৪. নির্বাচনের খরচ রাষ্ট্রীয়ভাবে যোগানো এবং রান-অফ ইলেকশন
প্রবাসে অনেকেই দেশের কথা ভাবেন, দেশের জন্য কিছু করতে চান, দেশের রাজনীতির পরিবর্তন চান। ডলার-দিনার-পাউন্ডে উপার্জন শুরু করার পর দেশদরদী হওয়া খুব সহজ। পরিকল্পনার চেয়ে ভালবাসা অনেক সহজ। দূরে বসে দেশকে ভালবাসতে স্রেফ ডিশ নেটওয়ার্কে এনটিভি-চ্যানেল আই, হালাল মাংস, আর চেক বুক লাগে। অথচ বিদেশী শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালিদের সত্যিকার দায়িত্ব তাঁদের জ্ঞানকে কাজে লাগানো, প্রকৌশল থেকে চিকিৎসা বা ব্যবসা পর্যন্ত সবকিছু নিয়ে লব্ধ জ্ঞান দেশে পাঠানো। সবাই শুধু স্কুলে কম্পিউটার দেন, নয়তো মাইক্রোক্রেডিটে টাকা ঢালেন। ফিতরা-যাকাতের যুগ পেরিয়ে এসে প্রবাসী বাঙালি আজ এক ধাপ আধুনিক। ওভারসিজ চ্যারিটির নতুন নাম তাই মাইক্রোক্রেডিট।
কার্যকর উন্নয়নের পেছনে বস্তুগত অবদান রাখতে নারাজ বাঙালি দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি অনেক আগেই। সবাই শুধু স্যানিটারি ল্যাট্রিন বা ধানমণ্ডিতে অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে টাকা পাঠায়। বাড়তি জামা-জুতা কিনতে কারো বাধে না, কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য সরাসরি সরকারী তহবিলে দশ-পনের ডলার অনুদান পাঠানোর কথা বললে গরিমসির শেষ নেই। সেই হতাশার মাঝেই অনেকটা আলোর মত ঠেকলো এক বড় ভাইয়ের কথা। দেশ নিয়ে কথা বলতে বলতে এক সময় জানালেন তাঁর পরিকল্পনার কথা। চাকরি-বাকরি করে কিছু টাকা জমাতে পারলে তিনি দেশে কিছু সৎ রাজনীতিককে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করবেন। মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকালীন আদর্শগুলোর প্রতি অনুগত থাকার মত কিছু মৌলিক শর্ত ছাড়া আর কোন খবরদারিই থাকবে না। কাগজ-কলম নিয়ে হিসেব করতে বসেই মনে হচ্ছিল কত বেশি সহজ এরকম কিছু করে ফেলা।
জাতীয় সংসদের প্রতিটি আসনে বর্তমান ব্যায়সীমা ৫ লক্ষ টাকা। বাস, ব্যানার, পোস্টার, বিরিয়ানি, আর মীরপুর এলাকায় কামাল মজুমদারের নেতৃত্বে নারী-মিছিল বাদ দিলে এর চেয়ে বেশি খরচের প্রয়োজনও নেই। ১৫ কোটি মানুষের বাংলাদেশে প্রতি আসনে গড় লোকসংখ্যা ৫ লক্ষ। এর অর্ধেক ভোটার হলেও ভোটার সংখ্যা আড়াই লক্ষ। দিনে আড়াই হাজার মত ভোটারের কাছে পৌঁছতে পারলে তিন মাসের মধ্যেই প্রত্যেক ভোটারের সাথে পরিচিত হওয়া যায়। আমেরিকার মত বিশাল দেশেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য মাত্র শ’পাঁচেক পেশাদার প্রচারকর্মী আছেন। বাকি সবাই স্বেচ্ছাসেবক। ৫০০ স্বেচ্ছাসেবক দিনে ৫০ জন ভোটারের কাছে দেখা করলেই হয়ে যায়। কাজটা কঠিন নয়, তবে ভীতিকর। সাহস করে নেমে পড়লে অস্ত্র ও অর্থের প্রভাব ছাড়া এভাবেই নতুন কোন প্রার্থীর পক্ষে স্বল্প খরচে তৃণমূল পর্যায়ে প্রচারাভিযান চালানো সম্ভব।
যদু-মধুদের নির্বাচনে দাঁড়িয়ে সরকারের টাকায় মোচ্ছব করা রোধ করতে মনোয়নপত্রের সাথে হাজার পঞ্চাশেক ভোটারের সাক্ষর সম্বলিত একটি পিটিশন জমা দেবার বিধান করা যায়। আপাতদৃষ্টে ছেলেমানুষি মনে হলেও হরতালের মত ধুম-ধাড়াক্কা রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রতিরোধের উপায় হিসেবে নাগরিকদের কাছে যাওয়া ও তাদের সমর্থন-প্রতিবাদের চিহ্নস্বরূপ সাক্ষর নেওয়ার সংস্কৃতি দাঁড় করানো যায় এভাবে। আইন করে হরতাল বন্ধ করে কোন লাভ নেই। রাজনীতিকদের যত বেশি ভোটারদের প্রতি মুখাপেক্ষী করা যাবে, ততই বাড়বে ভোটারের ইচ্ছার প্রতি সচেতনতা।
প্রতি আসনে ৩ জন করে প্রার্থীকে সরকারী তহবিল থেকে অনুদান দিলেও খুব সহজেই নির্বাচনের খরচ যোগানো সম্ভব। ৩০০ আসনে খরচ হবে মাত্র ৪৫ কোটি টাকা। যতদূর মনে পড়ে, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর অধ্যাপক আবুল বারাকাতের একটি লেখায় পড়েছিলাম সেই নির্বাচনে হাজার দশেক কোটি টাকা খরচ হবার কথা। হিসেবে খাতায় গোলমাল হয়ে যদি পাঁচ গুণ বেশি খরচ হয়, তবুও নির্বাচনী খরচ অনেক সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সকল প্রার্থীর জন্য নির্বাচনের আগে রেডিও-টেলিভিশন সহ প্রচার মাধ্যমগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া যায়। টাউন হল গুলোয় ইস্যুভিত্তিক তুলনামূলক অবস্থান স্পষ্ট করে রচিত প্রচারণার ব্যবস্থা করা যায়। পরবর্তীতে প্রার্থী মনোনয়নের খরচ বহন, নির্দিষ্ট সমাবেশস্থল দেওয়া, পরিকল্পিত ভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব মিডিয়াকে ব্যবহার, ইত্যাদি খুঁটিনাটি সংযোজন করা সম্ভব প্রয়োজন মত।
জর্জ বার্নার্ড শ’ গণতন্ত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একটি দুর্দান্ত উদাহরণ দিয়েছিলেন। ধরুন কোন নির্বাচনে চার জন প্রার্থী যথাক্রমে ১, ২, ৩, ও ৪ ভোট পেল। প্রথাগত গণতন্ত্রে সেই ব্যক্তিই নির্বাচিত হবেন, যিনি ৪ ভোট পেয়েছেন। অথচ বাস্তবতা এটাই যে অর্ধেকের বেশী ভোটার তার প্রার্থিতার বিপক্ষে। আপাতদৃষ্টে বেশি কচলানো বা ত্যানা প্যাঁচানো মনে হলেও এই ধরনের ছোট ছোট ব্যাপারগুলোই অনেক বড় বাটারফ্লাই ইফেক্টের জন্ম দিতে পারে। শুধু ভেবে দেখুন আমেরিকার ২০০০ সালের নির্বাচনের কথা। রালফ নেডার নাম পার্টি-ক্র্যাশার, সুপ্রিম কোর্টের নগ্ন পক্ষপাত, কিংবা গণনাযন্ত্রের ত্রুটির পর শেষতক মাত্র ৭০০ ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন জর্জ বুশ জুনিয়র ওরফে ডাবইয়া। অধিকাংশ ভোটার নিশ্চিত ভাবে অ্যাল গোর বা রালফ নেডারের পক্ষে না থাকলেও খুব দৃঢভাবে জর্জ বুশের বিপক্ষে ছিলেন। রান-অফ নির্বাচন হলে ইরাক যুদ্ধ হয় না, তিন হাজার মার্কিন সেনা ইরাকে মারা যায় না, লক্ষ লক্ষ ইরাকি নিজ দেশে পরাধীন হয়ে দিনাতিপাত করে না, এবং সাদ্দাম হোসেনকে অনভ্যস্ত দাড়ির চুলকানি থেকে বাঁচতে ফাঁসিতে ঝুলতে হয় না।
অতএব, কোন আসনে জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি শতকরা ৫ ভাগের কম ব্যবধানে হলে কিংবা বিজয়ী প্রার্থী অর্ধেকের কম ভোট পেলে সেখানে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত দুই প্রার্থীর মধ্যে পশ্চিমা ধারায় রান-অফ ইলেকশনের প্রচলন করা যায়। ফলশ্রুতিতে অন্যতম উপজাত হিসেবে কিছুটা এলাকাভিত্তিক ঐক্যেরও দেখা মিলবে। যে-ব্যক্তি দুই দুই বার নির্বাচনে জিতে আমার এলাকার প্রতিনিধিত্ব করবে, আমার সাথে মতে অমিল থাকলেও আমি তাকে আমার নেতা হিসেবে মেনে নেবো। কারণ দিনের শেষে একটি নির্বাচনের সফলতা নিরূপিত হয় বিজিত পক্ষ নিজেদের পরাজয় কীভাবে নিচ্ছেন তা দিয়ে, বিজয়ী পক্ষের জয়ের ব্যবধান দিয়ে না।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment