৩. আজ আমার শূন্য ঘরে আসিলো সুন্দর
আমার নানা প্রচন্ড শিল্প-রসিক। শিক্ষায় ডাক্তার, পেশায় প্রফেসর, নেশায় কবিতা আর গানের অনুরাগী। এতটাই বেশি যে রেডিওতে একবার নানার সাক্ষাৎকার পর্যন্ত নেওয়া হয়েছিল। নানা নিজের সংগ্রহের এলপি থেকে কী কী যেন শুনিয়েছিল। রেকর্ডিংটা হারিয়ে গেছে অনেক দিন হয়।
পরিবারে নতুন কোন অতিথি এলেই নামের জন্য নানার কাছে যাওয়া হয়। আমার মা-খালাদের ডাকনাম নানার দেওয়া – সীমা, নিশি, শীলা। আমার খুব পছন্দের নাম তিনটাই। আমার ডাকনামও নানারই দেওয়া – অভি। গালভরা ভাল নামটার চেয়ে এই নামটা অনেক বেশি আপন। নানার সাথে আমার চুক্তি আছে। আমার ছেলে-মেয়ের নাম ঠিক করে না দিয়ে তার ছুটি নেই।
বড় নাতি হিসেবে অনেক আদর পেয়েছি নানার কাছে। আমার জন্মদিন পালনের জন্য নানা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসে ঘুরে যেত রাতের ট্রেনে। আমার পছন্দ বলে বাক্স বাক্স গলদা চিংড়ি পাঠাতো। নানার বিশাল বইয়ের ভান্ডার থেকে আমাকে নিজের ইচ্ছামত চুরি করতে দিতো। বইমেলা এলে প্রথম বার যাওয়ার আগে আমি অবসর পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতো। আমাদের দুই ভাইয়ের চালানো সব সাইকেল নানার কিনে দেওয়া ছিল। একবার আমি ঝোঁকের মাথায় স্কুল থেকে একটা কুকুর ছানা কিনে এনেছিলাম। থাকি ভূতের গলির এক ভাড়া বাড়িতে। জল্লাদ বাড়িওয়ালা, তার উপর এমনিতেই বাসা-ভর্তি মানুষ। আমার নানা সেই কুকুরটা পেলেছিল আট বছর ধরে। ট্রাকচাপা পড়ে আমার ‘শাইনি’ মারা যাবার পর অনেক কেঁদেছিল।
নাতিপাগল আমার অসামান্য নানা আমাকে কোলে করে প্রথম বার বাসায় ঢোকার সময় গেয়েছিল, ‘আজ আমার শূন্য ঘরে আসিলো সুন্দর, ওগো অনেক দিনের পর’। স্মৃতিশক্তি আমার এমনিতেই খারাপ, তার উপর সেই ঘটনা পাক্কা ২৬ বছর আগের। তবু যেন সেই মুহূর্তের আগলে ধরা অনুভূতিতে মনটা অবশ হয়ে যায়। কল্পণায় ভাসে, উত্তম কুমারের মত দেখতে এক সুপুরুষ রঙিন কাপড়ে মোড়ানো ছোট্ট একটা মাংসপিণ্ড কোলে করে শিশুতোষ আনন্দে গানটা গাইছে।
নানার অফুরন্ত গল্পের সম্ভারের কারণে সত্যজিতের তাড়িণীখুড়োর কীর্তিকলাপ পড়ে মনে হয়েছিল যেন চুপিচুপি আমার নানাকে দেখে লেখা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেলের যে-কোন ছাত্রকে বায়োকেমিস্ট্রির প্রফেসর ইছহাকের কথা জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে তার উচ্ছ্বলতার কথা। ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে বেড়াতো। ল্যাবরেটরি ক্লাসে সল্যুশন বানিয়ে নিজের ধমনীতে ঢুকিয়ে পরীক্ষা করতো। দেশ-বিদেশের ইতিহাস নিয়ে মজার সব গল্প বলে যেত। ‘প্রফেসর ইছহাকের বড় মেয়ের বড় ছেলে’ পরিচয়ের সুবাদে কোনদিন ডাক্তারের কাছে গেলে লাইনে দাঁড়াতে হয়নি, ফি দিতে হয়নি।
হাল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে বিলেত গিয়েছিল। সে-সময় বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে নাকি একবার বরফজমা হ্রদের উপরের বরফ কেটে খালি গায়ে ডুব দিয়েছিল। এছাড়াও কাজের চাপে বৌয়ের চিঠি ভাইকে পাঠিয়ে দেওয়ার মত কীর্তি ছিল অনেক। ডানপিটে, খেলাপ্রিয়, এভার্টন আর ইংল্যান্ডের ভক্ত, প্রচন্ড রোম্যান্টিক এই মানুষটাকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে তার পাঁচটা ছেলে-মেয়ে আছে।
বাজারে দর কষাকষিতে আমার নানার মত পারদর্শী খুব কম দেখেছি। এই বয়সেও সকাল হলেই চলে যায় কাঁচা বাজারে। নানার বাসায় বেলায় বেলায় জনা বিশেক লোক খাওয়া-দাওয়া করতো এক সময়। খাওয়ার লোক কমলেও বাজারের পরিমাণ তেমন কমেছে বলে মনে হয় না। নিউ মার্কেট আর টঙ্গী বাজারের দোকানীরা নানাকে আড়ালে ডেকে নানার পছন্দমত দামে জিনিস দিয়ে দিতো। সবার সামনে নানা দর-দাম করলে ব্যাপারীর বেশি ক্ষতি, তাই!
নানার সাথের এই খুচরো অনুভূতিগুলো ঘুরে-ফিরে আসে এই গানটার সাথে। কথা হলেই বিভিন্ন রকম উপদেশ দেয় নানা। ভেজা চুলে বের হতে নেই, গলার পেছনটা স্কার্ফ দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়, বাজারে গেলে প্রথম চক্করে কিছু না কিনে সব দোকানের দাম যাচাই করে নিতে হয়, এমন ছোট ছোট উপদেশের পাশাপাশি এই গানটাও গেয়ে শোনায় একবার করে। অতুলপ্রসাদের এই গানটা শুনলেই মনে হয় যেন নানি বিছানার পাশে মোড়ায় বসে সুপারি কাটছে, আমি নানার পাশে শুয়ে আনন্দমেলা পড়ছি, আর নানা উৎপাত করার জন্য গায়ের উপর পা তুলে দিয়ে দুষ্টামি করছে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment