Tuesday, August 04, 2009

পোস্টারায়তনঃ ফেসঅফ


আশেপাশের দেশগুলোর তুলনায় আমাদের গণতন্ত্র অনেক বেশি প্রতিনিধিত্বশীল। দেশব্যাপী অরাজক আধুনিকতার প্রতিনিধিস্বরূপ দু'জন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পেয়েছিলাম আমরা।

ইয়ো আর আর-জে সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে একজন বাংরেজিতে বলে গেছেন, "উই আর লুকিং ফর শত্রু।"

আরেকজন কথা নয়, কাজে বিশ্বাসী। তিনি সমাজের সাথে মৌখিক ভাবে তাল না মিলিয়ে সোজা বিদেশ চলে গেছেন আমাদের পলায়নপরতার প্রতিভূ হয়ে।

পোস্টারায়তনে রেখে গেলাম এই যুগোত্তীর্ণ ব্যাক্তিদ্বয়ের 'ফেসঅফ'।

ডিজিটাল বাংলাদেশঃ ২ [জাতীয় পরিচয়পত্র]


জাতীয় পরিচয়পত্র ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট

ভাবতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্য যে ডিজিটাল দেশ গড়ার প্রথম শর্ত হলো প্রতিটি নাগরিককে একটি নম্বরে বন্দী করা। দ্বিতীয় কাজ হলো এই নম্বরটিকে যথাসম্ভব নিরাপদ করা। তৃতীয় কাজ হলো প্রতিটি নম্বরের মালিককে যথাসম্ভব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া। বহু বছরের চেষ্টা শেষে গত নির্বাচনের আগে এই প্রথম ধাপটি অতিক্রম করলো বাংলাদেশ। রাজা থেকে উজির পর্যন্ত প্রত্যেকেরই একটি পরিচয়পত্র আছে। এতে ছবি আছে, আছে শনাক্তকরণের জন্য কিছু তথ্য। এই নম্বর বর্তমানে পাসপোর্ট থেকে নির্বাচন পর্যন্ত সর্বত্র ব্যবহার হচ্ছে।

দুর্বৃত্তের কবল থেকে বর্তমান ধাঁচের পরিচয়পত্র খুব বেশিদিন নিরাপদ রাখা যাবে না। পৃথিবীময় তাই অনেক রকম প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে এই নম্বর বা পরিচয়পত্রগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। দিন দিন যুক্ত হচ্ছে অনেক রকম ইলেকট্রনিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম। যে-দেশে গলাকাটা পাসপোর্টের প্রতুলতাই রোধ করার উপায় নেই, সে-দেশে স্রেফ ছবি দেখে শনাক্তকরণের উপর ভরসা রাখা দুষ্কর।

পরিচয়পত্র নিরীক্ষার বর্তমান পদ্ধতি শুধুমাত্র ছবি মিলিয়ে দেখা। সরকারের কাছে একটি ছবি থাকে, আর ব্যবহারকারীর কাছে থাকে কার্ড। চোখের দেখায় ছবি মিলিয়ে রহিমকে রহিম বলে শনাক্ত করা হয়, করিমকে করিম বলে। এক্ষেত্রে জালিয়াতি প্রধানত দু’রকম হতে পারে।

যেখানে কেন্দ্রীয় ভাবে সংরক্ষিত ছবির সাথে মিলিয়ে দেখা হয় – যেমন নির্বাচন কমিশন – সেখানে রহিমের মূল ছবিটি বদলে করিমের একটি ছবি রেখে দেওয়া দুষ্কর কিছু নয়। এরপর রহিমের অজান্তেই তার পরিচয়ে জীবন চালাতে পারে করিম।

দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হলো নিজের ছবি তুলে একটি পরিচয়পত্র তৈরি করে ফেলা। এটি ব্যবহার হতে পারে এমন স্থানে যেখানে ছবি ব্যবহার হলেও কেন্দ্রীয় ভাবে সংরক্ষিত ছবির সাথে মিলিয়ে দেখা হয় না – যেমন, বাজার-ঘাটে পরিচয় দেওয়া, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সময় পরিচয়পত্র দেখানো, ইত্যাদি।

এই দুর্বলতা নিরসনে ভবিষ্যতে এমন কার্ড দরকার যা তার চুম্বক-স্মৃতিতে কিছু মৌলিক তথ্য সংরক্ষণ করবে। এটি হতে হবে এমন তথ্য যা শুধু সেই পরিচয়পত্রের প্রকৃত মালিক জানবেন। ধরা যাক রহিম ও করিমের একজনের গুপ্ত সংকেত ১২৩, অন্য জনের ৪৫৬। শুধু এটুকু তথ্য থাকলে তা খুব সহজেই জেনে যাওয়া সম্ভব। প্রয়োজন তাই আরেকটু কঠিন কিছু।

একটি পদ্ধতি হলো কেন্দ্রীয় সার্ভারে সংরক্ষিত ছবির সাথে স্বয়ংক্রিয় ভাবে মিলিয়ে নেওয়া। একটি স্ট্যাম্প-সাইজ ছবিতে প্রায় ৮০৪ পিক্সেল পরিমাণ তথ্য থাকে। এই পরিমাণ তথ্য ও আনুষাঙ্গিক প্রক্রিয়াকরণ দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে কেন্দ্রীয় ভাবে যাচাই করার প্রয়াস সুতার উপর ট্রাক চালানোর মতো ব্যাপার। তুলনায় অনেক কার্যকর পদ্ধতি হলো আঙ্গুলের ছাপ মিলিয়ে নেওয়া। এটি বর্তমানে বহুল-ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলোর একটি।

প্রতিটি মানুষের হাতের ছাপ ভিন্ন। এমনকি যমজ ভাই-বোনের হাতের ছাপও ভিন্ন হয়। এটি প্রতিটি মানুষেরই আছে, এবং এটি কোন পাসওয়ার্ডের মতো কষ্ট করে মুখস্তও রাখতে হবে না। কম্পিউটারে এই ভিন্নতাকে ধারণ করা হয় কো-অর্ডিনেট সিস্টেমের মাধ্যমে। পাঠক নিজের ডান হাতের তর্জনীর দিকে তাকালে দেখবেন, কোনো কোনো স্থানে হাতের দাগগুলো ভাগ হয়ে গেছে কাটা চামচের মতো (ফর্ক), কোথাও কোথাও দাগের সমাপ্তি ঘটেছে (টারমিনেশন), আর কোথাও কোথাও তৈরি হয়েছে পাহাড়চূড়া (মিনুশা পয়েন্ট)। মূলত এই তিনটি বিশেষত্বের অবস্থান দিয়েই গঠিত হয় একজন মানুষের ‘পরিচয়’।

এই তথ্য সংরক্ষণের জন্য একটি সাধারণ মেট্রিক্স যথেষ্ট। প্রান্তিক ভাবে বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই পদ্ধতিকে আরও শক্তিশালী করা সম্ভব। কেন্দ্রীয় সার্ভারেও নামের বিপরীতে একটি হাতের ছাপ সংরক্ষণ করা সহজতর। কেন্দ্র ও প্রান্ত উভয় ক্ষেত্রেই উচ্চতর প্রযুক্তি ব্যবহার করে পদ্ধতিটি শক্তিশালী করা সম্ভব। এই সামগ্রিক পরিবর্তন কোন ভাবেই তথ্য আদান-প্রদানের প্রক্রিয়াটি প্রভাবিত করবে না। পক্ষান্তরে, একটি ছবি কেন্দ্রীয় ভাবে যাচাই করার জন্য অনেক বেশি পরিমাণ তথ্য আদান-প্রদান করতে হয়। সাথে রয়েছে চেহারার বিভিন্ন অংশ খুঁজে বের করা, সেগুলোর আইগেন ভ্যালু নেওয়া, ইত্যাদি জটিলতা।

পরীক্ষায় দেখা গেছে, যান্ত্রিক ভাবে যাচাইকৃত ছবির ব্যর্থতার হার ২০ থেকে ৪০ ভাগ। তুলনায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করলে ব্যর্থতার হার কমে ২.৫% -এ নেমে আসে। এখনও পর্যন্ত জানা পদ্ধতির মধ্যে শুধুমাত্র ডিএনএ পরীক্ষা করেই এর চেয়ে সফল ভাবে পরিচয় যাচাই করা সম্ভব।

খুব সহসা না হলেও ২০২১ নাগাদ এই পদ্ধতি খুব সহজেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব বাংলাদেশে। জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির প্রাথমিক ধাপেই এ-ধরনের দিক-নির্দেশনা দেওয়া থাকলে সকল নাগরিকের হাতের ছাপ সংরক্ষিত থাকবে, যা ভবিষ্যতে অপরাধ দমনেও সাহায্য করবে ব্যাপক ভাবে।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ক্রেডিট কার্ড কিংবা পাসওয়ার্ডের ধারণার সাথে পরিচিত নয়। ব্যবহারকারীকে স্বয়ংক্রিয় ভাবে শনাক্ত করা তাই অনেক দুষ্কর। ফিঙ্গারপ্রিন্ট-ভিত্তিক পদ্ধতি ব্যবহারের অন্যতম সুবিধা হলো নিরক্ষর মানুষের প্রতিও এটি প্রযুক্তিবান্ধব। যুগ যুগ ধরে চলে আসা টিপসই প্রথার সাথে সবাই পরিচিত। স্রেফ আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে মানুষকে শনাক্ত করা গেলে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিভিন্ন রকম সুযোগসুবিধা দেওয়া সহজ হবে। নিরক্ষর কেউও খুব সহজে নিজের চাহিদার কথা জানাতে পারবেন।

প্রযুক্তির সুফল প্রান্তিক নাগরিকের কাছে পৌঁছে দিতে হলে তিনটি ধাপ প্রয়োজন – পরিচয়, শনাক্তকরণ, এবং সেবা। সেবা খাত আগে থেকেই আছে, তবে তা মূলত শহরকেন্দ্রিক। পরিচয় তৈরি করা হচ্ছে নির্বাচনের প্রয়োজনে। শনাক্তকরণের সেতুটি গড়ে দিলেই মানুষ সহজে বিদ্যমান সেবা পেতে পারে। তবে এর সবচেয়ে বড় সুফল হলো ভোক্তাকে চেনার সুবিধা, তাঁর (অনেক ক্ষেত্রেই সহজ ও সীমিত) চাহিদা সম্পর্কে অবগত হওয়া। এই সুফল পেলে সেবা খাতও অনেক এগিয়ে যাবে।

উদাহরণ হিসেবে সদ্য পাশ করা একজন কম্পিউটার/তড়িৎকৌশল প্রকৌশলীর দিকে তাকানো যায়। দেশের শীর্ষস্থানীয় এই ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ভবিষ্যৎ বলতে আছে বিদেশে চলে যাওয়া, মোবাইল কোম্পানিতে কাজ (এবং পাশাপাশি আইবিএ-তে এমবিএ) করা, নয়তো হাতে-গোনা কিছু আউটসোর্সিং কোম্পানিতে যোগ দিয়ে টুকটাক প্রোগ্রামিং করা। এঁদের যোগ্যতা ও সম্ভাবনা অনেক, কিন্তু এঁদের কাছে চাহিদা এটুকুই। এঁদের মাঝে মুষ্টিমেয় ক’জন মেটাচ্ছেন খুব উঁচু পর্যায়ের ভোক্তা/ক্রেতার দুরূহ কিছু চাহিদা। যদি এঁদের সবার কাছে কৃষক-মজুর-মুটেদের চাহিদা পৌঁছে দেওয়ার একটি পথ খুলে দেওয়া যায়, তবে তাঁরা খুব সহজেই তা পূরণ করতে পারেন। প্রকৌশলী থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সবাইই তখন উচ্চতর অবস্থান অর্জন করবেন। এভাবেই প্রথমত ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করে একটি বিশ্বস্ত শনাক্তকরণ পদ্ধতি তৈরি করা যায়, এবং তা বিবিধ ভাবে কাজে লাগিয়ে আধুনিকায়ন করা যায়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ-ধরনের বায়োমেট্রিক তথ্যসমৃদ্ধ চিপ ব্যবহার করেই ইলেক্ট্রনিক পাসপোর্ট তৈরি হয়। এই আধুনিক পাসপোর্টে একটি ডিজিটাল ছবি জুড়ে দেওয়া হয়। আগামী কিছু বছরের মধ্যে উন্নত বিশ্বে যাতায়াতের জন্য ইলেক্ট্রনিক পাসপোর্ট আবশ্যক হতে যাচ্ছে। অতএব, কোনো না কোনো পর্যায়ে বাংলাদেশের অনেক মানুষকেই নতুন করে পাসপোর্ট গ্রহণ করতে হবে। দেশব্যাপী কোনো প্রকল্প হাতে না নিলেও অন্তত এই নতুন পাসপোর্ট ইস্যুর সময় নিজস্ব একটি বায়োমেট্রিক ডেটাবেজ তৈরির দিকে নজর দেওয়া উচিত। অতঃপর সীমিত পরিসরে হলেও এর ব্যবহার ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। এভাবেই হাঁটি হাঁটি পা পা করে কিছু বছরের মধ্যে একটি ব্যাপক তথ্যভাণ্ডার গড়ে উঠবে।

ডিজিটাল বাংলাদেশঃ ১ [ভিশন ২০২১]


ভিশন ২০২১

ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। প্রত্যাশা পূরণের কথা উঠলে দলীয় নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশিত এই চমকের কথাই জোর দিয়ে বলছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। ইশতেহারে পরিবেশিত 'ভিশন ২০২১'-এ লিপিবদ্ধ কথাগুলো বাংলাদেশকে কতটুকু "ডিজিটাল" করতে পারবে, এবং সত্যিকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা খতিয়ে দেখা সময়েরই দাবি।

বহুল প্রচারিত এই ‘ভিশন ২০২১’ এর ব্যাপারে ইশতেহারে (বাংলায় আছে, ইংরেজিতে নেই) মাত্র সাত লাইনে যা বলা আছে, তার নির্যাস হলোঃ

১. প্রতিভাবান তরুণ ও আগ্রহী উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিয়ে সফটওয়্যার শিল্প ও আইটি সার্ভিসের বিকাশ সাধন করা হবে,
২. ২০১৩ সালে মাধ্যমিক স্তরে এবং ২০২১ সালে প্রাথমিক স্তরে আইটি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে,
তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক টাস্কফোর্স সক্রিয় ও কার্যকর করা হবে,
৩. বিভিন্ন স্থানে হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইসিটি ইনক্যুবেটর, এবং কম্পিউটার ভিলেজ স্থাপন করা হবে।

খুব একটা বিস্তারিত কিছু নয়, বলা বাহুল্য। এই গোটা পঞ্চাশেক শব্দ বারংবার উচ্চারিত হচ্ছে আগামী দিনে দেশ গড়ার মূল লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে, মানুষও তাতেই বিশ্বাস স্থাপন করছে। যাঁরা ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে আরেকটু সবিস্তারে স্বপ্ন দেখতে চান, তাঁদের জন্য কিছু চিন্তার-খোরাক যোগানো যাক।

উন্নয়নের জন্য প্রকৌশল

উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হওয়ার দু’টি পথ আছে।

একটি পথটি অনুকরণ-ভিত্তিক। অন্যের যা আছে, তা আমারও চাই।

ভারতের অজস্র লোকাল ট্রেন আছে, আমাদেরও চাই। জাপান বা ইউরোপে বুলেট ট্রেন আছে, আমাদেরও চাই। নিউ ইউর্ক বা লন্ডনের মতো মেট্রোপলিটন শহরে পাতাল রেল আছে, আমাদেরও চাই। ব্রাজিলের সাও পাওলোতে পাতাল রেল না থাকলেও অনেক অনেক বাস এবং তার জন্য আলাদা লেন আছে, আমাদেরও এমন ‘ট্রেন অফ বাসেস’ চাই। উন্নত বিশ্বে ক্রেডিট কার্ড আছে, আমাদেরও এমন ‘প্লাস্টিক মানি’ চাই। আমেরিকার ডিজিটাল পাসপোর্ট আছে, আমাদেরও চাই। সিঙ্গাপুর বা ওয়াশিংটন ডিসি’র প্রতিটি কোণে ক্লোজ-সার্কিট ক্যামেরা আছে, আমাদের চাই। বাকি পৃথিবীর হাইস্পিড ইন্টারনেট আছে, আমাদেরও চাই। এমনি অনেক অনেক ব্যাপার।

চোখ-কান খোলা রেখে চললে এমন অনেক কিছুই দেখা-জানা যায় প্রবাস থেকে। এ-ধরনের কিছু চাহিদার একটি সংকলন তৈরি কষ্টের কিছু নয়। তুলনায় অনেক কঠিন হলো এর পেছনের কারিগরী অবকাঠামো দাঁড় করানো। সদিচ্ছা থাকলে ব্যক্তিগত উদ্যোগ আর প্রযুক্তি কেনাবেচা করে এই ঘাটতির অনেকটাই খুব সহজে পূরণ সম্ভব।

দ্বিতীয় পথটি একটু কঠিন। মুখস্ত বা চোথামারা পদ্ধতি দিয়ে এই পথে সমাধান মেলে না। এর জন্য দরকার নিজের দেশের প্রযুক্তি ব্যবহার, দেশজ মেধা ও শ্রম কাজে লাগানো, দেশের কথা মনে রেখে দেশের মতো করে তৈরি প্রকল্প হাতে নেওয়া।

এ-ধরনের পরিকল্পণা হাতে নেওয়ার আগে অনেক চিন্তা-ভাবনা প্রয়োজন, দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা সব রকম মানবসম্পদের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। জোট সরকারের পাঁচ বছর ধরে সবাই ব্যস্ত ছিল প্রতিবাদ-প্রতিরোধ নিয়ে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু’বছর ধরে রাজনৈতিক দলগুলোরই কোন অস্তিত্ব ছিল না। ফলাফল, ক্ষমতার ব্যপ্তি থাকলেও পরিকল্পনার গভীরতা নেই।

সর্বশেষ নির্বাচনে মহাজোটের মহাবিজয়ের পর অনেক বড় প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। এই দাবিগুলোর মধ্যে নৈমিত্তিক কাজে প্রশাসনিক দুর্নীতি কমানো ছাড়া তেমন বড় কিছু হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই নিরাশার অন্যতম কারণ হলো, আমাদের বৌদ্ধিক পরিকল্পনাগুলো এটুকুতেই সীমিত। আজও আমরা চুরি এবং দুর্নীতিকে সমার্থক বলে জানি।

যতদিন না ডিজিটাল বাংলাদেশের চাহিদাটুকু সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আসছে, ততদিন এর জন্য সত্যিকার কাজ হবে না। সে-উদ্দেশ্যেই এই প্রকল্পগুলোর পেছনের কারিগরী শৈলী যথাসম্ভব সহজভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই প্রয়াসের লক্ষ্য একটাই – সাধারণ মানুষ প্রযুক্তিবিদের মতো ভাবতে শিখুক। তার এই ভাবনাই কালক্রমে চাহিদায় রূপান্তরিত হয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। অন্যথায় সুবর্ণ জয়ন্তীতে প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়ার সুবর্ণ একটি সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশের জন্য প্রকৌশল

প্রকৌশল মানেই বাস্তববাদিতা। বিজ্ঞানীর মতো দার্শনিক ও নতুন চিন্তার বিলাসিতা প্রকৌশলীদের নেই। সহজ ভাষায়, প্রকৌশলীরা নিউটনের চেয়ে ম্যাকগাইভার বেশি। প্রকল্পের আগে তাই অনেক রকম হিসেব কষতে হয় প্রকৌশলীদের। বিজ্ঞানীর কাছে দাবিটি বিজ্ঞানের অগ্রগতির, নতুন দিগন্ত খুঁজে বের করার। বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য তাই সাধারণ ভাবে অর্থের যোগান দেওয়া হয় অনেক লম্বা সময়ের জন্য।

পক্ষান্তরে, প্রকৌশলীর কাছে দাবিটি সাধারণ মানুষের। প্রান্তিক ভোক্তার খুব সাধারণ চাহিদাগুলোর সমাধানই প্রকৌশলীর কাজ। প্রকৌশলের জন্য অর্থের যোগান সে-কারণেই সময়ের সীমায় সীমিত থাকে। যে-দেশে যেমন শিল্প গড়ে ওঠে, সে-দেশে তেমন প্রকৌশলই শক্তিমান অবস্থানে থাকে।

প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রায়শ উপেক্ষিত একটি দিক হলো মূলনীতি ও দিকনির্দেশনা। সরকারের কাজ গবেষণা করা নয়, গবেষণার দিকনির্দেশনা দেওয়া। সরকার মানুষের সব প্রয়োজন মেটাবে না, মানুষের প্রয়োজনগুলোর স্বীকৃতি দিয়ে তা যোগাতে সহায়তা করবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যাতায়াত ব্যবস্থার কথা। প্রতিটি মানুষকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পরিবহনের কাজ সরকার করবে না, বরং সরকার এই বিষয়টি দৃষ্টিগোচর করবে যে এই দুই মেট্রোপলিটান শহরের মধ্যে সুলভ যোগাযোগ নিশ্চিত করা উচিত। অতঃপর, সরকার এ-কাজে ন্যূনতম দিকনির্দেশনা দেবে শুধু। এরপর কালক্রমে প্রযুক্তি আসবে, আসবে বিস্তারিত নীতিমালা।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোন প্রকল্পে হাত দেওয়ার আগের প্রথম যে প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে হবে তার মধ্যে আছেঃ

১. কার জন্য তৈরি করা হবে?
২. হাতে কী কী সম্পদ আছে?
৩. পূর্বপ্রস্তুত সমাধান আছে কিনা, থাকলে তা কীভাবে কাজে লাগানো যায়?
৪. কত কম খরচে কত বেশি লাভ করা যায়, এবং শেষ দিন পর্যন্ত নিংড়ে কতটুকু বাড়তি আয় বের করা যায়?

সহজ, সাধারণ এই প্রশ্নগুলোর উপর মূলনীতি দাঁড় করানোর কারণ একটাই – প্রযুক্তির ব্যাপারে আপাত-অজ্ঞ মানুষও যেন ভাল-মন্দ বিচার করতে পারেন। শিক্ষা বা পেশা নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিককে কম-বেশি প্রযুক্তি-সচেতন না করলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া অসম্ভব। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ও প্রগতি নিশ্চিত করানোর জন্য প্রান্তিক নাগরিকদের পদার্থবিজ্ঞানের জটিল সূত্র জানার প্রয়োজন নেই, শুধু প্রয়োজন একটি প্রযুক্তির উপযোগিতা বিচার-বিবেচনা করতে জানা।

প্রথম প্রশ্নের উত্তর, দেশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের জন্য। সুবিধাভোগীদের জন্য প্রযুক্তির প্রসার খুব সহজ। তুলনায় কঠিনতর হলো এমন কোন উন্নয়ন যা প্রান্তিক মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাবে। টাকার অংকে বললে বুঝতে সহজতর হবে। একজন শিল্পপতির আয় এক কোটি টাকা বৃদ্ধির চেয়ে এক কোটি রিকশাওয়ালার আয় এক টাকা করে বৃদ্ধি করা অনেক বেশি কষ্টের। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনেই কোন না কোন ভাবে প্রযুক্তির প্রসার ঘটাতে হবে।

সম্পদের বিভিন্ন প্রকরণের মধ্যে শুধু মানবসম্পদই বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে আছে। অদক্ষ শ্রমিক ছড়িয়ে আছে দেশময়, আর প্রবাসে আছেন অনেক দক্ষ শ্রমিক। মাঝামাঝি স্তরের মোটামুটি শিক্ষিত তরুণও আছেন অনেক। তুলনায় প্রাকৃতিক সম্পদ নেই বললেই চলে। শুধু মানুষ দিয়ে প্রযুক্তি হয় না, কিছু না কিছু কাঁচামাল লাগে। প্রযুক্তির যুগে কাঁচামালগুলো আর স্রেফ লোহা বা তামা নয়। রূপান্তরিত যে-কাঁচামাল প্রযুক্তির জন্য ব্যবহার করা হয়, তা খুব কম মূল্যে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশের আপেক্ষিকে সেই কাঁচামালের ব্যবহারই সর্বাধিক উপযুক্ত সমাধান।

যে-কোন কিছুরই নির্দিষ্ট আয়ু আছে, তবে সবকিছুই ওয়ান-টাইম-ইউজ নয়। ইটের বাড়ি ভেঙে সেই ইট যেমন নতুন বাড়ি বানানোর কাজে লাগানো যায়, তেমনি বিদ্যমান প্রযুক্তি ও অবকাঠামোও পুনর্ব্যবহার করে খরচ সীমিত রাখা যায়। অতএব, খরচের কথা মাথায় রেখেই নতুন প্রযুক্তি গড়ে তুলতে হবে। এ-কারণে বিগত শতাব্দিতে গড়ে তোলা সব রকম শিল্প কারখানা সম্পর্কে পূর্ণ ও বাস্তবসম্মত জ্ঞান প্রয়োজন।

সাধারণত ত্যানা প্যাঁচানো কিংবা অতিরিক্ত কচলে তিতারস বের করাকে নেতিবাচক ভাবে দেখা হলেও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এটাই মূল লক্ষ্য। প্রযুক্তি টেকসই হওয়ার পেছনে এটি অনেক বড় উপাদান। উদাহরণ হিসেবে জাপানে নির্মিত গাড়ি ও আমেরিকায় নির্মিত গাড়ির পার্থক্যের দিকে তাকানো যায়। দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহারোপযোগী করে তোলার চেষ্টা থাকে বলে টয়োটা বা হোন্ডার তৈরি গাড়ি বিশ্বজয় করছে। পক্ষান্তরে, স্বল্পকালীন ব্যবসা মাথায় রেখে তৈরি হওয়ায় আমেরিকায় নির্মিত গাড়ি বাজার হারাচ্ছে। প্রখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্কের বইয়ে আছে, ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন যে তালেবানরা পাহাড়-পর্বতে শুধু টয়োটার গাড়ির উপরেই ভরসা করে, অন্য কিছু নয়। বাংলাদেশের মতো সীমিত আয়ের দেশকে ডিজিটাইজ করতে হলে মূলনীতি হতে হবে এভাবে বিদ্যমান প্রযুক্তির মধ্য থেকে ‘এক্সট্রা মাইল’ বের করে আনা এবং নতুন প্রযুক্তিকে কালোত্তীর্ণ করা।

এই সাধারণ প্রশ্নগুলোর ভিত্তিতেই সাধারণ কিছু চিন্তা, কল্পনা, ও দর্শন মিশিয়ে এবার ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন এগিয়ে নেওয়া যাক।

ছবিঃ "স্টেপ-আউট", শোভন নাজমুস