মাঝে মধ্যে মনে হয় স্রেফ বসে থাকি। কিচ্ছু না করে, কোন দিকে না তাকিয়ে, কোন চিন্তায় না ভেসে। স্রেফ বসে থাকি। অলস, অচল, অসার সময় কাটাই কিছু। জানি ভুল, তবু সময় নষ্ট করি হেলায়। আবার কখনো খুব বেশি ইচ্ছা করে কিছু করতে। ‘কিছু’। কী, জানি না। তবে ‘কিছু একটা’। খুব অস্থির লাগে। কখনো উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেঁটে বেড়াই, কখনো পথের পাড়ে অচেনা কারো সাথে আড্ডায় মশগুল হয়ে যাই, কখনো ঘাসের পালঙ্কে শুয়ে আকাশ দেখি।
কোন কোন দিন এক রিকশায় চার-পাঁচ জন চড়ে বসি। জান্তব ফোঁসফোঁস আওয়াজে দম নিতে নিতে এগিয়ে চলে রিকশা। আমরা তখন হুডখোলা রিকশায় নগরদর্শনে ব্যস্ত। উঁচু দালানগুলোর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হই, গল্প করি দূর ভবিষ্যতে কে কেমন দালান বানাবো তা নিয়ে। রিকশাওয়ালার পিঠবেয়ে নেমে আসা ঘামের রেখাগুলো ধীরে ধীরে মূর্ত হয়ে ওঠে চিত্রকল্পের মত। এই চিত্র কিছু পরেই বদলে যায়, চোখে পড়ে না আমাদের। এই আমিই কখনো বিকেল কাটাই তাদের সাথে। বুড়ো চাচাকে বলি আমার পাশে সিটে বসতে, জিজ্ঞেস করি কোথায় ঘুমান উনি, কত টাকা জোটে দিনে, কোনদিন পকেট উলটে শেষ পয়সাটাও দিয়ে দেই।
একেকদিন মেয়ে-ছেলে দেখে লোলুপ চোখে তাকাই। চোখ দিয়ে চেটে দেই যেন। পাশের বন্ধুকে বলি বিশ্রী সব চিন্তার কথা। শিশ বাজাই, চোখ মারি, কামাতুর হয়ে ঠোঁট কামড়াই। এই আমিই বাসে গর্জে উঠি মেয়েদের গায়ে কেউ হাত লাগালে। আমারই সামনে অন্য কেউ শিশ বাজালে এই আমারই কেন যেন গা জ্বালা করে।
বাজারে গেলে হাত নিশপিশ করে যা পাই তা কিনতে। কিনতে না পারি তো মনে হয় স্রেফ আলগোছে মেরে দেই। খুব উশখুশ লাগে। নিষিদ্ধ রোমাঞ্চে কেমন যেন হাল্কা লাগে পা জোড়া। স্বপ্নে ভেসে যাই। এই আমিই আদ্ধেকটা খেয়ে খাবার দিয়ে দেই পাশের নাকশি ভেজা, পেটফোলা, ছেঁড়া হাফপ্যান্ট পড়া কৌতূহলী জীবটাকে।
আয়না সামনে পেলেই কেমন যেন পালোয়ান হয়ে যাই। কখনো ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন তো কখনো মাসুদ রানা। আলতো শ্যাডোর সাথে উড়ে যায় ম্যাচজয়ী ছক্কাগুলো, মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে সোহানা চৌধুরীরা। ওয়েস্টার্ন মুভি মনে পড়ে। ঘোড়া ছুটিয়ে যাই ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্টের মত। হাইয়ো সিল্ভার, আওয়ে! সামান্য ঝগড়া থেকে বন্ধুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি প্রায় বিকেলেই। এক বেলা জিতি তো আরেক বেলা হারি। গতরে না পারলে বচনে পুষিয়ে দেই। কখনো বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে বীর, কখনো ছায়ার সাথে। তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর ঘটনায়ও আমি হাতা গুটিয়ে এগিয়ে যাই দু’কদম। আবার এই আমিই কখনো পিঠ পেতে ঠেকাই নিপীড়িত বন্ধুকে। একটুও ফিরে তাকাই না, একবারের জন্যও প্রত্যাঘাত করি না। আঘাত করতে যাবার ফাঁকে যদি আমার আশ্রিত বন্ধুর গায়ে লাঠি পড়ে, সেই ভয়ে পরম স্নেহের বাতাবরনে ঢেকে রাখি তাকে।
ঘরে বাবার চেয়েও আমার দাপট বেশি। বাবা যতই উপার্জন করুক, আমার ভাগের খাবারটাই সময় মত আসা চাই। আমার ভাগের রুটিটাই গোল হতে হবে, আমার রুটিটাই পোড়া হতে পারবে না। কোনবেলায় আমিষ না থাকলে আমার মুখ ভার হয়ে থাকে। সবজি মানুষে খায় কিনা, এই নিয়ে আমি ক্ষিপ্ত মত রাখি। এই আমিই বাঁকা-ত্যাঁরা রুটি বানাই বন্যার্তের জন্য। পঁচা পানি ভেঙে মিশে যাই বানভাসির সাথে। এই আমিই সব অহম জলাঞ্জলি দিয়ে প্রবাসের পথে বসে ভিক্ষা করি দেশের জন্য দুটো টাকা জোগাড় করতে।
পড়ার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াই সবান্ধব। ক্লাস বাদ দিয়ে টুয়েন্টি-নাইন খেলি ক্যাফে কাঁপিয়ে। ক্লাসে যাই তো নাক ডেকে ঘুমাই। জেগে থাকলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করি কল্পনাযোগ্য সব রকম নষ্টামি করে। বিকেল হলে দল বেঁধে মাঠে যাই খেলতে। সন্ধ্যা হলে আড্ডায় জমে যাই চা-বিস্কুট সমেত। রাত বাড়লে কোনদিন তেহারি তো কোনদিন বিরিয়ানি। খেলা দেখবো বলে ক্লাস ফাঁকি দেই। বড় কিছু হলে হল্লা-হুল্লোড় করে সব বন্ধ করে দেই। এই আমিই রাত জাগি সমীকরণ সমাধান করতে। গন্ডা খানেক টিউশনি আর পানসে ডালে ভর করে এই আমিই একটি একটি করে দিন অতিপাত করি নতুন দিনের আশায়। জীবনের গতির সাথে তাল রাখতে না পারলেও জীবনের গভীরতা চিনতে চাই কেন যেন।
একটু চাপ আসলেই আমি ঝোপ খুঁজে বসে পড়ি। দেওয়াল দেখলে চতুষ্পদের মত নিজের উপস্থিতির চিহ্ন রেখে যাই। কেউ গাছের ছেলা বাকল দেখে আমাকে মনে করে, কেউ দেওয়ালপাড়ের গন্ধে বাধ্য হয় আমাকে মনে করতে। আমি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ফেলি ইমারতের প্লাস্টার। আবার পুরনো দালানগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আমিই গর্বিত হই এর ঐতিহ্যের অংশ হতে পেরে। আমিই দেওয়াল দাগাই, আমিই দেওয়ালে চড়ি, আমিই দেওয়াল ভাঙি, আমিই দেওয়াল হয়ে দাঁড়াই।
একটু চোখ রাঙালেই আমি চুপ হয়ে যাই, আবার ট্রাক-ট্যাঙ্কের সামনে আমি দাঁড়িয়ে যাই জগতের সবটুকু প্রতিবাদের মূর্তি হয়ে। আমি পথে ধাক্কা দিয়ে চলে যাই, বাসে সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমি শাহরুখের মত বুকফাড়া জামা পড়ি, আবার রাতজেগে বসে থাকি নববর্ষ বরণ করতে।
আমি পানির মত ভাসমান কখনো। বাঁধনগুলো আমি বাতাসের মত এড়িয়ে যাই কখনো। ধরিত্রীর মত সহিষ্ণু এই আমিই আগুনের মত জ্বলে উঠি অপমানের বদলা নিতে। নিজে না খেয়ে যাকে খাওয়াই, তাকেই প্রতিরোধ করতে আমি দেহের প্রতিটি উপশিরাকে মেরুদণ্ডে পরিণত করি কখনো। অনেক দুর্নীতি দেখেও আমি নিথর, আবার সামান্য অপনীতি দেখেও আমার চামড়ার ভেতরে-বাইরে জ্বলে ওঠে একসাথে।
অনেক দ্বন্দ্ব আমার। আমি ছাত্র, তাই।
No comments:
Post a Comment