Tuesday, December 30, 2008

গানবন্দী জীবনঃ আশিক-প্রিয়া

৫. আমি আশিক, তুমি প্রিয়া
বাংলা চলচ্চিত্রের গানের মত ‘গিলটি প্লেজার’ খুব কম আছে। আড়াল পেলে সবাইই কম-বেশি গুনগুন করলেও প্রকাশ্যে কেউ স্বীকার করতে চান না যে তাঁরা বাংলা চলচ্চিত্রের গান শোনেন। আমি নিজেও ব্যতিক্রম নই। মনে পড়ে, এন্ড্রু কিশোর একবার ইত্যাদি’তে আফসোস করে বলেছিলেন মধ্যবিত্তের বৈঠকখানায় তাঁর গান ঢুকতে না পারার কথা। এর পেছনে যেই ছ্যুৎমার্গ কাজ করে, আমিও তার ঊর্ধ্বে নই।

শক্তি ও পূর্ণতার কার্যকর কিছু নিরূপকের একটি হল দুর্বলের প্রতি উদারতা। একটি দেশ যত শক্তিমান, তার আইন সংখ্যালঘুদের প্রতি তত বন্ধুত্বপূর্ণ। একজন মানুষ যত বলিয়ান, তিনি ভিন্ন মত ও পথের মানুষের প্রতি তত সহনশীল। বাংলা সিনেমার গানের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি তেমনই।

আমি গাইতে জানি না, নাচের মুদ্রা বুঝি না, অভিব্যক্তি দিয়ে মন হরণ করতে পারি না, দুই অনুচ্ছেদের একটি অণুগল্পও লিখতে পারি না। তবু সমালোচনার খড়্গ হাতে উঠতে সেকেন্ড খানেক সময়ও লাগে না। বাংলা চলচ্চিত্র খুব দুস্থ ও দুর্বল, কিন্তু তার প্রতি আমার এক ধরণের অন্ধ আক্রোশের কিছুটা হয়তো আমারই ক্ষুদ্রতা থেকে উৎসারিত।

বয়সের সাথে সাথে খুব কম মানুষকেই দেখেছি এই সংকীর্ণতা থেকে বের হয়ে আসতে। ভেঙেছে পিঞ্জর, পড়ে না চোখের পলক, দুই দিনেরই এক জেল, একদিন স্বপ্নের দিন, মন চায়, কিংবা আমার মাঝে নেই আমি এখন এ-যুগেরই বাংলা চলচ্চিত্রের গান। এগুলো গুনগুন করে গেয়েছি সবাই। হাল আমলে ক্লোজআপ-ওয়ান আসার আগ পর্যন্ত গানগুলো সেভাবে সামনে আসেনি। চিরকাল ধরে ঢালাও গালি দিয়ে যাওয়া এই আমিও এখন মানতে বাধ্য হই যে আমাদেরই অবহেলার কারণে পরিস্থিতি আজ এত বেশি খারাপ।

এই উপলব্ধিগুলো অনেক বড় বয়সের। মানুষ যতই শিক্ষিত ও পরিমার্জিত হোক না কেন, কিছু মৌলিক প্রণোদনা তার মাঝে কাজ করেই। ভাড়ের ডিগবাজি, ভূতের হাসি, নায়িকার ইঙ্গিতপূর্ণ চাহনি, ইত্যাদি সব বয়স ও মতের মানুষকেই টানে। আর টানে গান। কেউ স্বীকার করি, আর কেউ করি না। এখানেই যেটুকু তফাৎ।

বহুকাল আগের কথা। ছোট ভাইকে ওয়াই-ডব্লিউ-সি-এ স্কুলে দিয়ে আসার সময় বছর ছয়েকের একটি ছেলেকে গান গাইতে দেখেছিলাম এক সকালে। বিদ্যাবিভীষিকায় কাতর হয়ে সবাই কাঁদছে স্কুলে ঢোকার আগে। এরই মাঝে ছেলেটি সবাইকে ঠেলে এগিয়ে আসছিল উদ্দাম গতিতে। পেছন পেছন ছুটছে বাবা-মা। তাঁদের চোখে-মুখে লজ্জা। ব্যাগের স্ট্র্যাপ দু’হাতে ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে ছেলেটি গান গাইছে – আমি আশিক, তুমি প্রিয়া। সাথে আরেক গানের লাইন মিলিয়ে দু’জন দু’জনার কত যে আপন, কেউ জানে না! আর একটু পরপর তারস্বরে তুমি প্রিয়া, তুমি প্রিয়া, তুমি প্রিয়া।

গানটি শিশুমনকে ছুঁয়েছিল। সকালে স্কুল যাবার আনন্দে ছেলেটি গান গাইছিল। আশিক-প্রিয়ার জটিলতার ধার দিয়েও না গিয়ে স্রেফ মনের আনন্দে গান গাইছিল। কত সহজ, কত সাধারণ। আমাদের যে কেন বড় হলেই সব কিছু পেঁচিয়ে ফেলতে হয়।

ছেলেটির সাথে গলা মেলানোর ইচ্ছে ছিল খুব। গান পছন্দ করে নয়, শুধু মুহূর্তটি উপভোগ করার জন্য। পারিনি। মনে হয় না চোখের সামনে এমন দৃশ্য দ্বিতীয়বার দেখার সুযোগ পেলেও পারবো। সংকোচের শৃঙ্খলেই আটকে থাকলো সব।

No comments: