গতকাল (২৫শে ফেব্রুয়ারি) বিডিআর-এর বিদ্রোহ নিয়ে নানান জনের অনেক রকম মত ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার নিজের মত অনেকের সাথেই মিলছে না। সেগুলো নিচে দেওয়ার চেষ্টা করছি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা সহ। আমার দৃষ্টিভঙ্গি অমানবিক মনে হয়ে থাকলে দুঃখিত। আমার বিবেচনায়, ব্যাপারটা নিয়ে খুব দ্রুত আবেগপ্রবণ না হয়ে প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর সম্ভাব্য ফলাফল দেখা উচিত। কখনও সময়ের অভাবে, কখনও পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকতে গিয়ে অনেক কিছু বলা যায় না। তবু চেষ্টা করছি খোলামেলা ভাবেই বলতে।
স্পেশাল কেস
জীবন-কলমের কালি অমোচনীয়। এতে একবার যা-লেখা হয়, তা মুছবার অবকাশ নেই। ভবিষ্যতে হয়তো টীকা জুড়ে দেওয়া যায়, চাই কি কেটে আবার লেখা যায়, কিন্তু মুছে নতুন করে লিখবার কোন অবকাশ নেই। সেই সাথে আরও সত্য, জীবন-খাতার পাতা উলটে বারবার পেছনে যাওয়া যত কমানো যায়, ততই ভাল। জীবন চলার অংশ হিসেবেই এই শিক্ষাটুকু আমরা ধারণ করি। কথাগুলো রাষ্ট্রের বেলায়ও সত্য। এই বিবেচনায় আমি “স্পেশাল কেস”-এর বিপরীতে।
এখানে “স্পেশাল কেস” হল আইনের স্বাভাবিক গতিকে রহিত বা প্রভাবিত করা। কোন অপরাধের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করা এমনই একটি স্পেশাল কেস। প্রতিটি স্পেশাল কেস একটা রাষ্ট্রকে ঐ সময়টায় আটকে রাখে। আমরা পঁচাত্তরের স্পেশাল কেসে ফিরে যাই আজও বারবার। দেরিতে হলেও আমরা উপলব্ধি করেছি যে অপরাধমাত্রেই তা শাস্তিযোগ্য, উদ্দেশ্য যেমনটাই হোক না কেন।
সাধারণ ক্ষমা ঘোষনার দ্রুততা
বিডিআর-এর সদস্যরা অস্ত্র জমা দিতে শুরু করেছেন বলে খবরে প্রকাশ। এর বাইরে তাদের হাতে কোন উপায় ছিল না। ঘেরাও অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকতে পারতেন না তারা। অনেকে দ্বিমত পোষন করলেও আমি এত দ্রুত সাধারণ ক্ষমা ঘোষনার বিপক্ষে ছিলাম, আছি এখনও। সেই বিচারই শ্রেষ্ঠ, যার পর বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। বিডিআর-এর দাবিগুলো ন্যায্য, কিন্তু সেই যৌক্তিকতা তাদের মানুষ হত্যার অধিকার দেয় না, দেশ ও সরকারকে জিম্মি করার অধিকার দেয় না। দাবি মেনে নেওয়া উচিত, তবে সেই সাথে বিচারেরও সম্মুখীন করা উচিত। তাহলেই সকল পক্ষের প্রতি সমান থাকা হবে। তাছাড়া, অপরাধের মাত্রা ও কারণ না জেনেই ব্ল্যাঙ্কেট ইমিউনিটি দেওয়া খুব বড় একটি কৌশলগত ভুল। এখন বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যাচ্ছে অনেক রকম অপকর্মের কথা। এগুলো না জেনেই সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা ঠিক ছিল বলে মনে করি না আমি।
আনুপাতিক প্রতিবাদ
এরপরের প্রসঙ্গ ছিল অনুপাতের। সেন্স-অফ-প্রোপোরশন অতিক্রম করে যাওয়া যেকোন কিছুই অপরাধ এবং শাস্তিযোগ্য। চুরি, দুর্নীতি বন্ধ করা সবার দাবি, ন্যায্য দাবি। তাই বলে এই দাবি আদায়ের জন্য সহিংস হওয়া ন্যায্য না। যেই দাবিগুলো করা হয়েছে, সেই একই দাবি সরকারের বিভিন্ন স্তরের কর্মচারীরা করে থাকেন। আলোচনা, কর্মবিরতি, বা অবরোধের মাধ্যমে আদায়ও করেন। তারা বিডিআর-এর জওয়ানদের চেয়ে শিক্ষা বা সামাজিক অবস্থানে খুব উন্নত নন। একবার এমন কোন জিম্মি অবস্থায় মাথা নত করে ফেললে তা চিরকালের জন্য সরকারকে দুর্বল করে দেবে।
প্রাণহানি হ্রাস বনাম প্রাণের মর্যাদা
যেকোন সশস্ত্র বিদ্রোহ চলাকালে প্রথম বিবেচ্য অবশ্যই প্রাণহানি হ্রাস। তবে এসময় অনেক রকম হিসাব ও সমীকরণ মাথায় রাখতে হয়। অনেক রকম আলোচ্য ও বিবেচ্য বিষয় থাকে। এর কিছু থাকে অবস্থা-নির্ভর, আবার কিছু থাকে সার্বজনীন। প্রাণহানি সর্বোচ্চ অপরাধ। এর বিনিময়ে যদি কারও দু’দিনের জেলও না হয়, তাহলে আইনের দরকার কী? প্রাণহানি হ্রাস যেমন প্রয়োজন, তেমনি হারিয়ে যাওয়া প্রাণের মর্যাদা দানের প্রশ্নও থেকে যায়।
নেগোসিয়েশন
কোন প্রকার সমঝোতা ততক্ষণই এগিয়ে যায়, যতক্ষণ উভয় পক্ষের কিছু চাইবার থাকে। প্রতিপক্ষের সব চাওয়া একবারেই পূরণ করে ফেললে তাদের মর্জির মুখাপেক্ষী হয়ে যেতে হয়। অতিদ্রুত সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করায় তা-ই হয়েছে। সাধারণ ক্ষমা হল সরকারের হাতের তুরুপের তাস। এটি শুরুতেই খেলে ফেলা মানে প্রতিপক্ষকে হাই-গ্রাউন্ড দিয়ে দেওয়া। এটি চূড়ান্ত মার্জনা, এবং তা পাবার জন্য অপরাধীকে চূড়ান্ত ভাবেই কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুগত হতে হবে। একজন প্রধানমন্ত্রী সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করতেই পারেন। এটি রাজনৈতিক ও মানবিক সিদ্ধান্ত, তবে এটি আসবে একেবারে শেষে। অতি দ্রুত সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করায় বিডিআর-এর সদস্যরা আরও দাবি করেছেন, অস্ত্র জমা দিতে গরিমসি করেছেন। এ-ধরণের ঘটনায় একজন প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান এবং কর্তৃত্ব প্রচণ্ডভাবে দুর্বল হয়।
প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল নিম্নবিধ পালটা প্রস্তাব দেওয়াঃ
- প্রথমে অস্ত্র নামিয়ে রাখতে হবে
- নারী, শিশু, ও বেসামরিক ব্যক্তিদের ছেড়ে দিতে হবে
- সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে
- আত্মসমর্পণের পর অভিযুক্তদের যথাযথ নিরাপত্তার বিধান করা হবে
- সকল অপরাধের বিচার হবে
- বিচারের পর আদালত উপযুক্ত শাস্তির বিধান করবেন
- এই আইনী প্রক্রিয়া যথাযথ ভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী আন্তরিকতার সাথে সাধারণ ক্ষমা করে দেওয়া বিবেচনা করবেন
এই পন্থা বিডিআর-এর কেউ স্বেচ্ছায় মেনে নিতে না চাওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু এর বিপরীতে তাদের মনে করিয়ে দেওয়া ছিল দু’টি বিষয়। প্রথমত, একটি সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে তারা প্রধানমন্ত্রীর আদেশ মানতে দায়বদ্ধ। ক্ষমা করবার পূর্বে তাদের দিক থেকেও প্রমাণ রাখা প্রয়োজন যে তারা ব্যারাকে ফিরে একটি অনুগত ও সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে কাজে যোগ দেবে। দ্বিতীয়ত, সাধারণ ক্ষমা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং তা গ্রহণ করতে প্রধানমন্ত্রী প্রস্তুত হলেও দেশের দীর্ঘমেয়াদী ভাল চিন্তা করলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা জরুরী। দেশের কথা ভেবেই প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত হতে হবে তাদের। খুনের অপরাধ মাফ হয়ে যাওয়া অনেক বড় ব্যাপার, এবং এই সুবিধাটি তাদের অর্জন করে নিতে হবে।
আইনের শাসন
পরের প্রসঙ্গ আইনের শাসনের। আইন প্রণয়নের সময় তা একদিনের জন্য তৈরি করা হয় না। আইনের কোন বিবেক নেই, আইনের কোন বুদ্ধি নেই। দুইয়ে দুইয়ে যেমন প্রতিবার চার হয়, তেমনি আইনের বিবেচনায় কোন অপরাধের শাস্তি প্রতিবার একই হয়। এই নৈর্ব্যক্তিকতার কারণেই আইন সার্বজনীন। আইনের লক্ষ্য থাকে রাষ্ট্রের দুর্বলতম নাগরিকের সকল নাগরিক অধিকার সর্বোচ্চ প্রতিকূলতার মুখেও রক্ষা করা। এ-কারণেই আইনে স্পেশাল কেস থাকতে নেই। এই সাধারণ ক্ষমা এটাই প্রতিষ্ঠিত করে গেল যে সাধারণ, নিয়মানুবর্তী নাগরিকের চেয়ে বিশৃঙ্খল বন্দুকধারীর ক্ষমতা বেশি। সব অপরাধের আইন আগে থেকেই তৈরি থাকে না। সেক্ষেত্রে বিবেচনার ভিত্তিতে অপরাধের প্রতিবিধান নির্ণীত হয়। এই ঘটনায় খুব খারাপ একটি প্রিসিডেন্স তৈরি করে গেল। এরপর যে-কেউ নিজের মত আইন হাতে তুলে নেবেন।
ক্ষমা বনাম সাধারণ ক্ষমা
সাধারণ ক্ষমা ঘোষনার আগে পরিস্থিতি নিয়ে আরেকটু সবিস্তারে জেনে নেওয়া উচিত ছিল। সব ব্যাপারে সম্পূর্ণ তথ্য না জেনেই এই ক্ষমা ঘোষনা করা হয়েছে। একটু একটু করে অনেক খবর বেরিয়ে আসছে এখন। বিডিআর-এর জওয়ানদের হাতে সার্বক্ষণিক অস্ত্র থাকার কথা না। তারা কীভাবে সুসজ্জিত হয়েই তৈরি ছিলেন? ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বিভিন্ন ভাবে অপদস্ত করা হয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশ। তাদের দিয়ে শারীরিক কসরত করানো হয়েছে। এটি কি দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন, না “হেইট ক্রাইম”? সেনাবাহিনীর কর্নেলদের খুন করে ড্রেনে লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছে। যত অপরাধীই হোন না কেন, পদস্থ অফিসারদের এভাবে অপমান করা কি ঠিক? ড্রেন থেকে তুলে আনা লাশে শুধু গুলি নয়, মুখে বেয়নেটের খোঁচার দাগও দেখা গেছে বলে পত্রিকায় প্রকাশ। এই অভব্যতা কি ক্ষমার্হ?
সাধারণ ক্ষমা অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর, কিন্তু ক্ষমা করবার আগে জেনে নেওয়া উচিত কী কী অপরাধ ক্ষমা করা হচ্ছে। সে-ব্যাপারে স্পষ্টভাবে আলোচনা হওয়া উচিত। এই অপরাধ সংঘটনের পর বিডিআর-এর সদস্যরা কি আবারও পুনর্বহাল হবেন পূর্বপদে? একটি রাষ্ট্রের জন্য কি খুব সুখকর পরিস্থিতি এটি? সে-কারণেই অপরাধ, প্রতিবাদ, বিশৃঙ্খলা, এবং বাড়াবাড়ির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত ছিল।
কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য
একটা সময় মানুষ বর্বর ছিল। সে-আমলে আলফা-মেল বলে একটা ব্যাপার ছিল। এ-কালেও গরিলাদের মধ্যে এমনটা দেখা যায়। সোজা বাংলায় একে “জোর যার, মুল্লুক তার” বলা হয়। সে-আমলে দ্বৈরথে জয়ীরাই হতেন নেতা, তাদের কথায়ই চলতো সবকিছু। আমরা সে-যুগ পেরিয়ে এসেছি। এখন বুদ্ধির শাসনের যুগ। পেশি চালিত হয় বুদ্ধি দিয়ে। সে-কারণেই পেশি বা নিশানা নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন না করলে কোন ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না। নিয়ম মানতে কারোই ভাল লাগে না, কিন্তু তবুও নিয়মানুবর্তীতার চর্চা করতে হয় বৃহত্তর স্বার্থেই। খেলার মাঠে আন্ডারডগদের সমর্থন করা এক জিনিস, কোন অর্গানগ্রামের নিম্নপদস্থ কাউকে সমর্থন করা আরেক।
উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েই একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে হয় যেখানে অধঃস্তনদের দাবি-দাওয়া শুনা ও মানা হয়। সেক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন যে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং তারা কোন দাবি না মানলে সেটি যুক্তিযুক্ত হতে পারে। সময় সময় অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়, এবং তা অস্বাভাবিক সমাধানের দাবি রাখে। আমি মনে করি না যে বিডিআর-এর অবস্থা অতটা নাজুক ছিল। যদি হয়েও থাকে, তবুও তা নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের ধাপগুলো অতিক্রম করে এই পর্যায়ে আসা উচিত ছিল। আবেগের বশবর্তী হয়ে কিংবা “সাধারণ কৃষকের ছেলে” বলে কেউ নিয়মের বাইরে বলে দাবি করাটা তাকে প্রকারান্তে অযোগ্য বলে অপমান করা বলে আমি মনে করি।
বিডিআর সদস্যরা সাধারণ মানুষের আবেগের কাছে আহ্বান করেছেন। সেই আবেগ আমাকেও ছুঁয়েছে, তাদের দুর্দশায় আমারও মন কেঁদেছে, কিন্তু তাই বলে আমি তাদের অপরাধটুকু ভুলে যেতে পারছি না। শুধুই আবেগের বশবর্তী না হয়ে তাই একটু দূরপ্রসারী প্রভাবগুলো ভেবে দেখা প্রয়োজন।
সেনাবাহিনী বনাম বাংলাদেশ
এভাবে সাধারণীকরণ করতে আমি নিজে খুব অপছন্দ করি, তবু মন থেকে প্রশ্নটা দূরে সরিয়ে রাখতে পারছি না। এই সংঘাতে সেনাবাহিনীর বিপরীতে মানুষের অবস্থান কি পূর্বের রাগের ফল নয়? মনে রাখা প্রয়োজন যে “বিগত দু’বছরের সেনাবাহিনী” আর “বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী” এক নয়। সীমান্ত প্রতিরক্ষা বাহিনী একটি আধা-সামরিক বাহিনী হিসেবে সেনাবাহিনীর অধীনস্ত। এই বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা অন্য কারও বিরুদ্ধে হলে আমাদের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হত। রাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এ-ধরণের প্রতিক্রিয়া দূষণীয় ও পরিত্যাজ্য।
নির্মোহ, নৈর্ব্যক্তিক দিক থেকে দেখলে এটা স্বীকার করতেই হবে যে এই বিদ্রোহ ছিল সেনাবাহিনীর গালে একটি চড় কষে দেওয়া। একই ভাবে, বিনা বিচারে বিডিআর-কে ক্ষমা করে দেওয়া সেই অপমানকেই আরও ঘনীভূত করবে। বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য এটি অনেক বড় আঘাত। তাদের কর্তৃত্ব অনেক বেশি কমিয়ে দেওয়ার মত ঘটনা এটি। সাম্প্রতিক কালে সেনাবাহিনীর দৌরাত্ম্যে বিরক্ত হয়ে এই ঘটনায় খুশিতে বাজনা বাজানো খুব সহজ। ভুলে যাওয়া সহজ যে এই বাহিনীর ঐতিহ্য এবং অহংকারের সাথে আমাদের দেশের নিরাপত্তা ও সম্মান জড়িত। সেনাবাহিনীর অন্যায়গুলো শুধু বিডিআর-এ হয়নি বা শুধু এই ক’মাসে হয়নি। অনেক আগে থেকেই ঘটা আসা এই অনাচার আমরা চলতে দিয়েছি। সেই দায়বদ্ধতা মাথায় রেখি সমালোচনা করা উচিত, সেনাবাহিনী কোন ভাবে অপদস্থ হলে তাতে খুশি হওয়া উচিত নয়।
নিরাপত্তাজনিত ব্যবস্থা
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিডিআর হেড কোয়ার্টারে যাওয়া ছিল অনেক বড় ঝুঁকি। এই সিদ্ধান্ত সহ পুরো ব্যাপারে কৌশলের চেয়ে আবেগ কাজ করেছে বেশি। সরকার থেকে নাগরিক পর্যন্ত সকল পর্যায়ে আবেগের এই আতিশয্য খুব খারাপ লক্ষণ। এই সরকারকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে, সেনাবাহিনীর গ্রাস থেকে রাজনীতিকে বের করতে হবে, নিজের দলের দস্যুবৃত্তি ঠেকাতে হবে। এতটা আবেগপ্রবণ হলে এর প্রতিটিই অর্জন করা দুষ্কর।
ঘটনা যেভাবে গেল (বা যেতে দেওয়া হল), তাতে সেনাবাহিনীতে অসন্তোষের সম্ভাবনা থেকে যায়। এই বিবেচনায় বিডিআর-এর ভালর জন্যই হয়তো তাদের জেল-হাজতে যাওয়া উচিত ছিল। ডিজিএফআই ঘটনার আগে ঘাস খেলেও ঘটনার পর শোধ তুলতে ছাড়বে না। কত নালা-নর্দমায় বিডিআর জওয়ানদের লাশ পড়ে থাকবে, তা কে বলতে পারে? পাশাপাশি আইনের শাসনের প্রসঙ্গটি তো আছেই। সেনাবাহিনীর একটি অংশ লোভ এবং দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। তারা তাদের এই অবস্থান এমনি এমনি ছেড়ে দেবে না। এ-ধরণের লোক অনেক বেশি বেপরোয়া হয়। সরকার শুধু বিডিআর নয়, সেনাবাহিনীরও অভিভাবক। তাদের এভাবে অপদস্থ হতে দেওয়ায় নিয়মনিষ্ঠদের দলে ভেড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়ে গেল।
শুদ্ধস্বর
সেনাবাহিনীর ভ্রষ্ট সংস্কৃতি শুদ্ধ করতে এবং রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর এক রকম দখলদারিত্ব রোধ করতে সরকারকে খুব দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। যে-সরকার এক দিকে সামান্য বিডিআর-কে (কিংবা ছাত্রলীগকে!) সামলাতে পারে না, এবং অন্য দিকে সেনা কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে পারে না, তারা কীভাবে আস্থা পাবে সেনাবাহিনীর? এই শুদ্ধির জন্য যেই দৃঢ় স্বর প্রয়োজন, তা এখনও সরকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে অনেক কথা বেরিয়ে এসেছে। এমনকি কিছু ব্যাপারে সেনাপ্রধানের নামও শোনা গেছে। এমতাবস্থায় সরকারের উচিত ছিল এমন পথে আগানো যাতে উভয় তরফ থেকেই কিছু মধ্যপন্থী মানুষ তাদের সমর্থন করে। বিডিআর-এর হত্যাযজ্ঞ সকাল নাগাদই হয়ে গিয়েছিল। তাদের ঘিরে ফেলা হয়েছিল, কোণঠাসা করা হয়েছিল। আর কিছুক্ষণ সময় দিলে, এবং সুনির্দিষ্ট কিছু কাজের জন্য ক্ষমা ঘোষনা করলে একটু পরে তারা নিজেরাই বিভক্ত হয়ে পড়তো। শুভবুদ্ধির মানুষেরা সামনে এগিয়ে আসতে পারতো। একই সাথে, সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের উপর আক্রমণ করে কেউ সাধারণ ক্ষমা পেয়ে যাওয়াটাও ভাল ভাবে নেওয়ার কোন কারণ নেই।
খুনের অপরাধেরও ক্ষমা হয়, তবে তা বিচারকার্যের নিষ্পত্তি এবং অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাওয়ার পর। এক্ষেত্রেও সেটি করা যেত বলে আমার মত। সেই সাথে এটি আবারও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল যে এই দেশে ভাংচুর করলে সব দাবি মেনে নেওয়া হয়। শাস্তি প্রদান কিংবা নিদেনপক্ষে বিচারকার্য হলে এটি প্রতিষ্ঠিত হত যে ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়া হবে, তবে অন্যায্য পন্থা সহ্য করা হবে না।