৫. স্টেট-এল্ডার বনাম পার্টি-এল্ডার
নিজেকে আমি মূলধারার বাঙালিদের একজন বলেই মনে করি। সরকারী চাকুরে বাবার মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম, বাংলা মাধ্যমের স্কুল-কলেজে পড়ে বড় হওয়া, বাটা স্যান্ডেল পায়ে ঘোরা, সন্ধ্যা হলে বিটিভি দেখে বিনোদনের চাহিদা মেটানো, স্বরলিপি না জানলেও নিয়মিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা, এই ছিল জীবনধারা। অনেকটা আচমকাই প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে চলে আসি ২০০৪-এ। আমেরিকা আসার পর দিনগুলো কেটেছে খুব কষ্টে। দক্ষিণের কৃষ্ণাঙ্গঅধ্যুষিত এলাকায় খুব কাছ থেকে দেখেছি মূলধারার আমেরিকাকেও। মিলগুলো অবাক করে, তফাৎগুলো ভাবায়।
দেশে চাকরি খুঁজতে গেলে তদবির করাটাই যথেষ্ট ছিল। মামা নেই তো শুকতলি খয়ে যাবে, ছিঁড়ে যাবে জামা। এখানেও অনেকটাই তাই, তবে সাথে রেজুমে নামক বিচিত্র একটা কাগজ দিতে হয়। দেশে চাকরির জন্যও লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়, এদিকে ক্যারিয়ার সার্ভিস নয়তো স্বদেশী বড় ভাই, নয়তো স্কুলের কোন অ্যালামনাই কানেকশন লাগে। স্রেফ নিজের যোগ্যতায়ও চাকরি জোটে প্রচুর। রিলিজিয়াসলি খুঁজলে নাকি অগতিরও গতি হয়ে যায়। তবে ব্যাপারটা তামাশার পর্যায়ে চলে যেতে দেখেছি এক পাকিস্তানি-চাইনিজ দম্পতির খাবারের দোকানে কামলা খাটার জন্য রেজুমে দিতে হওয়ায়। ভ্যাবলা বনে গিয়েছিলাম পুরো, কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম এর ভাল দিকও আছে। খুচরা ব্যাপারেও এদেশে খুব মেথোডিক্যাল সবকিছু। মূল কথাটা খুব সাধারণ, ইফ ইট এইন্ট ব্রোকেন, ডোন্ট ফিক্স ইট।
বিশাল আরেক তফাৎ দেখি বাচ্চা-কাচ্চা বড় করার বেলায়। আমার মা আজও হাজিরা নেয় প্রতি রাতে। বিস্তারিত বিবরণে জানাতে হয় চুলার আগুন থেকে খাবারের মেনু পর্যন্ত সবকিছু। অথচ গোরা বাবা-মায়েরা তিন দিনের বাচ্চাকেও আলাদা বিছানায় ঘুম পাড়ায়। এক কালে ভাবতাম এদের দিল’এ কোন রহম নাই। চামড়ার খায়েশ পুরো হয় না বাচ্চা কাছে থাকলে। স্বাধীন ভাবে গড়ে তোলার নামে বিযুক্ত পরিবার তৈরি করছে অযথা। এমনি এমনি তো ছেলেপুলে বুড়ো বাপ-মাকে ফেলে যায় না বুড়ো বয়সে। আমাদের প্রথাগুলো কত ভাল। কেউ স্বার্থপর না, প্রতিদিনই বাবা- বা মা-দিবস এখানে।
মুক্তমনার দেশ, উন্মুক্ত যৌনাচারের দেশ, সমকামী বিবাহের দেশ, ইত্যাদি অনেক সুনাম আছে আমেরিকার। বাইরের দুনিয়া যা ভাবে ভাবুক না কেন, মূলধারার পশ্চিম অনেক বেশি রক্ষণাত্মক। সমাজ ও রাজনীতিসংশ্লিষ্ট কিছু ব্যাপারে খুবই সনাতন এরা। সেই দিকে আলোকপাত করতেই পূর্ব-পশ্চিমের কিছু পার্থক্যের কথা বলা। লালন-পালনের প্রথার পার্থক্যগুলো এদেশের মানুষকে গড়ে তোলে অনেক স্বাধীন করে, যার প্রভাব দেখা যায় প্রায়োগিক দিকগুলোয়।
প্রাচ্যে আইন রচিত হয় বিধিনিষেধ দিয়ে। এই বেলা এটা করা যাবে তো ঐ বেলা সেটা করা যাবে না, এর সামনে দিয়ে হাঁটলে জুতা খুলতে হবে তো ওর হুকুমের অন্যথা করা যাবে না, শ্রাবণে এটা খাওয়া যাবে তো পৌষে ওটা বলা যাবে না। ঔপনিবেশিকতাকে খুব সহজেই দায়ী করা যায় এই অবস্থার জন্য। ব্রিটিশ রাজের উদ্দেশ্য ছিল শুধু ভারতবাসীকে শৃঙ্খলার নামে নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে শোষন করা। আইন প্রণয়নের পেছনে মুখ্য তাগিদ ছিল কনভিনিয়েন্স, এনলাইটেনমেন্ট নয়। সে-কারণেই ধর্মযাজকের লেবাস ধরে আসা ফিরিঙ্গিরা প্রথম দিকে ভারতবাসীর জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষাকে পাথেয় করেছিল, অথচ অতিশিক্ষায় সচেতন হয়ে যাবার পর এই শিক্ষাই হয়ে দাঁড়ায় বড় পাপ। আমরা এর ফলে খুব একটা দুঃখিত বোধ করিনি কখনই, কারণ ইংরেজপূর্ব আমলের অবস্থাও খুব একটা ভিন্ন ছিল না। পাল-সেন থেকে মুঘল আমল পর্যন্ত কর্তার ইচ্ছাই ছিল আইন। আইন প্রণয়নের জন্য যে আলোকিত মানুষ হতে হয়, এই ধারণার সাথেই আমাদের পরিচয় ছিল না কোন কালে।
পশ্চিমের দেশগুলোয় একেক রকম মূলনীতি কাজ করেছে আইন প্রণয়নের পেছনে। আগে এসেছে নীতি, পরে এসেছে সেই নীতির আলোকে আইন প্রণয়ন। ফ্রান্স বেছে নিয়েছে স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব, ও প্রগতি। ব্রিটেন বেছে নিয়েছে অনির্ধারিত, অলিখিত আইনের রীতি, যা সমাজবর্জিত না হবার বিশ্বাসের বন্ধনে আবদ্ধ। আমেরিকা পুরো পৃথিবীকে পথ দেখিয়ে গেছে মাত্র দুই পৃষ্ঠায় লিখিত সংবিধানে। দুর্মুখের তোয়াক্কা না করে সরাসরি ঘোষনা দিয়েছে, এ-সত্য আমরা শাশ্বত বলে মেনে নেই যে প্রতিটি মানুষ জন্মগতভাবে সমান, তারা তাদের স্রষ্টার আশীর্বাদে জীবন, স্বাধীনতা, আর আনন্দের সন্ধানের মত কিছু অবিচ্ছেদ্য অধিকার উপভোগ করে (উই হোল্ড দিজ ট্রুথস টু বি সেলফ এভিডেন্ট, দ্যাট অল মেন আর ক্রিয়েটেড ইকুয়্যাল, দ্যাট দে আর এনডাওড বাই দেয়ার ক্রিয়েটর ওয়িথ সার্টেন আনএলিয়েনেবল রাইটস, দ্যাট অ্যামং দিজ আর লাইফ, লিবার্টি, অ্যান্ড দ্য পার্সুট অফ হ্যাপিনেস)। আমাদের কি এমন কোন নীতি আছে? আমরা কি বলতে পারি দু-চারটি আপ্তবাক্য যা আমাদের সম্মিলিত মনন ও মানবিক প্রতিশ্রুতির নির্যাস হিসেবে ব্যবহার্য? মনে হয় না।
অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার মূল্যায়নের অন্যতম উপায় হিসেবে মুরুব্বিতন্ত্র বিভিন্ন দেশে প্রচলিত। এর অবশ্যই বিভিন্ন রকম সুফল আছে। এই মুরুব্বিরা দেশের হবেন, নাকি দলের, এটাই বিবেচনার বিষয়। উদাহরণ হিসেবে দুটি দেশের দিকে তাকানো যায়, ইরান ও আমেরিকা। ইরানে আছে আয়াতুল্লাহ খোমেনির মত স্টেট-এল্ডারেরা, যাদের পরম ও অসীম ক্ষমতার কাছে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী অসহায়। বাকি বিশ্বের কাছে গালাগালটুকু প্রেসিডেন্ট আহমেদিনেজাদ শুনলেও বাস্তবে তিনি ইরানের তৃতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি, প্রথম নন। উলটো দিকে তাকানো যাক যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির দিকে। প্রাক্তন ও অভিজ্ঞ সব নেতারা দলের বিভিন্ন উচ্চপদে আছেন এবং সেই অবস্থান থেকে সংকট নিরসনে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে প্রাথমিক নির্বাচনের পর তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য মনোনীত প্রার্থীর ভূমিকা ও ক্ষমতা। বড় বড় কর্পোরেশনের টাকা না নেওয়ার অঙ্গীকার করে বারাক ওবামা মনোনীত হয়েছেন। মনোনয়নের পরদিনই তিনি পার্টি-এল্ডারদের রাজি করিয়েছেন দলের তহবিল থেকে প্রায় এক লাখ ডলারের ডোনেশন ফিরিয়ে দিতে, তাঁর ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত মেসেজ অনুযায়ী পার্টির চাঁদা তোলার বিধিমালা সংশোধন করতে।
তালে হোক আর গোলে হোক, শেখ হাসিনা একটি ভাল কাজ করেছেন এবং একটি ভাল কথা বলেছেন গত দেড় বছরে। তিনি গ্রেফতারি পরোয়ানা সত্ত্বেও দেশে ফিরতে চাওয়ার কারণে ব্যারিস্টার মঈন ও সেনাসরকারের প্রকৃত রূপ বের হয়ে এসেছিল, শেষ হয়েছিল সুডো-মিলিটারি সরকারের রাজনৈতিক মধুচন্দ্রিমা। আইসিসি ট্রফিতে হল্যান্ডের বিপক্ষে আকরাম খানের হাফ সেঞ্চুরির ধারে-কাছে রাখি আমি শেখ হাসিনার এই কাজটিকে। তবে ভাল কথাটির গুরুত্ব আরো বেশি। দলে প্রাণসঞ্চারণের জন্য শেখ হাসিনা বলেছিলেন ষাটোর্ধ্ব সকল রাজনীতিকের অবসর গ্রহনের কথা। বলেছিলেন দলের উচ্চপদস্থ উপদেষ্টা হবার কথা, দেশ শাসনের জন্য নির্বাচনের ভার নবীনদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কথা। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে হোক, পিঠের ছাল বাঁচাতে হোক, কিংবা শুধুই দেশপ্রেম থেকে হোক, সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল কিছু স্টেট-এল্ডার বা জাতীয় মুরুব্বি তৈরির করা। এলেমদার লোকের এই ছোটখাটো সমাবেশ বিভিন্ন অবস্থায় আমাদের রক্ষা করবেন, এটাই কামনা। আমার সবিনয় মতামত, এতে করে রাষ্ট্র অযথা গতিশীলতা হারাবে। তারচেয়ে ভাল হয় যদি দলীয় মুরুব্বিতন্ত্রকে সীমিত ও নিয়মতান্ত্রিক করা যায়।
দল ও দেশের নেতৃত্বে যে একই ব্যক্তি থাকতে পারবেন না, এই মৌলিক সংস্কারটি অবধারিত বলে এর ধার দিয়ে যাচ্ছি না। পাশ্চাত্য রীতির সরাসরি অনুকরণ করে আমাদের দেশেও দুইবারের বেশি সরকারপ্রধান থাকতে না পারার করা বলা হচ্ছে। আমার মতে, এই ঊর্ধ্বসীমাটি সরকারের বদলে রাজনৈতিক দলে প্রয়োগ জরুরী বেশি। উন্নয়নশীল দেশের মারদাঙ্গা রাজনীতির মধ্য দিয়ে একজন সুযোগ্য নেতা উঠে আসার পথ খুবই বন্ধুর। মাহাথির বিন মোহাম্মদ বা জ্যোতি বসুর মত যাঁরা এই অসাধ্য সাধন করেছেন, তাঁরা যথাক্রমে ২২ ও ২৩ বছর ধরে ক্ষমতাশীর্ষে থাকতে না পারলে নিজ প্রজ্ঞা ও ধ্যানধারণা অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করতে পারতেন না। অতএব, যোগ্য নেতা যদি পাওয়াই যায়, তাঁকে জোরপূর্বক হটাবার চিন্তা একান্তই আত্মঘাতী।
যে-সব দেশে রাষ্ট্র- বা সরকার-প্রধানের ভূমিকায় দুই বারের বেশি অবতীর্ণ হওয়া যায় না, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব সতত পরিবর্তনশীল। পক্ষান্তরে, প্রাচ্যের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধানেরা ক্ষমতাকেন্দ্র হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকেন। একারণেই এটা কোন মতেই কাকতালীয় নয় যে ব্রিটেনে টোনি ব্লেয়ার প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় দলের ভেতর নেতৃত্ব বদল হয়ে গর্ডন ব্রাউন উঠে আসেন, আর ভারতে সোনিয়া গান্ধী আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রিত্ব বর্জন করেও ক্ষমতার নাটাই হাতে নিয়ে বসে থাকেন। শুরুতে উল্লেখকৃত পার্থক্যদুটি দেখতে পাওয়া যায় এখানেই। স্বাধীনচেতা মানুষের মুক্ত মত প্রকাশের জন্য দলের ভেতরেই রয়েছে উপযুক্ত পন্থা। কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই পদ্ধতিগুলো ভাঙেও না, রাস্তায় আন্দোলন করে এগুলো বদলাতেও হয় না।
একারণেই আমাদের রাজনীতিতে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমা ধার্য করে দেবার বদলে দলীয় নেতৃত্ব বদলের রীতি চালু করা উচিত। একজন শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া বা লেজেঅবহুমো এরশাদ যতদিন দলের প্রধান থাকছেন, ততদিন আমরা পুতুল সরকারের চেয়ে উন্নত কিছু পাবো না।
Saturday, June 21, 2008
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment