Friday, February 20, 2009

গল্পঃ ৭৫ নম্বর বাড়ি

এক
“এবার থামবি, না কষে দু’ঘা লাগাবো?”

হুমকিতেও নিলয়ের হাসি থামে না। রাগ হয়ে অর্ণব হাঁটা দেয়। নিলয় তাতে কোন বিকার দেখায় না। রাস্তার ধারেই পেট চেপে বসে হাসতে থাকে। খুব ভাল মতই জানে, তাকে ফেলে রেখে বন্ধুটি যাবে না। হলও তাই।

“খবরদার এই বিটকেল হাসি দিবি না। ওঠ এবার। জায়গাটা ভাল না, নয়তো ঠিকই রেখে চলে যেতাম। শালা বদমায়েশ একটা।”

“আমার বোনকে বিয়ে করবি তুই? পুরুত ডাকবো? তুই করলে আমি দুই বালতি গহনা যৌতুক দেবো।” বলেই আবার দমকা হাসিতে লুটিয়ে পড়ে নিলয়।

“ওঠ না রে বাপ। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। জায়গাটা ভাল না। কোন মানুষ থাকে না এখানে।” রাগ, লজ্জা, আর অদ্ভুত এক অস্বস্তি ঘিরে ধরছিল যেন অর্ণবকে।

সুযোগ মত পালটা খোঁচা দিতে ছাড়লো না নিলয়। “আমি তো আসার আগেই বলেছিলাম। তখন তো খুব বাজনা বাজাচ্ছিলি।”

অর্ণব বন্ধুর পাশে বসে পড়ে এবার। প্রাইমারি পেরিয়ে সেকেন্ডারিতে উঠেই নিলয়ের সাথে পরিচয়। সেই থেকে এক সাথে থাকা, খাওয়া, খেলা, ঝগড়া। রাতটা শুধু যে যার বাসায় ঘুমাতো। দু’জনেরই একটা করে বোন আছে। ভাই বলতে সাথের এই বন্ধুটি। এতগুলো বছরে মারামারি বাদে এই প্রথম বন্ধুর কাঁছে হাত রাখলো অর্ণব।

“মাফ করে দে রে। সবাই তো এক রকম না। তবু আমরা এত নির্জীব বলেই হয়তো ওরা এত দুঃসাহসী।”

চিরকালের নির্বিকার, নিশ্চিন্ত নিলয় চেনা সুরে ফোড়ন কেটে বললো, “চল সুন্দরী, তোমার মেকআপ তুলতে হবে।”

আজ আর পালটা জবাব না দিয়ে সাথে সাথে হাঁটা দিল অর্ণব। মাথায় ঘুরছিল রমিজের চায়ের দোকানের ঘটনাটা।

দুই
দুই বন্ধু আড্ডা দিতে বসেছিল এখানে।রাস্তার ধারের ছোট্ট দোকানটায় চায়ের কাপ মাত্র দু’টো। ওদের আড্ডার মাঝেই প্রৌঢ় এক ভদ্রলোক এলেন। আচারে নম্র, ব্যবহারে ভদ্র। ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জেনে খুশি হয়ে দু’চার কথা চলছিল।

ভদ্রলোক চা খাবেন শুনে অর্ণব তার কাপটি দ্রুত শেষ করে এগিয়ে দেয়। কথা-প্রসঙ্গে ওর নাম শুনেই যেন ঘোর কাটলো তাঁর। দোকানদার রমিজ আলিকে বললেন চায়ের বদলে কলা দিতে, এ-বেলা নাকি চায়ের তিয়াশ কম।

কিছুক্ষণ পর নিলয়ের কাপটি খালি হতেই ভদ্রলোক চা নিলেন। অর্ণবের রক্তচক্ষু দেখে সেই যে নিলয়ের হাসি শুরু হল, তা এখনও পর্যন্ত চলছে। পাশাপাশি চলছে অর্ণবের গজরানো, “আনকালচারড যত্তসব। এখনও সতের শ সালে পড়ে আছে। থাবড়া মেরে সোজা করে দেওয়া উচিত এদের।”

এবার নিলয় গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করে, “তাতে লাভ?”

অর্ণব ক্ষিপ্ত স্বরে বলে, “লাভ-ক্ষতি বুঝি না, এদের লাঠি-পেটা করা উচিত।”

“দেহটাকে নাহয় শাস্তি দিলি, কিন্তু তাতে করে কি মনের বিষ আরও ঘন হবে না? দু’ঘা জুতার বাড়ি খেয়ে কি ও হিন্দুর মুখের পানি খেত? এই ক্রোধ কি কোন মুসলমানকে হিন্দু বাড়ির মিষ্টি খাওয়াতে পারবে? আমি আজ এক হাটে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করলেও কি কেউ আমি স্রেফ হিন্দু বলে আমাকে কঞ্জুস ডাকা বন্ধ করবে?”

রাগে ছটফট করতে লাগলো তবু অর্ণব। মনের একটা অংশ বাবা-মায়ের উপর রাগ হচ্ছিল, হিন্দুয়ানি নাম রাখার জন্য। যেন নামটা অর্ণব না হয়ে আব্দুল করিম সওদাগর হলেই এভাবে অপদস্থ হতে হত না। বাস্তবতা থেকে আরও কিছুটা সময় আড়ালে থাকা যেত।

মনের অন্য অংশ সাথে সাথেই শুধরে দিল। পলায়নপর এই মানসিকতাই তো সমস্যা। মনে পড়ে, স্কুলে থাকতে পাঠ্যে পড়েছিল, বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বি। অর্ণব তো চেনে শুধু এক নিলয়কেই। ওর চেনা প্রতি ১০০ জনে বাকি ১৪ জন কোথায়? তারা নেই, নাকি অর্ণবের মত অবস্থানে কেউ নেই? নাকি দু’টাই?

তিন
“চলে যা রে,” ঠান্ডা গলায় বলে অর্ণব, “এখানে থাকার কোন অর্থ নেই।”

মৃদু হেসে নিলয় বলে, “তুইও বললি?”

এবার অর্ণবের অবাক হওয়ার পালা। ফিরতি পথের নীরবতাটা খুব বেশি অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল। এ-অবস্থায় বলবার মত কোন কথা নেই, এটুকু জেনেও সজ্ঞানে মুখ খুলেছিল। হয়তো অপরাধবোধ থেকে। যেন নিলয় চলে গেলে সেই বিচ্ছেদই হবে অর্ণবের প্রাপ্য শাস্তি।

নিলয় বলতে শুরু করে নন্দিনীদি’র গল্প। “সেই ঈদের কথা মনে পড়ে? যেবার একটা ছাত্র কোরবানি দিলাম?”

“ফাজলামো করতে হয় কেন সব কিছুতেই? ছাত্র কোরবানি দেব কেন? কোরবানির টাকা জমা করে একজন ছাত্রের পড়ার খরচ যোগানো একটা ভাল কাজ। কত মানুষ এল, কত প্রশংসা করলো সবাই। মনে থাকবে না কেন সেই ঈদের কথা? নন্দিনীদি আর অপর্ণা যেবার সাথে গেল। স্কুলের বার্ষিকীতে অপর্ণা একটা লেখা দিয়েছিল এ-নিয়ে। পরে সেটা পত্রিকায়ও ছাপা হল। ঐ ঈদ ভুলবো কীভাবে?”

“দিদি কাজে ফেরার পর প্রথম প্রশ্ন – ইন্ডিয়া কেমন ঘুরলেন?”

“স্রেফ ঠাট্টা এসব। এগুলো গায়ে মাখলে চলে? কেউ না কেউ তো বলবেই এগুলো।”

“গায়ে না মাখলেও মনে লেগে থাকে কথাগুলো। বারবার বললে কার না খারাপ লাগে? দিদি যখন সেই ঈদের কথা বললো, তখন জবাব এল – জানি, জানি। যান ঠিকই, বলবে না আর কি। সব টাকা-পয়সা তো ঐ পাড়েই পাঠান। ক’বছর পর দেখবো সব বিক্রি করে ওখানেই চলে গেছেন।”

দায়িত্ববোধ খুব বিলম্বিত অনুভূতি। কিছু না হারালে কিংবা কোন ভয় মনে না ঠুকলে দায়িত্বের পরিচয় দেওয়া খুব দুষ্কর। অর্ণবের মনে যেন সেই বন্ধ দরজাই খুলে গেল অবশেষে। পরিপার্শ্ব বিচারে অনেক দিন আগেই করা উচিত ছিল, এমন একটি প্রশ্ন অবশেষে বেরিয়ে এল। “আর কী কী বলিস নি তুই আমাকে?”

বন্ধুর এই অনভ্যস্ততা টের পেতে নিলয়ের সময় লাগলো না। বিব্রত বন্ধুকে স্বাভাবিক করার জন্য কথা ঘোরানোর চেষ্টা করলো, কাজ হল না।

“গেল বছর বাসায় একটা নতুন সেলাই মেশিন এসেছে, দেখেছিস?”

“হ্যাঁ, কাকীমা যেটা দিয়ে আমার জন্য জামা বানিয়ে দিলেন একটা।”

“ওটা ঋণের টাকায় কেনা ছিল। সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প থেকে দেওয়া ঋণ। প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল ওরা একটা। দ্রুততম সময়ে শ্রেষ্ঠ সদ্ব্যাবহারের জন্য পুরস্কার দেওয়ার কথা ছিল।”

“কথা ছিল মানে?”

“মা টাকা ফেরত দিয়েছিল সবার আগে। লাভও হয়েছিল বেশ ভালই। প্রথম পুরস্কার জিতেছিল। পুরস্কার ঘোষনার ক’দিন আগে জানলাম যে অনুষ্ঠানে আমাদের যেতে হবে না।”

“এটা কেমন কথা? যাবি না কেন? পুরস্কার কে নেবে তাহলে?”

“পুরস্কারের খাতা থেকে মা’র নাম কেটে দেওয়া হয়েছিল, তাই।”

“নাম কাটলো কেন? এমপি’র কোন আত্মীয়কে দেওয়ার জন্য?”

“হিন্দু, তাই। জিজ্ঞেস করেছিলাম। বললো এত বড় আয়োজনের প্রথম পুরস্কারে একটা হিন্দু নাম কেমন দেখায়, তাই বাদ। আগামী বার কষ্ট করে আবেদনপত্র জমা দিতেও মানা করলো।”

“অভিযোগ করিস নি কেন?”

বাঁকা হাসি হেসে নিলয় পালটা প্রশ্ন করলো, “যে-অন্যায় চোখের সামনে ঘটবার সময় কেউ থামায় না, সে-অন্যায়ের প্রকাশ্য প্রতিবাদ করে সেই কষ্ট দ্বিতীয়বার অনুভব করার অর্থ কী? মুখের পানি খেলে ধর্ম যায়, কিন্তু ইলেকশনের পর ঠাপানোর সময় ধর্ম যায় না।”

আবারও অস্বস্তিকর সেই নীরবতা নেমে এল দুই বন্ধুর মাঝে। এবার আর অর্ণব জোর করে কোন কথোপকথন শুরুর চেষ্টা করলো না।

চার
দুই বন্ধু বাসার মোড়ে আসতেই দেখলো নন্দিনী দি রিক্সা থেকে নামছে। বন্ধুর বড় বোন হলেও দিদি অর্ণব-অপর্ণার কাছে সহোদরের চেয়েও আপন। অর্ণবের মা স্কুলের পর দেরি করে বাড়ি ফেরা পছন্দ করতেন না। কোন খেলা বা অনুষ্ঠান থাকলে দিদি সাথে করে বাসায় দিয়ে আসতো, যাতে অর্ণবকে বকা খেতে না হয়। দিদি না থাকলে অপর্ণার স্কুল থেকে বনভোজনে যাওয়া হত না কোনদিন। সংকোচের বয়সে কথা বলার জন্য দিদি না থাকলে জীবনের নোংরা নতুনত্বের ধাক্কাটা হয়তো অনেক জোরে লাগতো ওদের দু’ভাইবোনের গায়ে।

যে-মানুষটার গন্ধ দু’মাইল দূর থেকেও চিনতে পারতো, আজ সেই মানুষটাকেই যেন অনেক অচেনা লাগছিল। হয়তো সে-কুণ্ঠা অজান্তেই অভিব্যক্তি পেয়ে গিয়েছিল। দুই ভাইকে দু’হাতে কাছে টেনে নন্দিনী প্রশ্ন করলো, “কী রে, আজ এত গোমরা কেন? আবার ঝগড়া করেছিস?”

“নাহ, ঝগড়া হয়নি। হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। আজকে ধকলটা একটু বেশি গেছে।”

অর্ণবের মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে নন্দিনী বললো, “ঘরে আয়, সরবত বানিয়ে দেই।”

“আজ থাক, আরেকদিন খাবো। আজ বিকেলটা মাকে সময় দেওয়ার কথা। ঘরের কিছু কাজ আছে।”

অস্বস্তি এড়াতে দিদিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাঁটা শুরু করলো অর্ণব। নেবার ভাগী হওয়ার সময় পুরোটাই নিয়েছে, দেবার বেলায় পারলো না। ঘটনাগুলো আগে জানলে কিছু করতে পারতো কিনা সে-প্রশ্ন অবান্তর। অজ্ঞানতার জন্য আদৌ নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিল না অর্ণব।

দৃশ্যত বিব্রত বন্ধুকে সঙ্গ দিতে নিলয় গেট পর্যন্ত এগিয়ে এল। “এসব মাথায় নিস না। সমাজ কখনও এক ধাক্কায় বদলায় না। সংশয় আর সংকীর্ণতাগুলো রাতারাতি আসেনি, রাতারাতি যাবেও না। নিজের জায়গায় ভাল থাক, সময়েই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“হবে না রে। সময় তো কম গেল না। এতগুলো বছরেও অবিশ্বাসগুলো ঝেড়ে ফেলতে পারিনি আমরা। এটা তো স্পষ্ট যে এই নিষ্ক্রিয়তা কাজে আসছে না। সরব হতে হবে, এদের মুখোমুখি হতে হবে। নইলে…”

মাঝপথে থামিয়ে দিল নিলয়। “কাগুজে বিপ্লব বাদ দিয়ে বাড়ি যা। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এ-নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। আমি যাই দিদির সাথে আড্ডা মারি গিয়ে।”

“তোরা দিদির ব্যাংকের কাছাকাছি কোথাও বাসা ভাড়া নিস না কেন? দিন দু’বার দিদিকে এতটা পথ আসা-যাওয়া দিতে হয় না তাহলে। ওদিকে একটা বাসার কথা বলেছিলাম তোকে। ঐ যে, ৭৫ নম্বর বাড়িটা। যাব-যাচ্ছি আর খোঁজ নিলি না তো তুই আলসেমি করে।”

“খোঁজ অনেক আগেই নিয়েছি। ভাড়া দেবে না।”

“ভাড়া দেবে না কে বললো? আমি তো গতকালও টু-লেট লেখা সাইন ঝুলতে দেখলাম।”

জবাবে নিলয় শুধু মুচকি হাসে।

গানবন্দী জীবনঃ ওবলাডি ওবলাডা

প্রিয় মানুষের প্রতি বিশ্বাস সব সময়ই মাত্রাছাড়া হয়। চিন্তা ও বুদ্ধির স্বাধীনতার শিখরে পৌঁছেও মানুষ প্রিয়ত্বের কাছে ন্যুব্জ হয়ে থাকে আজীবন। মানুষ কীভাবে যেন অন্যের ছায়া হয়ে যায়। অন্য কারও হাসিতে মন খুশি হয়ে ওঠে, অন্য কারও দুঃখে মন খিটখিটে হয়ে ওঠে। অন্যের প্রিয় গান নিজের প্রিয় হয়ে ওঠে।

বড় হওয়ার সুবাদে প্রায় সব নিকটাত্মীয়ের কাছেই এই যত্নটুকু পেয়েছি। আমার ভাল লাগে, তাই আমার ছোট মামা মুহম্মদ জাফর ইকবালের সব বই পড়ে শেষ করে ফেলেছিল। চলন্ত গাড়ির পাশে পাশে কাউকে দৌঁড়াতে দেখলে আমি খুশি হতাম, তাই আমার মামা ট্রেনের পাশে পাশে ছুটতো। সেই সময়গুলোর কথা।

আমার নানার ছিল এলপি’র এক বিশাল সংগ্রহ। রেকর্ড প্লেয়ারে সেগুলো চলতো খুব। পুরনো দিনের গান কিংবা পল্লীগীতি সেই বয়সে পোষাতো না তেমন একটা। সৌভাগ্যক্রমে, বিটলসের গান ছিল নানার খুব প্রিয়। পুরনো আমলের সেই গানগুলোর অর্থ না বুঝলেও তালে তাল মেলাতাম খুব। হয়তো তালের জন্যই ‘ওবলাডি ওবলাডা’ ছিল খুব প্রিয় গান। আমার পছন্দ, তাই নানা বারবার বাজাতো এই গান। গানের কথা কিছুই বুঝতাম না সেই বয়সে, শুধু ‘ও জ্যেডি, ও জ্যাডা’ বলে লাফালাফি করতাম। আর ছিল এলপি উলটে দেওয়া কিংবা পিন নাড়াচাড়ার আনন্দ। অগণিত এলপি আর পিন ভাঙলেও কোন শাসন পোহাতে হয়নি।

সে-সময় নানারা থাকতো সেন্ট্রাল রোডের এক বাসার নিচতলায়। সেখানেই আমার বড় হয়ে ওঠা। সকাল হলে দুই খালা তারস্বরে রেওয়াজ করতো, দুপুর হলে ছোট মামা চোখে গেঞ্জি পেঁচানো অবস্থায়ই কাছে ডেকে ‘অভি রে, অর্ণব রে’ করতো, বিকেল হলে বড় মামা বারান্দায় খেলতো। সেই সাথে ছিল গ্যারেজের সামনের জায়গাটুকুতে ক্রিকেট খেলা। নিঃসন্তান বাড়িওয়ালা শত রাগী হলেও আমার বেলায় প্রশ্রয়ী ছিল অনেক। টুকিটাকি দুষ্টামির কথা তো বাদই দিলাম।

একবার ‘কারেন্ট কী জিনিস’ জানবার ভূত ঢুকলো মাথায়। টেবিল ঠেলে বারান্দার এক সকেটের পাশে নিলাম। সেই টেবিলে উঠে একটি তারের দুই মাথা সকেটে ঢুকিয়ে দিলাম সুইচ টিপে। বিদ্যুতের ধাক্কায় টেবিল থেকে ছিটকে পড়লাম। সারা বাড়ির ফিউজ জ্বলে গেল। আরেকবার দাওয়াতে যাওয়ার তাড়ায় বারান্দার ‘আড়াল’ কাজে লাগিয়ে কাপড় বদলাচ্ছিলাম। যেই না প্যান্ট খুললাম, অমনি কাছের এক উঁচু দালান থেকে অট্টহাসি। সেই বেইজ্জতি ভুলতে পারিনি এখনও।

দিনের বেলা নানা-নানির আদরে সময় কাটতো। নানা বালিশে হেলান দিয়ে তাস খেলতো, আর নানি পাশের মোড়ায় বসে পান-সুপারি বানাতো। খেলতে খেলতে নানা আমাদের উপর পা তুলে দিত। ছোট ভাই তখন নানির কাছে অনুযোগ করে বলতো, নানি দেতো নানা তী তলে, নানা পা দেয়, নানার পা তা তেতে দাও তো!

সেই বাসাতেই ১৯৯১-এর নির্বাচন দেখেছিলাম। রাত জেগে বিটিভির বোর্ডে ফলাফল দেখানো হচ্ছে, মাঝে চলছে আনন্দমেলা, চলচ্চিত্র, গানের অনুষ্ঠান। একটু পর পর খাওয়া-দাওয়া, রাতভর আড্ডা আর গালগপ্পো। শবে-বরাত এলে ছাদে উঠে লুকিয়ে আতশবাজি পোড়াতাম। রাস্তার ঠিক উলটো দিকেই ছিল মানিক মামার মুদির দোকান। আমাকে আসতে দেখলেই এক বোতল কোক খুলে রাখতো। প্রতিদিন নানি কোক খাওয়াতো, নানা ঢাকা ক্লাব থেকে খাবার এনে খাওয়াতো।

নানাদের সেই ভাড়া বাসাতেই প্রথম দেওয়াল টপকানো শিখেছিলাম। একেক দিনে একেক রকম বোলিং অ্যাকশন নকল করে বোলিং শিখেছিলাম। ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে এনে ইন্ডিয়ানা জোনস, কিং সলোমন্স মাইন, স্টার ওয়ারস, সব দেখেছিলাম সেই বাসায়।

চুরির উৎপাতের কারণে প্রতি রাতে দরজা-জানালায় খিল দিয়ে শুতে হত। বড়দের মত এই কাজটা করায় আমার ছিল ব্যাপক উৎসাহ। যেমন ইচ্ছা, তেমন কাজ। এক রাতে আমি ভুলে গেলাম বাথরুম আর বেডরুমের মাঝের ড্রেসিং রুমের দরজায় খিল দিতে। সকালে উঠে দেখি ঘর ফাঁকা।

আমার নানা স্মিত হেসে বলেছিল, ব্যাপার না।

ওবলাডি ওবলাডা, লাইফ গোজ অন।

গানবন্দী জীবনঃ মিস লংকা

দুই ছেলেকে নিয়ে আমাদের মায়ের পরিকল্পণাগুলো অনেক দূরপ্রসারী ছিল। ছোট ভাইটি আমার চেয়ে প্রায় সাড়ে চার বছরের ছোট। তখনও তার কেঁদে-কেটে স্কুলে যাওয়ার বয়স। আমি পড়ি চতুর্থ কি পঞ্চম শ্রেণিতে। ভাইকে নিয়ে তখনও তেমন নির্দিষ্ট পরিকল্পণা না থাকলেও আমার বেলায় ছিল। মায়ের ইচ্ছা ছিল আমাকে নানা-দাদার মত ডাক্তার বানাবে। শুধু ভাবলেই হল না। ডাক্তারি শেখা অনেক কঠিন ব্যাপার। আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।

যেমন চিন্তা, তেমন কাজ। ব্যাঙ-কেঁচো-তেলাপোকার ছবি আঁকার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে আমাদের দুই ভাইকে ভর্তি করা হল ছবি আঁকার স্কুলে। বড় বোর্ড, হরেক রকম পেনসিল, আর গোল করে পাকানো আর্ট পেপার নিয়ে আমরা দুই ভাই প্রতি সপ্তাহে আর্ট স্কুলে যেতাম। গান বা ছবির প্রতি অনুরাগ নয়, বরং বিকেলে ঘর থেকে বের হতে পারাই ছিল মূল আকর্ষণ।

কাঁচা বয়সে কারও উপর কিছু চাপিয়ে দিতে নেই। বিশেষ করে নান্দনিক ব্যাপারে। আমাদের শিক্ষক এ-ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। তিনি প্রথম দিন ক্লাসে এসেই বললেন “ফ্রি হ্যান্ড ড্রয়িং” করতে। লোকজনের দেখাদেখি নৌকা আঁকলাম, নদীর পাড়ের কুড়েঘর আঁকলাম, বাড়ির পেছনে কলা গাছের পাতা আঁকলাম, আর আঁকলাম মেঘ এবং পাখি। এই একই ছবি এঁকে চললাম প্রায় দু’তিন মাস। শিক্ষক মহাশয়ও “ফ্রি হ্যান্ড ড্রয়িং”এর বাইরে কিছু করান না, আমিও নতুন কিছু আঁকতে পারি না।

ছবি আঁকা এবং গান গাওয়া, এই দু’টি গুণ একেবারেই নেই দেখে এই দিকের শিল্পীদের অনেক শ্রদ্ধার চোখে দেখি আমি। হাজারো ফাঁকিবাজি সত্বেও সেই শিক্ষক তাই আমার পরম আরাধ্য ছিলেন। এমনিতেও গল্প বেশি, পড়া কম ধরণের শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের প্রিয় হন। ভূতের গলি মসজিদের সামনের ময়লার ডিপো কিংবা ঝড়-বাদলায় ড্রয়িং বোর্ডকে ছাতা হিসেবে ব্যবহার করতে হওয়া তাই গায়ে মাখতাম না। কিছু না পড়ালেও অভিভাবকদের তুষ্ট রাখতে আমাদের ঠিক দেড় ঘন্টা আটকে রাখা হত সেই স্কুলে। দেড় ঘন্টার আড্ডা আর ঘর-বাড়ি আঁকা মন্দ লাগতো না।

এক বিকেলে গিয়ে দেখি ক্লাস ফাঁকা। স্যারের মুখেও কেমন যেন অন্য রকম রোশনাই। আয়োজন করে বসতে না বসতেই বললেন, আজ ছুটি। ছাত্র-অভিভাবক নির্বিশেষে সবাই আনন্দে বাড়ি ফিরে যাওয়া শুরু করলো। বুঝে গেলাম, সবাই এমন কিছু জানে যা আমার অজানা। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম ছুটির কারণ। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে স্যার বললেন, আজকে মিস লংকা!

ঘরে ফেরার পথে খেয়াল করলাম, পথ-ঘাটে মানুষ অস্বাভাবিক রকম কম। বাসায় এসে দেখি সবাই টিভির সামনে বসে আছে অসীম আগ্রহে। সেখানেই মিস লংকার সাথে পরিচয় আমার। ‘এসব মানুষে দেখে?’ জাতীয় একটা মুখ করে ঠিকই সোফার এক কোণে বসে পড়লাম। বাকিটা ইতিহাস। চা-বাগানে ববিতা দৌঁড়াচ্ছে, পেছন পেছন ছুটছে নায়ক। মূক-বধির নায়িকাকে ফুসলাতে গাইছে – চুরি করেছ আমার মনটা, হায়রে হায় মিস লংকা! নায়িকার অসম্মতি ও আনুষাঙ্গিক নানাবিধ নাটকীয় বালা-মুসিবত অতিক্রম করে নায়ক বাধ্য হয়েই পিতার পছন্দে বিয়ে করলো। দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে বাসর ঘরে ঢুকতেই কোমর দুলিয়ে কিন্নরকণ্ঠী লাল-টুকটুক বৌ গেয়ে উঠলো সেই গান। মনের খবর হায় ছিল না জানা, তোমার বাড়িটাই ছিল না চেনা, লগ্ন এলো এত দিন পরে, হাসি মেলে চেয়ে দেখো না! অন্তরে আজ বাজে ডংকা, হায় রে হায় মিস লংকা। আহা, শেষে এসে মনে কী শান্তি!

ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া এই গানটি পথ-ঘাটে শুনলেই সেই দিনটায় ফিরে যায় মন। ডাস্টবিনের গন্ধ, পঁচা-গলা পানি, আর ঝিরঝির বৃষ্টি উপেক্ষা করে মিস লংকার কাছে যাওয়ার তাড়না। স্থির হয়ে বসে থেকেও মনে মনে নেচে ওঠা। সেই সময়গুলোয়, যখন অধমের চিত্রাঙ্কনের গুণেই কিনা জানি না, দুই দুইটি আর্ট স্কুল ব্যবসা গুটিয়েছিল ভূতের গলি এলাকায়।