল একটা। ভয়েসমেইল শুনে ছ্যাৎ করে উঠলো তাই। জালাল ভাইকে ফোন করলাম, বাসায় এসে সচলায়তনে দেখলাম জুবায়ের ভাইয়ের সেই ছবিটা।

নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কাঁদবো না। প্রথম ফোঁটা দুটো এইতো সবে গড়াচ্ছে। অনেক বেশি অপরাধবোধ কাজ করছে মনের মধ্যে। কানে বাজছে ফোন করেই জুবায়ের ভাইয়ের অনুযোগ, “কী ব্যাপার ইশতি, আমার খবর নাও না যে?”

সচলায়তনে প্রথম দিকে নিজের মত এক কোণে থাকতাম। বড় লেখা দেখলে পড়তাম না, মন্তব্য করলেও ভয়ে ভয়ে করতাম। তখন ‘চুপকথা’ প্রকাশিত হচ্ছে কিস্তিতে। ধারাবাহিক উপন্যাস বলেই দূর দিয়ে যেতাম। একদিন কোন কুক্ষণে ভুল করে ঢুকে পড়েছিলাম একটি পর্বে। সেই থেকেই জুবায়ের ভাইয়ের লেখার সাথে পরিচয়। জুবায়ের ভাই কিছু লিখলেই প্রথমে মনে মনে কিছুক্ষণ বকে নিতাম তাঁকে। জুবায়ের ভাইয়ের লেখাগুলো যত বড়ই হোক, পড়তেই হত। না পড়লে ঘুম আসতো না, কেমন যেন একটা অস্বস্তি লাগতো। সপ্তাহের শুরুতে ফোনে বলতাম আমার লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে হলেও ছোট ছোট লেখা দিতে, আবার সপ্তাহের শেষে এই আমিই বলতাম লেখা দিচ্ছেন না কেন।

ব্লগের বাইরে জুবায়ের ভাইয়ের সাথে কথাবার্তার শুরু জানুয়ারির মাঝামাঝি। সচলায়তনেই ব্যাক্তিগত মেসেজ পাঠিয়ে জুবায়ের ভাই ধন্যবাদ দিয়েছিলেন ‘অবিনাশী গান’ এর সাথে তাঁকে একটা পোস্ট কার্ড দেবার জন্য। সামর্থ্যের অভাবে আট আনার পোস্টকার্ড, আর লজ্জার আধিক্যে শুধু ‘প্রিয় লেখককে শুভেচ্ছা’। সন্ধ্যা থেকে চেয়ে আছি সেই সামান্য অভিনন্দনটুকুর জবাবে জুবায়ের ভাইয়ের দেওয়া আন্তরিক মেসেজটার দিকে। একটা জায়গায় লিখেছিলেন, “লেখক হওয়ার বাসনা সত্যিই ছিলো, হলো না এ জীবনে, তবু প্রিয় লেখক হলাম কী করে? তারপরও মনে হয়, এইসব ছোটো ছোটো ভালো লাগা আছে বলে জীবন এতো সুন্দর।” হায় সে বিনয়, হায় সে জুবায়ের ভাই।

তার ক’দিন পরেই আবার মেসেজ দিয়েছিলেন। ফোন নম্বর নিশ্চিত করে বললেন সপ্তাহান্তে চমকে দেবেন। সেই শনিবারেই ছিল জুবায়ের ভাইয়ের সাথে প্রথম কথা। “ইশতি, আমি বর্গীয়-জ জুবায়ের!”। ঘুম জড়ানো চোখে সালাম-পর্ব সেরে আলাপচারিতায় যেতেই বললেন, “আপনাকে চমকে দেবো বলেছিলাম না? এখানে আরও একজন জুবায়ের আছেন। অন্তস্থ-য যুবায়ের।” বলেই ফোন দিয়েছিলেন সুবিনয় মুস্তফীকে। যুবায়ের ভাইয়ে অনেক বেশি হিংসা হচ্ছে আজকে, জুবায়ের ভাইয়ের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন তাই।

সেই থেকে প্রায়ই ফোন করতেন। অনেক আপত্তির পরও আপনি করে বলতেন। বলতেন, অহেতুক কাউকে কষ্ট দিতে চান না, সবাইকে সম্মান দেখাতে চান। আপনি করে ডাকলে আর কথা না বলার হুমকির পর অবশেষে তুমিতে নেমেছিলেন। আমার দ্বিগুণেরও বেশি বয়সী হয়েও আশ্চর্য রকম উদার ভাবে কথা বলতেন, আমার মত জানতে চাইতেন। প্রবাসজীবন নিয়ে কথা হত, লুইজিয়ানার গরম নিয়ে কথা হত, মা-ভাই কেমন আছে তা নিয়ে কথা হত, আর অনেক বেশি কথা হত বাংলাদেশ নিয়ে।

আমি লেখক নই, ইতিহাসবেত্তা নই, সমাজবিজ্ঞানী নই। আমি স্রেফ হাতুড়ে প্রকৌশলী। রাজনীতি, দর্শন, সমাজ, বা ইতিহাস নিয়ে লিখতে তাই আমার হাত কাঁপতো অনেক। জুবায়ের ভাই একদিকে ধাঁরালো সমালোচনা করতেন, আরেক দিকে সাহস দিতেন। আমি বলতাম যে তাঁর মাপের একজন মানুষের সাথে কথা বলতেই বুক দুরুদুরু করে আমার। তিনি জবাবে বলতেন, বিশ্বাস অটল থাকলে তো এটা হবার কথা নয়।

জুবায়ের ভাইকে আমি ‘সচলায়তনের হেডমাস্টার’ ডাকতাম। একমাত্র তিনিই সরাসরি ভুল ধরিয়ে দিতেন। শুনেছি কটূ কোন ভুল ধরা পড়লে ব্যাক্তিগত মেসেজ পাঠিয়ে সেটা জানান দিতেন। আমার সময় রাত ১১ টার দিকে জুবায়ের ভাই সাধারণত সচলায়তনে আসতেন। আমার লেখাগুলোয় প্রথম দিকের মন্তব্যকারী হতেন সব সময়। অল্পবিস্তরে অনেক গভীর সমালোচনা রেখে যেতেন। মনটা কোন রাতে জুবায়ের ভাইয়ের মন্তব্যের অপেক্ষা করতো, কোন রাতে লেখার। কিছুদিন আগে জুবায়ের ভাই খেলাপীর খাতায় আমার নাম তুলে দিয়ে গিয়েছেন। ‘হারিকেন, ফুটবল, ও কিছু মানুষের কথা’ নিয়ে বলেছিলাম, লেখায় ছেদ পড়ে গেছে দেখে আর দেইনি। সেই ছিল জুবায়ের ভাইয়ের কাছে প্রথম ধমক খাওয়া। তুমি থেকে আবার আপনিতে উঠে গিয়েছিলেন। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম শেষ করবো। জুবায়ের ভাই শেষ হয়ে গেলেন, আমি শেষ করতে পারলাম না। নিজেকে বলছিলাম শক্ত থাকবো। লেখাটা আজই সেরে পোস্ট করে দেবো। পারলাম না। মন মানলেও চোখ আর মানলো না।

দেশ আর রাজনীতি নিয়ে অনেক গল্প হত। জুবায়ের ভাইয়েরই গুঁতাগুঁতিতে ‘নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্র’ লেখা শুরু করেছিলাম। তাঁরই ধমকে সেটা শেষ হয়েছে। অখণ্ড পিডিএফ কপি ডাউনলোড করে জুবায়ের ভাই কথা দিয়েছিলেন, পুরোটা আবার পড়ে জানাবেন তাঁর মত। পারলেন না। আমি বারাক ওবামার ভক্ত, তাই আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন ওবামার মধ্যপন্থা সম্পর্কে আমার মতামত। ফোনে বলার পরে বলেছিলেন, “এবার এগুলো লিখে ফেল দেখি।” হল না।

সেলিম আল দীনের মৃত্যুর পর জুবায়ের ভাই হাত দিয়েছিলেন ‘আমাদের বাতিঘরগুলো ও আসন্ন দিন’ সিরিজে। দুরন্ত সেই সিরিজে লিখে চলছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের কথা। ষষ্ঠ পর্বের পর আটকে যায় সিরিজটি। জুবায়ের ভাই একদিন ফোন করে বললেন, “আমি তো ফেঁসে গেছি, ইশতি! এত বড় কাজে যে হাত দিয়েছি সেটা তো আগে বুঝিনি।” সে-দফা ভূমিকা বদলে গিয়েছিল। সবিস্তারে আলোচনা হচ্ছিল ইতিহাস নিয়ে, সিরিজ এরপর কোনদিকে যেতে পারে তা নিয়ে। জুবায়ের ভাইকে বলেছিলাম, আপনার লেখা এই সিরিজের লিংক আমি এ-প্রজন্মের অনেকের কাছে বিলিয়েছি, তাদের জন্য হলেও আপনাকে শেষ করতে হবে। জবাবে বলছিলেন বিভিন্ন জায়গায় গল্প-উপন্যাস লেখার কথা। ঠান্ডা গলায় বলেছিলাম, এমন কোন গল্প আপনি লিখবেন না যেটা আর কেউ বছর দশেক পর লিখতে পারবে না, তবে আমাদের ইতিহাস নিয়ে আপনার বিশ্লেষণের দায়িত্বটুকু আর কেউ পালন করতে পারবে না। জুবায়ের ভাই কথা দিয়েছলেন শেষ করবেন। বিনিময়ে আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন, সিরিজশেষে ফোনে প্রকাশ করা মতটুকু আমি পোস্ট আকারে দেবো।

একবার বায়না করার মত করেই জুবায়ের ভাই বলেছিলেন গল্প লেখার কথা। গল্পে গল্পে বললে বোধগুলো অনেক তরল অবস্থায় মানুষের মনের মাঝে ঢুকে যায়। বিশ্লেষণী প্রবন্ধ এই দিকে অনেক কাঠখোট্টা। বলেছিলাম যে আমাকে দিয়ে গল্প হয় না। নাম বানাতে পারি না, প্রথম পুরুষ ছাড়া লিখতে পারি না। জুবায়ের ভাই উপদেশ দিয়েছিলেন কিছু। কথা দিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের উপর একটা গল্প লিখবো। জুবায়ের ভাইয়ের সেটা দেখে দেওয়ার কথা ছিল। হল না।

এইতো সেদিন সচলায়তন নিষিদ্ধ হওয়া নিয়ে লেখার পর ফোন করে সাহস জুগিয়েছিলেন। শহীদ জননীকে নিয়ে লেখা পোস্টের আকার আরো বড় হতে পারতো বলেছিলেন। লেখার আকার দেখে পাঠক ভাগার ভয়ের কথা শুনে নিজের মত লিখে যাবার কথা বলেছিলেন। সেদিনই মাত্র তানভীর ভাইয়ের পোস্টে জুবায়ের ভাই আমার কথা বলেছেন জেনে লজ্জা আর আনন্দে ডুবে গেছি। লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ততায় ডুবেছিলাম কিছুদিনের জন্য। ফিরতাম অচিরেই। অথচ আজকে নাকি জুবায়ের ভাই নেই!

আমার কানে সেই সন্ধ্যা থেকে ভেসে আসছে একটাই কথা, “কী ব্যাপার ইশতি, আমার খবর নাও না যে?”

No comments: