৪. নায়ে বাদাম তুইলা দে ভাই
আমাদের বংশে মেয়ে নেই বলতে গেলে। সবার দু’টা করে ছেলে। স্বাভাবিক ভাবেই খুব রুক্ষ আর অসহনশীল হয়ে গড়ে উঠেছি আমরা সবাই। বোন না থাকার আফসোসটা সবাইকেই ভোগায় কম-বেশি। ভাই-বোনের সম্পর্ক কী অসামান্য, তা শুধু দেখেই গেলাম জীবনভর।
একবার পার্কে গিয়ে দেখেছিলাম ছোট বোন একটু পর পর বড় ভাইয়ের একদম মাথায় উঠে বসছে। এইতো সেদিন চ্যানেল আইয়ের ক্ষুদে গানরাজে দেখলাম বাদ পড়ে যাওয়া ছোট্ট হৃদ্য নিজের দুঃখ ভুলে বড় ভাই সদ্যের জন্য এসএমএস চাইছে, আহ্লাদ করে ভাইকে জড়িয়ে ধরছে। তার কিছুদিন আগে রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে দেখেছিলাম স্যারাহ পেলিনের মেয়ের ভ্রাতৃস্নেহ। মাত্র ৭ বছর বয়সী পাইপার কয়েক মাস বয়সের প্রতিবন্ধী ছোট ভাই ট্রিগের চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল মা বক্তৃতা দেওয়ার সময়টায়। ডান হাতের তালু জিভ দিয়ে চেটে ভেজায়, ভাইয়ের চুল ঘসে সমান করে দেয়, আবার চাটে, আবার চুল ঘসে সমান করে। আগ্রহীরা চোখ বুলাতে পারেন ইউটিউবেঃ ‘http://www.youtube.com/watch?v=GliQjmuf8_s’। এতটা স্বর্গীয় একটা দৃশ্য আর দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
গায়ে-গতরে বেশ বড় হয়ে যাবার পর মামা-খালাদের সূত্রে বোন পাওয়া শুরু হল। এদের মধ্যে সবার বড় জায়ান। অনেকটা কাল ধরে এই একটাই বোন ছিল। ছায়ানটে গান শেখে। নজরুল, রবীন্দ্র, পল্লীগীতি, আরও কত কত রকম গান। আমার এই বোনটা গান-পাগল। ছোটবেলা থেকেই অভিনয় আর আবৃত্তিতে পটু, এখন সাথে যোগ হয়েছে গান। গাইতে বললেই সবার ওজন দেখানো শুরু হয়ে যায়, অথচ আমার এই বোনটা বেহায়া রকম ব্যতিক্রম। ফোনে কথা হলেই মিষ্টি হেসে বলে, অভি ভাইয়া, তোমাকে একটা গান শোনাই, তোমার মন ভাল হয়ে যাবে। ভাল না ছাই। পল্লীগীতিতে গলা ছেড়ে টান দিতে শুধুই চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে। আমার এই বোনের কণ্ঠে আমার সবচেয়ে প্রিয় গান ‘নায়ে বাদাম তুইলা দে ভাই আল্লা-রাসূল বইলা, আমি পদ্মা নদী পাড়ি দেবো মাওলারও নাম লইয়া’। কথা হলেই এই গানটা শুনতে চাই, এখন পর্যন্ত প্রতিবারই চোখ বেয়ে পানি পড়েছে গানটা শুনে।
জায়ানের সাথেই পিঠাপিঠি বোন রাফাত। ঠিক নিচের তলায় থাকতো। সকাল হলেই দৌঁড়ে আমার কাছে চলে আসতো, রাত হলে থেকে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতো। আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই এসে গুটিসুটি মেরে বিছানায় উঠে পড়তো। এরপর হঠাৎ পেটের উপর লাফ দিয়ে পড়ে ঘুম ভাঙিয়ে ভুবন ভুলানো একটা হাসি দিতো। বাইরে চলে আসার পর হাতে লিখে চিঠি পাঠায় ক’দিন পরপর। জন্মদিন এলে তক্কেতক্কে থাকে। শুভেচ্ছা জানাতে ভুলে গেলেই বুক এফোড়-ওফোড় করে দেওয়া একটা খোঁচা, হু, আমাকে তো মনে থাকে না তোমার আর।
এরপর দুই মামাতো বোন। যুক্তরাজ্যে বড় হচ্ছে, প্রথমবার দেখার আগেই তাই বড় জন প্রায় ৮ বছরের হয়ে গেছে। অবিকল আমার নানীর মুখ যেন। একটু পরপর পাশে এসে খুব লজ্জা পেয়ে, শান্ত স্বরে বলতো, ভাইয়া, তোমার পাশে বসতে খুব ইচ্ছা করছে, আমাকে কোলে নিয়ে বসবে? রক্তের টান বোধহয় একেই বলে।
ছোট জন অনেক জেদী। ভোর ছয়টায় বাজলেই আমাকে ঠেলে তুলবে। বাচ্চাদের একটা বই এগিয়ে দিয়ে বলবে, রিড দ্যাট। ঘুম জড়ানো চোখে পড়ে শোনাই। শেষ হলেই হেসে বলে, রিড এগেইন। আবার পড়ি। আবারও মড়ার রিড এগেইন। এই চলে সকালের প্রথম আধা ঘন্টা। এক সকালে আব্বুর দিকে দেখিয়ে বলেছিলাম, ঐ যে ফুফা ডাকছে পড়ে শোনাবে বলে। মাত্র আড়াই বছরের সেই বিচ্ছুটা আমার সাথে সাতদিন কথা বলেনি আর।
সবার ছোট নুসাবা। আমার ছোট খালার মেয়ে। সম্ভবত আমার পরে আমাদের বংশে সবচেয়ে প্রতীক্ষিত সদস্য। বোন কী, বোনের অধিকার কী, বোনের দাবি কী, তা শিখেছি নুসাবার কাছ থেকেই। বাকিদের বেলায় আরামে আরামে কাটিয়েছি। সারাদিন পর হয়তো একটু আহ্লাদ করেছি, তাতেই হয়ে গেছে। নুসাবার বেলায় উলটো। বর্ষা-বাদল-ব্যস্ততা-অসুস্থতা নির্বিশেষে তার সাথে প্রতিদিন কথা বলতে হয়। প্রতিদিন ওয়েবক্যামে তাকে তার ভাগের সময়টুকু দিতে হয়। সামান্য ব্যত্যয় হলেই অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলবে, ও জানে নাই, ও শুনে নাই।
এই বোনটাও গানের পাগল। হরবোলার মত যেকোন গান শুনে শুনে শিখে ফেলে। বয়স দুই বছর হওয়ার আগেই গোটা ত্রিশেক গান তার মুখস্ত। নিথুয়া পাথারে, যাও পাখি বল তারে, ও আমার দেশের মাটি, বার্নির গান, এরকম আরও কত যে গান সকাল হলেই একাধারে শুনতে হয়।
ভালই চলছিলাম মাচো হবার পথে, কিন্তু বড় বয়সে এসে এই কলিজার টুকরাগুলো মনকে অনেক নরম করে দিল। একেকটার সাথে কথা বললেই মনে হয় সব ছেড়ে ওদের কাছে যাই গিয়ে। এত্ত আহ্লাদ, এত্ত ভালবাসা, আর এত্ত অধিকারের সাথে পরিচয় ছিল না। সেই অনুভূতিগুলো আটকে আছে অন্তর নিংরানো পল্লীগীতিটায়। কিছু অনুভবের জন্য আসলেই পদ্মা নদী পাড়ি দেওয়া যায়।
(গানটা নিজের কাছে নেই, কারো সংগ্রহে থাকলে জানানোর অনুরোধ রইলো)
Tuesday, December 30, 2008
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment