দুই ছেলেকে নিয়ে আমাদের মায়ের পরিকল্পণাগুলো অনেক দূরপ্রসারী ছিল। ছোট ভাইটি আমার চেয়ে প্রায় সাড়ে চার বছরের ছোট। তখনও তার কেঁদে-কেটে স্কুলে যাওয়ার বয়স। আমি পড়ি চতুর্থ কি পঞ্চম শ্রেণিতে। ভাইকে নিয়ে তখনও তেমন নির্দিষ্ট পরিকল্পণা না থাকলেও আমার বেলায় ছিল। মায়ের ইচ্ছা ছিল আমাকে নানা-দাদার মত ডাক্তার বানাবে। শুধু ভাবলেই হল না। ডাক্তারি শেখা অনেক কঠিন ব্যাপার। আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
যেমন চিন্তা, তেমন কাজ। ব্যাঙ-কেঁচো-তেলাপোকার ছবি আঁকার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে আমাদের দুই ভাইকে ভর্তি করা হল ছবি আঁকার স্কুলে। বড় বোর্ড, হরেক রকম পেনসিল, আর গোল করে পাকানো আর্ট পেপার নিয়ে আমরা দুই ভাই প্রতি সপ্তাহে আর্ট স্কুলে যেতাম। গান বা ছবির প্রতি অনুরাগ নয়, বরং বিকেলে ঘর থেকে বের হতে পারাই ছিল মূল আকর্ষণ।
কাঁচা বয়সে কারও উপর কিছু চাপিয়ে দিতে নেই। বিশেষ করে নান্দনিক ব্যাপারে। আমাদের শিক্ষক এ-ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। তিনি প্রথম দিন ক্লাসে এসেই বললেন “ফ্রি হ্যান্ড ড্রয়িং” করতে। লোকজনের দেখাদেখি নৌকা আঁকলাম, নদীর পাড়ের কুড়েঘর আঁকলাম, বাড়ির পেছনে কলা গাছের পাতা আঁকলাম, আর আঁকলাম মেঘ এবং পাখি। এই একই ছবি এঁকে চললাম প্রায় দু’তিন মাস। শিক্ষক মহাশয়ও “ফ্রি হ্যান্ড ড্রয়িং”এর বাইরে কিছু করান না, আমিও নতুন কিছু আঁকতে পারি না।
ছবি আঁকা এবং গান গাওয়া, এই দু’টি গুণ একেবারেই নেই দেখে এই দিকের শিল্পীদের অনেক শ্রদ্ধার চোখে দেখি আমি। হাজারো ফাঁকিবাজি সত্বেও সেই শিক্ষক তাই আমার পরম আরাধ্য ছিলেন। এমনিতেও গল্প বেশি, পড়া কম ধরণের শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের প্রিয় হন। ভূতের গলি মসজিদের সামনের ময়লার ডিপো কিংবা ঝড়-বাদলায় ড্রয়িং বোর্ডকে ছাতা হিসেবে ব্যবহার করতে হওয়া তাই গায়ে মাখতাম না। কিছু না পড়ালেও অভিভাবকদের তুষ্ট রাখতে আমাদের ঠিক দেড় ঘন্টা আটকে রাখা হত সেই স্কুলে। দেড় ঘন্টার আড্ডা আর ঘর-বাড়ি আঁকা মন্দ লাগতো না।
এক বিকেলে গিয়ে দেখি ক্লাস ফাঁকা। স্যারের মুখেও কেমন যেন অন্য রকম রোশনাই। আয়োজন করে বসতে না বসতেই বললেন, আজ ছুটি। ছাত্র-অভিভাবক নির্বিশেষে সবাই আনন্দে বাড়ি ফিরে যাওয়া শুরু করলো। বুঝে গেলাম, সবাই এমন কিছু জানে যা আমার অজানা। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম ছুটির কারণ। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে স্যার বললেন, আজকে মিস লংকা!
ঘরে ফেরার পথে খেয়াল করলাম, পথ-ঘাটে মানুষ অস্বাভাবিক রকম কম। বাসায় এসে দেখি সবাই টিভির সামনে বসে আছে অসীম আগ্রহে। সেখানেই মিস লংকার সাথে পরিচয় আমার। ‘এসব মানুষে দেখে?’ জাতীয় একটা মুখ করে ঠিকই সোফার এক কোণে বসে পড়লাম। বাকিটা ইতিহাস। চা-বাগানে ববিতা দৌঁড়াচ্ছে, পেছন পেছন ছুটছে নায়ক। মূক-বধির নায়িকাকে ফুসলাতে গাইছে – চুরি করেছ আমার মনটা, হায়রে হায় মিস লংকা! নায়িকার অসম্মতি ও আনুষাঙ্গিক নানাবিধ নাটকীয় বালা-মুসিবত অতিক্রম করে নায়ক বাধ্য হয়েই পিতার পছন্দে বিয়ে করলো। দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে বাসর ঘরে ঢুকতেই কোমর দুলিয়ে কিন্নরকণ্ঠী লাল-টুকটুক বৌ গেয়ে উঠলো সেই গান। মনের খবর হায় ছিল না জানা, তোমার বাড়িটাই ছিল না চেনা, লগ্ন এলো এত দিন পরে, হাসি মেলে চেয়ে দেখো না! অন্তরে আজ বাজে ডংকা, হায় রে হায় মিস লংকা। আহা, শেষে এসে মনে কী শান্তি!
ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া এই গানটি পথ-ঘাটে শুনলেই সেই দিনটায় ফিরে যায় মন। ডাস্টবিনের গন্ধ, পঁচা-গলা পানি, আর ঝিরঝির বৃষ্টি উপেক্ষা করে মিস লংকার কাছে যাওয়ার তাড়না। স্থির হয়ে বসে থেকেও মনে মনে নেচে ওঠা। সেই সময়গুলোয়, যখন অধমের চিত্রাঙ্কনের গুণেই কিনা জানি না, দুই দুইটি আর্ট স্কুল ব্যবসা গুটিয়েছিল ভূতের গলি এলাকায়।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment