১. কালের স্থিরচিত্র
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪-দলীয় মহাজোট বিপুল বিজয় অর্জন করেছে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে। ফলাফল বলছে, দেশে এখন কার্যত কোন বিরোধী দল রইলো না। ইতিহাসের পরিহাস সবসময় নির্মম হয় না। এক কালে অনেক দুর্নাম কামিয়ে আওয়ামী লীগ 'বাকশাল' তৈরি করেছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, নাশকতা, দুর্ভিক্ষ সহ অনেক রকম কারণ হয়তো ছিল, কিন্তু তবু এই পদক্ষেপ চিরকালের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগকে। ২০০৮ সালে কার্যত আরেকটি 'বাকশাল' স্থাপিত হল। পার্থক্য হল, এবারে এটি জনগণের মত ও সমর্থনেই ঘটছে। গোড়া সমর্থকেরা সেই চোখেই দেখবেন বলে ভয় হচ্ছে। স্রেফ মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য বলা, এটি কালের স্থিরচিত্র ছাড়া আর কিছু নয়। ভোটের হিসাব অনেক আনন্দের হলেও বাস্তবতা কিছু সচেতনতা দাবি করে।
২. অস্বাভাবিক ঐক্যঃ
সময়ের প্রয়োজনে অনেক রকম অস্বাভাবিক ঐক্য হয়। এ-ধরণের কৌশলগত বা শর্তসাপেক্ষ ঐক্য দীর্ঘমেয়াদে ফাটলেই পরিণত হয়। দৃশ্য শত্রুর গতিবিধি জানা যায়, তার ব্যাপারে পরিকল্পণা করা যায়। অজানা, অদৃশ্য শত্রুর বেলায় এই সুবিধা নেই। আওয়ামী লীগ এই মুহূর্তে এমনই একটি ঐক্যের সুফল ভোগ করছে। জয় মহাজোটের হলেও শাসন করবে কার্যত আওয়ামী লীগ। যে-দলগুলো নিয়ে মহাজোট গঠিত, তারা কেউই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক নয়। বিশ্বস্ত ভোটার বাদে যাঁরা মহাজোটকে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের বৈশিষ্ট্য দেখা যাক।
1. তরুণ ভোটঃ এবারে প্রায় দেড় কোটি নতুন ভোটার অংশগ্রহণ করেছেন নির্বাচনে। এরা নতুন যুগের মানুষ, এরা নিত্য-নতুন সুযোগের মধ্যে বড় হয়েছে, এরা বাইরের দেশের অনুকরনে অভ্যস্ত, এরা বাইরের রাজনীতির সাথে দেশের তুলনা করে। এরা সাফল্যের পরিমাপ করবে বহির্বিশ্বের সাথে। তরুণ ভোটের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, এরা খুব বেশি অস্থির। যুদ্ধাপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে আগামী নির্বাচনে এরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না, এই ভোট আওয়ামী লীগের পক্ষে ধরে রাখা সম্ভব না। এই কাজটি করার অন্য দিক হল, আওয়ামী লীগ আর কখনও মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত বেঁচে রাজনীতি করতে পারবে না।
2. জাতীয় পার্টিঃ লেজে অব হোমো এরশাদ বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে পল্টিবাজ ও সুবিধাবাদী রাজনীতিক। বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী এত বড় গর্ত খুড়েছিল নিজের জন্য, যে যে-কেউ এই নির্বাচনে জয়লাভ করতো। হুমকি-ধামকি দিলেও এরশাদ মহাজোট ছেড়ে যাননি এই বাস্তবতা বুঝতে পেরেই। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি একই কাতারের দল হওয়ার পূর্ণ সুবিধা নেবার ক্ষেত্র প্রস্তুত এখন তার জন্য। এই ভোটগুলোও আওয়ামী লীগ আর কখনও পাবে না।
সিলেট বা ঢাকায় সকল আসন জেতার মত জনপ্রিয় দল আওয়ামী লীগ না। বগুড়ায় একাধিক আসন জেতার মত দল আওয়ামী লীগ না। এই ভোটগুলো আওয়ামী লীগ আর পাবে না। এগুলো স্রেফ দৈব দুর্বিপাক। তারেক জিয়া বাড়াবাড়ি রকম চুরিদারি না করলে, খালেদা জিয়া তাঁর ছেলেদের ব্যাপারে অন্ধ না হলে, পিন্টুর মত গুন্ডাদের মনোনয়ন না দিলে, কাউকে মনোনয়ন দিলে পুরো পরিবারশুদ্ধ মনোনয়ন না দিলে এই সৌভাগ্য আওয়ামী লীগের হত না। এই ঐক্য চরম অস্বাভাবিক। ব্যবসা-মনস্ক জাতীয়তাবাদীরা আওয়ামী লীগের সমর্থক নন। সেনাবাহিনী বা ইসলামী শাসনের প্রবক্তারা আওয়ামী লীগের সমর্থক নন। এঁদের নব্যপ্রাপ্ত সমর্থক ভেবে এঁদের আদর্শ অবলম্বন করেও আওয়ামী লীগ এই ভোটগুলো পাবে না।
3. বামপন্থী ভোটঃ অনেকটা বাধ্য হয়েই বাম ঘরানার মুক্তমনা মানুষেরা ভোট দিয়েছেন আওয়ামী লীগকে। ধর্মব্যবসায়ী দলগুলোর সাথে আঁতাত করার চেষ্টা করে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিকে নতুন করে মুসলমানী দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। আওয়ামী লীগ ড্যামেজ-কন্ট্রোল করার জন্য যতই "আমরা আসলে ওদের প্রগতিশীল করতে চেয়েছিলাম" বলুক না কেন, অসাম্প্রদায়িক কেউ এ-কথায় ভুলেননি। এই ভোটও আর পাওয়া যাবে না।
4. বীতশ্রদ্ধ মধ্য ও নিম্নবিত্তঃ বাংলাদেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য খুব কম। যুদ্ধাপরাধী তোষণের দায়ে বিএনপি দুষ্ট হওয়ার ব্যাপারটি বাদ দিলে তেমন কোন তফাৎ নেই। বিএনপি'র বদলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও দ্রব্যমূল্য ও দুর্নীতি বেড়েই চলতো (হয়তো এতটা নয়)। আওয়ামী লীগের এই বিজয় যতটা অর্জন, তার চেয়ে উপহার বেশি। অতএব, এই আশংকা অবাস্তব নয় যে আওয়ামী লীগ একে যথাযথ মূল্যায়ন করবে না। বিজয়ের মাত্রার সাথে সমানুপাতিক উন্নয়ন না করলে দলহীন এই সাধারণ মানুষ আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের সাথে থাকবে না।
৩. জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধী সমীকরণঃ
এই নির্বাচনের মূল ম্যান্ডেট আওয়ামী লীগের পক্ষে না, যুদ্ধাপরাধীদের বিপক্ষে। সাম্প্রতিক সময়ে মূলত বিভিন্ন অরাজনৈতিক সংগঠনের চেষ্টায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি সামনে এসেছে। নির্বাচন পিছিয়ে জানুয়ারি মাসে নেওয়ার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোটের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, গণহত্যা, অত্যাচার, যুদ্ধাপরাধী বিচার, ইত্যাদি ব্যাপারে যেই গণসচেতনতা গড়ে উঠেছে, তার পেছনে আওয়ামী লীগের তিল পরিমাণ অবদান না থাকলেও এর পূর্ণ সুফল ভোগ করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় মহাজোট।
অতীতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দু'টি সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর একবার, ’৯৬ এর নির্বাচনের পর আরেকবার। সেই গণজাগরণ আওয়ামী লীগের তৈরি ছিল না, আওয়ামী লীগ সেই গণদাবির প্রতি কোন শ্রদ্ধাও দেখায়নি। জামায়াতের সাথে বরং আওয়ামী লীগ কৌশলগত আঁতাত করবার চেষ্টাও করেছিল এক কালে। মাত্র ক’দিন আগে তারা প্রায় রাজনৈতিক মুসলমানি করে বসেছিল মোল্লাদের সাথে চুক্তি করে। জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধী যে একই কাতারের, সেই সত্য আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেনি। এর সব কিছুই সামাজিক, অরাজনৈতিক অর্জন। এই নির্বাচনের আগে বিজয় দিবস নিয়ে বাঙালি গর্বে সরব হওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগের অবদান একেবারেই নগণ্য, অথচ এই আন্দোলনগুলোই আওয়ামী লীগকে ২৬২টি আসন এনে দিয়েছে।
ক্রমে শক্ত হয়ে ওঠা জামায়াতকে একমাত্র এই সমীকরণটিই ডুবাতে পারতো যে ‘জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধী সমার্থক’। এই কথা মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেওয়ার মত নৈতিক অবস্থান আওয়ামী লীগের ছিল না। জামায়াত দেরিতে হলেও এটি বুঝতে পেরেছে। মুক্তিযুদ্ধের কথা তাদের ইশতেহারে ঢুকিয়েছে, বিজয় দিবস বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মত ঘটনাগুলোকে মেনে নিয়েছে (যা এগুলোকে পর্যায়ক্রমে গুরুত্বহীন ও কথার কথা করবার প্রক্রিয়ায় আছে)। আগামী নির্বাচনের আগে জামায়াত নিজের শরীর থেকে যুদ্ধাপরাধের সব দৃশ্যমান চিহ্ন মুছে ফেলে স্রেফ একটি “ইসলামিক” দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এই বিজয়ের পেছনে তাই জামায়াতের বিলম্বিত উপলব্ধির ভূমিকা ব্যাপক।
সংবিধানের যাবতীয় কলঙ্কজনক ধারা এবং যুদ্ধাপরাধীদের চূড়ান্তভাবে শেষ করে দেওয়ার সুযোগকে আওয়ামী লীগ দলীয় জয় হিসেবে নিয়ে কতটা সুনিপুণ ভাবে হারায়, সেটাই দেখার বিষয়।
৪. বিজয়ী কুপ্রার্থী
অতি-খুশিতে বগল বাজানো শুরু করবার আগে বিবেচনার নেওয়া উচিত যে এই দুর্যোগের কালেও জামায়াত প্রায় প্রতিটি আসনেই ভোট পেয়েছে বেশি। কমান্ডার নিজামি হেরে গেলেও আড়াই লাখ ভোটের মধ্যে মাত্র ২২ হাজার ভোটে হেরেছেন। সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীর মত পাপীও জিতে গেছেন। এই বিষয়গুলো আমলে নেওয়া উচিত আওয়ামী লীগের, সাথে তাকিয়ে দেখা উচিত নিজ দলের এমন অনেক প্রার্থীর দিকে যাঁরা সাধারণ অবস্থায় জিততেন না। এই তালিকায় এরশাদ থেকে শুরু করে কামাল আহমেদ মজুমদার পর্যন্ত অনেকেই আছেন। নৌকার এই সুদিনেও ঢাকা শহরে কি এর চেয়ে ভাল প্রার্থী মিলতো না?
সাম্প্রতিক কালে বিএনপি’র মত আওয়ামী লীগের ভেতরেও রাজনৈতিক সার্জারির মাধ্যমে নেতা আমদানির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সজীব ওয়াজেদ জয় দেশে গেলে শিশুদের মেলা কিংবা অধুনা পত্রিকায় তাঁকে বিদগ্ধ রাজনীতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা তারই নিদর্শন। আগামী কিছুদিনে এই প্রক্রিয়া অব্যহত থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ ছিল সমাজতন্ত্রের পতন। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি নিজ নিজ শাসনামলে অনেক কর্মী রিক্রুট করলেও আওয়ামী লীগ তেমন কিছুই করতে পারেনি। সোভিয়েত রাশিয়ার পতন একঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক দিয়েছে। আওয়ামী লীগ তাঁদের যথাযথ মূল্যায়ন করেনি কখনই। সামনেও করবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। প্রমাণ হল, দেশ থেকে খবরে জানলাম ছাত্রলীগ এরই মধ্যে হল দখলে নেমেছে।
৫. স্বপ্নের সিড়ি বেয়ে স্বর্গে নামি
সাময়িক এই বিজয় আওয়ামী লীগ কতটা কাজে লাগায়, সেই ব্যাপারে আমি ব্যক্তিগত ভাবে সন্দিহান। দেশটা কিছু লম্পটের হাত থেকে বেঁচে যাওয়ায় অনেক খুশি হলেও তাই পাশাপাশি রয়ে গেছে হতাশ হওয়ার ভয়। দিনভর অনেক রকম কথা শুনেছি। ‘যাকে মাথায় তোলা হয়, তার দেওয়া ছোট আঘাতও লাগে বেশি’। ‘দ্য হাইয়ার ইউ রাইজ, দ্য হার্ডার ইউ ফল’। ‘আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে কী লাভ, আগেও তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলেছিল’। এগুলো সত্যকথন, এগুলো আওয়ামী লীগ কানে তুলবে না।
তেমন কোন প্রচার ছাড়াই ‘না’ ভোটের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দেখা গেছে এবার। আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টির খুব ঘৃণ্য একটি অভ্যাস হল তাদের সমর্থন না করলে ভোটারদের দেশাত্মবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলা। এবারেও নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা ‘না’ ভোট দেওয়াকে নির্বুদ্ধিতা কিংবা রাজাকারকে ক্ষমতায় আনার সাথে তুলনা করেছেন। কেউ ভেবে দেখেননি যে নিজামির সাথে মিটিং করা কিংবা দেশময় অতিরিক্ত আত্মপ্রচারের মত ‘বুদ্ধিমান’ কাজ আওয়ামী লীগই করেছে, সাধারণ ভোটারেরা না।
হয়তো উদ্দেশ্য বা আদর্শের বদলে ব্যক্তিপূজা থেকে গঠিত বলেই বিএনপি তুলনামূলকভাবে গতিশীল একটি দল। তারা নতুন ভোটারদের কাছে যাবে, অনেক ভাল ফল বয়ে আনবে। পরবর্তী নির্বাচনের সময় হয়তো দেশপ্রেম নামক চিজটি এমন “হিপ” থাকবে না। তখন হয়তো মুম্বাইয়ের নায়ক-নায়িকার মত “আমার বাংলাদেশ”ও “কুল” থাকবে না। হয়তো সেবার কোন ঠিকা বুয়া দু’দিন আগে তেহকেই ঠিক মত ব্যালট পেপার ভাজ করার পদ্ধতি রপ্ত করতে লাগবেন না। হয়তো সেদিনও অলস দুপুরে গুগুলে “বাংলাদেশ” লিখে সার্চ করলে আদৌ আমার দেশ নিয়ে একটি মানসম্মত বাংলাদেশি ওয়েবসাইট পাওয়া যাবে না। হয়তো সেদিন আর ইন্টারনেট জুড়ে ‘মুক্তিযুদ্ধে মৃতের সংখ্যা অতিরঞ্জন’ দাবি করলে আর কোন তরুণ ছাত্র বা সাংবাদিক উদ্যোগী হয়ে প্রতিবাদ করবেন না। হয়তো সেদিন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতিকদের উন্নাসিকতা উপেক্ষা করে কোন এমএমআর জালাল নিজ খরচে প্রবাসের পথে পথে ঘুরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সব রকম নথি সংগ্রহ করে যাবেন না।
সেদিনের বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে যে স্থিতধী, মোহমুক্তি, ও প্রশ্নোর্ধ্ব দেশপ্রেম প্রয়োজন, তা আওয়ামী লীগকে দেখাতে হবে। মুক্তচিন্তার প্রসার, মানবাধিকার রক্ষা, আইনের সংস্কার, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, ও নারী অধিকারায়ন না করলে এ-দিনের অনেক ভোটার নীরব হয়ে যাবেন। অন্যদিকে হায়েনা ফিরে আসবে নতুন কোন রূপে, আরো শান দেওয়া নখরদন্ত নিয়ে।
২০০১ এর নির্বাচনের পর গৎ বাঁধা কিছু প্রতিশ্রুতির ময়ূরপুচ্ছ গায়ে লাগিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল কিছু হায়েনা। এবারে আওয়ামী লীগও একই ধারার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। সে-কারণেই আশা করতে সংকোচ হয়। ২৬২ টি আসনে জয়ের জন্য যেই নৈতিক উচ্চতা ও সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা লাগে, তা আওয়ামী লীগের নেই। ভোটের আগে আওয়ামী লীগের প্রচারণাতেই বলা ছিল, তারা বিএনপি-জামায়াত জোটের তুলনায় উন্নততর দেখে তাদের ভোট দেওয়া উচিত। সেই মতেই, বিএনপি-জামায়াত জোট অনেক বেশি খারাপ দেখেই আওয়ামী লীগের অনেক বড় জয়।
আওয়ামী লীগের তাই সবচেয়ে বড় ধন্যবাদ দেওয়া উচিত তারেক জিয়াকে তার অবিমৃশ্যতার জন্য, ডিসেম্বর মাসকে বিজয়ের মাস হওয়ার জন্য, আর অগণিত দেশপ্রেমিককে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে ব্যাপকভিত্তিক জনমত গড়ে তুলবার জন্য।
Tuesday, December 30, 2008
গানবন্দী জীবনঃ আশিক-প্রিয়া
৫. আমি আশিক, তুমি প্রিয়া
বাংলা চলচ্চিত্রের গানের মত ‘গিলটি প্লেজার’ খুব কম আছে। আড়াল পেলে সবাইই কম-বেশি গুনগুন করলেও প্রকাশ্যে কেউ স্বীকার করতে চান না যে তাঁরা বাংলা চলচ্চিত্রের গান শোনেন। আমি নিজেও ব্যতিক্রম নই। মনে পড়ে, এন্ড্রু কিশোর একবার ইত্যাদি’তে আফসোস করে বলেছিলেন মধ্যবিত্তের বৈঠকখানায় তাঁর গান ঢুকতে না পারার কথা। এর পেছনে যেই ছ্যুৎমার্গ কাজ করে, আমিও তার ঊর্ধ্বে নই।
শক্তি ও পূর্ণতার কার্যকর কিছু নিরূপকের একটি হল দুর্বলের প্রতি উদারতা। একটি দেশ যত শক্তিমান, তার আইন সংখ্যালঘুদের প্রতি তত বন্ধুত্বপূর্ণ। একজন মানুষ যত বলিয়ান, তিনি ভিন্ন মত ও পথের মানুষের প্রতি তত সহনশীল। বাংলা সিনেমার গানের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি তেমনই।
আমি গাইতে জানি না, নাচের মুদ্রা বুঝি না, অভিব্যক্তি দিয়ে মন হরণ করতে পারি না, দুই অনুচ্ছেদের একটি অণুগল্পও লিখতে পারি না। তবু সমালোচনার খড়্গ হাতে উঠতে সেকেন্ড খানেক সময়ও লাগে না। বাংলা চলচ্চিত্র খুব দুস্থ ও দুর্বল, কিন্তু তার প্রতি আমার এক ধরণের অন্ধ আক্রোশের কিছুটা হয়তো আমারই ক্ষুদ্রতা থেকে উৎসারিত।
বয়সের সাথে সাথে খুব কম মানুষকেই দেখেছি এই সংকীর্ণতা থেকে বের হয়ে আসতে। ভেঙেছে পিঞ্জর, পড়ে না চোখের পলক, দুই দিনেরই এক জেল, একদিন স্বপ্নের দিন, মন চায়, কিংবা আমার মাঝে নেই আমি এখন এ-যুগেরই বাংলা চলচ্চিত্রের গান। এগুলো গুনগুন করে গেয়েছি সবাই। হাল আমলে ক্লোজআপ-ওয়ান আসার আগ পর্যন্ত গানগুলো সেভাবে সামনে আসেনি। চিরকাল ধরে ঢালাও গালি দিয়ে যাওয়া এই আমিও এখন মানতে বাধ্য হই যে আমাদেরই অবহেলার কারণে পরিস্থিতি আজ এত বেশি খারাপ।
এই উপলব্ধিগুলো অনেক বড় বয়সের। মানুষ যতই শিক্ষিত ও পরিমার্জিত হোক না কেন, কিছু মৌলিক প্রণোদনা তার মাঝে কাজ করেই। ভাড়ের ডিগবাজি, ভূতের হাসি, নায়িকার ইঙ্গিতপূর্ণ চাহনি, ইত্যাদি সব বয়স ও মতের মানুষকেই টানে। আর টানে গান। কেউ স্বীকার করি, আর কেউ করি না। এখানেই যেটুকু তফাৎ।
বহুকাল আগের কথা। ছোট ভাইকে ওয়াই-ডব্লিউ-সি-এ স্কুলে দিয়ে আসার সময় বছর ছয়েকের একটি ছেলেকে গান গাইতে দেখেছিলাম এক সকালে। বিদ্যাবিভীষিকায় কাতর হয়ে সবাই কাঁদছে স্কুলে ঢোকার আগে। এরই মাঝে ছেলেটি সবাইকে ঠেলে এগিয়ে আসছিল উদ্দাম গতিতে। পেছন পেছন ছুটছে বাবা-মা। তাঁদের চোখে-মুখে লজ্জা। ব্যাগের স্ট্র্যাপ দু’হাতে ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে ছেলেটি গান গাইছে – আমি আশিক, তুমি প্রিয়া। সাথে আরেক গানের লাইন মিলিয়ে দু’জন দু’জনার কত যে আপন, কেউ জানে না! আর একটু পরপর তারস্বরে তুমি প্রিয়া, তুমি প্রিয়া, তুমি প্রিয়া।
গানটি শিশুমনকে ছুঁয়েছিল। সকালে স্কুল যাবার আনন্দে ছেলেটি গান গাইছিল। আশিক-প্রিয়ার জটিলতার ধার দিয়েও না গিয়ে স্রেফ মনের আনন্দে গান গাইছিল। কত সহজ, কত সাধারণ। আমাদের যে কেন বড় হলেই সব কিছু পেঁচিয়ে ফেলতে হয়।
ছেলেটির সাথে গলা মেলানোর ইচ্ছে ছিল খুব। গান পছন্দ করে নয়, শুধু মুহূর্তটি উপভোগ করার জন্য। পারিনি। মনে হয় না চোখের সামনে এমন দৃশ্য দ্বিতীয়বার দেখার সুযোগ পেলেও পারবো। সংকোচের শৃঙ্খলেই আটকে থাকলো সব।
বাংলা চলচ্চিত্রের গানের মত ‘গিলটি প্লেজার’ খুব কম আছে। আড়াল পেলে সবাইই কম-বেশি গুনগুন করলেও প্রকাশ্যে কেউ স্বীকার করতে চান না যে তাঁরা বাংলা চলচ্চিত্রের গান শোনেন। আমি নিজেও ব্যতিক্রম নই। মনে পড়ে, এন্ড্রু কিশোর একবার ইত্যাদি’তে আফসোস করে বলেছিলেন মধ্যবিত্তের বৈঠকখানায় তাঁর গান ঢুকতে না পারার কথা। এর পেছনে যেই ছ্যুৎমার্গ কাজ করে, আমিও তার ঊর্ধ্বে নই।
শক্তি ও পূর্ণতার কার্যকর কিছু নিরূপকের একটি হল দুর্বলের প্রতি উদারতা। একটি দেশ যত শক্তিমান, তার আইন সংখ্যালঘুদের প্রতি তত বন্ধুত্বপূর্ণ। একজন মানুষ যত বলিয়ান, তিনি ভিন্ন মত ও পথের মানুষের প্রতি তত সহনশীল। বাংলা সিনেমার গানের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি তেমনই।
আমি গাইতে জানি না, নাচের মুদ্রা বুঝি না, অভিব্যক্তি দিয়ে মন হরণ করতে পারি না, দুই অনুচ্ছেদের একটি অণুগল্পও লিখতে পারি না। তবু সমালোচনার খড়্গ হাতে উঠতে সেকেন্ড খানেক সময়ও লাগে না। বাংলা চলচ্চিত্র খুব দুস্থ ও দুর্বল, কিন্তু তার প্রতি আমার এক ধরণের অন্ধ আক্রোশের কিছুটা হয়তো আমারই ক্ষুদ্রতা থেকে উৎসারিত।
বয়সের সাথে সাথে খুব কম মানুষকেই দেখেছি এই সংকীর্ণতা থেকে বের হয়ে আসতে। ভেঙেছে পিঞ্জর, পড়ে না চোখের পলক, দুই দিনেরই এক জেল, একদিন স্বপ্নের দিন, মন চায়, কিংবা আমার মাঝে নেই আমি এখন এ-যুগেরই বাংলা চলচ্চিত্রের গান। এগুলো গুনগুন করে গেয়েছি সবাই। হাল আমলে ক্লোজআপ-ওয়ান আসার আগ পর্যন্ত গানগুলো সেভাবে সামনে আসেনি। চিরকাল ধরে ঢালাও গালি দিয়ে যাওয়া এই আমিও এখন মানতে বাধ্য হই যে আমাদেরই অবহেলার কারণে পরিস্থিতি আজ এত বেশি খারাপ।
এই উপলব্ধিগুলো অনেক বড় বয়সের। মানুষ যতই শিক্ষিত ও পরিমার্জিত হোক না কেন, কিছু মৌলিক প্রণোদনা তার মাঝে কাজ করেই। ভাড়ের ডিগবাজি, ভূতের হাসি, নায়িকার ইঙ্গিতপূর্ণ চাহনি, ইত্যাদি সব বয়স ও মতের মানুষকেই টানে। আর টানে গান। কেউ স্বীকার করি, আর কেউ করি না। এখানেই যেটুকু তফাৎ।
বহুকাল আগের কথা। ছোট ভাইকে ওয়াই-ডব্লিউ-সি-এ স্কুলে দিয়ে আসার সময় বছর ছয়েকের একটি ছেলেকে গান গাইতে দেখেছিলাম এক সকালে। বিদ্যাবিভীষিকায় কাতর হয়ে সবাই কাঁদছে স্কুলে ঢোকার আগে। এরই মাঝে ছেলেটি সবাইকে ঠেলে এগিয়ে আসছিল উদ্দাম গতিতে। পেছন পেছন ছুটছে বাবা-মা। তাঁদের চোখে-মুখে লজ্জা। ব্যাগের স্ট্র্যাপ দু’হাতে ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে ছেলেটি গান গাইছে – আমি আশিক, তুমি প্রিয়া। সাথে আরেক গানের লাইন মিলিয়ে দু’জন দু’জনার কত যে আপন, কেউ জানে না! আর একটু পরপর তারস্বরে তুমি প্রিয়া, তুমি প্রিয়া, তুমি প্রিয়া।
গানটি শিশুমনকে ছুঁয়েছিল। সকালে স্কুল যাবার আনন্দে ছেলেটি গান গাইছিল। আশিক-প্রিয়ার জটিলতার ধার দিয়েও না গিয়ে স্রেফ মনের আনন্দে গান গাইছিল। কত সহজ, কত সাধারণ। আমাদের যে কেন বড় হলেই সব কিছু পেঁচিয়ে ফেলতে হয়।
ছেলেটির সাথে গলা মেলানোর ইচ্ছে ছিল খুব। গান পছন্দ করে নয়, শুধু মুহূর্তটি উপভোগ করার জন্য। পারিনি। মনে হয় না চোখের সামনে এমন দৃশ্য দ্বিতীয়বার দেখার সুযোগ পেলেও পারবো। সংকোচের শৃঙ্খলেই আটকে থাকলো সব।
বিজয় দিবসের নাটিকাঃ "সেমিকোলন"
শুরুটা খুব সাদা-মাটা। পরীক্ষার মাঝে মাথা হালকা করতে "মুক্তির গান" ছাড়লো আজমীর। পাশের ঘরে মাহমুদের তখন মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করছে টেক-হোম টেস্টের সমাধান করতে গিয়ে। পড়ার বিরতিতে পাশের ঘর থেকে ভেসে আসলো মুক্তির গান। সেই গান শুনেই মাথায় খেলে গেল একটি চিন্তা। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কীভাবে যেন দূরে সরে যাচ্ছে। ভাবতে বসে গেল ইতিহাসের কথা।
ব্যাকরণে 'সেমিকোলন' ব্যবহৃত হয় দুটি সম্পূর্ণ বা প্রায়-সম্পূর্ণ বাক্যকে যুক্ত করতে। সেমিকোলনটি প্রথম বাক্যকে পূর্ণতা দেয়, দ্বিতীয় বাক্যটিকে দেয় ভিন্ন মাত্রা। একক ভাবে যতি চিহ্ন, কিংবা তার আগে-পরের বাক্যগুলো গুরুত্ব হারায়।
আমাদের ইতিহাসও তো তেমনই। বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ যেন একটি বিশাল সেমিকোলন। এর আগের সময়টুকুর সব চেতনার পূর্ণতা দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধে। সেই সাথে মেলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দিক-নির্দেশনা।
আমাদের অসারতা, আর উত্তরপ্রজন্মের নিরুৎসাহের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও তার চেতনা। সেই চিন্তা থেকেই বিজয় দিবসের রাতে পরীক্ষার মাঝেই এই নাটিকাটি লিখে ফেলে মাহমুদ। আজ রাতে বিজয় দিবসের অনুষ্টানে দেখানো হল নাটিকাটি।
নগণ্য কিছু প্রবাসী ছাত্রের এই ক্ষুদ্র প্রয়াসটুকু তুলে দিলাম আপনাদের জন্য। ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরে দিলে বাধিত থাকবো।
জয় বাংলা!
ব্যাকরণে 'সেমিকোলন' ব্যবহৃত হয় দুটি সম্পূর্ণ বা প্রায়-সম্পূর্ণ বাক্যকে যুক্ত করতে। সেমিকোলনটি প্রথম বাক্যকে পূর্ণতা দেয়, দ্বিতীয় বাক্যটিকে দেয় ভিন্ন মাত্রা। একক ভাবে যতি চিহ্ন, কিংবা তার আগে-পরের বাক্যগুলো গুরুত্ব হারায়।
আমাদের ইতিহাসও তো তেমনই। বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ যেন একটি বিশাল সেমিকোলন। এর আগের সময়টুকুর সব চেতনার পূর্ণতা দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধে। সেই সাথে মেলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দিক-নির্দেশনা।
আমাদের অসারতা, আর উত্তরপ্রজন্মের নিরুৎসাহের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও তার চেতনা। সেই চিন্তা থেকেই বিজয় দিবসের রাতে পরীক্ষার মাঝেই এই নাটিকাটি লিখে ফেলে মাহমুদ। আজ রাতে বিজয় দিবসের অনুষ্টানে দেখানো হল নাটিকাটি।
নগণ্য কিছু প্রবাসী ছাত্রের এই ক্ষুদ্র প্রয়াসটুকু তুলে দিলাম আপনাদের জন্য। ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরে দিলে বাধিত থাকবো।
জয় বাংলা!
গানবন্দী জীবনঃ নায়ে বাদাম তুইলা দে ভাই
৪. নায়ে বাদাম তুইলা দে ভাই
আমাদের বংশে মেয়ে নেই বলতে গেলে। সবার দু’টা করে ছেলে। স্বাভাবিক ভাবেই খুব রুক্ষ আর অসহনশীল হয়ে গড়ে উঠেছি আমরা সবাই। বোন না থাকার আফসোসটা সবাইকেই ভোগায় কম-বেশি। ভাই-বোনের সম্পর্ক কী অসামান্য, তা শুধু দেখেই গেলাম জীবনভর।
একবার পার্কে গিয়ে দেখেছিলাম ছোট বোন একটু পর পর বড় ভাইয়ের একদম মাথায় উঠে বসছে। এইতো সেদিন চ্যানেল আইয়ের ক্ষুদে গানরাজে দেখলাম বাদ পড়ে যাওয়া ছোট্ট হৃদ্য নিজের দুঃখ ভুলে বড় ভাই সদ্যের জন্য এসএমএস চাইছে, আহ্লাদ করে ভাইকে জড়িয়ে ধরছে। তার কিছুদিন আগে রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে দেখেছিলাম স্যারাহ পেলিনের মেয়ের ভ্রাতৃস্নেহ। মাত্র ৭ বছর বয়সী পাইপার কয়েক মাস বয়সের প্রতিবন্ধী ছোট ভাই ট্রিগের চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল মা বক্তৃতা দেওয়ার সময়টায়। ডান হাতের তালু জিভ দিয়ে চেটে ভেজায়, ভাইয়ের চুল ঘসে সমান করে দেয়, আবার চাটে, আবার চুল ঘসে সমান করে। আগ্রহীরা চোখ বুলাতে পারেন ইউটিউবেঃ ‘http://www.youtube.com/watch?v=GliQjmuf8_s’। এতটা স্বর্গীয় একটা দৃশ্য আর দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
গায়ে-গতরে বেশ বড় হয়ে যাবার পর মামা-খালাদের সূত্রে বোন পাওয়া শুরু হল। এদের মধ্যে সবার বড় জায়ান। অনেকটা কাল ধরে এই একটাই বোন ছিল। ছায়ানটে গান শেখে। নজরুল, রবীন্দ্র, পল্লীগীতি, আরও কত কত রকম গান। আমার এই বোনটা গান-পাগল। ছোটবেলা থেকেই অভিনয় আর আবৃত্তিতে পটু, এখন সাথে যোগ হয়েছে গান। গাইতে বললেই সবার ওজন দেখানো শুরু হয়ে যায়, অথচ আমার এই বোনটা বেহায়া রকম ব্যতিক্রম। ফোনে কথা হলেই মিষ্টি হেসে বলে, অভি ভাইয়া, তোমাকে একটা গান শোনাই, তোমার মন ভাল হয়ে যাবে। ভাল না ছাই। পল্লীগীতিতে গলা ছেড়ে টান দিতে শুধুই চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে। আমার এই বোনের কণ্ঠে আমার সবচেয়ে প্রিয় গান ‘নায়ে বাদাম তুইলা দে ভাই আল্লা-রাসূল বইলা, আমি পদ্মা নদী পাড়ি দেবো মাওলারও নাম লইয়া’। কথা হলেই এই গানটা শুনতে চাই, এখন পর্যন্ত প্রতিবারই চোখ বেয়ে পানি পড়েছে গানটা শুনে।
জায়ানের সাথেই পিঠাপিঠি বোন রাফাত। ঠিক নিচের তলায় থাকতো। সকাল হলেই দৌঁড়ে আমার কাছে চলে আসতো, রাত হলে থেকে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতো। আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই এসে গুটিসুটি মেরে বিছানায় উঠে পড়তো। এরপর হঠাৎ পেটের উপর লাফ দিয়ে পড়ে ঘুম ভাঙিয়ে ভুবন ভুলানো একটা হাসি দিতো। বাইরে চলে আসার পর হাতে লিখে চিঠি পাঠায় ক’দিন পরপর। জন্মদিন এলে তক্কেতক্কে থাকে। শুভেচ্ছা জানাতে ভুলে গেলেই বুক এফোড়-ওফোড় করে দেওয়া একটা খোঁচা, হু, আমাকে তো মনে থাকে না তোমার আর।
এরপর দুই মামাতো বোন। যুক্তরাজ্যে বড় হচ্ছে, প্রথমবার দেখার আগেই তাই বড় জন প্রায় ৮ বছরের হয়ে গেছে। অবিকল আমার নানীর মুখ যেন। একটু পরপর পাশে এসে খুব লজ্জা পেয়ে, শান্ত স্বরে বলতো, ভাইয়া, তোমার পাশে বসতে খুব ইচ্ছা করছে, আমাকে কোলে নিয়ে বসবে? রক্তের টান বোধহয় একেই বলে।
ছোট জন অনেক জেদী। ভোর ছয়টায় বাজলেই আমাকে ঠেলে তুলবে। বাচ্চাদের একটা বই এগিয়ে দিয়ে বলবে, রিড দ্যাট। ঘুম জড়ানো চোখে পড়ে শোনাই। শেষ হলেই হেসে বলে, রিড এগেইন। আবার পড়ি। আবারও মড়ার রিড এগেইন। এই চলে সকালের প্রথম আধা ঘন্টা। এক সকালে আব্বুর দিকে দেখিয়ে বলেছিলাম, ঐ যে ফুফা ডাকছে পড়ে শোনাবে বলে। মাত্র আড়াই বছরের সেই বিচ্ছুটা আমার সাথে সাতদিন কথা বলেনি আর।
সবার ছোট নুসাবা। আমার ছোট খালার মেয়ে। সম্ভবত আমার পরে আমাদের বংশে সবচেয়ে প্রতীক্ষিত সদস্য। বোন কী, বোনের অধিকার কী, বোনের দাবি কী, তা শিখেছি নুসাবার কাছ থেকেই। বাকিদের বেলায় আরামে আরামে কাটিয়েছি। সারাদিন পর হয়তো একটু আহ্লাদ করেছি, তাতেই হয়ে গেছে। নুসাবার বেলায় উলটো। বর্ষা-বাদল-ব্যস্ততা-অসুস্থতা নির্বিশেষে তার সাথে প্রতিদিন কথা বলতে হয়। প্রতিদিন ওয়েবক্যামে তাকে তার ভাগের সময়টুকু দিতে হয়। সামান্য ব্যত্যয় হলেই অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলবে, ও জানে নাই, ও শুনে নাই।
এই বোনটাও গানের পাগল। হরবোলার মত যেকোন গান শুনে শুনে শিখে ফেলে। বয়স দুই বছর হওয়ার আগেই গোটা ত্রিশেক গান তার মুখস্ত। নিথুয়া পাথারে, যাও পাখি বল তারে, ও আমার দেশের মাটি, বার্নির গান, এরকম আরও কত যে গান সকাল হলেই একাধারে শুনতে হয়।
ভালই চলছিলাম মাচো হবার পথে, কিন্তু বড় বয়সে এসে এই কলিজার টুকরাগুলো মনকে অনেক নরম করে দিল। একেকটার সাথে কথা বললেই মনে হয় সব ছেড়ে ওদের কাছে যাই গিয়ে। এত্ত আহ্লাদ, এত্ত ভালবাসা, আর এত্ত অধিকারের সাথে পরিচয় ছিল না। সেই অনুভূতিগুলো আটকে আছে অন্তর নিংরানো পল্লীগীতিটায়। কিছু অনুভবের জন্য আসলেই পদ্মা নদী পাড়ি দেওয়া যায়।
(গানটা নিজের কাছে নেই, কারো সংগ্রহে থাকলে জানানোর অনুরোধ রইলো)
আমাদের বংশে মেয়ে নেই বলতে গেলে। সবার দু’টা করে ছেলে। স্বাভাবিক ভাবেই খুব রুক্ষ আর অসহনশীল হয়ে গড়ে উঠেছি আমরা সবাই। বোন না থাকার আফসোসটা সবাইকেই ভোগায় কম-বেশি। ভাই-বোনের সম্পর্ক কী অসামান্য, তা শুধু দেখেই গেলাম জীবনভর।
একবার পার্কে গিয়ে দেখেছিলাম ছোট বোন একটু পর পর বড় ভাইয়ের একদম মাথায় উঠে বসছে। এইতো সেদিন চ্যানেল আইয়ের ক্ষুদে গানরাজে দেখলাম বাদ পড়ে যাওয়া ছোট্ট হৃদ্য নিজের দুঃখ ভুলে বড় ভাই সদ্যের জন্য এসএমএস চাইছে, আহ্লাদ করে ভাইকে জড়িয়ে ধরছে। তার কিছুদিন আগে রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে দেখেছিলাম স্যারাহ পেলিনের মেয়ের ভ্রাতৃস্নেহ। মাত্র ৭ বছর বয়সী পাইপার কয়েক মাস বয়সের প্রতিবন্ধী ছোট ভাই ট্রিগের চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল মা বক্তৃতা দেওয়ার সময়টায়। ডান হাতের তালু জিভ দিয়ে চেটে ভেজায়, ভাইয়ের চুল ঘসে সমান করে দেয়, আবার চাটে, আবার চুল ঘসে সমান করে। আগ্রহীরা চোখ বুলাতে পারেন ইউটিউবেঃ ‘http://www.youtube.com/watch?v=GliQjmuf8_s’। এতটা স্বর্গীয় একটা দৃশ্য আর দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
গায়ে-গতরে বেশ বড় হয়ে যাবার পর মামা-খালাদের সূত্রে বোন পাওয়া শুরু হল। এদের মধ্যে সবার বড় জায়ান। অনেকটা কাল ধরে এই একটাই বোন ছিল। ছায়ানটে গান শেখে। নজরুল, রবীন্দ্র, পল্লীগীতি, আরও কত কত রকম গান। আমার এই বোনটা গান-পাগল। ছোটবেলা থেকেই অভিনয় আর আবৃত্তিতে পটু, এখন সাথে যোগ হয়েছে গান। গাইতে বললেই সবার ওজন দেখানো শুরু হয়ে যায়, অথচ আমার এই বোনটা বেহায়া রকম ব্যতিক্রম। ফোনে কথা হলেই মিষ্টি হেসে বলে, অভি ভাইয়া, তোমাকে একটা গান শোনাই, তোমার মন ভাল হয়ে যাবে। ভাল না ছাই। পল্লীগীতিতে গলা ছেড়ে টান দিতে শুধুই চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে। আমার এই বোনের কণ্ঠে আমার সবচেয়ে প্রিয় গান ‘নায়ে বাদাম তুইলা দে ভাই আল্লা-রাসূল বইলা, আমি পদ্মা নদী পাড়ি দেবো মাওলারও নাম লইয়া’। কথা হলেই এই গানটা শুনতে চাই, এখন পর্যন্ত প্রতিবারই চোখ বেয়ে পানি পড়েছে গানটা শুনে।
জায়ানের সাথেই পিঠাপিঠি বোন রাফাত। ঠিক নিচের তলায় থাকতো। সকাল হলেই দৌঁড়ে আমার কাছে চলে আসতো, রাত হলে থেকে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতো। আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই এসে গুটিসুটি মেরে বিছানায় উঠে পড়তো। এরপর হঠাৎ পেটের উপর লাফ দিয়ে পড়ে ঘুম ভাঙিয়ে ভুবন ভুলানো একটা হাসি দিতো। বাইরে চলে আসার পর হাতে লিখে চিঠি পাঠায় ক’দিন পরপর। জন্মদিন এলে তক্কেতক্কে থাকে। শুভেচ্ছা জানাতে ভুলে গেলেই বুক এফোড়-ওফোড় করে দেওয়া একটা খোঁচা, হু, আমাকে তো মনে থাকে না তোমার আর।
এরপর দুই মামাতো বোন। যুক্তরাজ্যে বড় হচ্ছে, প্রথমবার দেখার আগেই তাই বড় জন প্রায় ৮ বছরের হয়ে গেছে। অবিকল আমার নানীর মুখ যেন। একটু পরপর পাশে এসে খুব লজ্জা পেয়ে, শান্ত স্বরে বলতো, ভাইয়া, তোমার পাশে বসতে খুব ইচ্ছা করছে, আমাকে কোলে নিয়ে বসবে? রক্তের টান বোধহয় একেই বলে।
ছোট জন অনেক জেদী। ভোর ছয়টায় বাজলেই আমাকে ঠেলে তুলবে। বাচ্চাদের একটা বই এগিয়ে দিয়ে বলবে, রিড দ্যাট। ঘুম জড়ানো চোখে পড়ে শোনাই। শেষ হলেই হেসে বলে, রিড এগেইন। আবার পড়ি। আবারও মড়ার রিড এগেইন। এই চলে সকালের প্রথম আধা ঘন্টা। এক সকালে আব্বুর দিকে দেখিয়ে বলেছিলাম, ঐ যে ফুফা ডাকছে পড়ে শোনাবে বলে। মাত্র আড়াই বছরের সেই বিচ্ছুটা আমার সাথে সাতদিন কথা বলেনি আর।
সবার ছোট নুসাবা। আমার ছোট খালার মেয়ে। সম্ভবত আমার পরে আমাদের বংশে সবচেয়ে প্রতীক্ষিত সদস্য। বোন কী, বোনের অধিকার কী, বোনের দাবি কী, তা শিখেছি নুসাবার কাছ থেকেই। বাকিদের বেলায় আরামে আরামে কাটিয়েছি। সারাদিন পর হয়তো একটু আহ্লাদ করেছি, তাতেই হয়ে গেছে। নুসাবার বেলায় উলটো। বর্ষা-বাদল-ব্যস্ততা-অসুস্থতা নির্বিশেষে তার সাথে প্রতিদিন কথা বলতে হয়। প্রতিদিন ওয়েবক্যামে তাকে তার ভাগের সময়টুকু দিতে হয়। সামান্য ব্যত্যয় হলেই অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলবে, ও জানে নাই, ও শুনে নাই।
এই বোনটাও গানের পাগল। হরবোলার মত যেকোন গান শুনে শুনে শিখে ফেলে। বয়স দুই বছর হওয়ার আগেই গোটা ত্রিশেক গান তার মুখস্ত। নিথুয়া পাথারে, যাও পাখি বল তারে, ও আমার দেশের মাটি, বার্নির গান, এরকম আরও কত যে গান সকাল হলেই একাধারে শুনতে হয়।
ভালই চলছিলাম মাচো হবার পথে, কিন্তু বড় বয়সে এসে এই কলিজার টুকরাগুলো মনকে অনেক নরম করে দিল। একেকটার সাথে কথা বললেই মনে হয় সব ছেড়ে ওদের কাছে যাই গিয়ে। এত্ত আহ্লাদ, এত্ত ভালবাসা, আর এত্ত অধিকারের সাথে পরিচয় ছিল না। সেই অনুভূতিগুলো আটকে আছে অন্তর নিংরানো পল্লীগীতিটায়। কিছু অনুভবের জন্য আসলেই পদ্মা নদী পাড়ি দেওয়া যায়।
(গানটা নিজের কাছে নেই, কারো সংগ্রহে থাকলে জানানোর অনুরোধ রইলো)
গানবন্দী জীবনঃ আজ আমার শূন্য ঘরে আসিল সুন্দর
৩. আজ আমার শূন্য ঘরে আসিলো সুন্দর
আমার নানা প্রচন্ড শিল্প-রসিক। শিক্ষায় ডাক্তার, পেশায় প্রফেসর, নেশায় কবিতা আর গানের অনুরাগী। এতটাই বেশি যে রেডিওতে একবার নানার সাক্ষাৎকার পর্যন্ত নেওয়া হয়েছিল। নানা নিজের সংগ্রহের এলপি থেকে কী কী যেন শুনিয়েছিল। রেকর্ডিংটা হারিয়ে গেছে অনেক দিন হয়।
পরিবারে নতুন কোন অতিথি এলেই নামের জন্য নানার কাছে যাওয়া হয়। আমার মা-খালাদের ডাকনাম নানার দেওয়া – সীমা, নিশি, শীলা। আমার খুব পছন্দের নাম তিনটাই। আমার ডাকনামও নানারই দেওয়া – অভি। গালভরা ভাল নামটার চেয়ে এই নামটা অনেক বেশি আপন। নানার সাথে আমার চুক্তি আছে। আমার ছেলে-মেয়ের নাম ঠিক করে না দিয়ে তার ছুটি নেই।
বড় নাতি হিসেবে অনেক আদর পেয়েছি নানার কাছে। আমার জন্মদিন পালনের জন্য নানা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসে ঘুরে যেত রাতের ট্রেনে। আমার পছন্দ বলে বাক্স বাক্স গলদা চিংড়ি পাঠাতো। নানার বিশাল বইয়ের ভান্ডার থেকে আমাকে নিজের ইচ্ছামত চুরি করতে দিতো। বইমেলা এলে প্রথম বার যাওয়ার আগে আমি অবসর পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতো। আমাদের দুই ভাইয়ের চালানো সব সাইকেল নানার কিনে দেওয়া ছিল। একবার আমি ঝোঁকের মাথায় স্কুল থেকে একটা কুকুর ছানা কিনে এনেছিলাম। থাকি ভূতের গলির এক ভাড়া বাড়িতে। জল্লাদ বাড়িওয়ালা, তার উপর এমনিতেই বাসা-ভর্তি মানুষ। আমার নানা সেই কুকুরটা পেলেছিল আট বছর ধরে। ট্রাকচাপা পড়ে আমার ‘শাইনি’ মারা যাবার পর অনেক কেঁদেছিল।
নাতিপাগল আমার অসামান্য নানা আমাকে কোলে করে প্রথম বার বাসায় ঢোকার সময় গেয়েছিল, ‘আজ আমার শূন্য ঘরে আসিলো সুন্দর, ওগো অনেক দিনের পর’। স্মৃতিশক্তি আমার এমনিতেই খারাপ, তার উপর সেই ঘটনা পাক্কা ২৬ বছর আগের। তবু যেন সেই মুহূর্তের আগলে ধরা অনুভূতিতে মনটা অবশ হয়ে যায়। কল্পণায় ভাসে, উত্তম কুমারের মত দেখতে এক সুপুরুষ রঙিন কাপড়ে মোড়ানো ছোট্ট একটা মাংসপিণ্ড কোলে করে শিশুতোষ আনন্দে গানটা গাইছে।
নানার অফুরন্ত গল্পের সম্ভারের কারণে সত্যজিতের তাড়িণীখুড়োর কীর্তিকলাপ পড়ে মনে হয়েছিল যেন চুপিচুপি আমার নানাকে দেখে লেখা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেলের যে-কোন ছাত্রকে বায়োকেমিস্ট্রির প্রফেসর ইছহাকের কথা জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে তার উচ্ছ্বলতার কথা। ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে বেড়াতো। ল্যাবরেটরি ক্লাসে সল্যুশন বানিয়ে নিজের ধমনীতে ঢুকিয়ে পরীক্ষা করতো। দেশ-বিদেশের ইতিহাস নিয়ে মজার সব গল্প বলে যেত। ‘প্রফেসর ইছহাকের বড় মেয়ের বড় ছেলে’ পরিচয়ের সুবাদে কোনদিন ডাক্তারের কাছে গেলে লাইনে দাঁড়াতে হয়নি, ফি দিতে হয়নি।
হাল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে বিলেত গিয়েছিল। সে-সময় বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে নাকি একবার বরফজমা হ্রদের উপরের বরফ কেটে খালি গায়ে ডুব দিয়েছিল। এছাড়াও কাজের চাপে বৌয়ের চিঠি ভাইকে পাঠিয়ে দেওয়ার মত কীর্তি ছিল অনেক। ডানপিটে, খেলাপ্রিয়, এভার্টন আর ইংল্যান্ডের ভক্ত, প্রচন্ড রোম্যান্টিক এই মানুষটাকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে তার পাঁচটা ছেলে-মেয়ে আছে।
বাজারে দর কষাকষিতে আমার নানার মত পারদর্শী খুব কম দেখেছি। এই বয়সেও সকাল হলেই চলে যায় কাঁচা বাজারে। নানার বাসায় বেলায় বেলায় জনা বিশেক লোক খাওয়া-দাওয়া করতো এক সময়। খাওয়ার লোক কমলেও বাজারের পরিমাণ তেমন কমেছে বলে মনে হয় না। নিউ মার্কেট আর টঙ্গী বাজারের দোকানীরা নানাকে আড়ালে ডেকে নানার পছন্দমত দামে জিনিস দিয়ে দিতো। সবার সামনে নানা দর-দাম করলে ব্যাপারীর বেশি ক্ষতি, তাই!
নানার সাথের এই খুচরো অনুভূতিগুলো ঘুরে-ফিরে আসে এই গানটার সাথে। কথা হলেই বিভিন্ন রকম উপদেশ দেয় নানা। ভেজা চুলে বের হতে নেই, গলার পেছনটা স্কার্ফ দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়, বাজারে গেলে প্রথম চক্করে কিছু না কিনে সব দোকানের দাম যাচাই করে নিতে হয়, এমন ছোট ছোট উপদেশের পাশাপাশি এই গানটাও গেয়ে শোনায় একবার করে। অতুলপ্রসাদের এই গানটা শুনলেই মনে হয় যেন নানি বিছানার পাশে মোড়ায় বসে সুপারি কাটছে, আমি নানার পাশে শুয়ে আনন্দমেলা পড়ছি, আর নানা উৎপাত করার জন্য গায়ের উপর পা তুলে দিয়ে দুষ্টামি করছে।
আমার নানা প্রচন্ড শিল্প-রসিক। শিক্ষায় ডাক্তার, পেশায় প্রফেসর, নেশায় কবিতা আর গানের অনুরাগী। এতটাই বেশি যে রেডিওতে একবার নানার সাক্ষাৎকার পর্যন্ত নেওয়া হয়েছিল। নানা নিজের সংগ্রহের এলপি থেকে কী কী যেন শুনিয়েছিল। রেকর্ডিংটা হারিয়ে গেছে অনেক দিন হয়।
পরিবারে নতুন কোন অতিথি এলেই নামের জন্য নানার কাছে যাওয়া হয়। আমার মা-খালাদের ডাকনাম নানার দেওয়া – সীমা, নিশি, শীলা। আমার খুব পছন্দের নাম তিনটাই। আমার ডাকনামও নানারই দেওয়া – অভি। গালভরা ভাল নামটার চেয়ে এই নামটা অনেক বেশি আপন। নানার সাথে আমার চুক্তি আছে। আমার ছেলে-মেয়ের নাম ঠিক করে না দিয়ে তার ছুটি নেই।
বড় নাতি হিসেবে অনেক আদর পেয়েছি নানার কাছে। আমার জন্মদিন পালনের জন্য নানা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসে ঘুরে যেত রাতের ট্রেনে। আমার পছন্দ বলে বাক্স বাক্স গলদা চিংড়ি পাঠাতো। নানার বিশাল বইয়ের ভান্ডার থেকে আমাকে নিজের ইচ্ছামত চুরি করতে দিতো। বইমেলা এলে প্রথম বার যাওয়ার আগে আমি অবসর পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতো। আমাদের দুই ভাইয়ের চালানো সব সাইকেল নানার কিনে দেওয়া ছিল। একবার আমি ঝোঁকের মাথায় স্কুল থেকে একটা কুকুর ছানা কিনে এনেছিলাম। থাকি ভূতের গলির এক ভাড়া বাড়িতে। জল্লাদ বাড়িওয়ালা, তার উপর এমনিতেই বাসা-ভর্তি মানুষ। আমার নানা সেই কুকুরটা পেলেছিল আট বছর ধরে। ট্রাকচাপা পড়ে আমার ‘শাইনি’ মারা যাবার পর অনেক কেঁদেছিল।
নাতিপাগল আমার অসামান্য নানা আমাকে কোলে করে প্রথম বার বাসায় ঢোকার সময় গেয়েছিল, ‘আজ আমার শূন্য ঘরে আসিলো সুন্দর, ওগো অনেক দিনের পর’। স্মৃতিশক্তি আমার এমনিতেই খারাপ, তার উপর সেই ঘটনা পাক্কা ২৬ বছর আগের। তবু যেন সেই মুহূর্তের আগলে ধরা অনুভূতিতে মনটা অবশ হয়ে যায়। কল্পণায় ভাসে, উত্তম কুমারের মত দেখতে এক সুপুরুষ রঙিন কাপড়ে মোড়ানো ছোট্ট একটা মাংসপিণ্ড কোলে করে শিশুতোষ আনন্দে গানটা গাইছে।
নানার অফুরন্ত গল্পের সম্ভারের কারণে সত্যজিতের তাড়িণীখুড়োর কীর্তিকলাপ পড়ে মনে হয়েছিল যেন চুপিচুপি আমার নানাকে দেখে লেখা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেলের যে-কোন ছাত্রকে বায়োকেমিস্ট্রির প্রফেসর ইছহাকের কথা জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে তার উচ্ছ্বলতার কথা। ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে বেড়াতো। ল্যাবরেটরি ক্লাসে সল্যুশন বানিয়ে নিজের ধমনীতে ঢুকিয়ে পরীক্ষা করতো। দেশ-বিদেশের ইতিহাস নিয়ে মজার সব গল্প বলে যেত। ‘প্রফেসর ইছহাকের বড় মেয়ের বড় ছেলে’ পরিচয়ের সুবাদে কোনদিন ডাক্তারের কাছে গেলে লাইনে দাঁড়াতে হয়নি, ফি দিতে হয়নি।
হাল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে বিলেত গিয়েছিল। সে-সময় বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে নাকি একবার বরফজমা হ্রদের উপরের বরফ কেটে খালি গায়ে ডুব দিয়েছিল। এছাড়াও কাজের চাপে বৌয়ের চিঠি ভাইকে পাঠিয়ে দেওয়ার মত কীর্তি ছিল অনেক। ডানপিটে, খেলাপ্রিয়, এভার্টন আর ইংল্যান্ডের ভক্ত, প্রচন্ড রোম্যান্টিক এই মানুষটাকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে তার পাঁচটা ছেলে-মেয়ে আছে।
বাজারে দর কষাকষিতে আমার নানার মত পারদর্শী খুব কম দেখেছি। এই বয়সেও সকাল হলেই চলে যায় কাঁচা বাজারে। নানার বাসায় বেলায় বেলায় জনা বিশেক লোক খাওয়া-দাওয়া করতো এক সময়। খাওয়ার লোক কমলেও বাজারের পরিমাণ তেমন কমেছে বলে মনে হয় না। নিউ মার্কেট আর টঙ্গী বাজারের দোকানীরা নানাকে আড়ালে ডেকে নানার পছন্দমত দামে জিনিস দিয়ে দিতো। সবার সামনে নানা দর-দাম করলে ব্যাপারীর বেশি ক্ষতি, তাই!
নানার সাথের এই খুচরো অনুভূতিগুলো ঘুরে-ফিরে আসে এই গানটার সাথে। কথা হলেই বিভিন্ন রকম উপদেশ দেয় নানা। ভেজা চুলে বের হতে নেই, গলার পেছনটা স্কার্ফ দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়, বাজারে গেলে প্রথম চক্করে কিছু না কিনে সব দোকানের দাম যাচাই করে নিতে হয়, এমন ছোট ছোট উপদেশের পাশাপাশি এই গানটাও গেয়ে শোনায় একবার করে। অতুলপ্রসাদের এই গানটা শুনলেই মনে হয় যেন নানি বিছানার পাশে মোড়ায় বসে সুপারি কাটছে, আমি নানার পাশে শুয়ে আনন্দমেলা পড়ছি, আর নানা উৎপাত করার জন্য গায়ের উপর পা তুলে দিয়ে দুষ্টামি করছে।
Subscribe to:
Posts (Atom)