উগ্র জাতীয়তাবাদ নিঃসন্দেহে অপরাধীর আবেগ। মহাবিতর্কিত এই মহাসত্য আবারও প্রকাশ পেল উন্নত অথচ কলহমান দুটি এশীয় মহাশক্তির সাম্প্রতিক কার্যকলাপে। সম্প্রতি জাপানের পাঠ্যপুস্তকে চীনের সাথে তার ঐতিহাসিক বিরোধ ও সংঘাত গুলো নিয়ে আপত্তিকর ও অসত্য বক্তব্য সংযুক্ত করার প্রেক্ষিতে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে অনেক রকম পুরনো জঞ্জাল। শুধু জঞ্জালই নয়, নাড়া পড়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদের লাল সালুতেও।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলেও চীন ও জাপানের বিরোধ পুরনো। সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে পরষ্পরের উপর প্রভাব বিস্তাার ও আঞ্চলিক আধিপত্য লাভের জন্য এই দেশ দুটো অনেকবার মুখোমুখি হয়েছে। সর্বশেষ প্রধান সংঘাত ছিল ২য় মহাযুদ্ধের সময়। সে সময় জাপান ছিল নাৎসি জার্মানির অন্যতম তাবেদার। তাবেদার হবারই কথা। তাদের দাবিও ছিল অভিন্ন। উন্নততর জাতি হিসেবে তাদের আরও জমি ও সম্পদ চাই। অনুন্নত জাতিগুলো চাহিবামাত্র তা যোগাতে বাধ্য। তাদের সম্রাট হলেন ঐশী আশির্বাদে পুষ্ট এক নেতা, যার ইচ্ছাপূরণের কাছে প্রচলিত শিষ্টাচার কিংবা মানবতা নগণ্য। যুদ্ধের সময় তারা দখল করে নিয়েছিল চীনের অর্ধেকেরও বেশি জমি। আর সব দখলকৃত দেশের মত চীনকেও সইতে হয় বর্ণনাতীত নির্যাতন। অত্যাচারের মাধ্যম হিসেবে বিশেষ পছন্দনীয় ছিল খুন ও ধর্ষণ, যেমনটা জাতীয়তাবাদী সব অপশক্তিই মোটামুটি প্রাতিষ্ঠানিকীকৃত করার মধ্যে এক প্রকার বিকৃত তৃপ্তি লাভ করে থাকে।
যুদ্ধের জঘন্যতম অধ্যায়গুলোর একটি ছিল নানজিঙ্গের গণহত্যা। ১৯৩৭-এর ডিসেম্বরে এই শহরটি দখল করে নেবার পর জাপানি সেনারা খোলা রাস্তায় ইচ্ছেমত গুলি চালায়। নারী ও শিশু নির্বিশেষে খুন করে আনুমানিক আড়াই লক্ষ নিরস্ত্র চীনা নাগরিককে। অনেককেই জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। বহুকাল পর স্থানবিশেষে গণকবরে পাওয়া যায় ১০,০০০ এরও বেশি লাশ। সাথে ধর্ষিতা হন ২০,০০০ এরও বেশি নারী। ধর্ষণের পর কারও স্তন কেটে নেওয়া হয়, কারও যোনিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ধারালো তলোয়ার। ব্যক্তিগত বিনোদনের জন্য অনেক সেনাই ছবি তুলে রাখেন এই নির্যাতনের। আজও বিশ্বের বিভিন্ন লাইব্রেরি আর ওয়েবসাইটে এই ছবিগুলো ঝুলছে মানুষের নীচতা আর বর্বতার প্রতীক হয়ে। জাতি হিসেবে চীনা আর জাপানিরা বাঙালিদের তুলনায় অনেক উন্মুক্ত। ছবিগুলোকে তারা অশ্লীল বলে গাল দেয়নি, বরং প্রামান্য দলিলের মর্যাদা দিয়েছে। তাই এই বর্বতার আলোকচিত্রগুলো আজও মিথ্যাচারী আর সংশোধনবাদীদের টুঁটি চেপে ধরে। যেমন ধরছে এখন জাপানের নব্য রচয়িতাদের।
জাপানের পাঠ্যপুস্তকগুলোয় ইতিহাস এখন নতুন করে লেখা হচ্ছে। তাইওয়ান, মানবাধিকার, নিরাপত্তা পরিষদে জাপানের স্থায়ী সদস্যপদ দাবী, ইত্যাদি বিষয়ে দেশ দুটোর মধ্যে দূরত্ব ক্রমবর্ধমান। বিরোধের বারুদে আগুন লাগালো ইতিহাসবিকৃতি আর জাতীয়তাবাদী শুদ্ধি অভিযান। ফলাফলটাও প্রত্যাশিত। বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে পুরো চীন। বিশ্বের নজরও সেদিকে। যথারীতি, প্রতিবাদের কারণের চেয়ে মাত্রার দিকেই সবার নজর বেশি। সমাজতান্ত্রিক চীনের এই প্রতিবাদের ঝড় পশ্চিমের কারও চোখেই ভাল ঠেকছে না। এর পেছনে সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ খুঁজে পাচ্ছেন তারা। চীনা সরকার তার যা করার করছে বলেই নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের মত। জাপানি দূতাবাস থেকে শুরু করে দোকান-পাট পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরকারি নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে।
জাপান এই উত্তপ্ত সময়ে বিতর্কিত পূর্ব চীনা সাগরে তেল-গ্যাস সন্ধানের অনুসন্ধানের অনুমতি দিচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানিকে। শুধু তাই নয়, জাপান তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চীনে পাঠিয়েছে চীনা সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা দাবি করে। স্বাভাবিকভাবেই এই আবেদনে কান দেয়নি চীন। ওদিকে থেমে নেই জাপানের জাতীয়তাবাদী সংশোধনও। তাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোয় অত্যাচারের ইতিহাসকে আলোকিত অধ্যায় বলে অভিহিত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, মাত্রানির্বিশেষে চীনাদের উপর নির্যাতন উপযুক্ত ছিল, নানজিঙ্গের হতাহতের সংখ্যা অতিরঞ্জন, যুদ্ধের সময় এমন ঘটনা হতেই পারে, ইত্যাদি। প্রতিবাদের বিপরীতে জাপান সরকারের ব্যাখ্যাগুলোও যথেষ্ট হাস্যকর। পুস্তক গুলোর রচয়িতা সরকার কর্তৃক নিয়োজিত নন। এই পাঠ্যপুস্তকগুলো নির্বাচন করছে স্কুলগুলো, এর পেছনে সরকারের হাত নেই। খুব বেশি স্কুলে এগুলো পড়ানো হবে না। এই ধরণের কিছু খোঁড়া বক্তব্য। একটি জাতির অভিভাবক হিসেবে তাকে সত্য ও সুন্দরের পথে রাখার দায়িত্ব কোন সরকারের পক্ষেই এড়ানো সম্ভব না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্পর্শকাতর কোন বিষয়ে কেউ মিথ্যা বা আক্রমণাত্মক কিছু করে বসলে তার দায়ও এড়ানোর উপায় নেই।
বিবাদমান এই দুটি দেশকে নিয়ে অনেক কিছুই বলার আছে। অনেকে বলছেনও। কেউ কেউ জাপানের হয়ে বলছেন, দেশাত্মবোধ জাগ্রত করার জন্য এমন বক্তব্য সংযোজন করতেই হয়। কেউ বা তাইওয়ান বা তিব্বতের উদাহরণ টেনে বলছেন চীনের অসঙ্গতিপূর্ণ মনোভাব ও কার্যকলাপের কথা। কেউ কেউ যুক্তি দিয়ে দেখাচ্ছেন যে একই জর্জ ওয়াশিংটন আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে যথাক্রমে হিরো ও ভিলেন রূপে চিহ্নিত। বিগত ৬০ বছরে জাপানের প্রধানমন্ত্রীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন তাদের অতীতের জন্য। যুদ্ধের পর শান্তি আর কঠোর পরিশ্রমের প্রতি জাপানিরাই সবচেয়ে বেশি মনোনিবেশ করেছে, ইত্যাদি। কিন্তু সবকিছুই যেন শুন্য দিয়ে গুণ হয়ে গেল মুহূর্তের এই উন্মাদনায়।
জাতীয়তাবাদের অপশক্তির এটাই সবচেয়ে ভীতিকর দিক। নিমেষেই এটি মানুষকে প্ররোচিত করতে পারে তার স্বভাববিরুদ্ধ উগ্র আচরণ করতে। সব রকম প্রযুক্তিতে নেতৃত্বদানকারী দেশ হয়েও যারা আণবিক বোমার দিকে হাত বাড়ায়নি, কর্মময়তায় ব্যাঘাত ঘটবে বলে যারা অলিম্পিক আয়োজনেও নাখোশ ছিল, সেই দেশেই এমনটা হচ্ছে? বিশ্বাস করতে কষ্ট হবারই কথা। জাতীয়তাবাদের অনেক রকম গুণের কথা বলে থাকেন অনেকেই। নিজের দেশ ও জাতিকে শ্রেষ্ঠ বলে জানা ও তার সেই শ্রেষ্ঠত্ব অন্যের ওপর আরোপ করা, নিজের দেশের অন্যায়কেও প্রশ্রয়ের চোখে দেখা, ইত্যাদি জাতীয়তাবাদেরই অনূষদ। ভয়ের বিষয় হল, এক পর্যায়ে জাতীয়তাবাদীর কাছে যুক্তি আর বিবেকের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায় অহংকার আর আত্মম্ভরিতা; যার প্রত্যক্ষ্য ফল রূপে সমাজ আর রাষ্ট্র আক্রান্ত হয় নানাবিধ অসুখে।
প্রশ্ন আসতে পারে, জনগণ কেন কিছু করছেন না। ভিন্ দেশের ভিন্ বাসিন্দাদের সমালোচনায় এটুকু বলাই যায়। আমরা বলিও। জাতি হিসেবে আমরা ছোট ও বাচাল। এহেন প্রশ্ন আমাদের চেয়ে ভাল তাই কাউকে মানায় না। এর জবাবে আমার শুধু ছোট্ট একটি প্রশ্ন। কেউ কি আয়নার নিজের দিকে দেখেছেন? একই কাজ আরও অনেক গুণে বেশি চলছে বাংলাদেশে! দেশের ভেতরেই চলছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেশদ্রোহিতা । কী বলছি আমরা? আমাদের নানজিং নেই, কিন্তু মনে রাখবার মত ’৭১ আছে। পরাজিত শক্তি আর তাদের তাবেদার দেশীয় আগাছারা আজ দেশটা ছাড়খার করলেও আমরা কিছু বলছি না, অন্যকে দোষ দেব কী? আমরাও তো আজ আকাশে-বাতাসে শুনছি নিজামীদের বলা “হো সাক্তা হ্যায়” জাতীয় উক্তি! নানজিংকে তাই মনে পড়ে সংবাদপত্রে ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে খুন-ধর্ষণের খবর অতিরঞ্জন’ কিংবা পাঠ্যে ‘সন্ত্রাসী কার্যকলাপের দায়ে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়’ পড়লে। নানজিংকে মনে পড়ে নিজামীরা যুদ্ধকালে তাদের ভূমিকার সাফাই গাইলে। নানজিংকে মনে পড়ে স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার শপথ নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদেরই পুষতে-পালতে দেখলে। নানজিংকে মনে পড়ে প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে মাহফিল করতে দেখলে। তবে বিধাতাকে মনে পড়ে শুধু একবার - যখন কোন সন্তানহারা মা কিংবা বীরাঙ্গনা বোন নিভৃতে অশ্রু মোছেন। বিধাতা ছুটিতে ছিলেন তাঁরা সব হারানোর সময়। বিধাতা যেন আজও ছুটিতে আছেন তাঁরা আরেক প্রস্থ অপমানিত হবার সময়।
এত রক্ত, এত কষ্ট, এত ত্যাগ, সবই যেন তাই শুধু এক আপেক্ষিকতা। সবই বন্ধ হৃদয়ের অন্ধ আবেগ।
এপ্রিল ১৯, ২০০৫
No comments:
Post a Comment