০. ভূমিকা
জীবনের গতিময়তা, আকস্মিকতা, আর গভীরতার সাথে সবাই কমবেশি পরিচিত। বহুবার চেষ্টা করেও জীবনকে থামাতে বা ফেরাতে পারিনি। অথচ সেই জীবন যেন নিজে থেকে এসে আটকা পড়েছে কিছু গানের মাঝে। স্মৃতির স্ফটিক হয়ে যাওয়া জীবনের ভগ্নাংশগুলো খুব বেশি জীবন্ত হয়ে ফিরে আসে সেই গানগুলোর সাথে সাথে। কিছু গান, আর তার মাঝে আটকা পড়া জীবন নিয়েই এই প্রলাপ-সিরিজ।
১. সে যে বসে আছে একা একা
সবেমাত্র নিজের একটা ঘর পেয়েছি তখন। আমেরিকা এসেছি প্রায় ৬ সপ্তাহ হয়ে গেছে। প্রথম ক'দিন খুব বাজে কেটেছিল। প্রথম যে-বাসায় উঠলাম, সেখান থেকে তিন দিনের মাথায় বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। বিচিত্র এক অভিজ্ঞতা ছিল সেই ক'দিন। জেটল্যাগে মারা যাচ্ছি এমন সময় সাত-সকালে উঠিয়ে দিয়ে বাড়ির মালিক বললেন, আমি বাইরে যাবো, তুমি বের হও বাসা থেকে। সেই দিনটা কাটলো পার্কের বেঞ্চে বসে। সে-বাসার একটা ঘর খালি ছিল, তবু সেখানে ঢোকা বা শোয়া বারণ। যাঁর ঘর, তিনি দূর থেকেই মানা করে দিয়েছেন ফোন করে। উঠেছিলাম অস্থায়ী ভাবে, তবু তিন দিনের মাথায় বলে দেওয়া হল লিভিং রুমে শাওয়ার কার্টেইন টাঙিয়ে থাকার কথা। শর্ত মানলে এক-তৃতীয়াংশ ভাড়া দিয়ে থেকে যাওয়া, না মানলে সে-রাতেই অন্যত্র জায়গা খোঁজা। বের হয়ে গিয়েছিলাম।
হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম পথে পথে। জানুয়ারির সকাল। কী প্রচণ্ড শীত। দু'হাতের গিঁটের চামড়া ফেটে রক্ত ঝরছে শীতের প্রকোপে। এরই মাঝে আরেক স্বদেশী উদ্ধার করলেন। নিয়ে গেলেন তাঁর বাসায়। থাকতে দিলেন দু'সপ্তাহ। সে-বাসায় শোওয়ার ঘর তিনটি, কিন্তু মানুষ থাকে মাত্র সাতজন। এক বাঙালি নিজের ঘরে, বাকি দুই ঘর মিলিয়ে ছয় নেপালি। একটা ঘরে বিশাল উঁচু এক বিছানা। পথে-ঘাটে যত ম্যাট্রেস ফেলে রাখা ছিল, তার সব কুড়িয়ে এনে স্তুপ করা হয়েছে সেই ঘরে। ফলাফল, প্রায় চার ফুট উঁচু বিছানা। সেই ঘরে থাকতো দুই জন।
অন্যঘরটি আয়তনে বড়, সাথে লাগোয়া বাথ, ড্রেসিং। সে-ঘরে থাকতো চারজন। কোন আসবাব নেই। এক কোণায় কিছু বই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। চাদর পেতে বিছানা বানানো। একজন ঘুমিয়ে উঠে গেলে আরেকজন এসে ঘুমায়। খুব একটা অর্থকষ্টের কারণে যে এই ব্যবস্থা, তাও না। তবু অবাক হয়ে ভাবছিলাম, দু'জন বাঙালিকে আজ পর্যন্ত এক ঘরে থাকতে দেখলাম না। নিজের একটা ঘরের মূল্য আমাদের কাছে অপরিমেয়। অথচ মুদ্রার অন্য পিঠে একই এলাকা থেকে উঠে আসা এই ছাত্রেরা।
চার সপ্তাহ পর এক অ্যাপার্টমেন্টে একটা ঘর খালি হল। উঠলাম সেখানে। নিজের ঘর। বিছানা হিসেবে ব্যবহারের জন্য আমিও একটা ম্যাট্রেস কুড়িয়ে নিলাম। সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম ৩৫০০ ডলার। স্কলারশিপের পরও নিজের পকেট থেকে হাজার তিনেক টাকা দিতে হত বিশ্ববিদ্যালয়কে। বাকি টাকা থেকে ৪০০ ডলার দিয়ে একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার কিনলাম। বাধ্য হয়েই কিনতে হল। ঠান্ডা বয়ে দু'মাইল হেঁটে লাইব্রেরিতে যেতে পারি না। সেই কম্পিউটার রাখবার জন্য টেবিলের প্রয়োজন। ওয়ালমার্ট থেকে বিশাল একটা টেবিল কিনলাম। অল-পার্পাস টেবিল হিসেবে ব্যবহারের জন্য। সেই দিন থেকে ৪ বছর ধরে লেখাপড়া, খাওয়াদাওয়া, কাপড় ইস্ত্রি করা, ইত্যাদি সব কাজই করেছি ৫৮ ডলারে কেনা সেই টেবিলে। আজকে আমি ভার্জিনিয়া, লুইজিয়ানায় সেই টেবিল আজও আছে।
রাত জেগে নাট-বল্টু লাগাচ্ছিলাম সেই টেবিলের। শ্রান্ত হয়ে বিরতি নিয়েছিলাম একটু। এক বন্ধু বললো, নতুন একটা গান শুনে দেখতে। অর্ণবের "সে যে বসে আছে" সেই প্রথমবারের মত শুনলাম। কোথায় যেন একটা মোঁচড় লাগলো। একটা কোণায় গিয়ে পা ছড়িয়ে বসলাম। দেওয়ালে হেলান দিয়ে পুরো রাত কাটিয়ে দিলাম গানটা শুনতে শুনতে।
এইতো সেদিন ওয়াশিংটন ডিসি গিয়েছিলাম অর্ণবের কনসার্ট দেখতে। শেষদিকে যখন সবাই গলা মিলিয়ে গাইছে, তখন আমি আনমনে ফিরে গেছি আমার সেই প্রথম দিকের দিনগুলোয়। সেই দিনের প্রতিটা অনুভূতি যেন অনেক বেশি জীবন্ত হয়ে ফিরে এসেছিল গানটার সাথে। শত মানুষের মাঝেও যেন একা একা বসে ছিলাম, রঙিন স্বপ্ন বুনছিলাম, জানালার পাশে বসে মেঘ গুনছিলাম। ঘাড় ফেরালেই জীর্ণ বিছানা, হাত বাড়ালেই কোণায় পড়ে থাকা ওটমিল বিস্কুট।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment