Friday, November 14, 2008

গানবন্দী জীবনঃ খরবায়ু বয় বেগে

২. খরবায়ু বয় বেগে
বাংলায় কিশোর সাহিত্য বেশ অবহেলিত। সবাই শুধু বড়দের জন্য লিখতে চায়, বড়দের কথা লিখতে চায়। বড়দের লেখার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। বয়সের সাথে সাথে অনুভূতিগুলো গাঢ় হয়, মানুষ অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়। সেই চিন্তাগুলো সাহিত্যে স্থান পেলে সাহিত্যই মহিমান্বিত হয়। পরিণত সাহিত্য তাই খুবই জরুরী। তবে তাই বলে যে কিশোর সাহিত্যকে অবহেলা করতে হবে, এমন তো কথা নেই।

সাহিত্যের কাজ মূলত দু’টি – অভ্যস্ত জীবনের বাস্তবতাগুলো তুলে ধরা, নয়তো কল্পণার কোন জীবনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। অধিকাংশ সাহিত্যিকই কল্পণার রাজ্য নিয়ে লেখেন। দুই বাংলা মিলিয়ে যেই উপন্যাসগুলো সবচেয়ে বেশি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, তার সবগুলোই লেখকের নিজের জীবন নিয়ে, অথবা নিজের জীবন থেকে লেখা। বড়দের লেখায় এটি আর দেখা যায় না। সবাই কল্পিত ঘটনা নিয়ে লেখেন। একলা ঘরে একটি নারী কার কথা ভাবে, নিঃসঙ্গ পুরুষ কীভাবে পরনারীতে স্বস্তি খোঁজে, ইত্যাদি বালছাল লেখায় ভরা চারদিক। এই সব প্যানপ্যানে ঘটনার চেয়ে প্রথম কৈশোরের কুকর্মগুলো অনেক উপাদেয় ছিল। স্কুল পালানো, পড়শি মেয়ের দিকে চোখ মারা, রগরগে নীল ছবি দেখা, নিষিদ্ধ বিনোদন, ইত্যাদি নিয়ে অকপটে লিখলে লেখকের সুশীলতা অক্ষুণ্ন থাকে না। কিশোর সাহিত্য অবহেলিত হওয়ার পেছনে হয়তো এটা অন্যতম কারণ।

খোলামেলা লেখার দায়ে ‘সেবা’ প্রকাশনীর বই পড়তে হলে মায়ের কাছ থেকে অনেক ভাবে লুকাতে হত। প্রকাশ্যে পড়ার মত বলতে ছিল সত্যজিৎ রায় আর শাহরিয়ার কবিরের লেখা বই। স্কাউটিং, প্রবাস ভ্রমণ, উঠতি বয়সের কুসুম কুসুম প্রেম, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, ইত্যাদি নিয়ে জানতে পারতাম শাহরিয়ার কবিরের বই খুললে। এভাবে কেটেছে আমার প্রথম কৈশোর। সে-সময়ের খুব প্রিয় বইগুলোর একটি ছিল ‘নিকোলাস রোজারিওর ছেলেরা’।

নিজে মিশনারি স্কুলে পড়েছি, তাই বাড়তি আকর্ষণ ছিল বইটির প্রতি। মন যেন হারিয়ে গিয়েছিল সমবয়সী একদল কিশোরের মাঝে। কেউ বাড়ি থেকে অনুমতি পাচ্ছে না, কেউ চাঁদার টাকা জোগাড় করতে পারছে না, কেউ অন্যের ছায়া থেকে বের হয়ে আসতে ছটফট করছে। বুক ভারি হয়ে যেত গল্পের চরিত্রগুলোর কচি সংগ্রামে। হায় সে কী উৎকণ্ঠা!

সম্ভবত সেখানেই পড়েছিলাম, গল্পের কোন এক বখাটে বড় ভাই বছরের পর বছর ধরে স্কাউটিং ক্যাম্পে ‘খরবায়ু বয় বেগে’ গেয়ে যেত। তখন পর্যন্ত শুধু গানটির দু’লাইন জানতাম। বই পড়েই খুঁজে-পেতে পুরো গান শুনেছিলাম। শাহরিয়ার কবিরের বই পড়ার অনুভূতিগুলো যেন সেই থেকেই আটকে গেছে ‘খরবায়ু বয় বেগে’র মধ্যে।

প্রথমে মনে পড়ে ‘নিকোলাস রোজারিওর ছেলেরা’র কথা। এরপর একে একে মনে পড়ে যায় নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়, পাথারিয়ার সোনার খনি, কার্পেথিয়ানের কালো গোলাপ, বার্চবনে ঝড়, সীমান্তে সংঘাত, অনীকের জন্য ভালবাসা, লুসাই পাহাড়ের শয়তান, ব্যাভারিয়ার রহস্যময় দুর্গ, হানাবাড়ির রহস্য।

সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, ইত্যাদি নিয়ে অনেক তর্ক চলে বড়দের মহলে। খুব বড় একটা ব্যাপার ভুলে যায় সবাই। মানুষের মনন স্থায়ী রূপ নিয়ে ফেলে তার কৈশোরে। শত চেষ্টায়ও এরপর আর তার চিন্তা-চেতনার পরিবর্তণ সম্ভব না। বিশ্বাসের মধ্যাকর্ষণের কাছে জ্ঞানের বহুমুখী বিস্তার মার খেয়ে যায়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তণ, রাজসভায় মিছিল-সমাবেশ, বা মিডিয়ায় জ্ঞানগর্ভ আলোচনা কৈশোরোত্তীর্ণ মানুষের মনের উপর খুব কমই প্রভাব রাখতে পারে।

উঠতি প্রজন্মের কাছে কৈশোরের মৌলিক কিছু অনুভূতি তুলে ধরেছিলেন সত্যজিৎ রায়, শাহরিয়ার কবির, আর মুহম্মদ জাফর ইকবালের মত লেখকেরা। অধীর আগ্রহে তাঁদের নতুন বইয়ের অপেক্ষা, আর বই এলেই গোগ্রাসে গিলে ফেলার সেই সময়টা মনে আটকে আছে ‘খরবায়ু বয় বেগে’র মাঝে। কৈশোরের দ্বন্দ্ব আর ভয়গুলোর শৃঙ্খল বারবার ঝনঝন করে ওঠে এই একটি গানে। নিজের মনে প্রশ্ন জাগে, কতটুকু আসতে পেরেছি সেই দিনগুলো থেকে। স্বপ্নগুলো স্বপ্নই থেকে গেল। কান পাতলেই ঝন, ঝন, ঝন।

No comments: