“...তো সেই দাওয়াতে উনি বলছিলেন আমেরিকা এসে কত জায়গায় থেকেছেন, কী কী কাজ করেছেন, কতগুলো ডিগ্রি নিয়েছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।”
হ্যাঁ, উনি তো মনে হয় কয়েকটা করে মাস্টার্স আর পিএইচডি করেছেন। একটা মানুষ যে কত পড়াশুনা করতে পারে! আমার তো একটা ব্যাচেলরর্স করতেই তেল বের হয়ে যাচ্ছে।
“আরে কারণ আছে। ঐ দাওয়াতের কিছুদিন পরেই আরেক দাওয়াতে সেই কথা তুলে এক ভাই বলছিলেন এত সাফল্যের উৎস কী।”
তাই নাকি? কেমন? জানা দরকার। আমার মত লোকেদের যদি অবশেষে সিদ্ধিলাভ হয় শুনে, মন্দ কী?
“ওনাদের বাড়ি তো যমুনা নদীর পাড়ে। বন্যায় ভেসে যায় প্রতি বছর। বলছিলেন যে ওনার বাবা নাকি ওনাকে ছোটবেলায় নদীর পাড়ে নিয়ে ঘাড় ধরে পানির উপর ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। বলেছিলেন, ঠিক মত লেখাপড়া করবি, নয়তো এই নদীতে মাঝিগিরি করতে হবে। এরপর বাকি জীবন শুধু পড়াশুনার উপরেই আছেন উনি। এমন শিক্ষা কি সহজে ভুলা যায়?”
অসাধারণ ব্যাখ্যা। আমার এক বন্ধু আছে এই রকম। খুবই পড়ুয়া। ব্যাটা কিছুদিন আগে জিআরইতে ৮০০ স্কোর করলো ভার্বালে।
“বল কী? জিআরই-তে ৮০০? তাও ভার্বালে? পাগল নাকি? আমাকে তো সিপাই-বন্দুক দিয়ে পাহারা দিয়ে পড়ালেও আমি এমন কিছু করতে পারবো না!”
আর বলবেন না। পাগলই ব্যাটা। মাত্র তিন সপ্তাহের পড়ায় এমন স্কোর, বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে আমার। আমার জানা মতে আর কোন খাস বাঙ্গালি প্রোডাক্ট এত স্কোর করে নাই।
“তা ওকে কোন নদীর পাড়ে ঝুলিয়ে রেখেছিল ওর বাপ?”
কী জানি। নারায়নগঞ্জ বাড়ি। শীতলক্ষ্যার উপর হবে হয়তো।
“এটা তো পত্রিকায় দেওয়ার মত অর্জন। সবাইকে বলা দরকার এটা নিয়ে।”
হ্যাঁ, সেটাই। বেশি বিনয়ী, তাই বলে না। হবেই না কেন? এটুকু না থাকলে তো আমার-আপনার সাথে তফাৎ থাকতো না। জাত লাগে আসলে।
“সেটাই। সবার জন্য সব না। এরকম বড় বড় কিছু করতে হলে জাত লাগে অন্য রকম। যাক, খুব ভাল লাগলো শুনে। আমাদের জন্য তো এই দেশে এটাই আছে শুধু। লেখাপড়া দিয়ে কিছু অর্জন করা, একটু নাম কামানো। লেগে থাকতে বল, বড় কিছু হলে আমরা বলতে পারবো।”
এই জায়গাটায়ই খারাপ লাগে। এই দেশে যতদিনই থাকি, যতকিছুই করি, কোনদিন পলিসিমেকার জাতীয় কিছু হতে পারবো না। আমাদের সুযোগ আর সবার সমান, রেজাল্ট আর সবার চেয়ে ভাল, সবাই নামও করে অনেক। কিন্তু তবু যেন কেমন কেমন লাগে একটু।
“সব সময় না। সুযোগ যে কখন এসে পরে, তা কেউ বলতে পারে না। এই যে বাঁধ ভাঙ্গলো, এটা বানিয়েছিলো আর্মির ইঞ্জিনিয়াররা। এক রিটায়ার্ড অফিসার পত্রিকায় লিখেছিলেন যে উনি আগেই প্রেডিক্ট করেছিলেন এমন একটা সমস্যার কারণে বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। ঐটা আমার রিসার্চের মধ্যেই পড়ে। লোকটার কথা পুরা ভুল ছিল। আমি পত্রিকায় চিঠি লিখলাম। প্রথমে তো আমার কথা কেউ পাত্তাই দিতে চায় না। আমি বাইরের দেশের এক প্রোফেসর, আমি কী জানি, বলো? পরে অনেক রিপোর্ট হল এটা নিয়ে, শেষ পর্যন্ত সেই আর্মি অফিসার মেনে নিলেন যে ভুল তাঁরই ছিল।”
একই ব্যাপার তো এলএসইউ হারিকেন সেন্টারের ডঃ ভ্যান হিয়েরডেনকে নিয়ে হয়েছিল শুনেছিলাম। উনি বলেছিলেন যে বড় হারিকেন আসবে, তাই যেন আগে কিছু তাঁবু কিনে রাখে সরকার। ওনার সাউথ আফ্রিকান অ্যাক্সেন্ট শুনে ফিমার অপারেটর বলেছিলো, আমেরিকানরা তাঁবুতে ঘুমায় না। এই ব্যাপারগুলোই খারাপ লাগে। যত কিছুই করেন না কেন, সারা জীবন সেকেন্ডক্লাস সিটিজেনের তকমা গায়ে লেগে থাকবে।
“ঠিক কথা। এই যে আমি এই এলাকায় আছি, তবু কেমন যেন লাগে। এই শহরের এটা সবচেয়ে দামী এলাকা। আমার রিসার্চ নিয়ে মিডিয়ায় অনেক রকম রিপোর্ট হচ্ছে, তবুও আমি ঘর থেকে বের হলেই মনে হয় যে পাড়াভর্তি সাদার মধ্যে আমি একটা কালো চামড়ার লোক।”
এই কথাই আমি বাইরে আসার কিছুদিন পর আমার হিন্দু বন্ধুদের বলছিলাম। সংখ্যালঘু জীবন কী জিনিস, সেটা বাইরে এসে বুঝেছি আমি। সংখ্যালঘু জীবনের দহনগুলো চামড়ার নিচে। উপর থেকে মনে হয় যেন সবই ভাল, সবাই সমান, সবই ঠিক। কিন্তু ভেতরের জ্বালাটা কাউকে ভাষায় বোঝানোর না। আমেরিকায় এত সমতা, আইনে এত নিরপেক্ষতা, তবুও এটা মনে হয়। আমাদের দেশে কী করতে বাকি রেখেছি আমরা সংখ্যালঘুদের উপর!
“কী বলে শুনে তারা?”
কী আর বলবে। শুকনা একটা হাসি দিয়ে বলে, বুঝলা তাহলে এতদিন পরে। আমি এই জন্যও বলি যে আমাদের দেশের মানুষের কিছুদিন বাইরে ঘুরে আসা উচিত। তাতে যদি স্বভাব একটু ঠিক হয় বাঙ্গালির।
“নাহ, সেটা হওয়ার না। বাঙ্গালি উলটা যেখানে যায়, সেই জায়গাই নষ্ট করে দেয়। দুইটা বাঙ্গালি এক হলেই শুরু হয়ে যায় হিংসা আর দলাদলি। চরিত্র বদলাবে না বাঙ্গালির কোনদিন।”
সেটা খুব একটা ভুল বলেন নাই। আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আমাদের শুধু আরো বেশি করে ধার্মিক করে দেয় বাইরে আসলে। দেশে মানুষ মোল্লা হয়ে যায় আইডি প্রকাশ পেয়ে গেলে, আর বাইরে এসে মোল্লা হয়ে যায় আইডি খুঁজে না পেলে।
“দেশে আইডি প্রকাশ পেয়ে যায় কীভাবে?”
জেলে গেলে! পত্রিকা খুললেই দেখেন না, এক সপ্তাহ রিমান্ডে গেলেই কেমন নূরানী দাড়ি নিয়ে বের হয় সব।
“ঠিক, ঠিক। তবে আইডি ক্রাইসিস আছে বলেই মাইনরিটিরা লেখাপড়ায় মনোযোগী হয় অনেক। ছেলেমেয়েদের অনেক যত্ন করে পড়ায়। এটা এই দেশের লোকেরা করে না। করার দরকারও নাই তেমন। দেশ তো এদেরই। এত্ত সম্পদ। ঝুট-ঝামেলার কাজ করে দেওয়ার জন্য তো আমরা আছিই।”
হ্যাঁ, তবে আমরাও মাইনরিটি, কালোরাও মাইনরিটি, হিসপ্যানিকরাও মাইনরিটি, ঐদিকে আবার ইহুদিরাও মাইনরিটি। অথচ তফাৎটা কেমন আকাশ-পাতাল।
“ইহুদিদের কথা আলাদা। ওরা পাঁচ হাজার বছর ধরে মাইনরিটি। সার্ভাইভাল স্কিল ওদের চেয়ে ভাল জানে না কেউ। ওরা যেখানে যেতে হয় যাবে, যা করতে হয় করবে। ওদের পা-ধোয়া পানি খাওয়ার যোগ্যতাও নাই আমাদের।”
এটা ঠিক বলেছেন। আমরা কথায় কথায় গালি দেই ওদের ঠিকই। কিন্তু নিজেরটা কীভাবে আদায় করে নিতে হয়, সেটা ওদের কাছ থেকে শেখার আছে আমাদের। আর, ওদের কেউ কোন কিছু হাতে তুলে দেয় নাই। কখনও জোর করে, কখনও পরিশ্রম দিয়ে, কখনও কৌশলে ওরা নিজেদেরটা ঠিকই আদায় করে নিয়েছে।
“আমি আর সব মুসলমানের মত ইহুদিদের কথায় কথায় গালি দেই না। আমি তো বরং বলি যে আমাকে দশটা ইহুদির সাথে বোতলে ভরে ঝাঁকায় না কেন? তাহলে যদি আমি ওদের কাছে কিছু শিখতে পারতাম। এরা যে কী পরিমাণ পরিশ্রম করে, আর কত আন্তরিকতা নিয়ে কোন কাজ করে, সেটা না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না।”
মুসলমানদের চেয়ে তো ওদের ক্রিশ্চিয়ানদের সাথে ঝামেলা বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু কীভাবে ঘাড়ে চড়ে গেছে সব ক্রিশ্চিয়ান দেশের। ওদের হয়ে আমেরিকা যুদ্ধ করে পথে বসে, ওদিকে ওরা আরো জাঁকিয়ে বসে নিজের দেশে। পুরো মধ্যপ্রাচ্যের যেই একটা মাত্র জায়গায় তেল নাই, সেখানে বসে পুরা আরব শাসন করছে। স্টেটসম্যানশিপ শেখার আছে অনেক ওদের কাছে।
“আমি তো অ্যাকাডেমিক লাইনে দেখছি। সব উঁচু ইউনিভার্সিটির প্রোফেসররা ইহুদি। নোবেল পুরষ্কার এরাই পায় সব। সেই রকম কাজগুলো এরাই করছে। আমরা শুধু পাশের মানুষটার দোষ খুঁজি আর ফালতু সব ব্যাপারে দুনিয়া মাথায় তুলে ফেলি। এসব করি, আবার দাবি করি আমরাই নাকি শ্রেষ্ঠ জাতি।”
কাজে আর কথায় ফারাকটা তো নতুন কিছু না। আমার সেই বন্ধুই বলছিলো যে ৬২% এর বেশি নোবেল লরেট নাকি ইহুদি।
“খুবই স্বাভাবিক। আমার সাথের এক প্রোফেসরের কথা বলি। ইরান থেকে এসেছে এই লোক। আমি দেখি তার কাছে-ধারে যায় না ডিপার্টমেন্টের কেউ। কারণ জানতে চাইলাম এক আমেরিকান প্রোফেসরের কাছে। বলে যে তাদের মনে হয় ঐ লোকের মাথায় দোষ আছে একটু। একবার নাকি টয়লেটে ওযু করার সময় সিঙ্কে পা তুলে দিয়ে পা ধুচ্ছিলেন। চিন্তা কর, একটা লোক সিঙ্কে পা ধুচ্ছে, আবার পাশের লোকটার দিকে তাকিয়ে বলছে, আমি তোমার চেয়ে উত্তম, আমি বেহেশতে যাবো। একই কাজ যে কত বাঙ্গালিকেও করতে দেখেছি, তার কোন হিসাব নাই।”
আমাদের দেশে হবে সেই মুমিন কবে, কথায় না বড় হয়ে নিচে পা ধুবে!
“এই দেশের মানুষ ইহুদিদের দেখতে পারে, তা না। সেই জন্যই ক্ষমতায় ওরা উঠতে পারে না, কিন্তু সবকিছুর উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ঠিকই রেখেছে ওরা। শেখার আছে আমাদের অনেক এই দিকে।”
আমার চোখে ইহুদিদের একটা বড় গুণ হল, তাদের নিয়ে কেউ কিছু বললেও ওরা সেটা গায়ে মাখে না। নিজের কাজ করে যায়। বরং নিজেরাই নিজেদের নিয়ে এত ঠাট্টা করে, যে আর কারও কিছু বলার নাই। আর আমরা মুসলমানরা সামান্য কিছুতেই অযথা লাফ দিয়ে উঠি। এত্ত বেশি হুজুগে আমরা সবাইই যে বলার মত না।
“সার্ভাইভাল মেকানিজম। ঐ যে বললাম, পাঁচ হাজার বছরের মাইনরিটি। ওরা জানে যে এসব নিয়ে পড়ে থাকলে ওদেরই ক্ষতি। এই জন্যই এত বেশি কাজের মধ্যে থাকে ওরা।”
আরেকটা ব্যাপার হল ইসরায়েলের প্রতি এদের ডিভোশন। পৃথিবীর যেই প্রান্তেই থাকুক না কেন, এরা এদের আয়ের একটা অংশ ইসরায়েলকে দেয় প্রতি বছর। স্যাবাটিকাল লিভ কাটায় ইসরায়েলি ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়ে। এমন কি ভারতীয়রাও এটা করে। করি না শুধু আমরা।
“আমাদের সমস্যা তো গোড়াতেই। আমরা আমাদের সব ব্যার্থতার জন্যই অন্য কাউকে দোষারোপ করে অভ্যস্ত। এজন্যই আমরা এত পিছনে।”
এটা নিয়ে আমার সেই বন্ধু একটা মজার কথা বলেছিল। ফ্যামিলি গাই-তে নাকি একবার স্টুয়ি ইহুদি হওয়ার জন্য গিয়ে দেখে অপ্টিমাস প্রাইম স্কালক্যাপ পরে বসে আছে।
“ফ্যামিলি গাই? অপ্টিমাস প্রাইম? এগুলা আবার কী?”
No comments:
Post a Comment