Thursday, January 24, 2008

প্রবাসের কথোপকথন ৮

“ঈদ মুবারক, দুবলা!”
ঈদ মোবারক, ভাইয়া। এই নিয়ে ছয়বার হল একদিনে।

“কী করবো বল? প্যাদরা নাই, ঘটি নাই, তাই তোমাকেই বলি বারবার।”
সেটাই। আপনি আর আমি ছাড়া এই ঘরে কেউ নাই।

“এই ব্যাটা, ভাগ! কী সব অশ্লীল কথাবার্তা বলিস।”
মন বড়ই উতলা, ভাইয়া। আর কাউকে তো কিছু বলার নাই। তাই আপনার সাথেই ঈদের দিনের আন্তরিক সময় কাটাই।

“হ্যাঁ, কেউ নাই আসলে এই ঈদে।”
মন খারাপ, হানি? ব্যাপার না। আসেন আপনি আর আমি মিলেই ঈদাঈদি করি।

“এই, তোর সমস্যাটা কী বল তো? আজকে এমন আমেরিকান হয়ে গেছিস যে? বিয়ার-টিয়ার খেয়ে আসছিস নাকি বাইরে থেকে?”
নাহ, বাইরে আর গেলাম কখন। মন ভাল না আসলে, ভাইয়া। সেই জন্যই ইয়ার্কি-তামাশা করছিলাম। দেশের বাইরে ঈদ, অল্প কয়টা মানুষ আমরা, তবুও আমরা দুইজন একা বসে আছি। কতক্ষণ আর অন্য কথা বলে আসল ব্যাপার এড়াবো, বলেন? সবাই মিলে ঈদে ঘুরতে গেল, আমাদের একবার বললোও না।

“তা ঠিক। এই ভাবে দেখার কিছু নাই। আফটার অল, এটা ওদের চয়েস।”
তা তো অবশ্যই। কিন্তু তবুও তো মনটা একটু কেমন কেমন লাগে, তাই না? আমি নাহয় অল্প দিন হয় এসেছি, আপনি তো আজকে সাড়ে চার বছর ধরে এদের সাথেই আছেন। আপনাকেও বললো না?

“নাহ, আমার এসব আর গায়ে লাগে না। অভ্যাস হয়ে গেছে। আমার ভালোও লাগে না এত হইচই।”
উপেক্ষিতের আত্মপ্রবোধ। সত্যিটা আপনি-আমি দুই জনেই জানি। আর সবার সাথে তফাৎ এখানেই যে, আমাদের দুই জনের গাড়ি নাই। সকালে ঈদের জামাতের জন্য জাগিয়ে দিতে হবে দেখেই যেন সাথে করে নিয়ে গেল। আর এই বেলায় একই আসর থেকে সবাই উঠে দাওয়াতে গেল এমন কায়দা করে যাতে আমরা দুই জনেই আলাদা থেকে যাই। কালকেই আবার শুনাবে আমরা গেলাম না কেন, আমাদের দাম বেড়ে গেছে নাকি, ওদেরকে ভাল লাগে না নাকি। বিরক্ত এসব দেখে দেখে।

“উহু, এই ভাবে চিন্তা করতে নাই। আল্লাহ ওদের দিয়েছে, ওরা এনজয় করছে। এগুলা আমি পাত্তা দেই না। আমার যেটুকু আছে সেটা নিয়েই আমি খুশি।”
তবুও তো খারাপ একটু লাগেই। প্রথম ঈদের কথা মনে পড়ছে, জানেন? বড় বেশি দোটানার ছিল ঈদটা। জীবনে প্রথম শার্ট-প্যান্ট-সোয়েটার পড়ে ঈদের নামাজ পরলাম সেবার। নামাজ সেরে ঘরে এসেই ক্লাসে দৌঁড়ানো। বিকালে ছাত্ররা মিলে জমায়েতটা ভাল ছিল, কিন্তু দেশের তুলনায় কিছুই না। মা ফোন করে খুব কাঁদছিল। বকেছিলাম খুব। কিন্তু ফোনটা রাখার পর বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা মোচড় দিলো। অথচ আগের রাতেই অনেক রোমাঞ্চিত ছিলাম। একা ঈদ করবো। নিজের মত ঘুরে বেড়াবো। কেউ ডাকবে না, কেউ বকবে না। সেটাই বিকাল নাগাদ আফসোস হয়ে ফেরত আসলো। কেউ ডাকলো না, কেউ বকলো না!

“আরে তুমি তো অনেক খুশি ছিলা সেই ঈদে। আমরা বলাবলি করছিলাম তুমি একা ঈদ করেও এমন খুশি, ব্যাপারটা কী। নতুন ছাত্ররা আরেকটু মনমরা থাকে।”
সিদ্ধি, সিদ্ধি। সাধনার সিদ্ধি।

“সিদ্ধি? এটা তো জিআরই বাংলা বললা। আমি তো বাইরে বড় হওয়া মানুষ, এত কঠিন বাংলা বুঝি না।”
হাহ, হাহ। আমি বাচ্চা কাল থেকে একটা মেয়েকে পছন্দ করি। পাত্তা না পেয়ে মনের দুঃখে বাইরে চলে আসলাম। সেই ঈদের দিন সকালে দেখি ইমেইল করে প্রেমের কথা বলছে।

“ওয়াও! ছক্কা! এই কথা আগে বললা না কেন? আমরাও মজা করতাম। লাভ-লেটার লিখছিলা তাহলে বসে বসে ঈদের দিনে।”
উহু। বলেছিলাম, ভাল মত ঈদ কর। আমিও ঈদটা ঠিক মত করে নেই। তারপরে জবাব দিবো।

“বল কী? রাগ করে নাই?”
করে নাই মানে? এই যে দাগটা দেখছেন না? দেশে গিয়ে সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম যে। এইটা হল ওনাকে এক দিন অপেক্ষা করানোর শাস্তি।

“প্যাদরারটার মত তাহলে। ব্যাটার বৌ আসার পরপর দেখি মুখে কাটাছাটা দাগ। জিজ্ঞেস করলাম, কী রে ব্যাটা, বেশ সুখে আছিস মনে হয়? বলে, না না, দরজায় বাড়ি খেয়েছি!”
হ্যাঁ, মনে আছে। তবে আরো মজার ছিল ভাবি আসার আগে ওনার সাঁতার কাটা বেড়ে যাওয়া। সপ্তাহে নিয়ম করে বারো বার সাঁতার কাটতে যেতেন। দেখেও না দেখে থাকতাম আর কী। এখন তো আর চিনেই না আমাদের। আচ্ছা, কোথায় কোথায় বেড়াচ্ছে এখন মনে হয়?

“লেটস নট টক অ্যাবাউট ইট। আজকে বৌ নাই ইন্টারনেটে? কথা হয় নাই আজকে?”
ছিল কিছুক্ষণ। ঘুরতে বের হয়ে গেছে বন্ধুদের সাথে। উনি আমার জন্য আর কোন কিছু তুলে রাখতে নারাজ।

“দেন লেটস নট টক অ্যাবাউট দ্যাট অ্যাজ ওয়েল। ঢাকায় কেমন কাটতো ঈদের দিন তোমাদের? আমি তো আফ্রিকায় বেবুনের সাথে উগাবুগা করে করে দিন কাটাতাম।”
দেশে থাকতে কত মজার ছিল ঈদের দিনগুলো। একা বের হতে দিত না, তবে আত্মীয়দের বাড়ি ঘুরতে যাওয়া হত। ঈদের সকালে স্পেশাল চটপটি বানাতো মা। নানার বাসায় কোর্মা করতো শুধু আমার জন্য আলাদা করে। বেশি মিষ্টি দিয়ে জর্দা-সেমাই বানাতো।

“এই ব্যাটা, ক্ষুধা লেগে যায় তো। চুপ থাক। খাওয়ার কথা বলবি না।”
দুই বাড়িতে ছাত্রদের জন্য দাওয়াত জোগাড় করেছিলাম। সবাইকে ফোন করে জানালাম, অথচ নিজেই বসে আছি এখন একা একা। ধ্যাৎ।

“বললাম না এসব মাথায় আনতে না? গ্রো আপ। লাইফে এরকম অনেক কিছুই হয়।”
আমার বেলায়ই এরকম বিব্রতকর ব্যাপারগুলো হয় শুধু। উফ, ক্ষুধায় পেটে বোমা ফুটছে।

“আরে আস্তে বল, ব্যাটা। দেখা যাবে ধরে নিয়ে যাবে শেষে। তখন মামুর বাড়ির মিষ্টি খেয়ো বসে বসে।”
খারাপ না আইডিয়াটা। কেমন না এই অতিসাবধানতা? এই যে সাধারণ কথাবার্তার সময়ও চোরের মত থাকা। মাঝেমধ্যে মনে হয় আসলেই কিছু একটা করে ফেলি। ভুগবো যখন, দোষ করেই ভুগি।

“এসব ভেবে লাভ নেই। এটুকু ঝামেলা মেনে নিতেই হবে এখন। ঘটি তো নিজের নামের সামনে থেকে মুহাম্মদই সরিয়ে ফেললো ভয়ে। ভীতু একটা। আমাদের আরেক বড় ভাই ছিল। সিটিজেন এই দেশের। তবুও ব্যাটা ভয়ে বের হত না ঘর থেকে প্রথম প্রথম।”
মেনে নিতেই হয় এখন। তবুও ভালো আমাদের দেখে ইন্ডিয়ান বলে, মুসলিম না। এই একটা দিকে সবজিদের কাছে আমাদের ঋণ শোধ হবার না। নাহলে খবরই ছিল। আরবগুলো তো বদমাইশি করলেও ওদের ব্যাকিং আছে অনেক। ধরপাকড়ের সময় তো আমাদের উপর দিয়েই যায় সব।

“আমার তো এক সিমেস্টারের টিউশন ফি আটকে দিয়েছিল। আমার বাবার নামে এক লোকের নাম আছে বলে ওয়াচলিস্টে। আর যায় কই। এই দিকে আমাকে তো টাকার জন্য বের করার অবস্থা। শেষে ক্রেডিট কার্ডে কাজ সারলাম। পরে টাকা রিলিজ হল ছয় মাস পর।”
আহারে বেচারা। আমাকে তো পাঠানোর সময় এক সিমেস্টারের টাকা দিয়ে বলেছিল যে এটাই শেষ। বাকিটা নিজেরই যোগাড় করতে হয়েছে। আমেরিকা দেখেই পেরেছি। যত যাই বলেন, ছাত্রদের জন্য এরচেয়ে ভালো জায়গা নাই আর কোন।

“বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। ভালই। ঘুম দিবো নে একটা। ক্ষুধাটাই সমস্যা। গান গাও তো দেখি একটা।”
আমি? গান? বের করে দেবে বাসা থেকে তাহলে। এখন কে অশ্লীল কথা বলছে? এর পরে কী বলবেন? বাইজির মত নাচবো? আপনি বরং গিটার খেলেন।

“লজ্জা দাও, না?”
লজ্জা পেলেই লজ্জা। আমি তো শুধু আপনার কথা আপনাকে মনে করিয়ে দিলাম।

“আমার কী দোষ? ইংলিশে বলে প্লেয়িং দ্য গিটার, আমি তাই বাংলায় গিটার খেলা বলে ফেলেছিলাম। পরে বুঝলাম যে এটা ভুল। বাংলা অনেক কঠিন ভাষা।”
তা ঠিক। তবে, আপনাদের ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা শুনে অসম্ভব মজা লাগতো। সাতার কথা মনে আছে? ঐ যে, দাওয়াতে গিয়ে বলেছিলেন, সাতা আসে? এইটা মনে থাকবে কেন, বলেন? ছাতা চাইলেন আর ট্র্যাশ ধরিয়ে দিল, এমন দৃশ্য বিরল।

“হ্যাঁ, দ্যাট ওয়াজ ভেরি এমব্যারাসিং। জন্ম বাংলাদেশে, বড় হয়েছি আফ্রিকায়, পড়ি আমেরিকায়, এর উপর আবার আরবি শিখতে হয়েছে। ছ উচ্চারণ করা খুবই কঠিন। আমার চেয়ে ভাল জানে না এটা কেউ। বহু কষ্টে এখন ছ বলি।”
তা আর আমি জানি না? যাক, পেট ডাকছে। বার্গার কিং বন্ধ হয়ে যাবে। সলেন!

“হ্যাঁ, সলো! কিন্তু টাকা আছে তো? আমার হাত একদম ফাঁকা।”
আমার কাছে সাড়ে পাঁচ টাকা আছে সাকুল্যে। বার্গার হবে একটা, ড্রিংক ভাগ করে খাবো নে। তবে এই দফায় আপনার সানডে পাই হচ্ছে না।

“ইশ, বৃষ্টি নেমে গেলো। একটু বসে যাই।”
আর দেরি করা যাবে না। পিছনের মাঠটা দিয়ে শর্টকাট মারলেও বন্ধ হওয়ার পাঁচ মিনিট মত আগে ঢুকতে পারবো।

“তাহলে কী আর করা। এ কী, ব্যাটারা ছাতাগুলোও নিয়ে গেছে?”

No comments: