প্রিয় মানুষের প্রতি বিশ্বাস সব সময়ই মাত্রাছাড়া হয়। চিন্তা ও বুদ্ধির স্বাধীনতার শিখরে পৌঁছেও মানুষ প্রিয়ত্বের কাছে ন্যুব্জ হয়ে থাকে আজীবন। মানুষ কীভাবে যেন অন্যের ছায়া হয়ে যায়। অন্য কারও হাসিতে মন খুশি হয়ে ওঠে, অন্য কারও দুঃখে মন খিটখিটে হয়ে ওঠে। অন্যের প্রিয় গান নিজের প্রিয় হয়ে ওঠে।
বড় হওয়ার সুবাদে প্রায় সব নিকটাত্মীয়ের কাছেই এই যত্নটুকু পেয়েছি। আমার ভাল লাগে, তাই আমার ছোট মামা মুহম্মদ জাফর ইকবালের সব বই পড়ে শেষ করে ফেলেছিল। চলন্ত গাড়ির পাশে পাশে কাউকে দৌঁড়াতে দেখলে আমি খুশি হতাম, তাই আমার মামা ট্রেনের পাশে পাশে ছুটতো। সেই সময়গুলোর কথা।
আমার নানার ছিল এলপি’র এক বিশাল সংগ্রহ। রেকর্ড প্লেয়ারে সেগুলো চলতো খুব। পুরনো দিনের গান কিংবা পল্লীগীতি সেই বয়সে পোষাতো না তেমন একটা। সৌভাগ্যক্রমে, বিটলসের গান ছিল নানার খুব প্রিয়। পুরনো আমলের সেই গানগুলোর অর্থ না বুঝলেও তালে তাল মেলাতাম খুব। হয়তো তালের জন্যই ‘ওবলাডি ওবলাডা’ ছিল খুব প্রিয় গান। আমার পছন্দ, তাই নানা বারবার বাজাতো এই গান। গানের কথা কিছুই বুঝতাম না সেই বয়সে, শুধু ‘ও জ্যেডি, ও জ্যাডা’ বলে লাফালাফি করতাম। আর ছিল এলপি উলটে দেওয়া কিংবা পিন নাড়াচাড়ার আনন্দ। অগণিত এলপি আর পিন ভাঙলেও কোন শাসন পোহাতে হয়নি।
সে-সময় নানারা থাকতো সেন্ট্রাল রোডের এক বাসার নিচতলায়। সেখানেই আমার বড় হয়ে ওঠা। সকাল হলে দুই খালা তারস্বরে রেওয়াজ করতো, দুপুর হলে ছোট মামা চোখে গেঞ্জি পেঁচানো অবস্থায়ই কাছে ডেকে ‘অভি রে, অর্ণব রে’ করতো, বিকেল হলে বড় মামা বারান্দায় খেলতো। সেই সাথে ছিল গ্যারেজের সামনের জায়গাটুকুতে ক্রিকেট খেলা। নিঃসন্তান বাড়িওয়ালা শত রাগী হলেও আমার বেলায় প্রশ্রয়ী ছিল অনেক। টুকিটাকি দুষ্টামির কথা তো বাদই দিলাম।
একবার ‘কারেন্ট কী জিনিস’ জানবার ভূত ঢুকলো মাথায়। টেবিল ঠেলে বারান্দার এক সকেটের পাশে নিলাম। সেই টেবিলে উঠে একটি তারের দুই মাথা সকেটে ঢুকিয়ে দিলাম সুইচ টিপে। বিদ্যুতের ধাক্কায় টেবিল থেকে ছিটকে পড়লাম। সারা বাড়ির ফিউজ জ্বলে গেল। আরেকবার দাওয়াতে যাওয়ার তাড়ায় বারান্দার ‘আড়াল’ কাজে লাগিয়ে কাপড় বদলাচ্ছিলাম। যেই না প্যান্ট খুললাম, অমনি কাছের এক উঁচু দালান থেকে অট্টহাসি। সেই বেইজ্জতি ভুলতে পারিনি এখনও।
দিনের বেলা নানা-নানির আদরে সময় কাটতো। নানা বালিশে হেলান দিয়ে তাস খেলতো, আর নানি পাশের মোড়ায় বসে পান-সুপারি বানাতো। খেলতে খেলতে নানা আমাদের উপর পা তুলে দিত। ছোট ভাই তখন নানির কাছে অনুযোগ করে বলতো, নানি দেতো নানা তী তলে, নানা পা দেয়, নানার পা তা তেতে দাও তো!
সেই বাসাতেই ১৯৯১-এর নির্বাচন দেখেছিলাম। রাত জেগে বিটিভির বোর্ডে ফলাফল দেখানো হচ্ছে, মাঝে চলছে আনন্দমেলা, চলচ্চিত্র, গানের অনুষ্ঠান। একটু পর পর খাওয়া-দাওয়া, রাতভর আড্ডা আর গালগপ্পো। শবে-বরাত এলে ছাদে উঠে লুকিয়ে আতশবাজি পোড়াতাম। রাস্তার ঠিক উলটো দিকেই ছিল মানিক মামার মুদির দোকান। আমাকে আসতে দেখলেই এক বোতল কোক খুলে রাখতো। প্রতিদিন নানি কোক খাওয়াতো, নানা ঢাকা ক্লাব থেকে খাবার এনে খাওয়াতো।
নানাদের সেই ভাড়া বাসাতেই প্রথম দেওয়াল টপকানো শিখেছিলাম। একেক দিনে একেক রকম বোলিং অ্যাকশন নকল করে বোলিং শিখেছিলাম। ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে এনে ইন্ডিয়ানা জোনস, কিং সলোমন্স মাইন, স্টার ওয়ারস, সব দেখেছিলাম সেই বাসায়।
চুরির উৎপাতের কারণে প্রতি রাতে দরজা-জানালায় খিল দিয়ে শুতে হত। বড়দের মত এই কাজটা করায় আমার ছিল ব্যাপক উৎসাহ। যেমন ইচ্ছা, তেমন কাজ। এক রাতে আমি ভুলে গেলাম বাথরুম আর বেডরুমের মাঝের ড্রেসিং রুমের দরজায় খিল দিতে। সকালে উঠে দেখি ঘর ফাঁকা।
আমার নানা স্মিত হেসে বলেছিল, ব্যাপার না।
ওবলাডি ওবলাডা, লাইফ গোজ অন।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment