“এলে অবশেষে?”
কাজ থেকে বের হতে হতে সোয়া নয়টা বেজে গেলো। এরপর বাসে আরো চল্লিশ মিনিট।
“কোন ব্যাপার না। খাওয়া সব ঠান্ডা হয়ে গেছে। গরম দেবো? সবাই খেয়ে নিয়েছে। নিজের মনে করে নিয়ে খেয়ো কিন্তু।”
উহু। নিজের মনে করে খেয়ে ঠকবো নাকি? নিজের মনে করে খেলে তো এক প্লেট ভাত তিন দিন ঘুরবে। পরের মনে করে গোগ্রাসে গিলবো। দাওয়াত দেখে দুই বেলা না খেয়ে বসে আছি!
“আহা রে। ছাত্রজীবনে একটু কষ্ট করতেই হবে। আমাদেরও বেশ কষ্টের সময় গেছে। তোমার আংকেল তো ছাত্র অবস্থায় বিবাহিত ছিল। দেশে বুড়ো বাপ-মার দেখভাল করতে হয়েছে। চাকরি পাওয়ার পরও আমরা ছাত্রদের মত ফার্নিচার কুড়িয়ে চলতাম। বিত্তবৈভব করতে পারতাম, কিন্তু সামান্য একটু বিলাসিতার মোহ ত্যাগ করতে পারলে কতগুলো মানুষের উপকার করা যায়।”
সেটাই। এই ভাবনাটা শিক্ষিত প্রবাসীদের মধ্যে খুব বিরল। যদিও হওয়ার কথা ছিল উল্টাটা। যেই মানুষগুলো কামলা খেটে টাকা কামায়, তারাই দেশে টাকা পাঠায়। তাদের তুলনায় তো পেশাজীবিদের সামর্থ্য অনেক বেশি। কিন্তু তারা দেশে কিছুই পাঠায় না।
“ছেলেপুলে বড় করার ব্যাপার আছে তো, তাই অনেকেই এখানে থিতু হয়ে যায়।”
সেটাই। তবে তার পরেও করা যায়। সবজিরা করে, হালাপিনোরা করে, ব্রকলিরা করে। করি না বলতে আমরা বাঙ্গালিরাই।
“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি। চিরদিন তোমার আকাশ...”
ওহ, গান শুরু হয়ে গেলো? আমি খাওয়া সেরে আসরে আসি, আপনি গলা মেলান গিয়ে।
“মা তোর মুখের বাণী আমার কানে বাজে সুখার মত। মরি হায়, হায়রে ও মা হুহু হুহু...”
(জাতীয় সঙ্গীতের জন্য দাঁড়িয়ে ভাত খাচ্ছি, এর মধ্যে গানের কথা ভুলে যেতে হল? কেউ ধরে দেয় না কেন? আমার কানে লাগে, বাজে না। মা তোর বদন খানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি।)
“আমরা বড়রা তো গান গাইই। আজকে নতুক কিছু করা হোক। বাচ্চারা গান করুক আগে।”
এটা ভাল বলেছেন। ইস, রেকর্ড করে রাখা গেলে ভাল হত।
“ফুরযাপতি, ফুরযাপতি, কোতায় পেলে বাই এমনো রঙ্গিন পাখা।”
খুব ভাল গেয়েছো, ভাইয়া। গানটার মানে জানো তুমি? এটা বাটারফ্লাই নিয়ে লেখা খুব সুন্দর একটা গান।
“হ্যাঁ, জানি।”
বলতো পাখা মানে কী?
“এটা তো সহজ। ইট দ্য লেগ!”
ইয়ে... আসো আমরা পরের গানটা শুনি। আমার কোলে বসে শুনবে? ওকি! কোথায় যাচ্ছো? পোকিমন? ঠিক আছে, দেখ গিয়ে।
“ভাবী, আকাশের ঐ মিটিমিটি তারা গান।”
(এহ, দিলো মুডটা নষ্ট করে। আর গান পাওয়া গেল না? কী যেন নাম এই গানের শিল্পী নায়িকার? যাক, চেহারা মনে করেই কেমন কেমন লাগছে। নাম মনে না পড়াই ভাল।)
“বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, করেছো দান।”
(গানগুলো সব এমন কেন? বেছে বেছে আজকেই বৃষ্টিতে পেতে হল সবাইকে?)
“আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে। এই নিরালায়...”
(আহা, এতক্ষণে মনের মত গান একটা। যাব না এই মাতাল সমীরণে আজ...)
“আচ্ছা, এবার কিছু নজরুল গীতি হোক। এই সুজন, গাও তো কিছু গান। না, না। আমরা কিছু শুনবো না। গাইতেই হবে গান।”
আরে পড়বে। গাইলেই গান মনে পড়বে। আমরা তো আছিই। লাইন মনে করিয়ে দিবো। না, শ্মশানে জাগিছে মনে নাই আমার। থাক, নজরুল ভুলে গেলে ঠাকুরই মারো এই বেলা।
“একটা কাগজ আর কলম দেন তো। গানটা লিখে নেই।”
কী গান লেখো? রবীন্দ্রসঙ্গীত? আইয়ূবের আমলে তোমার মত প্রতিভা যে কোথায় লুকিয়ে ছিল!
“এসো শ্যামল সুন্দর, আনো তব... পরের লাইন যেন কী?”
বকুল মুকুল রেখেছে গাঁথিয়া...
“ও হ্যাঁ। আচ্ছা, লিখে রাখি এটুকু।”
রবীন্দ্রনাথ এখানে থাকলে বলতো, ধরিত্রী দ্বিধা হও, তোমার মাঝে আমি হান্দায়া যাই! মতিন ভাই, আপনি শুরু করেন আপনার ব্যান্ডের গান।
“আরে না, না। আমি কি আর গান পারি?”
না পারলে আর কী করার আছে, ভাইয়া? সুজনের কাছে শুনতাম আপনি টয়লেট কাঁপিয়ে ফেলেন আজম খানের গানে। যাক, আমরা নাহয় আবৃত্তি শুনি কারও গলায়।
“ঠিক আছে, তোমরা যখন এত সাধাসাধি করছো, গেয়েই শুনাই কিছু গান।”
কিছু? কিছু তো একটু বেশি হয়ে যায়। না, ভাইয়া। থাকুক না। পরে কখনও হবে নাহয়।
“আমি যেই গানটা গাবো, সেটা যিনি গেয়েছেন, তাঁকে বাংলাদেশের অনেকেই গুরু বলে ডাকেন...”
এদিকে আসেন সবাই! মতিন ভাই গান গাবে!
“তিনি গান শুরু করেন সত্তরের দশকে। তখনও বাংলাদেশে ব্যান্ড সঙ্গীত তেমন জনপ্রিয় হয়নি।”
ভাইয়া, আমরা তো আজম খানকে চিনি। শানে নুযূলটা বাদ দেওয়া যায় না?
“ঐ পোলা, আমাগো আজম খান চিনাস? প্যাঁচাল না পাইরা গান ধর!”
(এইবার ঠিক আছে। একেই বলে ওপার বাংলার মুখে এপার বাংলার গালি।)
“রেল লাইনের ঐ বস্তিতে, জন্মেছিল একটি ছেলে। মা তার কাঁদে।”
(পকেটের রুমালটা শক্ত করে কামড়ে অন্য দিকে চেয়ে থাকা।)
“সে যে ব্যথিত হৃদয় আছে বিছায়ে...”
এটা কোত্থেকে আসলো?
“এই সুজন, তুমি গানে মাজখানে কী শুরু করলা? কিছু বুজো না!”
(চিড়িয়াখানা হয়ে গেল ঘরটা। হায়রে গৃহদাহ!)
“কত আশা ছিল তার জীবনে। ছেলেটি মরে গেল। তার সব আশা শেষ হয়ে গেল। মা তার কাঁদে!”
জ্বী, আমরা এবার অন্য গানে যাই। পাপ্পু ভাই, আপনি কী যেন গাবেন বলছিলেন।
“চল আমরা জেমস গাই। দাদা, আপনি গান ধরেন, আমি টান লাগাই।”
হ্যাঁ, সেভেনটিস থেকে আমরা নাইনটিসে আসি এবার।
“দুঃখিনী দুঃখ কোর না...”
সবাই এত দুঃখের গান কেন গাচ্ছে আজকে?
“আমরা এবার একটু ওয়ারফেজ গাই।”
হাহ হাহ, আরো কয়েক বছর সামনে গেলাম, তাই না?
“আচ্ছা, এখন দেশে কারা হট?”
জানি না। আমি আসার আগে তো অর্থহীন খুব চলছিল। আমি ত্রিমাত্রিক নিয়ে এসেছিলাম সাথে করে। এর পরে বাংলার কিছু গান শুনলাম। মাঝে ব্ল্যাক সহ আরো কিছু বেশ উঠে গেছে শুনলাম। সেটাও তো বছর তিনেক আগের কথা।
“আমি দেশ ছেড়ে আসার আগে সিলসিলা বের হয়েছিল, বুঝলে? আমরা সবাই দেখা এক খোয়াব তো গেয়ে গেয়ে ভার্সিটির মেয়েদের বিরক্ত করে ফেলেছিলাম। তোমরা কত আধুনিক, দেশ সম্পর্কে কত জানো, কত যোগাযোগ তোমাদের।”
এটা ঠিক যে আমাদের ইন্টারনেট আছে, ফোন আছে। কিন্তু দেশের খবর ওগুলোয় পাওয়া গেলেও দেশের জোশটা পাওয়া যায় না। এই জন্যই আমরা গানগুলো পেলেও বুঝি না কোন গান কোথায় এবং কতটা জনপ্রিয়।
“ফেরদৌসির একটা গান আছে। কী যেন নাম ছায়াছবিটার? এই নীল নীল নির্জন নিরজনে...”
No comments:
Post a Comment