১.
প্রবাস জীবনটা যেন আয়নায় ভরা। দেশে থাকতে কোনদিন খুব একটা আয়না দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বাইরে আসা অবধি তাই ক্ষণে ক্ষণে বিভিন্ন আয়নায় নিজেকে দেখার বিব্রতকর অভিজ্ঞতার সাথে খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করে চলেছি। দেশের আয়নাগুলোর ধরন ও অবস্থান আগেই জানা থাকতো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালে বেহায়া সিঁথি, টয়লেটে গেলে উঠতি ব্রন, টার্মের পর হাতে পাওয়া রিপোর্ট কার্ড, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার পর বাবার ‘শান্তি হয়েছে?’, শুক্রবার দুপুরে মাংসের বদলে সবজি দেখে উঠে যাওয়ার সময় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা মায়ের চোখ, তুচ্ছ কারণে গায়ে হাত তোলার পরও কুঁকড়ে থাকা কাজের ছেলেটার পিঠের কুঁজ, তিন টাকা ভাড়ার পথের রিকশা ধরার সময় পাশে দাঁড়ানো দারোয়ান চাচার নিঃশব্দে সরে যাওয়া, এরকম কিছু সহজে-উপেক্ষ আয়না ছিল আশে-পাশে।
প্রতিফলক হরদম মিলতো, আয়না ছিল এরকম অল্প কিছু। সব প্রতিফলনকে মানুষ ‘জাজমেন্টাল’ দৃষ্টিতে দেখে না, সেজন্যই সব প্রতিফলক আয়না না।কে জানে, খেয়াল করলে হয়তো অনেক কিছুই দেখা যেত এই চোখে। প্রবাসে এসে জীবন সীমিত হয়ে গেছে। যাবার জায়গা কম। কথা বলার লোক কম। বাসে চড়লে মন খুলে কথা বলা যায় না, রেস্টুরেন্টে বসলে বেশরমের মত খাওয়া যায় না। অনেক ঝক্কি। অনেক ভেবে চলতে হয়। অনুভূতিগুলো অনেক বেশি তীক্ষ্ণ যেন। নিজেকে উজার করে দেওয়া এত বেশি কঠিন বলে এই চূড়ান্ত বহির্মুখী আমিও আর সবার মত অন্তর্মুখী জীবন যাপন করে চলি। এর উপজাত হিসেবেই যেন চারপাশে এত আয়নার আধিক্য। যে-হারে নিজে অন্যকে বিচার করি, সে-হারে অন্যরা আমাকে বিচার করে হয়তো। হয়তো প্রতিটা দৃষ্টিবিনিময়ই একবার করে আয়না-দর্শন।
মনে পড়ে ২০০৫এর শীতে দেশে যাবার কথা। কুয়েত এয়ারওয়েজে গিয়েছিলাম। মধ্যপ্রাচ্যে যাত্রাবিরতি মানেই স্বজাতি ভাইদের কুলিগিরি করতে দেখা, বিমানবন্দর ঝাড়ামোছা করতে দেখা। অনেকেই সুপারভাইজরের চোখ এড়িয়ে এসে দু’কথা বলে যেতেন। কারো মুখে রাজনীতির কথা, কারো মুখে শোষিত জীবনের যন্ত্রনার কথা, আবার কেউ শুধুই পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন।আমিও এমনি শান্তিতে বসেছিলাম। দেশ সবাইকেই টানে। দেশের মানুষও অনেক বেশি টানে। কেন টানে, তার একটা কারণ সেদিন বুঝেছিলাম। নিজের আলো-হাওয়া-মানুষে কেউ আমার দিকে অনভ্যস্ত চোখে তাকাবে না, ঠিক মত চেনার আগেই আমাকে উপসংহারে পর্যবসিত করবে না। কী অদ্ভুত আরামের ছিল সেই অনুভূতি।
২.
সেই সফরেই আয়না-মুদ্রার অন্য পিঠও দেখেছিলাম। আটলান্টিকের এপার থেকে যাওয়া সব যাত্রীই কমবেশি বিরক্ত হই মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্লেন ভরে ফেলা ‘ফরেনার’ ভাইদের পানি-কম্বল-রশি-বাক্স দেখে। কেমন যেন একটা আভিজাত্য নিয়ে থাকি, চেনা-অচেনার মাঝামাঝি একটা দূরত্ব রেখে মিশি, আদেখলাপনা আর হ্যাংলামোর ভান্ডার থেকে দূরে সরে সরে থাকি। আমরা শিক্ষিত, মার্জিত, শোভন। আমরা গোল্ডের বার আর মোবাইল ফোন কিনি। এভাবেই চলছিল আমারো। উচ্চতর অবস্থান পেলে যা হয় আর কী, একটু পর আমার মনও অতি আরামে জাত্যাভিমানী হয়ে উঠলো। অস্ফুট স্বরে পাশের এক নীল পাসপোর্টধারী সহযাত্রীকে বললাম কিছু লোকের বিচিত্র পোশাকের কথা। চামড়ার প্যান্ট, মেরুন কোট, বেগুনী শার্ট, পাঞ্জাবির সাথে কেডস, কী নেই ডিপার্চার লাউঞ্জে। বড় ভাই নিজেও উচ্চতর মানসিকতার। হু হু করে সায় দিলেন। বাৎচিৎ সেরে কিছু পরে আমরাও হুড়মুড় করে ধাক্কিয়ে প্লেনে উঠলাম। আগে প্লেনে চড়ার অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত করে সাধ্যি কার, বলুন?
হুশ ফিরলো প্লেনে খাবার দেওয়ার সময়। শ্রমিক শ্রেণির এক সহযাত্রী কোমল পানীয় চাইলেন। চকচকে ত্বক, টুকটুকে লাল ঠোঁট, আর মাখনের মত পেট দেখিয়ে হেঁটে বেড়ানো এক বিমানবালা এক শ্রমিককে প্রকাশ্যেই কটাক্ষ করলো ‘ফ্যান্টা’কে ‘পান্টা’ বলায়। না, শুধরে বলার পরও বেচারার গলা ভেজানোর উপায় হয়নি। মুহূর্তে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। পরে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিতও হলাম। সেই সাইকেডেলিক রঙের পোশাক ছিল জীবনের উচ্ছিষ্টসম এই মানুষগুলোর শেষ রক্ষণব্যুহ। জামায় জাত প্রকাশ পেয়ে গেলে কুকুরের মত ব্যবহার করে এদের সাথে আরবগুলো। আমার সামনেই মেটাল ডিটেক্টরের মধ্যে দিয়ে যাবার আগে জুতা খুলতে ভুলে যাওয়ায় এক যাত্রীকে চড় মারতে হাত তুলে ফেলেছিল এক আরব পেয়াদা। যৎসামান্য সঞ্চয়ের টাকা উজাড় করে তাই এদের বেশি দামের পোশাক পরা। যেকোন ছুতায় সমাজের আয়নায় সম্মানীয় হওয়ার অক্ষম প্রয়াস।
রাগের আতিশয্যে পরবর্তী কিছুক্ষণ ধরে সবধরনের সৌন্দর্যের পিপাসু-চিবাসু-লেহসু এই আমি মনের ভেতর অনেক রকম উষ্ণ-আন্তরিক বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেললাম সেই বিমানবালাকে। তাকে পূর্ণ করে দিলাম আমার সকল শূন্য করে। চোখ খুলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেশের লাল আকাশ বিশাল এক আয়না হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল চোখের সামনে। প্রখর আলোয় বুক চিতিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেশকে কুর্ণিশ করছিল শুধু সেই পান্টা ভাইয়েরাই, যারা দশ টাকা আয় করলে সাড়ে নয় টাকা দেশে পাঠিয়ে দেশকে বাঁচায়। অধোবদন হয়ে চোখ ঢাকছিলাম আমরা বাকি সব উচ্চমার্গীয় মীর জাফরেরা।
বিমানবালাকে দেখলাম না কোথাও। মনে হয় গোঙাচ্ছিল কোন কোণায়। কল্পনার দেশপ্রেম যদি আমাকে এত অধিকার দেয় দেশ ও তার মানুষকে বিচার করার, তাহলে আমার ঘাম-ঝরানো প্রতিবাদে বিমানবালা একটু তো ব্যাথা পেতেই পারে। নাহয় সে-ঘাম কল্পনায়ই ঝরল।
No comments:
Post a Comment