সপ্তাহ খানেক আগের কথা। পুরুষ দেহের সবচেয়ে ঘাউড়া অঙ্গের সাথে ঘন্টা কয়েক সময় কাটালাম একান্তে। প্রবাসে একলা আছি অনেক দিন। মনের ক্ষুধাগুলো কোন ভাবে চেপে রাখা গেলেও দেহের ক্ষুধাকে খুব বেশি দিন চেপে রাখা যায় না। হাতে কাড়ি কাড়ি ডলার থাকলে কোন চিন্তা নেই, কিন্তু আমার মত হতদরিদ্র ছাত্র হলেই বিপত্তি। কপাল ভাল থাকলে হয়তো একই ঝাঁকের আর কোন পাখি মিলে যেতে পারে। যাদের সেই ভাগ্যও নেই, তাদের ‘আপনা হাত জগন্নাথ’। আমি শেষ দলের মানুষ।
প্রথম চিন্তাই ছিল, কোন হাত? দীর্ঘদিনের অনভ্যাসজনিত কারণে ভ্যাবলার মত তাকিয়ে ছিলাম দুই হাতের দিকেই। কিছুক্ষণ হাওয়ায় হাত মকশো করলাম। অনেকটা শ্যাডো প্র্যাকটিসের ঢঙ্গে। নাহ, তবু মনে পড়ে না। অগত্যা বাধ্য হলাম সীমিত আকারে অডিশন দিতে। মানুষ আমি ডানহাতী। প্রত্যাশিত ভাবেই ডান হাত হল ব্যাটম্যান, আর হতভাগা বাম হাত হল রবিন।
অধম এই আমি ইবলিশ হলেও মোনাফেক নই। ইবলিশের আদর্শ অনুসরণ করে আমি ভাল-মন্দ নির্বিশেষে সব কাজ করি বিসমিল্লাহ বলে। ব্যতিক্রম হল না এবারও। বাড়ন্ত প্রত্যাশা, শুকনো কাপড়, আর এক রোল টয়লেট পেপারসহ ঢুকে পড়লাম বৃন্দাবনে। রুমমেটের সাথে চোখাচোখি হয়ে গিয়েছিল মাঝপথে। চোখ টিপে বললাম, হে বন্ধু, বিদায়। বাচ্চা ছেলে। ভদ্রতা করে হাসি চেপে শুধু বললো, বেস্ট অফ লাক, ব্রাদার! জবাবে বললাম, বিসমিল্লাহ বলে নিয়েছি, রাখে আল্লাহ মারে কে?
আমার যুদ্ধক্ষেত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল। দেহ থেকে সুতা খসে গেল, হাতের নাগালের সবটুকু জায়গা ঢেকে দেওয়া হল টয়লেট পেপারে। দুস্থ, রুক্ষ, আগাছামণ্ডিত চেহারাটা আয়নায় দেখলাম কিছুক্ষণ। নাহ, বেসিনের উপরের ছোট আয়নায় পোষাচ্ছে না। বিব্রতকর অবস্থায় যাবার আগেই খেয়াল হয়েছিল, ভাগ্যিস। দৌঁড়ে ঘরে গেলাম, টেনে নিয়ে আসলাম ঢাউশ আয়নাটা। এবার হয়েছে। দৃষ্টিসুখ যেন সৃষ্টিসুখ। আগডুম-বাগডুম ভাবতে ভাবতে দাঁড়ালাম আয়নার সামনে। এবার খেলা ভাঙার খেলা।
চলছিল ভালই। তবে কিছুদূর এগিয়ে মনে হল, একটু ভিজিয়ে নিলে মন্দ হত না। নয়তো বলি এক, করে আরেক। আলতো করে হাত বুলিয়ে একদিকে আনার বেলায় ঠিক আছে, কিন্তু স্বাভাবিকের চেয়ে একটু ভিন্ন কোন অবস্থানে নিতে গেলেই তিড়িং করে আরেক দিকে চলে যায়। এতক্ষণ কাজের কাজ তো হলই না, উলটা ধস্তাধস্তি করেই ঘেমে গেলাম পুরো। ভিজিয়ে নেবার পর দুঃসময়ের সঙ্গী হিসেবে এগিয়ে এল টয়লেট পেপারগুলো। প্রায় আধ ঘন্টা পর দেখা গেল এক ঘর টিস্যুর মধ্যে বসে আছি ক্লান্ত আমি। বড় বড় শ্বাস পড়ছে সশব্দে, অসম্পূর্ণ কাজের বিরক্তিকর নিদর্শন ছড়িয়ে আছে আশেপাশে। মনের ভেতর একটা কণ্ঠ বলছে বাদ দিতে। সবার জন্য সব না। পরে কোনদিন হবে নাহয়। সাথে সাথেই অন্য অংশ প্রতিবাদ করে উঠলো। না, পারতে হবে। এত আয়োজন তো সবদিন হয় না। এক রুমমেট বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি, আরেকজনকে দিয়ে বৃন্দাবনের কাজ সারিয়েছি আগেই। এই কষ্ট বৃথা যেতে দেওয়া যায় না।
যুদ্ধজয়ের প্রথম শর্ত মানচিত্রজ্ঞান। ভেবে বুঝলাম, মানচিত্রজ্ঞানের অভাবই আমার দুরবস্থার কারণ। মাঝপথে কিছুটা স্কাউটিং সেরে নিলাম। যুদ্ধক্ষেত্রটা অনেকটা বটগাছের মত। গোড়ার দিকে শক্ত মাটিতে শেকড় ছড়িয়ে আছে। চাইলেও তাকে তৎক্ষণাৎ ঘায়েল করা আমার কম্মো না। যদি কখনও আগ্রাসী ও আগ্রহী কোন সুন্দরীর সান্নিধ্য পাই, তাহলে তাকে দিয়েই করিয়ে নিতে হবে।
মূলের সাথে লেগে থাকা কাণ্ডটাই সবচেয়ে বেয়াড়া। পিছলে যায়, ফসকে যায়। চাপাচাপি করে তবুও কিছুটা সামাল দেওয়া যায়। আপোষের সাথেই কাজ এগিয়ে নিলাম। বটের মতই দু’পাশ বেয়ে ঝুল নেমে আছে কিছু। আর বাকি আছে গাছের আগার সাথে সম্মুখ-সমর। ঝুলগুলো একেবারেই নিরীহ। এরা দৃষ্টিসীমায় থাকলেও বৃষ্টিসীমায় থাকে না। এদের ছেড়ে গেলেও চলতো, তবু লেগে গেলাম। করবো যখন, ঠিকমতই করি। এমনিতেই মাসে একবার এমন সুবর্ণ সুযোগ মেলে।
যেমনটা বলছিলাম, আসল যুদ্ধ গাছের আগায়। ঝুলে হাত পড়তেই ফোঁস করে উঠলো সেটা। আমিও তাই বলে ছেড়ে দেবার পাত্র না। কৌশলটা কঠিন না তেমন একটা। শক্ত মুঠি করতে হয় শুরুতে। পিছলে যেতে চায়। চাবেই তো। মানবদেহের সব অনুষঙ্গেরই নিজস্ব প্রাণ আছে। শক্ত করে ধরতে হয়। গোড়া শক্ত না হলে আগার পরিচর্যা হবে কীভাবে? চলছে আমার কাজ। শরীর ভার হয়ে ছিল, একটু একটু করে হালকা হচ্ছি। আহা, কী আরাম। ছিলাম টম ক্রুজ, হয়ে যাচ্ছি ড্যানিয়েল ক্রেগ। ছন্দে ছন্দে হাত দু’টো দুলছে। আমি মুগ্ধ চোখে নিজেকে দেখছি জোড়া আয়নায়। এমন সময় ঠক্-ঠক্-ঠক্। ভাইয়া, আন্টি তোমার খোঁজ করছে।
আমার মা চিরদিনই কিছুটা বেরসিক। তারচেয়েও বাজে তার সময়জ্ঞান। আমি কোন কুকাজে রত হলেই আমাকে তার মনে পড়তে হবে। বইয়ের ভাজে বই নিয়ে কাঁথার নিচে ঢুকতে গেলেই আচমকা উদয় হয়ে বলে, টেবিলে বসে পড় বাবা, আমি গরম দুধ এনে দেই। জমানো টাকায় মোড়ের ভিডিও গেমের দোকানে যেতে গেলে বলে, মসজিদে যাও, সাথে খুচরা টাকা থাকলে দান-খয়রাত কোর। দশ মিনিট ধরে হেয়ার-জেল লাগিয়ে বের হওয়ামাত্র মাথায় এক আজলা পানি ঢেলে দিয়ে বলে, জমজমের পানি এটা, একটু দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দেই, মাথা ঠান্ডা হবে। অতএব, এ-রকম সময়ে আমার মায়ের আমাকে মনে পড়তেই হল।
আমিও এ-যুগের ছেলে। জননীর চেয়ে মান-ইজ্জত বড়। তারচেয়েও বড় ব্যক্তিগত বিলাস। অতএব, রুমমেটকে বলে দিলাম মাকে অপেক্ষা করতে বলতে। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন। এক হাত ধুয়ে, দরজার ফাঁক দিয়ে ফোন নিলাম। শীতের ভোরের মত প্রশান্ত আর শরতের মেঘের মত ভেসে যাওয়া একটা কণ্ঠে বললাম, হুম। মা অবাক হল এই আনন্দে। এ-আনন্দের স্বাদ আমার পাবার কথা না। একটু উদ্বিগ্ন হয়েই প্রশ্ন, কী করছো?
এজবাস্টনের টাই ম্যাচে ফিফটি করার পরের স্টিভ ওয়াহ’র মত চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, একা একা চুল কেটে সারলাম, কী যে শান্তি!
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment