Tuesday, December 30, 2008
ময়ূরপংখী রাজনীতি
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪-দলীয় মহাজোট বিপুল বিজয় অর্জন করেছে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে। ফলাফল বলছে, দেশে এখন কার্যত কোন বিরোধী দল রইলো না। ইতিহাসের পরিহাস সবসময় নির্মম হয় না। এক কালে অনেক দুর্নাম কামিয়ে আওয়ামী লীগ 'বাকশাল' তৈরি করেছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, নাশকতা, দুর্ভিক্ষ সহ অনেক রকম কারণ হয়তো ছিল, কিন্তু তবু এই পদক্ষেপ চিরকালের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগকে। ২০০৮ সালে কার্যত আরেকটি 'বাকশাল' স্থাপিত হল। পার্থক্য হল, এবারে এটি জনগণের মত ও সমর্থনেই ঘটছে। গোড়া সমর্থকেরা সেই চোখেই দেখবেন বলে ভয় হচ্ছে। স্রেফ মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য বলা, এটি কালের স্থিরচিত্র ছাড়া আর কিছু নয়। ভোটের হিসাব অনেক আনন্দের হলেও বাস্তবতা কিছু সচেতনতা দাবি করে।
২. অস্বাভাবিক ঐক্যঃ
সময়ের প্রয়োজনে অনেক রকম অস্বাভাবিক ঐক্য হয়। এ-ধরণের কৌশলগত বা শর্তসাপেক্ষ ঐক্য দীর্ঘমেয়াদে ফাটলেই পরিণত হয়। দৃশ্য শত্রুর গতিবিধি জানা যায়, তার ব্যাপারে পরিকল্পণা করা যায়। অজানা, অদৃশ্য শত্রুর বেলায় এই সুবিধা নেই। আওয়ামী লীগ এই মুহূর্তে এমনই একটি ঐক্যের সুফল ভোগ করছে। জয় মহাজোটের হলেও শাসন করবে কার্যত আওয়ামী লীগ। যে-দলগুলো নিয়ে মহাজোট গঠিত, তারা কেউই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক নয়। বিশ্বস্ত ভোটার বাদে যাঁরা মহাজোটকে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের বৈশিষ্ট্য দেখা যাক।
1. তরুণ ভোটঃ এবারে প্রায় দেড় কোটি নতুন ভোটার অংশগ্রহণ করেছেন নির্বাচনে। এরা নতুন যুগের মানুষ, এরা নিত্য-নতুন সুযোগের মধ্যে বড় হয়েছে, এরা বাইরের দেশের অনুকরনে অভ্যস্ত, এরা বাইরের রাজনীতির সাথে দেশের তুলনা করে। এরা সাফল্যের পরিমাপ করবে বহির্বিশ্বের সাথে। তরুণ ভোটের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, এরা খুব বেশি অস্থির। যুদ্ধাপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে আগামী নির্বাচনে এরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না, এই ভোট আওয়ামী লীগের পক্ষে ধরে রাখা সম্ভব না। এই কাজটি করার অন্য দিক হল, আওয়ামী লীগ আর কখনও মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত বেঁচে রাজনীতি করতে পারবে না।
2. জাতীয় পার্টিঃ লেজে অব হোমো এরশাদ বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে পল্টিবাজ ও সুবিধাবাদী রাজনীতিক। বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী এত বড় গর্ত খুড়েছিল নিজের জন্য, যে যে-কেউ এই নির্বাচনে জয়লাভ করতো। হুমকি-ধামকি দিলেও এরশাদ মহাজোট ছেড়ে যাননি এই বাস্তবতা বুঝতে পেরেই। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি একই কাতারের দল হওয়ার পূর্ণ সুবিধা নেবার ক্ষেত্র প্রস্তুত এখন তার জন্য। এই ভোটগুলোও আওয়ামী লীগ আর কখনও পাবে না।
সিলেট বা ঢাকায় সকল আসন জেতার মত জনপ্রিয় দল আওয়ামী লীগ না। বগুড়ায় একাধিক আসন জেতার মত দল আওয়ামী লীগ না। এই ভোটগুলো আওয়ামী লীগ আর পাবে না। এগুলো স্রেফ দৈব দুর্বিপাক। তারেক জিয়া বাড়াবাড়ি রকম চুরিদারি না করলে, খালেদা জিয়া তাঁর ছেলেদের ব্যাপারে অন্ধ না হলে, পিন্টুর মত গুন্ডাদের মনোনয়ন না দিলে, কাউকে মনোনয়ন দিলে পুরো পরিবারশুদ্ধ মনোনয়ন না দিলে এই সৌভাগ্য আওয়ামী লীগের হত না। এই ঐক্য চরম অস্বাভাবিক। ব্যবসা-মনস্ক জাতীয়তাবাদীরা আওয়ামী লীগের সমর্থক নন। সেনাবাহিনী বা ইসলামী শাসনের প্রবক্তারা আওয়ামী লীগের সমর্থক নন। এঁদের নব্যপ্রাপ্ত সমর্থক ভেবে এঁদের আদর্শ অবলম্বন করেও আওয়ামী লীগ এই ভোটগুলো পাবে না।
3. বামপন্থী ভোটঃ অনেকটা বাধ্য হয়েই বাম ঘরানার মুক্তমনা মানুষেরা ভোট দিয়েছেন আওয়ামী লীগকে। ধর্মব্যবসায়ী দলগুলোর সাথে আঁতাত করার চেষ্টা করে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিকে নতুন করে মুসলমানী দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। আওয়ামী লীগ ড্যামেজ-কন্ট্রোল করার জন্য যতই "আমরা আসলে ওদের প্রগতিশীল করতে চেয়েছিলাম" বলুক না কেন, অসাম্প্রদায়িক কেউ এ-কথায় ভুলেননি। এই ভোটও আর পাওয়া যাবে না।
4. বীতশ্রদ্ধ মধ্য ও নিম্নবিত্তঃ বাংলাদেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য খুব কম। যুদ্ধাপরাধী তোষণের দায়ে বিএনপি দুষ্ট হওয়ার ব্যাপারটি বাদ দিলে তেমন কোন তফাৎ নেই। বিএনপি'র বদলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও দ্রব্যমূল্য ও দুর্নীতি বেড়েই চলতো (হয়তো এতটা নয়)। আওয়ামী লীগের এই বিজয় যতটা অর্জন, তার চেয়ে উপহার বেশি। অতএব, এই আশংকা অবাস্তব নয় যে আওয়ামী লীগ একে যথাযথ মূল্যায়ন করবে না। বিজয়ের মাত্রার সাথে সমানুপাতিক উন্নয়ন না করলে দলহীন এই সাধারণ মানুষ আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের সাথে থাকবে না।
৩. জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধী সমীকরণঃ
এই নির্বাচনের মূল ম্যান্ডেট আওয়ামী লীগের পক্ষে না, যুদ্ধাপরাধীদের বিপক্ষে। সাম্প্রতিক সময়ে মূলত বিভিন্ন অরাজনৈতিক সংগঠনের চেষ্টায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি সামনে এসেছে। নির্বাচন পিছিয়ে জানুয়ারি মাসে নেওয়ার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোটের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, গণহত্যা, অত্যাচার, যুদ্ধাপরাধী বিচার, ইত্যাদি ব্যাপারে যেই গণসচেতনতা গড়ে উঠেছে, তার পেছনে আওয়ামী লীগের তিল পরিমাণ অবদান না থাকলেও এর পূর্ণ সুফল ভোগ করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় মহাজোট।
অতীতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দু'টি সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর একবার, ’৯৬ এর নির্বাচনের পর আরেকবার। সেই গণজাগরণ আওয়ামী লীগের তৈরি ছিল না, আওয়ামী লীগ সেই গণদাবির প্রতি কোন শ্রদ্ধাও দেখায়নি। জামায়াতের সাথে বরং আওয়ামী লীগ কৌশলগত আঁতাত করবার চেষ্টাও করেছিল এক কালে। মাত্র ক’দিন আগে তারা প্রায় রাজনৈতিক মুসলমানি করে বসেছিল মোল্লাদের সাথে চুক্তি করে। জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধী যে একই কাতারের, সেই সত্য আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেনি। এর সব কিছুই সামাজিক, অরাজনৈতিক অর্জন। এই নির্বাচনের আগে বিজয় দিবস নিয়ে বাঙালি গর্বে সরব হওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগের অবদান একেবারেই নগণ্য, অথচ এই আন্দোলনগুলোই আওয়ামী লীগকে ২৬২টি আসন এনে দিয়েছে।
ক্রমে শক্ত হয়ে ওঠা জামায়াতকে একমাত্র এই সমীকরণটিই ডুবাতে পারতো যে ‘জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধী সমার্থক’। এই কথা মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেওয়ার মত নৈতিক অবস্থান আওয়ামী লীগের ছিল না। জামায়াত দেরিতে হলেও এটি বুঝতে পেরেছে। মুক্তিযুদ্ধের কথা তাদের ইশতেহারে ঢুকিয়েছে, বিজয় দিবস বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মত ঘটনাগুলোকে মেনে নিয়েছে (যা এগুলোকে পর্যায়ক্রমে গুরুত্বহীন ও কথার কথা করবার প্রক্রিয়ায় আছে)। আগামী নির্বাচনের আগে জামায়াত নিজের শরীর থেকে যুদ্ধাপরাধের সব দৃশ্যমান চিহ্ন মুছে ফেলে স্রেফ একটি “ইসলামিক” দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এই বিজয়ের পেছনে তাই জামায়াতের বিলম্বিত উপলব্ধির ভূমিকা ব্যাপক।
সংবিধানের যাবতীয় কলঙ্কজনক ধারা এবং যুদ্ধাপরাধীদের চূড়ান্তভাবে শেষ করে দেওয়ার সুযোগকে আওয়ামী লীগ দলীয় জয় হিসেবে নিয়ে কতটা সুনিপুণ ভাবে হারায়, সেটাই দেখার বিষয়।
৪. বিজয়ী কুপ্রার্থী
অতি-খুশিতে বগল বাজানো শুরু করবার আগে বিবেচনার নেওয়া উচিত যে এই দুর্যোগের কালেও জামায়াত প্রায় প্রতিটি আসনেই ভোট পেয়েছে বেশি। কমান্ডার নিজামি হেরে গেলেও আড়াই লাখ ভোটের মধ্যে মাত্র ২২ হাজার ভোটে হেরেছেন। সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীর মত পাপীও জিতে গেছেন। এই বিষয়গুলো আমলে নেওয়া উচিত আওয়ামী লীগের, সাথে তাকিয়ে দেখা উচিত নিজ দলের এমন অনেক প্রার্থীর দিকে যাঁরা সাধারণ অবস্থায় জিততেন না। এই তালিকায় এরশাদ থেকে শুরু করে কামাল আহমেদ মজুমদার পর্যন্ত অনেকেই আছেন। নৌকার এই সুদিনেও ঢাকা শহরে কি এর চেয়ে ভাল প্রার্থী মিলতো না?
সাম্প্রতিক কালে বিএনপি’র মত আওয়ামী লীগের ভেতরেও রাজনৈতিক সার্জারির মাধ্যমে নেতা আমদানির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সজীব ওয়াজেদ জয় দেশে গেলে শিশুদের মেলা কিংবা অধুনা পত্রিকায় তাঁকে বিদগ্ধ রাজনীতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা তারই নিদর্শন। আগামী কিছুদিনে এই প্রক্রিয়া অব্যহত থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ ছিল সমাজতন্ত্রের পতন। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি নিজ নিজ শাসনামলে অনেক কর্মী রিক্রুট করলেও আওয়ামী লীগ তেমন কিছুই করতে পারেনি। সোভিয়েত রাশিয়ার পতন একঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক দিয়েছে। আওয়ামী লীগ তাঁদের যথাযথ মূল্যায়ন করেনি কখনই। সামনেও করবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। প্রমাণ হল, দেশ থেকে খবরে জানলাম ছাত্রলীগ এরই মধ্যে হল দখলে নেমেছে।
৫. স্বপ্নের সিড়ি বেয়ে স্বর্গে নামি
সাময়িক এই বিজয় আওয়ামী লীগ কতটা কাজে লাগায়, সেই ব্যাপারে আমি ব্যক্তিগত ভাবে সন্দিহান। দেশটা কিছু লম্পটের হাত থেকে বেঁচে যাওয়ায় অনেক খুশি হলেও তাই পাশাপাশি রয়ে গেছে হতাশ হওয়ার ভয়। দিনভর অনেক রকম কথা শুনেছি। ‘যাকে মাথায় তোলা হয়, তার দেওয়া ছোট আঘাতও লাগে বেশি’। ‘দ্য হাইয়ার ইউ রাইজ, দ্য হার্ডার ইউ ফল’। ‘আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে কী লাভ, আগেও তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলেছিল’। এগুলো সত্যকথন, এগুলো আওয়ামী লীগ কানে তুলবে না।
তেমন কোন প্রচার ছাড়াই ‘না’ ভোটের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দেখা গেছে এবার। আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টির খুব ঘৃণ্য একটি অভ্যাস হল তাদের সমর্থন না করলে ভোটারদের দেশাত্মবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলা। এবারেও নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা ‘না’ ভোট দেওয়াকে নির্বুদ্ধিতা কিংবা রাজাকারকে ক্ষমতায় আনার সাথে তুলনা করেছেন। কেউ ভেবে দেখেননি যে নিজামির সাথে মিটিং করা কিংবা দেশময় অতিরিক্ত আত্মপ্রচারের মত ‘বুদ্ধিমান’ কাজ আওয়ামী লীগই করেছে, সাধারণ ভোটারেরা না।
হয়তো উদ্দেশ্য বা আদর্শের বদলে ব্যক্তিপূজা থেকে গঠিত বলেই বিএনপি তুলনামূলকভাবে গতিশীল একটি দল। তারা নতুন ভোটারদের কাছে যাবে, অনেক ভাল ফল বয়ে আনবে। পরবর্তী নির্বাচনের সময় হয়তো দেশপ্রেম নামক চিজটি এমন “হিপ” থাকবে না। তখন হয়তো মুম্বাইয়ের নায়ক-নায়িকার মত “আমার বাংলাদেশ”ও “কুল” থাকবে না। হয়তো সেবার কোন ঠিকা বুয়া দু’দিন আগে তেহকেই ঠিক মত ব্যালট পেপার ভাজ করার পদ্ধতি রপ্ত করতে লাগবেন না। হয়তো সেদিনও অলস দুপুরে গুগুলে “বাংলাদেশ” লিখে সার্চ করলে আদৌ আমার দেশ নিয়ে একটি মানসম্মত বাংলাদেশি ওয়েবসাইট পাওয়া যাবে না। হয়তো সেদিন আর ইন্টারনেট জুড়ে ‘মুক্তিযুদ্ধে মৃতের সংখ্যা অতিরঞ্জন’ দাবি করলে আর কোন তরুণ ছাত্র বা সাংবাদিক উদ্যোগী হয়ে প্রতিবাদ করবেন না। হয়তো সেদিন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতিকদের উন্নাসিকতা উপেক্ষা করে কোন এমএমআর জালাল নিজ খরচে প্রবাসের পথে পথে ঘুরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সব রকম নথি সংগ্রহ করে যাবেন না।
সেদিনের বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে যে স্থিতধী, মোহমুক্তি, ও প্রশ্নোর্ধ্ব দেশপ্রেম প্রয়োজন, তা আওয়ামী লীগকে দেখাতে হবে। মুক্তচিন্তার প্রসার, মানবাধিকার রক্ষা, আইনের সংস্কার, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, ও নারী অধিকারায়ন না করলে এ-দিনের অনেক ভোটার নীরব হয়ে যাবেন। অন্যদিকে হায়েনা ফিরে আসবে নতুন কোন রূপে, আরো শান দেওয়া নখরদন্ত নিয়ে।
২০০১ এর নির্বাচনের পর গৎ বাঁধা কিছু প্রতিশ্রুতির ময়ূরপুচ্ছ গায়ে লাগিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল কিছু হায়েনা। এবারে আওয়ামী লীগও একই ধারার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। সে-কারণেই আশা করতে সংকোচ হয়। ২৬২ টি আসনে জয়ের জন্য যেই নৈতিক উচ্চতা ও সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা লাগে, তা আওয়ামী লীগের নেই। ভোটের আগে আওয়ামী লীগের প্রচারণাতেই বলা ছিল, তারা বিএনপি-জামায়াত জোটের তুলনায় উন্নততর দেখে তাদের ভোট দেওয়া উচিত। সেই মতেই, বিএনপি-জামায়াত জোট অনেক বেশি খারাপ দেখেই আওয়ামী লীগের অনেক বড় জয়।
আওয়ামী লীগের তাই সবচেয়ে বড় ধন্যবাদ দেওয়া উচিত তারেক জিয়াকে তার অবিমৃশ্যতার জন্য, ডিসেম্বর মাসকে বিজয়ের মাস হওয়ার জন্য, আর অগণিত দেশপ্রেমিককে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে ব্যাপকভিত্তিক জনমত গড়ে তুলবার জন্য।
গানবন্দী জীবনঃ আশিক-প্রিয়া
বাংলা চলচ্চিত্রের গানের মত ‘গিলটি প্লেজার’ খুব কম আছে। আড়াল পেলে সবাইই কম-বেশি গুনগুন করলেও প্রকাশ্যে কেউ স্বীকার করতে চান না যে তাঁরা বাংলা চলচ্চিত্রের গান শোনেন। আমি নিজেও ব্যতিক্রম নই। মনে পড়ে, এন্ড্রু কিশোর একবার ইত্যাদি’তে আফসোস করে বলেছিলেন মধ্যবিত্তের বৈঠকখানায় তাঁর গান ঢুকতে না পারার কথা। এর পেছনে যেই ছ্যুৎমার্গ কাজ করে, আমিও তার ঊর্ধ্বে নই।
শক্তি ও পূর্ণতার কার্যকর কিছু নিরূপকের একটি হল দুর্বলের প্রতি উদারতা। একটি দেশ যত শক্তিমান, তার আইন সংখ্যালঘুদের প্রতি তত বন্ধুত্বপূর্ণ। একজন মানুষ যত বলিয়ান, তিনি ভিন্ন মত ও পথের মানুষের প্রতি তত সহনশীল। বাংলা সিনেমার গানের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি তেমনই।
আমি গাইতে জানি না, নাচের মুদ্রা বুঝি না, অভিব্যক্তি দিয়ে মন হরণ করতে পারি না, দুই অনুচ্ছেদের একটি অণুগল্পও লিখতে পারি না। তবু সমালোচনার খড়্গ হাতে উঠতে সেকেন্ড খানেক সময়ও লাগে না। বাংলা চলচ্চিত্র খুব দুস্থ ও দুর্বল, কিন্তু তার প্রতি আমার এক ধরণের অন্ধ আক্রোশের কিছুটা হয়তো আমারই ক্ষুদ্রতা থেকে উৎসারিত।
বয়সের সাথে সাথে খুব কম মানুষকেই দেখেছি এই সংকীর্ণতা থেকে বের হয়ে আসতে। ভেঙেছে পিঞ্জর, পড়ে না চোখের পলক, দুই দিনেরই এক জেল, একদিন স্বপ্নের দিন, মন চায়, কিংবা আমার মাঝে নেই আমি এখন এ-যুগেরই বাংলা চলচ্চিত্রের গান। এগুলো গুনগুন করে গেয়েছি সবাই। হাল আমলে ক্লোজআপ-ওয়ান আসার আগ পর্যন্ত গানগুলো সেভাবে সামনে আসেনি। চিরকাল ধরে ঢালাও গালি দিয়ে যাওয়া এই আমিও এখন মানতে বাধ্য হই যে আমাদেরই অবহেলার কারণে পরিস্থিতি আজ এত বেশি খারাপ।
এই উপলব্ধিগুলো অনেক বড় বয়সের। মানুষ যতই শিক্ষিত ও পরিমার্জিত হোক না কেন, কিছু মৌলিক প্রণোদনা তার মাঝে কাজ করেই। ভাড়ের ডিগবাজি, ভূতের হাসি, নায়িকার ইঙ্গিতপূর্ণ চাহনি, ইত্যাদি সব বয়স ও মতের মানুষকেই টানে। আর টানে গান। কেউ স্বীকার করি, আর কেউ করি না। এখানেই যেটুকু তফাৎ।
বহুকাল আগের কথা। ছোট ভাইকে ওয়াই-ডব্লিউ-সি-এ স্কুলে দিয়ে আসার সময় বছর ছয়েকের একটি ছেলেকে গান গাইতে দেখেছিলাম এক সকালে। বিদ্যাবিভীষিকায় কাতর হয়ে সবাই কাঁদছে স্কুলে ঢোকার আগে। এরই মাঝে ছেলেটি সবাইকে ঠেলে এগিয়ে আসছিল উদ্দাম গতিতে। পেছন পেছন ছুটছে বাবা-মা। তাঁদের চোখে-মুখে লজ্জা। ব্যাগের স্ট্র্যাপ দু’হাতে ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে ছেলেটি গান গাইছে – আমি আশিক, তুমি প্রিয়া। সাথে আরেক গানের লাইন মিলিয়ে দু’জন দু’জনার কত যে আপন, কেউ জানে না! আর একটু পরপর তারস্বরে তুমি প্রিয়া, তুমি প্রিয়া, তুমি প্রিয়া।
গানটি শিশুমনকে ছুঁয়েছিল। সকালে স্কুল যাবার আনন্দে ছেলেটি গান গাইছিল। আশিক-প্রিয়ার জটিলতার ধার দিয়েও না গিয়ে স্রেফ মনের আনন্দে গান গাইছিল। কত সহজ, কত সাধারণ। আমাদের যে কেন বড় হলেই সব কিছু পেঁচিয়ে ফেলতে হয়।
ছেলেটির সাথে গলা মেলানোর ইচ্ছে ছিল খুব। গান পছন্দ করে নয়, শুধু মুহূর্তটি উপভোগ করার জন্য। পারিনি। মনে হয় না চোখের সামনে এমন দৃশ্য দ্বিতীয়বার দেখার সুযোগ পেলেও পারবো। সংকোচের শৃঙ্খলেই আটকে থাকলো সব।
বিজয় দিবসের নাটিকাঃ "সেমিকোলন"
ব্যাকরণে 'সেমিকোলন' ব্যবহৃত হয় দুটি সম্পূর্ণ বা প্রায়-সম্পূর্ণ বাক্যকে যুক্ত করতে। সেমিকোলনটি প্রথম বাক্যকে পূর্ণতা দেয়, দ্বিতীয় বাক্যটিকে দেয় ভিন্ন মাত্রা। একক ভাবে যতি চিহ্ন, কিংবা তার আগে-পরের বাক্যগুলো গুরুত্ব হারায়।
আমাদের ইতিহাসও তো তেমনই। বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ যেন একটি বিশাল সেমিকোলন। এর আগের সময়টুকুর সব চেতনার পূর্ণতা দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধে। সেই সাথে মেলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দিক-নির্দেশনা।
আমাদের অসারতা, আর উত্তরপ্রজন্মের নিরুৎসাহের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও তার চেতনা। সেই চিন্তা থেকেই বিজয় দিবসের রাতে পরীক্ষার মাঝেই এই নাটিকাটি লিখে ফেলে মাহমুদ। আজ রাতে বিজয় দিবসের অনুষ্টানে দেখানো হল নাটিকাটি।
নগণ্য কিছু প্রবাসী ছাত্রের এই ক্ষুদ্র প্রয়াসটুকু তুলে দিলাম আপনাদের জন্য। ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরে দিলে বাধিত থাকবো।
জয় বাংলা!
গানবন্দী জীবনঃ নায়ে বাদাম তুইলা দে ভাই
আমাদের বংশে মেয়ে নেই বলতে গেলে। সবার দু’টা করে ছেলে। স্বাভাবিক ভাবেই খুব রুক্ষ আর অসহনশীল হয়ে গড়ে উঠেছি আমরা সবাই। বোন না থাকার আফসোসটা সবাইকেই ভোগায় কম-বেশি। ভাই-বোনের সম্পর্ক কী অসামান্য, তা শুধু দেখেই গেলাম জীবনভর।
একবার পার্কে গিয়ে দেখেছিলাম ছোট বোন একটু পর পর বড় ভাইয়ের একদম মাথায় উঠে বসছে। এইতো সেদিন চ্যানেল আইয়ের ক্ষুদে গানরাজে দেখলাম বাদ পড়ে যাওয়া ছোট্ট হৃদ্য নিজের দুঃখ ভুলে বড় ভাই সদ্যের জন্য এসএমএস চাইছে, আহ্লাদ করে ভাইকে জড়িয়ে ধরছে। তার কিছুদিন আগে রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে দেখেছিলাম স্যারাহ পেলিনের মেয়ের ভ্রাতৃস্নেহ। মাত্র ৭ বছর বয়সী পাইপার কয়েক মাস বয়সের প্রতিবন্ধী ছোট ভাই ট্রিগের চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল মা বক্তৃতা দেওয়ার সময়টায়। ডান হাতের তালু জিভ দিয়ে চেটে ভেজায়, ভাইয়ের চুল ঘসে সমান করে দেয়, আবার চাটে, আবার চুল ঘসে সমান করে। আগ্রহীরা চোখ বুলাতে পারেন ইউটিউবেঃ ‘http://www.youtube.com/watch?v=GliQjmuf8_s’। এতটা স্বর্গীয় একটা দৃশ্য আর দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
গায়ে-গতরে বেশ বড় হয়ে যাবার পর মামা-খালাদের সূত্রে বোন পাওয়া শুরু হল। এদের মধ্যে সবার বড় জায়ান। অনেকটা কাল ধরে এই একটাই বোন ছিল। ছায়ানটে গান শেখে। নজরুল, রবীন্দ্র, পল্লীগীতি, আরও কত কত রকম গান। আমার এই বোনটা গান-পাগল। ছোটবেলা থেকেই অভিনয় আর আবৃত্তিতে পটু, এখন সাথে যোগ হয়েছে গান। গাইতে বললেই সবার ওজন দেখানো শুরু হয়ে যায়, অথচ আমার এই বোনটা বেহায়া রকম ব্যতিক্রম। ফোনে কথা হলেই মিষ্টি হেসে বলে, অভি ভাইয়া, তোমাকে একটা গান শোনাই, তোমার মন ভাল হয়ে যাবে। ভাল না ছাই। পল্লীগীতিতে গলা ছেড়ে টান দিতে শুধুই চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে। আমার এই বোনের কণ্ঠে আমার সবচেয়ে প্রিয় গান ‘নায়ে বাদাম তুইলা দে ভাই আল্লা-রাসূল বইলা, আমি পদ্মা নদী পাড়ি দেবো মাওলারও নাম লইয়া’। কথা হলেই এই গানটা শুনতে চাই, এখন পর্যন্ত প্রতিবারই চোখ বেয়ে পানি পড়েছে গানটা শুনে।
জায়ানের সাথেই পিঠাপিঠি বোন রাফাত। ঠিক নিচের তলায় থাকতো। সকাল হলেই দৌঁড়ে আমার কাছে চলে আসতো, রাত হলে থেকে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতো। আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই এসে গুটিসুটি মেরে বিছানায় উঠে পড়তো। এরপর হঠাৎ পেটের উপর লাফ দিয়ে পড়ে ঘুম ভাঙিয়ে ভুবন ভুলানো একটা হাসি দিতো। বাইরে চলে আসার পর হাতে লিখে চিঠি পাঠায় ক’দিন পরপর। জন্মদিন এলে তক্কেতক্কে থাকে। শুভেচ্ছা জানাতে ভুলে গেলেই বুক এফোড়-ওফোড় করে দেওয়া একটা খোঁচা, হু, আমাকে তো মনে থাকে না তোমার আর।
এরপর দুই মামাতো বোন। যুক্তরাজ্যে বড় হচ্ছে, প্রথমবার দেখার আগেই তাই বড় জন প্রায় ৮ বছরের হয়ে গেছে। অবিকল আমার নানীর মুখ যেন। একটু পরপর পাশে এসে খুব লজ্জা পেয়ে, শান্ত স্বরে বলতো, ভাইয়া, তোমার পাশে বসতে খুব ইচ্ছা করছে, আমাকে কোলে নিয়ে বসবে? রক্তের টান বোধহয় একেই বলে।
ছোট জন অনেক জেদী। ভোর ছয়টায় বাজলেই আমাকে ঠেলে তুলবে। বাচ্চাদের একটা বই এগিয়ে দিয়ে বলবে, রিড দ্যাট। ঘুম জড়ানো চোখে পড়ে শোনাই। শেষ হলেই হেসে বলে, রিড এগেইন। আবার পড়ি। আবারও মড়ার রিড এগেইন। এই চলে সকালের প্রথম আধা ঘন্টা। এক সকালে আব্বুর দিকে দেখিয়ে বলেছিলাম, ঐ যে ফুফা ডাকছে পড়ে শোনাবে বলে। মাত্র আড়াই বছরের সেই বিচ্ছুটা আমার সাথে সাতদিন কথা বলেনি আর।
সবার ছোট নুসাবা। আমার ছোট খালার মেয়ে। সম্ভবত আমার পরে আমাদের বংশে সবচেয়ে প্রতীক্ষিত সদস্য। বোন কী, বোনের অধিকার কী, বোনের দাবি কী, তা শিখেছি নুসাবার কাছ থেকেই। বাকিদের বেলায় আরামে আরামে কাটিয়েছি। সারাদিন পর হয়তো একটু আহ্লাদ করেছি, তাতেই হয়ে গেছে। নুসাবার বেলায় উলটো। বর্ষা-বাদল-ব্যস্ততা-অসুস্থতা নির্বিশেষে তার সাথে প্রতিদিন কথা বলতে হয়। প্রতিদিন ওয়েবক্যামে তাকে তার ভাগের সময়টুকু দিতে হয়। সামান্য ব্যত্যয় হলেই অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলবে, ও জানে নাই, ও শুনে নাই।
এই বোনটাও গানের পাগল। হরবোলার মত যেকোন গান শুনে শুনে শিখে ফেলে। বয়স দুই বছর হওয়ার আগেই গোটা ত্রিশেক গান তার মুখস্ত। নিথুয়া পাথারে, যাও পাখি বল তারে, ও আমার দেশের মাটি, বার্নির গান, এরকম আরও কত যে গান সকাল হলেই একাধারে শুনতে হয়।
ভালই চলছিলাম মাচো হবার পথে, কিন্তু বড় বয়সে এসে এই কলিজার টুকরাগুলো মনকে অনেক নরম করে দিল। একেকটার সাথে কথা বললেই মনে হয় সব ছেড়ে ওদের কাছে যাই গিয়ে। এত্ত আহ্লাদ, এত্ত ভালবাসা, আর এত্ত অধিকারের সাথে পরিচয় ছিল না। সেই অনুভূতিগুলো আটকে আছে অন্তর নিংরানো পল্লীগীতিটায়। কিছু অনুভবের জন্য আসলেই পদ্মা নদী পাড়ি দেওয়া যায়।
(গানটা নিজের কাছে নেই, কারো সংগ্রহে থাকলে জানানোর অনুরোধ রইলো)
গানবন্দী জীবনঃ আজ আমার শূন্য ঘরে আসিল সুন্দর
আমার নানা প্রচন্ড শিল্প-রসিক। শিক্ষায় ডাক্তার, পেশায় প্রফেসর, নেশায় কবিতা আর গানের অনুরাগী। এতটাই বেশি যে রেডিওতে একবার নানার সাক্ষাৎকার পর্যন্ত নেওয়া হয়েছিল। নানা নিজের সংগ্রহের এলপি থেকে কী কী যেন শুনিয়েছিল। রেকর্ডিংটা হারিয়ে গেছে অনেক দিন হয়।
পরিবারে নতুন কোন অতিথি এলেই নামের জন্য নানার কাছে যাওয়া হয়। আমার মা-খালাদের ডাকনাম নানার দেওয়া – সীমা, নিশি, শীলা। আমার খুব পছন্দের নাম তিনটাই। আমার ডাকনামও নানারই দেওয়া – অভি। গালভরা ভাল নামটার চেয়ে এই নামটা অনেক বেশি আপন। নানার সাথে আমার চুক্তি আছে। আমার ছেলে-মেয়ের নাম ঠিক করে না দিয়ে তার ছুটি নেই।
বড় নাতি হিসেবে অনেক আদর পেয়েছি নানার কাছে। আমার জন্মদিন পালনের জন্য নানা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসে ঘুরে যেত রাতের ট্রেনে। আমার পছন্দ বলে বাক্স বাক্স গলদা চিংড়ি পাঠাতো। নানার বিশাল বইয়ের ভান্ডার থেকে আমাকে নিজের ইচ্ছামত চুরি করতে দিতো। বইমেলা এলে প্রথম বার যাওয়ার আগে আমি অবসর পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতো। আমাদের দুই ভাইয়ের চালানো সব সাইকেল নানার কিনে দেওয়া ছিল। একবার আমি ঝোঁকের মাথায় স্কুল থেকে একটা কুকুর ছানা কিনে এনেছিলাম। থাকি ভূতের গলির এক ভাড়া বাড়িতে। জল্লাদ বাড়িওয়ালা, তার উপর এমনিতেই বাসা-ভর্তি মানুষ। আমার নানা সেই কুকুরটা পেলেছিল আট বছর ধরে। ট্রাকচাপা পড়ে আমার ‘শাইনি’ মারা যাবার পর অনেক কেঁদেছিল।
নাতিপাগল আমার অসামান্য নানা আমাকে কোলে করে প্রথম বার বাসায় ঢোকার সময় গেয়েছিল, ‘আজ আমার শূন্য ঘরে আসিলো সুন্দর, ওগো অনেক দিনের পর’। স্মৃতিশক্তি আমার এমনিতেই খারাপ, তার উপর সেই ঘটনা পাক্কা ২৬ বছর আগের। তবু যেন সেই মুহূর্তের আগলে ধরা অনুভূতিতে মনটা অবশ হয়ে যায়। কল্পণায় ভাসে, উত্তম কুমারের মত দেখতে এক সুপুরুষ রঙিন কাপড়ে মোড়ানো ছোট্ট একটা মাংসপিণ্ড কোলে করে শিশুতোষ আনন্দে গানটা গাইছে।
নানার অফুরন্ত গল্পের সম্ভারের কারণে সত্যজিতের তাড়িণীখুড়োর কীর্তিকলাপ পড়ে মনে হয়েছিল যেন চুপিচুপি আমার নানাকে দেখে লেখা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেলের যে-কোন ছাত্রকে বায়োকেমিস্ট্রির প্রফেসর ইছহাকের কথা জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে তার উচ্ছ্বলতার কথা। ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে বেড়াতো। ল্যাবরেটরি ক্লাসে সল্যুশন বানিয়ে নিজের ধমনীতে ঢুকিয়ে পরীক্ষা করতো। দেশ-বিদেশের ইতিহাস নিয়ে মজার সব গল্প বলে যেত। ‘প্রফেসর ইছহাকের বড় মেয়ের বড় ছেলে’ পরিচয়ের সুবাদে কোনদিন ডাক্তারের কাছে গেলে লাইনে দাঁড়াতে হয়নি, ফি দিতে হয়নি।
হাল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে বিলেত গিয়েছিল। সে-সময় বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে নাকি একবার বরফজমা হ্রদের উপরের বরফ কেটে খালি গায়ে ডুব দিয়েছিল। এছাড়াও কাজের চাপে বৌয়ের চিঠি ভাইকে পাঠিয়ে দেওয়ার মত কীর্তি ছিল অনেক। ডানপিটে, খেলাপ্রিয়, এভার্টন আর ইংল্যান্ডের ভক্ত, প্রচন্ড রোম্যান্টিক এই মানুষটাকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে তার পাঁচটা ছেলে-মেয়ে আছে।
বাজারে দর কষাকষিতে আমার নানার মত পারদর্শী খুব কম দেখেছি। এই বয়সেও সকাল হলেই চলে যায় কাঁচা বাজারে। নানার বাসায় বেলায় বেলায় জনা বিশেক লোক খাওয়া-দাওয়া করতো এক সময়। খাওয়ার লোক কমলেও বাজারের পরিমাণ তেমন কমেছে বলে মনে হয় না। নিউ মার্কেট আর টঙ্গী বাজারের দোকানীরা নানাকে আড়ালে ডেকে নানার পছন্দমত দামে জিনিস দিয়ে দিতো। সবার সামনে নানা দর-দাম করলে ব্যাপারীর বেশি ক্ষতি, তাই!
নানার সাথের এই খুচরো অনুভূতিগুলো ঘুরে-ফিরে আসে এই গানটার সাথে। কথা হলেই বিভিন্ন রকম উপদেশ দেয় নানা। ভেজা চুলে বের হতে নেই, গলার পেছনটা স্কার্ফ দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়, বাজারে গেলে প্রথম চক্করে কিছু না কিনে সব দোকানের দাম যাচাই করে নিতে হয়, এমন ছোট ছোট উপদেশের পাশাপাশি এই গানটাও গেয়ে শোনায় একবার করে। অতুলপ্রসাদের এই গানটা শুনলেই মনে হয় যেন নানি বিছানার পাশে মোড়ায় বসে সুপারি কাটছে, আমি নানার পাশে শুয়ে আনন্দমেলা পড়ছি, আর নানা উৎপাত করার জন্য গায়ের উপর পা তুলে দিয়ে দুষ্টামি করছে।
Friday, November 14, 2008
গানবন্দী জীবনঃ খরবায়ু বয় বেগে
বাংলায় কিশোর সাহিত্য বেশ অবহেলিত। সবাই শুধু বড়দের জন্য লিখতে চায়, বড়দের কথা লিখতে চায়। বড়দের লেখার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। বয়সের সাথে সাথে অনুভূতিগুলো গাঢ় হয়, মানুষ অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়। সেই চিন্তাগুলো সাহিত্যে স্থান পেলে সাহিত্যই মহিমান্বিত হয়। পরিণত সাহিত্য তাই খুবই জরুরী। তবে তাই বলে যে কিশোর সাহিত্যকে অবহেলা করতে হবে, এমন তো কথা নেই।
সাহিত্যের কাজ মূলত দু’টি – অভ্যস্ত জীবনের বাস্তবতাগুলো তুলে ধরা, নয়তো কল্পণার কোন জীবনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। অধিকাংশ সাহিত্যিকই কল্পণার রাজ্য নিয়ে লেখেন। দুই বাংলা মিলিয়ে যেই উপন্যাসগুলো সবচেয়ে বেশি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, তার সবগুলোই লেখকের নিজের জীবন নিয়ে, অথবা নিজের জীবন থেকে লেখা। বড়দের লেখায় এটি আর দেখা যায় না। সবাই কল্পিত ঘটনা নিয়ে লেখেন। একলা ঘরে একটি নারী কার কথা ভাবে, নিঃসঙ্গ পুরুষ কীভাবে পরনারীতে স্বস্তি খোঁজে, ইত্যাদি বালছাল লেখায় ভরা চারদিক। এই সব প্যানপ্যানে ঘটনার চেয়ে প্রথম কৈশোরের কুকর্মগুলো অনেক উপাদেয় ছিল। স্কুল পালানো, পড়শি মেয়ের দিকে চোখ মারা, রগরগে নীল ছবি দেখা, নিষিদ্ধ বিনোদন, ইত্যাদি নিয়ে অকপটে লিখলে লেখকের সুশীলতা অক্ষুণ্ন থাকে না। কিশোর সাহিত্য অবহেলিত হওয়ার পেছনে হয়তো এটা অন্যতম কারণ।
খোলামেলা লেখার দায়ে ‘সেবা’ প্রকাশনীর বই পড়তে হলে মায়ের কাছ থেকে অনেক ভাবে লুকাতে হত। প্রকাশ্যে পড়ার মত বলতে ছিল সত্যজিৎ রায় আর শাহরিয়ার কবিরের লেখা বই। স্কাউটিং, প্রবাস ভ্রমণ, উঠতি বয়সের কুসুম কুসুম প্রেম, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, ইত্যাদি নিয়ে জানতে পারতাম শাহরিয়ার কবিরের বই খুললে। এভাবে কেটেছে আমার প্রথম কৈশোর। সে-সময়ের খুব প্রিয় বইগুলোর একটি ছিল ‘নিকোলাস রোজারিওর ছেলেরা’।
নিজে মিশনারি স্কুলে পড়েছি, তাই বাড়তি আকর্ষণ ছিল বইটির প্রতি। মন যেন হারিয়ে গিয়েছিল সমবয়সী একদল কিশোরের মাঝে। কেউ বাড়ি থেকে অনুমতি পাচ্ছে না, কেউ চাঁদার টাকা জোগাড় করতে পারছে না, কেউ অন্যের ছায়া থেকে বের হয়ে আসতে ছটফট করছে। বুক ভারি হয়ে যেত গল্পের চরিত্রগুলোর কচি সংগ্রামে। হায় সে কী উৎকণ্ঠা!
সম্ভবত সেখানেই পড়েছিলাম, গল্পের কোন এক বখাটে বড় ভাই বছরের পর বছর ধরে স্কাউটিং ক্যাম্পে ‘খরবায়ু বয় বেগে’ গেয়ে যেত। তখন পর্যন্ত শুধু গানটির দু’লাইন জানতাম। বই পড়েই খুঁজে-পেতে পুরো গান শুনেছিলাম। শাহরিয়ার কবিরের বই পড়ার অনুভূতিগুলো যেন সেই থেকেই আটকে গেছে ‘খরবায়ু বয় বেগে’র মধ্যে।
প্রথমে মনে পড়ে ‘নিকোলাস রোজারিওর ছেলেরা’র কথা। এরপর একে একে মনে পড়ে যায় নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়, পাথারিয়ার সোনার খনি, কার্পেথিয়ানের কালো গোলাপ, বার্চবনে ঝড়, সীমান্তে সংঘাত, অনীকের জন্য ভালবাসা, লুসাই পাহাড়ের শয়তান, ব্যাভারিয়ার রহস্যময় দুর্গ, হানাবাড়ির রহস্য।
সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, ইত্যাদি নিয়ে অনেক তর্ক চলে বড়দের মহলে। খুব বড় একটা ব্যাপার ভুলে যায় সবাই। মানুষের মনন স্থায়ী রূপ নিয়ে ফেলে তার কৈশোরে। শত চেষ্টায়ও এরপর আর তার চিন্তা-চেতনার পরিবর্তণ সম্ভব না। বিশ্বাসের মধ্যাকর্ষণের কাছে জ্ঞানের বহুমুখী বিস্তার মার খেয়ে যায়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তণ, রাজসভায় মিছিল-সমাবেশ, বা মিডিয়ায় জ্ঞানগর্ভ আলোচনা কৈশোরোত্তীর্ণ মানুষের মনের উপর খুব কমই প্রভাব রাখতে পারে।
উঠতি প্রজন্মের কাছে কৈশোরের মৌলিক কিছু অনুভূতি তুলে ধরেছিলেন সত্যজিৎ রায়, শাহরিয়ার কবির, আর মুহম্মদ জাফর ইকবালের মত লেখকেরা। অধীর আগ্রহে তাঁদের নতুন বইয়ের অপেক্ষা, আর বই এলেই গোগ্রাসে গিলে ফেলার সেই সময়টা মনে আটকে আছে ‘খরবায়ু বয় বেগে’র মাঝে। কৈশোরের দ্বন্দ্ব আর ভয়গুলোর শৃঙ্খল বারবার ঝনঝন করে ওঠে এই একটি গানে। নিজের মনে প্রশ্ন জাগে, কতটুকু আসতে পেরেছি সেই দিনগুলো থেকে। স্বপ্নগুলো স্বপ্নই থেকে গেল। কান পাতলেই ঝন, ঝন, ঝন।
গানবন্দী জীবনঃ সে যে বসে আছে একা একা
জীবনের গতিময়তা, আকস্মিকতা, আর গভীরতার সাথে সবাই কমবেশি পরিচিত। বহুবার চেষ্টা করেও জীবনকে থামাতে বা ফেরাতে পারিনি। অথচ সেই জীবন যেন নিজে থেকে এসে আটকা পড়েছে কিছু গানের মাঝে। স্মৃতির স্ফটিক হয়ে যাওয়া জীবনের ভগ্নাংশগুলো খুব বেশি জীবন্ত হয়ে ফিরে আসে সেই গানগুলোর সাথে সাথে। কিছু গান, আর তার মাঝে আটকা পড়া জীবন নিয়েই এই প্রলাপ-সিরিজ।
১. সে যে বসে আছে একা একা
সবেমাত্র নিজের একটা ঘর পেয়েছি তখন। আমেরিকা এসেছি প্রায় ৬ সপ্তাহ হয়ে গেছে। প্রথম ক'দিন খুব বাজে কেটেছিল। প্রথম যে-বাসায় উঠলাম, সেখান থেকে তিন দিনের মাথায় বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। বিচিত্র এক অভিজ্ঞতা ছিল সেই ক'দিন। জেটল্যাগে মারা যাচ্ছি এমন সময় সাত-সকালে উঠিয়ে দিয়ে বাড়ির মালিক বললেন, আমি বাইরে যাবো, তুমি বের হও বাসা থেকে। সেই দিনটা কাটলো পার্কের বেঞ্চে বসে। সে-বাসার একটা ঘর খালি ছিল, তবু সেখানে ঢোকা বা শোয়া বারণ। যাঁর ঘর, তিনি দূর থেকেই মানা করে দিয়েছেন ফোন করে। উঠেছিলাম অস্থায়ী ভাবে, তবু তিন দিনের মাথায় বলে দেওয়া হল লিভিং রুমে শাওয়ার কার্টেইন টাঙিয়ে থাকার কথা। শর্ত মানলে এক-তৃতীয়াংশ ভাড়া দিয়ে থেকে যাওয়া, না মানলে সে-রাতেই অন্যত্র জায়গা খোঁজা। বের হয়ে গিয়েছিলাম।
হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম পথে পথে। জানুয়ারির সকাল। কী প্রচণ্ড শীত। দু'হাতের গিঁটের চামড়া ফেটে রক্ত ঝরছে শীতের প্রকোপে। এরই মাঝে আরেক স্বদেশী উদ্ধার করলেন। নিয়ে গেলেন তাঁর বাসায়। থাকতে দিলেন দু'সপ্তাহ। সে-বাসায় শোওয়ার ঘর তিনটি, কিন্তু মানুষ থাকে মাত্র সাতজন। এক বাঙালি নিজের ঘরে, বাকি দুই ঘর মিলিয়ে ছয় নেপালি। একটা ঘরে বিশাল উঁচু এক বিছানা। পথে-ঘাটে যত ম্যাট্রেস ফেলে রাখা ছিল, তার সব কুড়িয়ে এনে স্তুপ করা হয়েছে সেই ঘরে। ফলাফল, প্রায় চার ফুট উঁচু বিছানা। সেই ঘরে থাকতো দুই জন।
অন্যঘরটি আয়তনে বড়, সাথে লাগোয়া বাথ, ড্রেসিং। সে-ঘরে থাকতো চারজন। কোন আসবাব নেই। এক কোণায় কিছু বই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। চাদর পেতে বিছানা বানানো। একজন ঘুমিয়ে উঠে গেলে আরেকজন এসে ঘুমায়। খুব একটা অর্থকষ্টের কারণে যে এই ব্যবস্থা, তাও না। তবু অবাক হয়ে ভাবছিলাম, দু'জন বাঙালিকে আজ পর্যন্ত এক ঘরে থাকতে দেখলাম না। নিজের একটা ঘরের মূল্য আমাদের কাছে অপরিমেয়। অথচ মুদ্রার অন্য পিঠে একই এলাকা থেকে উঠে আসা এই ছাত্রেরা।
চার সপ্তাহ পর এক অ্যাপার্টমেন্টে একটা ঘর খালি হল। উঠলাম সেখানে। নিজের ঘর। বিছানা হিসেবে ব্যবহারের জন্য আমিও একটা ম্যাট্রেস কুড়িয়ে নিলাম। সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম ৩৫০০ ডলার। স্কলারশিপের পরও নিজের পকেট থেকে হাজার তিনেক টাকা দিতে হত বিশ্ববিদ্যালয়কে। বাকি টাকা থেকে ৪০০ ডলার দিয়ে একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার কিনলাম। বাধ্য হয়েই কিনতে হল। ঠান্ডা বয়ে দু'মাইল হেঁটে লাইব্রেরিতে যেতে পারি না। সেই কম্পিউটার রাখবার জন্য টেবিলের প্রয়োজন। ওয়ালমার্ট থেকে বিশাল একটা টেবিল কিনলাম। অল-পার্পাস টেবিল হিসেবে ব্যবহারের জন্য। সেই দিন থেকে ৪ বছর ধরে লেখাপড়া, খাওয়াদাওয়া, কাপড় ইস্ত্রি করা, ইত্যাদি সব কাজই করেছি ৫৮ ডলারে কেনা সেই টেবিলে। আজকে আমি ভার্জিনিয়া, লুইজিয়ানায় সেই টেবিল আজও আছে।
রাত জেগে নাট-বল্টু লাগাচ্ছিলাম সেই টেবিলের। শ্রান্ত হয়ে বিরতি নিয়েছিলাম একটু। এক বন্ধু বললো, নতুন একটা গান শুনে দেখতে। অর্ণবের "সে যে বসে আছে" সেই প্রথমবারের মত শুনলাম। কোথায় যেন একটা মোঁচড় লাগলো। একটা কোণায় গিয়ে পা ছড়িয়ে বসলাম। দেওয়ালে হেলান দিয়ে পুরো রাত কাটিয়ে দিলাম গানটা শুনতে শুনতে।
এইতো সেদিন ওয়াশিংটন ডিসি গিয়েছিলাম অর্ণবের কনসার্ট দেখতে। শেষদিকে যখন সবাই গলা মিলিয়ে গাইছে, তখন আমি আনমনে ফিরে গেছি আমার সেই প্রথম দিকের দিনগুলোয়। সেই দিনের প্রতিটা অনুভূতি যেন অনেক বেশি জীবন্ত হয়ে ফিরে এসেছিল গানটার সাথে। শত মানুষের মাঝেও যেন একা একা বসে ছিলাম, রঙিন স্বপ্ন বুনছিলাম, জানালার পাশে বসে মেঘ গুনছিলাম। ঘাড় ফেরালেই জীর্ণ বিছানা, হাত বাড়ালেই কোণায় পড়ে থাকা ওটমিল বিস্কুট।
বৃন্দাবনে জগন্নাথ
প্রথম চিন্তাই ছিল, কোন হাত? দীর্ঘদিনের অনভ্যাসজনিত কারণে ভ্যাবলার মত তাকিয়ে ছিলাম দুই হাতের দিকেই। কিছুক্ষণ হাওয়ায় হাত মকশো করলাম। অনেকটা শ্যাডো প্র্যাকটিসের ঢঙ্গে। নাহ, তবু মনে পড়ে না। অগত্যা বাধ্য হলাম সীমিত আকারে অডিশন দিতে। মানুষ আমি ডানহাতী। প্রত্যাশিত ভাবেই ডান হাত হল ব্যাটম্যান, আর হতভাগা বাম হাত হল রবিন।
অধম এই আমি ইবলিশ হলেও মোনাফেক নই। ইবলিশের আদর্শ অনুসরণ করে আমি ভাল-মন্দ নির্বিশেষে সব কাজ করি বিসমিল্লাহ বলে। ব্যতিক্রম হল না এবারও। বাড়ন্ত প্রত্যাশা, শুকনো কাপড়, আর এক রোল টয়লেট পেপারসহ ঢুকে পড়লাম বৃন্দাবনে। রুমমেটের সাথে চোখাচোখি হয়ে গিয়েছিল মাঝপথে। চোখ টিপে বললাম, হে বন্ধু, বিদায়। বাচ্চা ছেলে। ভদ্রতা করে হাসি চেপে শুধু বললো, বেস্ট অফ লাক, ব্রাদার! জবাবে বললাম, বিসমিল্লাহ বলে নিয়েছি, রাখে আল্লাহ মারে কে?
আমার যুদ্ধক্ষেত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল। দেহ থেকে সুতা খসে গেল, হাতের নাগালের সবটুকু জায়গা ঢেকে দেওয়া হল টয়লেট পেপারে। দুস্থ, রুক্ষ, আগাছামণ্ডিত চেহারাটা আয়নায় দেখলাম কিছুক্ষণ। নাহ, বেসিনের উপরের ছোট আয়নায় পোষাচ্ছে না। বিব্রতকর অবস্থায় যাবার আগেই খেয়াল হয়েছিল, ভাগ্যিস। দৌঁড়ে ঘরে গেলাম, টেনে নিয়ে আসলাম ঢাউশ আয়নাটা। এবার হয়েছে। দৃষ্টিসুখ যেন সৃষ্টিসুখ। আগডুম-বাগডুম ভাবতে ভাবতে দাঁড়ালাম আয়নার সামনে। এবার খেলা ভাঙার খেলা।
চলছিল ভালই। তবে কিছুদূর এগিয়ে মনে হল, একটু ভিজিয়ে নিলে মন্দ হত না। নয়তো বলি এক, করে আরেক। আলতো করে হাত বুলিয়ে একদিকে আনার বেলায় ঠিক আছে, কিন্তু স্বাভাবিকের চেয়ে একটু ভিন্ন কোন অবস্থানে নিতে গেলেই তিড়িং করে আরেক দিকে চলে যায়। এতক্ষণ কাজের কাজ তো হলই না, উলটা ধস্তাধস্তি করেই ঘেমে গেলাম পুরো। ভিজিয়ে নেবার পর দুঃসময়ের সঙ্গী হিসেবে এগিয়ে এল টয়লেট পেপারগুলো। প্রায় আধ ঘন্টা পর দেখা গেল এক ঘর টিস্যুর মধ্যে বসে আছি ক্লান্ত আমি। বড় বড় শ্বাস পড়ছে সশব্দে, অসম্পূর্ণ কাজের বিরক্তিকর নিদর্শন ছড়িয়ে আছে আশেপাশে। মনের ভেতর একটা কণ্ঠ বলছে বাদ দিতে। সবার জন্য সব না। পরে কোনদিন হবে নাহয়। সাথে সাথেই অন্য অংশ প্রতিবাদ করে উঠলো। না, পারতে হবে। এত আয়োজন তো সবদিন হয় না। এক রুমমেট বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি, আরেকজনকে দিয়ে বৃন্দাবনের কাজ সারিয়েছি আগেই। এই কষ্ট বৃথা যেতে দেওয়া যায় না।
যুদ্ধজয়ের প্রথম শর্ত মানচিত্রজ্ঞান। ভেবে বুঝলাম, মানচিত্রজ্ঞানের অভাবই আমার দুরবস্থার কারণ। মাঝপথে কিছুটা স্কাউটিং সেরে নিলাম। যুদ্ধক্ষেত্রটা অনেকটা বটগাছের মত। গোড়ার দিকে শক্ত মাটিতে শেকড় ছড়িয়ে আছে। চাইলেও তাকে তৎক্ষণাৎ ঘায়েল করা আমার কম্মো না। যদি কখনও আগ্রাসী ও আগ্রহী কোন সুন্দরীর সান্নিধ্য পাই, তাহলে তাকে দিয়েই করিয়ে নিতে হবে।
মূলের সাথে লেগে থাকা কাণ্ডটাই সবচেয়ে বেয়াড়া। পিছলে যায়, ফসকে যায়। চাপাচাপি করে তবুও কিছুটা সামাল দেওয়া যায়। আপোষের সাথেই কাজ এগিয়ে নিলাম। বটের মতই দু’পাশ বেয়ে ঝুল নেমে আছে কিছু। আর বাকি আছে গাছের আগার সাথে সম্মুখ-সমর। ঝুলগুলো একেবারেই নিরীহ। এরা দৃষ্টিসীমায় থাকলেও বৃষ্টিসীমায় থাকে না। এদের ছেড়ে গেলেও চলতো, তবু লেগে গেলাম। করবো যখন, ঠিকমতই করি। এমনিতেই মাসে একবার এমন সুবর্ণ সুযোগ মেলে।
যেমনটা বলছিলাম, আসল যুদ্ধ গাছের আগায়। ঝুলে হাত পড়তেই ফোঁস করে উঠলো সেটা। আমিও তাই বলে ছেড়ে দেবার পাত্র না। কৌশলটা কঠিন না তেমন একটা। শক্ত মুঠি করতে হয় শুরুতে। পিছলে যেতে চায়। চাবেই তো। মানবদেহের সব অনুষঙ্গেরই নিজস্ব প্রাণ আছে। শক্ত করে ধরতে হয়। গোড়া শক্ত না হলে আগার পরিচর্যা হবে কীভাবে? চলছে আমার কাজ। শরীর ভার হয়ে ছিল, একটু একটু করে হালকা হচ্ছি। আহা, কী আরাম। ছিলাম টম ক্রুজ, হয়ে যাচ্ছি ড্যানিয়েল ক্রেগ। ছন্দে ছন্দে হাত দু’টো দুলছে। আমি মুগ্ধ চোখে নিজেকে দেখছি জোড়া আয়নায়। এমন সময় ঠক্-ঠক্-ঠক্। ভাইয়া, আন্টি তোমার খোঁজ করছে।
আমার মা চিরদিনই কিছুটা বেরসিক। তারচেয়েও বাজে তার সময়জ্ঞান। আমি কোন কুকাজে রত হলেই আমাকে তার মনে পড়তে হবে। বইয়ের ভাজে বই নিয়ে কাঁথার নিচে ঢুকতে গেলেই আচমকা উদয় হয়ে বলে, টেবিলে বসে পড় বাবা, আমি গরম দুধ এনে দেই। জমানো টাকায় মোড়ের ভিডিও গেমের দোকানে যেতে গেলে বলে, মসজিদে যাও, সাথে খুচরা টাকা থাকলে দান-খয়রাত কোর। দশ মিনিট ধরে হেয়ার-জেল লাগিয়ে বের হওয়ামাত্র মাথায় এক আজলা পানি ঢেলে দিয়ে বলে, জমজমের পানি এটা, একটু দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দেই, মাথা ঠান্ডা হবে। অতএব, এ-রকম সময়ে আমার মায়ের আমাকে মনে পড়তেই হল।
আমিও এ-যুগের ছেলে। জননীর চেয়ে মান-ইজ্জত বড়। তারচেয়েও বড় ব্যক্তিগত বিলাস। অতএব, রুমমেটকে বলে দিলাম মাকে অপেক্ষা করতে বলতে। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন। এক হাত ধুয়ে, দরজার ফাঁক দিয়ে ফোন নিলাম। শীতের ভোরের মত প্রশান্ত আর শরতের মেঘের মত ভেসে যাওয়া একটা কণ্ঠে বললাম, হুম। মা অবাক হল এই আনন্দে। এ-আনন্দের স্বাদ আমার পাবার কথা না। একটু উদ্বিগ্ন হয়েই প্রশ্ন, কী করছো?
এজবাস্টনের টাই ম্যাচে ফিফটি করার পরের স্টিভ ওয়াহ’র মত চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, একা একা চুল কেটে সারলাম, কী যে শান্তি!
Thursday, October 16, 2008
আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও বাঙালি ভোট
বাঙালি স্বভাবগত ভাবেই রাজনীতিমগ্ন জাতি। আমেরিকায় বসবাসকারী বাঙালিরাও এর ব্যতিক্রম নন। আমেরিকার ইতিহাসে স্মরণকালের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তেজনাপূর্ণ নির্বাচনের প্রাক্কালে তাই বাঙালিরাও অনেকাংশে নির্বাচন-জ্বরে আক্রান্ত। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন রকম বিশ্লেষণ চলছে এই নির্বাচন গিরে। আমেরিকায় বসবাসকারী ভোটারদের নির্বাচন ভাবনার কিছু দিক সেই আলোচনায় উহ্য রয়ে যায়, এবং পৃথক বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
অভিবাসীর দেশ আমেরিকায় আইরিশ, ইতালীয়, বা হিসপ্যানিকদের তুলনায় বাঙালিদের বসবাস অনেক কম সময় ধরে। সময়ের আবর্তে ইতালি, আয়ারল্যান্ড, জার্মানি, জাপান, ভিয়েতনাম, বা মেক্সিকো থেকে আগত অভিবাসীরা মূলধারার মার্কিন সমাজে মিশে গেলেও বাঙালিরা কিছুটা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পছন্দ করেন। সুযোগ পেলেই দেশি গান, খাবার, পোশাকে হারিয়ে যাওয়ার তাড়না বাঙালির যাবার নয়। অপরাপর জাতিগুলো এক শব্দে ‘আমেরিকান’ হলেও বাঙালিরা ততটা নয়। আমেরিকায় স্থায়ী ভাবে বসবাসকারী বাঙালিদের রাজনৈতিক চেতনা তাই মূলধারার আমেরিকার সামাজিক ও আঞ্চলিক উপাদানগুলোর চেয়ে বৈশ্বিক উপাদান দিয়ে চালিত বেশি। এ-কারণে বাঙালিরা সংখ্যায় প্রচুর হলেও আমেরিকার রাজনৈতিক মানচিত্রে উল্লেখযোগ্য কোন অংশ নয়।
ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা এদিক থেকে অনুকরণীয় রকম ভিন্ন। মাত্র ক’দিন আগেই আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম কনিষ্ঠ গভর্নর নির্বাচিত ববি জিন্ডাল ভারতীয় বংশোদ্ভূত। শুধু তাই নয়, তিনি নির্বাচিত হয়েছেন লুইজিয়ানার মত রক্ষণশীল অঙ্গরাজ্যে এবং রিপাবলিকান দলের সমর্থনপুষ্ট হয়ে। মুদ্রার অন্যপিঠে আছেন বাঙালিরা, যাঁরা প্রবাসে বসেও দেশের রাজনীতিরই লেজুড়বৃত্তি করেন। ইসরায়েলের পর তাই আমেরিকার অন্যতম মিত্র হিসেবে ভারত উঠে আসছে, ইহুদিদের পর সবচাইতে সুবিধাভোগী হিসেবে ভারতীয়রা জায়গা করে নিচ্ছেন, পেছনে পরে থাকছে বাঙালিরাই।
পরিহার্যতার পীড়াদায়ক বাস্তবতার কারণে বাঙালিরা মূলধারার তুলনায় ভিন্নতর প্রণোদনায় রাজনৈতিক ভাবে উদ্বুদ্ধ বোধ করে থাকে। আমেরিকার ইস্যুভিত্তিক রাজনীতির উপাদানগুলোর মধ্যে সাস্থ্যসেবা বাঙালিদের কাছে মুখ্য বিবেচ্য। উচ্চমূল্যের কারণে চিকিৎসাবঞ্চিত থাকা থেকে বেরিয়ে আসতে চান তারা সবাই। সাস্থ্যসেবার পাশাপাশি শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক নীতির কারণে ডেমোক্রেটিক পার্টিই গড়পড়তা সব বাঙালির পছন্দ। এই ইস্যুগুলোর পাশাপাশি উদারপন্থা ও অভিবাসীদের প্রতি সহনশীলতার কারণে ডেমোক্রেটিক পার্টি আমেরিকার অধিকাংশ অভিবাসীর ঠিকানায় পরিণত হয়েছে। বাঙালিরা তাই প্রার্থী নির্বিশেষে ডেমোক্রেটিক পার্টির নিষ্ঠাবান ভোটিং ব্লক।
সাদা চোখে দেখলে বারাক ওবামা ও জন ম্যাকেইনের দ্বৈরথে বাঙালি ভোটারদের অবস্থান এটুকুতেই সমাপ্ত। মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাঙালিমাত্রেই নীল পতাকাধারী ডেমোক্রেটিক দলের গাধা মার্কায় ভোট দেবেন। প্রশ্ন হল, কতজন বাঙালি ভোট দেবেন, কেন ভোট দেবেন, কতটা উচ্ছ্বাসের সাথে ভোট দেবেন, এবং সেই ভোট কতটুকু মূল্য পাবে।
২. বাঙালি ভোট অবহেলিত হবার কারণ
আমেরিকায় বাঙালি ভোট তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ না হওয়ার একটি বড় কারণ অবস্থানগত। বাঙালিরা যেসব অঙ্গরাজ্যে বসবাস করেন, সেগুলো দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলের কোন না কোনটির নির্ভরযোগ্য ঘাঁটি। নিউ ইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, অরিগন, ম্যাসাচুসেটস, বা ওয়াশিংটনে বাঙালিরা নীলের সাগরে বিলীন। অন্যদিকে টেক্সাস, ওকলাহোমা, বা অ্যারিজোনায় বাঙালিরা রক্ষণশীলদের দুর্গে বন্দী।
এই প্রান্তিক পরিস্থিতির বিপরীত অবস্থানে আছে তথাকথিত ‘সুইং স্টেট’ গুলো। এই স্টেটগুলো তুলনামূলক ভাবে জনবৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়ায় এগুলো নির্দিষ্ট কোন দলের ঘাঁটি নয়। এই গোটা দশেক ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট’-এই নির্ধারিত হয় মার্কিন নির্বাচন। নিউ জার্সি কিংবা ফ্লোরিডার মাত্র কয়েক হাজার ভোটের ব্যবধানে নির্বাচনের ফলাফল ঘুরে যেতে পারে বলে দুই দলই এসব এলাকায় ভোটারদের তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে। নিউ জার্সির একাংশের শ’খানেক ‘ইহুদি’ ভোটার, ফ্লোরিডার ‘সিনিয়র সিটিজেন’ ভোটার, বা ওহায়োর ‘ইভ্যাঞ্জেলিক্যাল’ ভোটারেরা তাই উভয় পক্ষ থেকেই ঈর্ষণীয় মনোযোগ পাচ্ছেন। অন্যদিকে সংখ্যায় অনেক বেশি হয়েও অনেক এলাকায় ভোটারেরা নির্বাচনের দামামা তেমন একটা শুনতে পাচ্ছেন না।
বিশ্বস্ত ভোটার হওয়া সত্ত্বেও বাঙালিরা ডেমোক্রেটিক দলের কাছ থেকেও তুলনামূলক ভাবে কম সমাদর লাভ করে থাকে। সংখ্যালঘু হলেই ডেমোক্রেটিক দলের পক্ষে ভোট দিতে হবে, এই রীতি থেকে বাঙালিরাও বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে একটু একটু করে। এক্ষেত্রে ‘সুইং ভোটার’-এর মর্যাদা লাভের চেয়ে ডেমোক্রেটিক দলের প্রতি অসম্মতির ভূমিকা বেশি। বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে একটি সমান্তরাল উদাহরণ এ-ব্যাপারটি পরিষ্কার করতে সাহায্য করবে।
অপেক্ষাকৃত সহনশীল ও মধ্যবামপন্থী দল হওয়ার কারণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ধারাবাহিক ভাবে জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের ভোট পেয়ে এসেছে। অনায়াসে পেয়ে যাওয়ায় এই ভোট কখনই যথাযথ মূল্য পায়নি, ভোটারদের প্রয়োজনগুলো দল বা সরকারের কাছে প্রাধান্য পায়নি। এই নিষ্ঠার জন্য ধর্মীয় ও জাতিগত ভাবে সংখ্যালঘুদের প্রতি মনোযোগী না হয়ে বরং তাদের ভুলে গেছে। অল্প কিছু উগ্র ধর্মান্ধ ও জাতীয়তাবাদীর ভোটের লোভে তাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরে আসতে পেরেছে অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে সরব ও অনড় অবস্থান থেকে।
সাম্প্রতিক সময়ে ডেমোক্রেটিক দলের ব্যাপারে বাঙালিদের কিঞ্চিৎ আশাভঙ্গের কারণটিও অনুরূপ। রিপাবলিকান দলের নিরন্তর আক্রমণের মুখে ডেমোক্রেটিক দল নিজেদের শক্তিশালী ও দৃঢ় হিসেবে জাহির করবার প্রয়োজনে তাদের অনেক মৌলিক নীতির সাথে আপোষ করেছে। সেপ্টেম্বর ১১-র সন্ত্রাসী আক্রমণের পর এটি কিছুটা রাজনৈতিক প্রয়োজন থেকে করা, কিছুটা নেতৃত্বের ব্যর্থতা। তালেবান সরকারের পতন ঘটাতে আফগানিস্তান আক্রমণ বিশ্বের অনেকেই সমর্থন করলেও ইরাক যুদ্ধের পেছনে তেমন কোন কারণই ছিল না। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ একক ভাবে বিশ্বের চোখে খলনায়ক হলেও বাস্তব এটাই যে ডেমোক্রেটিক দলও সেই আক্রমণের সমর্থনে সিনেট ও কংগ্রেসে ভোট দিয়েছে। বাংলাদেশের খেলাফত মজলিশের মত আমেরিকার কট্টর ডানপন্থী ইভ্যাঞ্জেলিক্যালদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেছে ডেমোক্রেটিক দল। এর সাথে আছে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির প্রশ্নে ইসরায়েলের পক্ষে নিঃশর্ত সমর্থন, ইত্যাদি। নির্বাচন জয়ের জন্য অল্প কিছু ভোটের সন্ধানে ডেমোক্রেটিক দল এভাবেই পেছনে ফেলে গেছে তার অনেক পুরনো সমর্থকদের।
৩. ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমর্থন – বিল ও হিলারি ক্লিনটন
ইংরেজ ধাঁচের গণতন্ত্রগুলোর সাথে আমেরিকার সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে। আভিজাত্যের প্রভাব আমেরিকায় নেই বললেই চলে। এদেশে উদয়াস্ত পরিশ্রম করলে যে-কেউ একটি সচ্ছল জীবন যাপন করতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও ভাষার মানুষের মিশেল হওয়ায় এখানে সামাজিক সহনশীলতা ব্যাপক। আমেরিকার রাজনৈতিক কাঠামোর ব্যাপারেও কথাগুলো সত্য। এখানে ইংরেজ ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোর মত বহু বছর ধরে দলের হয়ে কাজ করে একটু একটু করে উঠে আসতে হয় না। মানুষকে আকর্ষণ ও আস্বস্ত করবার মত গুণাবলি থাকলে যে-কেউ দলের নেতৃস্থানীয় অবস্থানে উঠে আসতে পারেন খুব সহজেই। নির্বাচিত হওয়ার বছর খানেক আগেও তেমন কেউ জিমি কার্টার নামে জর্জিয়ার অঙ্গরাজ্যের গভর্নরের নাম জানতেন না। তাঁকে হারিয়ে দুই দফার জন্য রাষ্ট্রপতি হওয়া রনাল্ড রেগান ছিলেন হলিউডের ডাকসাইটে নায়ক।
দ্রুত জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতা অর্জনের পথটির কারণে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি পদে অধীষ্ঠিতরা তাই প্রায়ই চুম্বক ব্যক্তিত্বের অধিকারী হন। তাঁরা নির্বাচিত হবার পর নিজের নীতি ও বিশ্বাস প্রচার করে একটি সুনাম রেখে যাওয়ার চেষ্টা করেন। নীতির বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দলের সমর্থন ও প্রতিনিধি পরিষদের দলীয় সাংসদদের ভূমিকা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই মূল কৃতিত্বের ভাগিদার হন শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতি। একই বাস্তবতা অজনপ্রিয় কাজের বেলায়ও প্রযোজ্য। সাম্প্রতিকতম দুই রাষ্ট্রপতির দিকে তাকালেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হবের ইরাক যুদ্ধ, দুর্বল অর্থনীতি, কট্টর ডানপন্থা, ইত্যাদির দায় মাথায় নিয়ে জর্জ বুশ পৃথিবীময় ঘৃণিত। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য শান্তিচুক্তি, আফ্রিকায় ত্রাণ সহায়তা, ও বর্ধনশীল অর্থনীতির কারণে বিল ক্লিনটন সবচেয়ে আদৃত নামগুলোর একটি।
এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালিরা মূলত বিল ও হিলারি ক্লিনটনের একান্ত অনুসারী। বয়োজ্যেষ্ঠ বাঙালিরা, যাঁরা বছর দশেকের বেশি সময় ধরে আমেরিকায় আছেন, তাঁরা অর্থনৈতিক স্বর্ণযুগের কারণে বিল ক্লিনটনকে স্মরণ করেন প্রতিদিন। বিল ক্লিনটনের প্রথম শাসনামলে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করার জন্য হিলারি ক্লিনটনের প্রয়াসের কথাও তাঁরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। সেই সাথে হিলারি ক্লিনটন বাঙালিদের মুখ্য বসত নিউ ইয়র্কের সিনেটর, এক কালে বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন, ডঃ ইউনুস সহ অনেক বাঙালির পরিচিত, বাংলাদেশের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে সরব হয়েছেন, বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষায় সহায়তা করেছেন। সব মিলিয়ে আমেরিকার রাজনীতিতে বাঙালিদের পছন্দের শীর্ষে আছেন বিল ও হিলারি ক্লিনটন।
ডেমোক্রেটিক দলের প্রাইমারি নির্বাচনের সময় বারাক ওবামা ও হিলারি ক্লিনটনের মধ্যে হাড্ডা-হাড্ডি লড়াই হয়। বিভিন্ন সময়ে তিক্ততার জন্ম দেওয়া সেই লড়াইয়ের পর আমেরিকা জুড়ে অনেক হিলারি-সমর্থকই বারাক ওবামাকে সমর্থন করা থেকে বিরত আছেন। কেউ কেউ রিপাবলিকান প্রার্থী জন ম্যাকেইনের পক্ষে ভোট দেওয়ার কথাও বলছেন প্রকাশ্যে। বাঙালিদের মধ্যে তেমন প্রবণতা না থাকলেও প্রৌঢ়দের মধ্যে এক ধরণের নির্লিপ্ততা চোখে পড়বার মত। এঁদের অনেকেই প্রথম বারের মত ভোটার হয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার আশায়। বারাক ওবামার পক্ষে হয়তো তাঁরা তবু ভোট দেবেন, তবে দল বেঁধে বা উচ্ছ্বাসের সাথে নয়। তাঁরা ওবামার চৌকষ উপস্থাপনা ও স্থিতধী চিন্তায় মুগ্ধ হলেও মন থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না হিলারির বিপরীতে প্রাক-নির্বাচনী লড়াইয়ের সময়ের তিক্ততা।
৪. বাঙালির চোখে ব্যক্তি বারাক ওবামা
এব্রাহাম লিংকনের অঙ্গরাজ্য ইলিনয় থেকে নির্বাচিত সিনেটর বারাক ওবামা পুরো আমেরিকার কাছেই এক নতুন ব্যক্তিত্ব। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে অন্যতম কনিষ্ঠ প্রার্থী, মাত্র দু’বছর আগে সিনেটে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। এর আগে তিনি বছর সাতেক ইলিনয়ের স্টেট সিনেটে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বারাক ওবামার জাতিগত পরিচয় এখন অনেকেই জানেন। ওবামার বাবা ছিলেন কেনিয়া থেকে আগত, তাঁর মা শ্বেতাঙ্গ, তাঁর জন্ম হাওয়াই অঙ্গরাজ্যে, তিনি শৈশবে কিছু বছর ইন্দোনেশিয়ায় কাটিয়েছেন। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রার্থী হিসেবে তিনি মূলধারার আমেরিকানদের কাছে সংশয়ের, আর বাঙালিদের কাছে ভয়ের। অনেক বাঙালিই ভয় পান ওবামা আসলেই নির্বাচিত হতে পারবেন কিনা, নির্বাচনে ভোট পেলেও কারচুপিতে হেরে যাবেন কিনা, ভোটে জিতলেও তাঁকে বেঁচে থাকতে দেওয়া হবে কিনা, ইত্যাদি ভয়ের কথা শোনা যায় বাঙালি আলোচনাগুলোয় কান পাতলে।
ওবামার ব্যাপারে প্রৌঢ় বাঙালিদের এই সংকোচের মধ্যে একটি প্রজন্মগত বৈশিষ্ট্যও লক্ষ করা যায়। হিলারি ক্লিনটন ও বারাক ওবামার প্রাইমারি নির্বাচনের সময় উভয়েই ১৮ মিলিয়নের কিছু বেশি ভোট পেয়েছিলেন। উল্লেখযোগ্য দিক হল, হিলারি পুরনো ডেমোক্রেট ও বয়োজ্যেষ্ঠদের ভোট পেয়েছিলেন। এই ভোটে বখরা বসানোর চেষ্টা না করে ওবামা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জড়িত করেছেন নতুন ভোটারদের। সদ্য ইউনিভার্সিটিতে প্রবেশ করা ছেলেমেয়েরা তাঁর হয়ে প্রাণান্ত খাটুনি করেছে। দেশ নিয়ে ভেবেছে, রাজনীতিতে জড়িত হয়েছে। এই ‘আর্মি অফ নিউ ভোটারস’ দিয়েই ওবামা হারিয়েছেন হিলারিকে। প্রৌঢ় বাঙালিদের হিলারির প্রতি সমর্থনের কারণ ও ধরণ মূলধারার আমেরিকান ভোটারদের সাথে মিলে যায় এক্ষেত্রে। দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালি কিংবা অপেক্ষাকৃত কম বয়সী ভোটারদের মাঝে ওবামার ব্যাপারে আমেরিকান তরুণ-তরুণীদের অনুরূপ উচ্ছ্বাস ও উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। এই দিক থেকে প্রজন্মগত পছন্দের বিভেদ অনেক প্রকট।
সবশেষে আছে ধর্মের প্রসঙ্গ। হাজার উদারতা সত্ত্বেও আমেরিকায় ধর্মীয় অনুভূতি অন্য যেকোন পশ্চিমা দেশের চেয়ে গভীর। দুই প্রান্তের দুই মহাসমুদ্রের তীরের অভিবাসী-অধ্যুষিত অংশগুলো বাদ দিলে এদেশ অত্যন্ত ধর্মভীরু ও কট্টর। দুঃখজনক বাস্তবতা এটাই যে এদেশে খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বি নন, এমন কারও জন্য রাষ্ট্রপতি পদের মত ক্ষমতাধর কোন অবস্থানে আরোহন দুষ্কর। বারাক ওবামার পুরো নাম বারাক হুসেইন ওবামা। ধর্মবিশ্বাস মতে খ্রীষ্টান হওয়া সত্ত্বেও পিতৃদত্ত এই মুসলিম নামটি তাঁকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। রিপাবলিকান দল ভোটারদের ভীত করার জন্য বারাক ওবামাকে মুসলিম বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে আসছে বহুদিন ধরে। এই মিথ্যা আক্রমণের বিপরীতে এক পর্যায়ে বারাক ওবামা সাংবাদিক সম্মেলনে নিজের ধর্মের কথা খোলামেলা ভাবে বলেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি অনেক কালের মধ্যে প্রথম ডেমোক্রেটিক প্রার্থী যিনি গীর্জায় গিয়ে ইভ্যাঞ্জেলিকালদের সাথে দেখা করেছেন, মৌলিক বিভেদগুলো মেনে নিয়ে দেশের কারণে এক হতে বলেছেন। যেকোন ডেমোক্রেটিক প্রার্থীর চেয়ে তিনি তাঁর ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারে সরব। ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মকর্ম নিয়ে কোন মাথা-ব্যাথা না থাকলেও গুজব প্রতিহত করতে গিয়ে ওবামার বলা কিছু কথা বাঙালি ও মুসলিম ভোটারেরা কিছুটা মনক্ষুন্ন। তাঁরা আশা করেছিলেন বারাক ওবামা সরাসরি প্রশ্ন করবেন তিনি মুসলিম হলেও কেন তা তাঁকে অযোগ্য করবে। ওবামা তেমনটা না করা রাজনৈতিক ভাবে সমীচিন হলেও এটি অনেকের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে।
৫. বাঙালির চোখে ব্যক্তি জন ম্যাকেইন
বারাক ওবামার প্রতিদ্বন্দ্বী জন ম্যাকেইন দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে অ্যারিজোনা থেকে নির্বাচিত সিনেটর। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় তাঁর যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হলে তিনি আরও অনেকের সাথে যুদ্ধবন্দী হন। জন ম্যাকেইনের পিতা সে-সময় নেভির অ্যাডমিরাল ছিলেন। বাবার ক্ষমতার সূত্রে তাঁর মুক্তির বন্দোবস্ত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সহযোদ্ধাদের ফেলে একা যাবেন না বলে তিনি দীর্ঘ চার বছর থেকে গিয়েছিলেন যুদ্ধবন্দীদের ক্যাম্পে। সে-সময় ‘সলিটারি কনফাইনমেন্ট’ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম শাস্তি পেতে হয়েছিল তাঁকে। যুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি যোগ দেন রাজনীতিতে।
নীতির প্রশ্নে আপোষহীন থাকার একটি সুনাম জন ম্যাকেইনের অনেক দিনের। রিপাবলিকান দলের সমর্থক নন, এমন সবার মাঝেও তাঁর ভাবমূর্তি একজন নিপাট ভদ্রলোকের। আমেরিকার শাসনব্যবস্থায় নিম্নকক্ষ বা কংগ্রেসের হাতে যাবতীয় ব্যয়ভারের দায়িত্ব অর্পণ করা আছে। বাজেট থেকে শুরু করে ছোট ছোট ‘স্পেন্ডিং বিল’ গুলোও কংগ্রেসের হাত ঘুরে আসতে হয়। জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের এলাকার উন্নয়নের জন্য এসব বিলের মধ্যে অনেক রকম প্রকল্প ঢুকিয়ে দেন। রাজনীতির পরিভাষায় এগুলোকে ‘ইয়ারমার্ক’ বলা হয়, আর অপচয়ের কারণে কথ্য ভাষায় বলা হয় ‘পর্ক-ব্যারেল’ (শূকরের মাংস আর মদের ব্যারেল নিয়ে উৎসবে মেতে ওঠার জন্য বাড়তি টাকা বোঝাতে)। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে জন ম্যাকেইন এ-ধরণের অপচয়ের বিরুদ্ধে অনেক শক্ত অবস্থান নেওয়ার কারণে বিখ্যাত।
রিপাবলিকান দলের নেতা হলেও জন ম্যাকেইন মূলত অর্থনৈতিকভাবে রক্ষণশীল। গর্ভপাত বা সমকামিতার ব্যাপারে সামাজিক ভাবে রক্ষণশীল হলেও তিনি জর্জ বুশ বা মিট রমনি বা মাইক হাকাবি-র মত কট্টর নন। অ্যারিজোনা অন্যতম ‘বর্ডার স্টেট’ হওয়ায় তিনি অবৈধ অভিবাসন নিয়েও কাজ করেছেন। অত্যধিক ব্যয়, অভিবাসন নীতি, ইত্যাদি বিষয়ে নিজের দলের বিপক্ষে তিনি অপ্রিয় অবস্থান নিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। এতে করে বহু বছর ধরে জন ম্যাকেইন একজন প্রথাবিরোধী বা ম্যাভরিক হিসেবে নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন।
বর্ণিল ক্যারিয়ার ও চারিত্রিক গুণাবলির কারণে জন ম্যাকেইন বাঙালিদের চোখেও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। ২০০০ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী অ্যাল গোর তাঁর ‘রানিং মেট’ হিসেবে বাছাই করেছিলেন জো লিবারম্যানকে। ইসরায়েল ও ইহুদি অধিকার প্রসঙ্গে আমেরিকার অন্যতম কট্টর এই ব্যক্তিকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ায় বাঙালি সহ অনেক মুসলমানের ভোটই হারিয়েছিলেন অ্যাল গোর। সেই বছরও রিপাবলিকান দলের মনোনয়নের জন্য প্রতিযোগিতা করেছিলেন জন ম্যাকেইন। প্রথম দিকের কিছু নির্বাচনে তিনিই জিতেছিলেন, জর্জ বুশ নন। দক্ষিণা অঙ্গরাজ্য সাউথ ক্যারোলিনার প্রাইমারি নির্বাচনের আগে গুজব রটানো হয়েছিল যে জন ম্যাকেইনের একটি জারজ সন্তান আছে। বাস্তবে সেই কন্যা সন্তানটি বাংলাদেশ থেকে দত্তক নেওয়া ব্রিজিট ম্যাকেইন। জর্জ বুশ ও কার্ল রোভের নোংরা কৌশল ও চরিত্রহননের হাতে ধরাশায়ী হলেন জন ম্যাকেইন।
রাজনীতির প্রয়োজনে জন ম্যাকেইন এরপর দিনে দিনে আরো বেশি ডানপন্থী হতে থাকেন। বিভিন্ন রকম ইস্যুতে তিনি নিরলস সমর্থন দিয়ে গেছেন রিপাবলিকান প্রশাসনকে। বাঙালি ও অন্যান্য অভিবাসীদের মধ্যে জন ম্যাকেইনের যেই শক্ত অবস্থান ছিল, তা সেই সময়টা থেকেই লোপ থেকে থাকে। ইরাক যুদ্ধের পক্ষে থাকা, দলত্যাগী জো লিবারম্যানকে সাথে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা করা, প্রচারনার কাজে জর্জ বুশের আমলের ব্যক্তি ও কৌশল নিয়োগ, আপোষহীনতার নীতি থেকে সরে আসা, এবং মোটা দাগে একজন রিপাবলিকান হওয়ার কারণে জন ম্যাকেইন শুধু বাঙালি নয়, সবার কাছেই কম-বেশি অসমর্থনের পাত্র।
৬. কেমন যাচ্ছে নির্বাচনী প্রচারণা
বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এই মুহূর্তে বারাক ওবামা জনপ্রিয়তায় বেশ খানিকটাই এগিয়ে। আমেরিকার ভোটাররা সাধারণত জাতীয় নিরাপত্তার চিন্তা করলে রিপাবলিকানদের ভোট দেন, আর অর্থনীতির চিন্তা করলে ডেমোক্রেটদের। সেই সাথে যোগ হয়েছে গত আট বছরের দুঃশাসনের ফলে রিপাবলিকানদের প্রতি জমে ওঠা বিদ্বেষ। সব রকম নির্দেশক ডেমোক্রেটদের পক্ষে হওয়া সত্ত্বেও ওবামা বনাম ম্যাকেইন প্রতিযোগিতা বেশ কাছাকাছি ছিল কিছুদিন আগ পর্যন্ত। ওবামা কৃষ্ণাঙ্গ, তরুণ, ও স্বল্পপরিচিত হবার ফলে এরকমটা হয়েছে বলে অধিকাংশ বিশ্লেষক মত ব্যক্ত করতেন।
আমেরিকার নির্বাচন পদ্ধতিতে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের কিছু ‘ইলেক্টোরাল ভোট’ থাকে তার জনসংখ্যা অনুযায়ী। সে-কারণেই আকারে অনেক বড় হওয়া সত্ত্বেও মন্টানার ভোট সংখ্যা ৩ এবং নিউ জার্সির ভোট সংখ্যা ১৫। ৫০টি অঙ্গরাজ্য মিলিয়ে ইলেক্টোরাল ভোট ৫৩৮টি। ২০০৪ সালের নির্বাচনে জর্জ বুশ জিতেছিলেন ২৮৬-২৫১ ব্যবধানে। ভোর পর্যন্ত সিদ্ধান্ত ঝুলে ছিল ওহায়োর ২০টি ইলেক্টোরাল ভোটের উপর। ঠিক যেমন ২০০০ সালে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ফ্লোরিডার ২৭টি ভোটে।
এবছর এখনও পর্যন্ত বারাক ওবামা ডেমোক্রেটিক দলের ঘাঁটিগুলো ধরে রেখেছেন। স্পষ্ট ব্যবধানে যেসব অঙ্গরাজ্যে এগিয়ে আছেন, তাতে তাঁর পক্ষে ২৬৪ ভোট মোটামুটি নিশ্চিত। বিজয়ের জন্য দরকার আর ৬ টি ভোট, জিততে হবে ৭টি অঙ্গরাজ্যের যেকোন একটি। এগুলোর সবই ২০০৪ সালে জর্জ বুশের পক্ষে গিয়েছিল। একমাত্র ইন্ডিয়ানা বাদে বাকি ৬টিতেই (ফ্লোরিডা, ওহায়ো, কলোরাডো, নেভাডা, ভার্জিনিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা) ওবামা এগিয়ে আছেন। শেষ তিন সপ্তাহ এই অগ্রগতি ধরে রাখতে পারলে তিনি স্মরণকালের ব্যাপকতম ব্যবধানে জিততে পারেন। তবে এক্ষেত্রে গলার কাঁটা হয়ে আছে ‘ব্র্যাডলি এফেক্ট’ বলে একটি ঘটনা।
১৯৮২ সালে টম ব্র্যাডলি নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ নেতা ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনের আগে সব জরিপে তিনি বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন, অথচ নির্বাচনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরাজিত হন। পরবর্তীতে দেখা যায়, প্রাক-নির্বাচন জরিপের সময় ব্র্যাডলিকে ভোট দেবার কথা বললেও কৃষ্ণাঙ্গ বলে অনেকেই তাঁকে ভোট দেননি। এই ঘটনা এবারেও ঘটতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। শেষ মুহূর্তে ভোটিং বুথে ঢুকে অনেকে হয়তো বারাক ওবামাকে তাঁর বর্ণের কারণে ভোট না দিতে পারেন। অন্যদিকে অনেকে ‘রিভার্স-ব্র্যাডলি এফেক্ট’ এর কথাও বলছেন, আশাবাদ ব্যক্ত করছেন যে অনেকে হয়তো ভোটিং বুথে গিয়ে ওবামাকেই ভোট দেবেন, শুধু মুখে বলছেন না আগে থেকেই। এছাড়া আছে সময়ের আগেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যাবার ভয়। বারাক ওবামার সামনের পথটুকু কেমন, তা সময়ই বলে দেবে। তবে আপাতত তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিজের হাতেই।
‘কী ব্যাপার ইশতি, আমার খবর নাও না যে?’
নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কাঁদবো না। প্রথম ফোঁটা দুটো এইতো সবে গড়াচ্ছে। অনেক বেশি অপরাধবোধ কাজ করছে মনের মধ্যে। কানে বাজছে ফোন করেই জুবায়ের ভাইয়ের অনুযোগ, “কী ব্যাপার ইশতি, আমার খবর নাও না যে?”
সচলায়তনে প্রথম দিকে নিজের মত এক কোণে থাকতাম। বড় লেখা দেখলে পড়তাম না, মন্তব্য করলেও ভয়ে ভয়ে করতাম। তখন ‘চুপকথা’ প্রকাশিত হচ্ছে কিস্তিতে। ধারাবাহিক উপন্যাস বলেই দূর দিয়ে যেতাম। একদিন কোন কুক্ষণে ভুল করে ঢুকে পড়েছিলাম একটি পর্বে। সেই থেকেই জুবায়ের ভাইয়ের লেখার সাথে পরিচয়। জুবায়ের ভাই কিছু লিখলেই প্রথমে মনে মনে কিছুক্ষণ বকে নিতাম তাঁকে। জুবায়ের ভাইয়ের লেখাগুলো যত বড়ই হোক, পড়তেই হত। না পড়লে ঘুম আসতো না, কেমন যেন একটা অস্বস্তি লাগতো। সপ্তাহের শুরুতে ফোনে বলতাম আমার লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে হলেও ছোট ছোট লেখা দিতে, আবার সপ্তাহের শেষে এই আমিই বলতাম লেখা দিচ্ছেন না কেন।
ব্লগের বাইরে জুবায়ের ভাইয়ের সাথে কথাবার্তার শুরু জানুয়ারির মাঝামাঝি। সচলায়তনেই ব্যাক্তিগত মেসেজ পাঠিয়ে জুবায়ের ভাই ধন্যবাদ দিয়েছিলেন ‘অবিনাশী গান’ এর সাথে তাঁকে একটা পোস্ট কার্ড দেবার জন্য। সামর্থ্যের অভাবে আট আনার পোস্টকার্ড, আর লজ্জার আধিক্যে শুধু ‘প্রিয় লেখককে শুভেচ্ছা’। সন্ধ্যা থেকে চেয়ে আছি সেই সামান্য অভিনন্দনটুকুর জবাবে জুবায়ের ভাইয়ের দেওয়া আন্তরিক মেসেজটার দিকে। একটা জায়গায় লিখেছিলেন, “লেখক হওয়ার বাসনা সত্যিই ছিলো, হলো না এ জীবনে, তবু প্রিয় লেখক হলাম কী করে? তারপরও মনে হয়, এইসব ছোটো ছোটো ভালো লাগা আছে বলে জীবন এতো সুন্দর।” হায় সে বিনয়, হায় সে জুবায়ের ভাই।
তার ক’দিন পরেই আবার মেসেজ দিয়েছিলেন। ফোন নম্বর নিশ্চিত করে বললেন সপ্তাহান্তে চমকে দেবেন। সেই শনিবারেই ছিল জুবায়ের ভাইয়ের সাথে প্রথম কথা। “ইশতি, আমি বর্গীয়-জ জুবায়ের!”। ঘুম জড়ানো চোখে সালাম-পর্ব সেরে আলাপচারিতায় যেতেই বললেন, “আপনাকে চমকে দেবো বলেছিলাম না? এখানে আরও একজন জুবায়ের আছেন। অন্তস্থ-য যুবায়ের।” বলেই ফোন দিয়েছিলেন সুবিনয় মুস্তফীকে। যুবায়ের ভাইয়ে অনেক বেশি হিংসা হচ্ছে আজকে, জুবায়ের ভাইয়ের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন তাই।
সেই থেকে প্রায়ই ফোন করতেন। অনেক আপত্তির পরও আপনি করে বলতেন। বলতেন, অহেতুক কাউকে কষ্ট দিতে চান না, সবাইকে সম্মান দেখাতে চান। আপনি করে ডাকলে আর কথা না বলার হুমকির পর অবশেষে তুমিতে নেমেছিলেন। আমার দ্বিগুণেরও বেশি বয়সী হয়েও আশ্চর্য রকম উদার ভাবে কথা বলতেন, আমার মত জানতে চাইতেন। প্রবাসজীবন নিয়ে কথা হত, লুইজিয়ানার গরম নিয়ে কথা হত, মা-ভাই কেমন আছে তা নিয়ে কথা হত, আর অনেক বেশি কথা হত বাংলাদেশ নিয়ে।
আমি লেখক নই, ইতিহাসবেত্তা নই, সমাজবিজ্ঞানী নই। আমি স্রেফ হাতুড়ে প্রকৌশলী। রাজনীতি, দর্শন, সমাজ, বা ইতিহাস নিয়ে লিখতে তাই আমার হাত কাঁপতো অনেক। জুবায়ের ভাই একদিকে ধাঁরালো সমালোচনা করতেন, আরেক দিকে সাহস দিতেন। আমি বলতাম যে তাঁর মাপের একজন মানুষের সাথে কথা বলতেই বুক দুরুদুরু করে আমার। তিনি জবাবে বলতেন, বিশ্বাস অটল থাকলে তো এটা হবার কথা নয়।
জুবায়ের ভাইকে আমি ‘সচলায়তনের হেডমাস্টার’ ডাকতাম। একমাত্র তিনিই সরাসরি ভুল ধরিয়ে দিতেন। শুনেছি কটূ কোন ভুল ধরা পড়লে ব্যাক্তিগত মেসেজ পাঠিয়ে সেটা জানান দিতেন। আমার সময় রাত ১১ টার দিকে জুবায়ের ভাই সাধারণত সচলায়তনে আসতেন। আমার লেখাগুলোয় প্রথম দিকের মন্তব্যকারী হতেন সব সময়। অল্পবিস্তরে অনেক গভীর সমালোচনা রেখে যেতেন। মনটা কোন রাতে জুবায়ের ভাইয়ের মন্তব্যের অপেক্ষা করতো, কোন রাতে লেখার। কিছুদিন আগে জুবায়ের ভাই খেলাপীর খাতায় আমার নাম তুলে দিয়ে গিয়েছেন। ‘হারিকেন, ফুটবল, ও কিছু মানুষের কথা’ নিয়ে বলেছিলাম, লেখায় ছেদ পড়ে গেছে দেখে আর দেইনি। সেই ছিল জুবায়ের ভাইয়ের কাছে প্রথম ধমক খাওয়া। তুমি থেকে আবার আপনিতে উঠে গিয়েছিলেন। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম শেষ করবো। জুবায়ের ভাই শেষ হয়ে গেলেন, আমি শেষ করতে পারলাম না। নিজেকে বলছিলাম শক্ত থাকবো। লেখাটা আজই সেরে পোস্ট করে দেবো। পারলাম না। মন মানলেও চোখ আর মানলো না।
দেশ আর রাজনীতি নিয়ে অনেক গল্প হত। জুবায়ের ভাইয়েরই গুঁতাগুঁতিতে ‘নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্র’ লেখা শুরু করেছিলাম। তাঁরই ধমকে সেটা শেষ হয়েছে। অখণ্ড পিডিএফ কপি ডাউনলোড করে জুবায়ের ভাই কথা দিয়েছিলেন, পুরোটা আবার পড়ে জানাবেন তাঁর মত। পারলেন না। আমি বারাক ওবামার ভক্ত, তাই আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন ওবামার মধ্যপন্থা সম্পর্কে আমার মতামত। ফোনে বলার পরে বলেছিলেন, “এবার এগুলো লিখে ফেল দেখি।” হল না।
সেলিম আল দীনের মৃত্যুর পর জুবায়ের ভাই হাত দিয়েছিলেন ‘আমাদের বাতিঘরগুলো ও আসন্ন দিন’ সিরিজে। দুরন্ত সেই সিরিজে লিখে চলছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের কথা। ষষ্ঠ পর্বের পর আটকে যায় সিরিজটি। জুবায়ের ভাই একদিন ফোন করে বললেন, “আমি তো ফেঁসে গেছি, ইশতি! এত বড় কাজে যে হাত দিয়েছি সেটা তো আগে বুঝিনি।” সে-দফা ভূমিকা বদলে গিয়েছিল। সবিস্তারে আলোচনা হচ্ছিল ইতিহাস নিয়ে, সিরিজ এরপর কোনদিকে যেতে পারে তা নিয়ে। জুবায়ের ভাইকে বলেছিলাম, আপনার লেখা এই সিরিজের লিংক আমি এ-প্রজন্মের অনেকের কাছে বিলিয়েছি, তাদের জন্য হলেও আপনাকে শেষ করতে হবে। জবাবে বলছিলেন বিভিন্ন জায়গায় গল্প-উপন্যাস লেখার কথা। ঠান্ডা গলায় বলেছিলাম, এমন কোন গল্প আপনি লিখবেন না যেটা আর কেউ বছর দশেক পর লিখতে পারবে না, তবে আমাদের ইতিহাস নিয়ে আপনার বিশ্লেষণের দায়িত্বটুকু আর কেউ পালন করতে পারবে না। জুবায়ের ভাই কথা দিয়েছলেন শেষ করবেন। বিনিময়ে আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন, সিরিজশেষে ফোনে প্রকাশ করা মতটুকু আমি পোস্ট আকারে দেবো।
একবার বায়না করার মত করেই জুবায়ের ভাই বলেছিলেন গল্প লেখার কথা। গল্পে গল্পে বললে বোধগুলো অনেক তরল অবস্থায় মানুষের মনের মাঝে ঢুকে যায়। বিশ্লেষণী প্রবন্ধ এই দিকে অনেক কাঠখোট্টা। বলেছিলাম যে আমাকে দিয়ে গল্প হয় না। নাম বানাতে পারি না, প্রথম পুরুষ ছাড়া লিখতে পারি না। জুবায়ের ভাই উপদেশ দিয়েছিলেন কিছু। কথা দিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের উপর একটা গল্প লিখবো। জুবায়ের ভাইয়ের সেটা দেখে দেওয়ার কথা ছিল। হল না।
এইতো সেদিন সচলায়তন নিষিদ্ধ হওয়া নিয়ে লেখার পর ফোন করে সাহস জুগিয়েছিলেন। শহীদ জননীকে নিয়ে লেখা পোস্টের আকার আরো বড় হতে পারতো বলেছিলেন। লেখার আকার দেখে পাঠক ভাগার ভয়ের কথা শুনে নিজের মত লিখে যাবার কথা বলেছিলেন। সেদিনই মাত্র তানভীর ভাইয়ের পোস্টে জুবায়ের ভাই আমার কথা বলেছেন জেনে লজ্জা আর আনন্দে ডুবে গেছি। লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ততায় ডুবেছিলাম কিছুদিনের জন্য। ফিরতাম অচিরেই। অথচ আজকে নাকি জুবায়ের ভাই নেই!
আমার কানে সেই সন্ধ্যা থেকে ভেসে আসছে একটাই কথা, “কী ব্যাপার ইশতি, আমার খবর নাও না যে?”
হুদাই...
আড়াই মিনিট পর্যন্ত পেলাম তিশমার মুখে ৭১টি বাংলা শব্দ, আর ফুয়াদের মুখে ৫০টি। হুম, কি, আচ্ছা, ভাইয়াস-আপুস জাতীয় শব্দগুলো সহ, অবশ্যই।
এই সময়কালে মাত্র ৭টি বাক্য পেলাম যেগুলোয় কোন ইংরেজি শব্দ নেই। এই সাতটির মধ্যে ২টি বাক্য "ভাল।" এবং হ্যাঁ?"।
কারো হাতে যদি আমার চেয়েও বেশি ফালতু সময় থেকে থাকে, তাহলে গুণে দেখতে পারেন পুরোটুকু।
তিশমা ও ফুয়াদের সাক্ষাৎকার
সাক্ষাৎকারে ফুয়াদের মুখে বাণিজ্যিক গান করবার ব্যাপারে ৫ লাখ শ্রোতা থাকার কুযুক্তি শুনে বেকুব বনে গেলাম স্রেফ। বড় অবস্থান ও জনপ্রিয়তা মানুষকে কিছু দায়িত্ব দেয়, যা এ-কালে কেউ স্বীকার করতে চায় না। টাকাই সব, হায়!
ফুয়াদের গান নিয়ে সমালোচনাগুলো নাকি অপপ্রচার। যাঁদের মতামত মান্য, তাঁরা সবাই নাকি তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। অনেক কষ্টেও মনের মধ্যে ফুয়াদের জন্য কোন দিওয়ানা ভাব আনতে না পেরে নতুন দিনের মিছিলে নাম লিখিয়ে তিশমাদর্শনেই নামলাম।
মনের বদ অংশ বলে, মেয়েটার গলার জিনিসটা কি দুষ্টু ছবিতে দেখা কোন কিছুর মত?
আধুনিকতার ভীড়ে পাত্তা না পেয়ে ভেসে যাওয়া আরেকটা অংশ বলে, চোখ-মুখের কালি মুছে চুলটা খোঁপা করে দিলে মেয়েটাকে অন্য রকম লাগতো। সাথে কিছুটা ঢিলেঢালা কাপড় সহ, অবশ্যই!
হুদাই টাইম লস...
Sunday, July 27, 2008
শূন্য আটের দিনগুলিঃ ফর সার্টেইন, ভিকট্রি উইল বি আওয়ারস
গল্পটা সম্ভবত নানার কাছে শুনেছিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের গল্প। ইউরোপ তখন সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার ভয়ে কাঁপছে। বিভিন্ন দেশে গুপ্ত সমাজতন্ত্রী সন্দেহে উইচহান্ট চলছে। এরই মাঝে খবর বেরোলো, ফ্রান্সের অধিপতি চার্লস দ্য গলের ছেলে নাকি তালিকাভুক্ত সমাজতন্ত্রী। এক সাংবাদিক এ-নিয়ে প্রশ্ন করলেন তাঁকে। দ্য গল জবাবে বললেন, আমার ছেলে যদি আঠারো বছর বয়সে সমাজতন্ত্রী না হয়, তাহলে বুঝতে হবে তার কোন সমস্যা আছে। যদি সে চল্লিশ বছর বয়সেও সমাজতন্ত্রী থাকে, তাহলেও বুঝতে হবে তার কোন সমস্যা আছে।
বয়সের সাথে সাথে কিছু মানুষ শক্তিশালী হয়, আর কিছু মানুষ হয় সাবধানী। চেতনার যে-বীজ মানুষের ভেতর শৈশবে উপ্ত হয়, কেউ বয়সের সাথে সাথে তার বাস্তবায়নের জন্য শক্তি সঞ্চয় করেন, বিপর্যয় আর প্রলোভনের ঊর্ধ্বে উঠে নিজের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করে যান। আবার কেউ বয়সের সাথে সাথে কেমন যেন মিইয়ে যান। তাঁরা কখনো সুশীল, কখনো মধ্যপন্থী, কখনো জাতির বিবেক।
দুটোর মাঝে অনেক মিল থাকা সত্ত্বেও স্বপ্ন পানির চেয়ে মূল্যবান। দুটোই বিনামূল্যে পাওয়া যায়, দুটোই মানুষ হেলায় হারায়। তবে পানির পরিশোধনাগার থাকলেও স্বপ্নের পরিশোধনাগার নেই। বাস্তবায়ন করতে হলে স্বপ্নকে বেহায়ার মত আঁকড়ে ধরে থাকতে হয়। বয়সের সাথে অনেক স্বপ্নের পঁচন ধরে, অনেক সদিচ্ছা হারিয়ে যায়। নির্লিপ্ততার জং ধরে যায় স্বপ্নগুলোর মধ্যে। কিছুদিন না যেতেই এককালের স্বপ্নবাজেরা হয়ে যান অক্ষম পরাজয়ের পূজারী। তেমনটা হয়ে যাওয়াই সাফল্য, হতে না পারাটা সমস্যা। অন্যথায় রাষ্ট্রযন্ত্র বিব্রত হবে, এর আপদকালীন শান্তিব্যবসায়ীদের বাজার নষ্ট হবে।
৩.২
আইনের প্রয়োগ আদালতে হলেও এর জন্ম মানুষের মনে। নিজের মনে প্রতিটি মানুষ জানে কোন কাজটি অন্যায় কিংবা কার ভোগবিলাস অন্যায্য। মানুষ দূরদর্শী হলেও ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নয়। সে-কারণেই অন্যায়ের প্রতিবিধান করবার জন্য আইনের সংশোধন হয়। রাষ্ট্র এতে বাধা দেয়, অহেতুক দুর্যোগের ভয়ে কেউ কেউ গালভরা বুলি ছড়িয়ে শান্ত হতে বলেন। ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রয়াস বা ইচ্ছাপ্রকাশকে এঁরা বাহুল্য মানেন। পাপাচারীর সানন্দ উপস্থিতি এঁদের কাছে সহনীয়। দু’চারটে চড়-থাপ্পড় মেরে দেওয়া কিংবা উকিল বাপের উপস্থিতিতে হালকা করে বকে দেওয়াই এঁদের কাছে সহজ সমাধান। এরপর যে বিধির হাতে বিধান ছেড়ে দিয়ে বালিতে মুখ গুঁজে সাহিত্যরস আস্বাদন করা যায়!
মাত্র সাঁইত্রিশ বছর গেল। গোলাম আযম নাগরিকত্ব পেয়েছে, শাহ আজীজ সংসদ ভবন চত্বরে শায়িত হয়েছে, কামারুজ্জামান মন্ত্রী হয়েছে, নিজামী রাজসিক অভ্যর্থনার সাথে কারামুক্ত হয়ে রাজনীতিতে ফিরেছে। রাষ্ট্র এদের ব্যাপারে সবসময়ই নীরব। ঝুঁকি নিয়েও এদের প্রাপ্য বিচারের দাবি তুলেছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। জনতার আদালতে দেওয়া হয়েছিল মৃত্যুদণ্ড, ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল তাদের কুশপুত্তলিকা। বুঝিবা সাহিত্যচর্চায় ব্যাঘাত ঘটার ভয়েই সুশীলেরা জাহানারা ইমামের উপরও ছিলেন বিরক্ত।
আমি মনে করি না শহীদ জননীর সে-প্রয়াস শুধুই স্বামী-সন্তান হারানোর বেদনা থেকে ছিল। যে-মা হাসিমুখে সন্তানকে যুদ্ধে পাঠাতে পারেন, তিনি স্রেফ আবেগের বশবর্তী হয়ে সংগ্রামের ডাক দিতে পারেন না। তাঁর কাছে স্বাধীন বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় ছিল, মুক্তি সবচেয়ে বড় আরাধ্য ছিল। কোন দুর্যোগের ভয় তাঁকে বিরত করেনি তাই। সুবিধাবাদীদের দাপট সত্ত্বেও তিনি লড়ে গেছেন একা। স্বপ্নের সাথে আপোষ না করা এই মহীয়সী শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বলে গেছেন যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির কথা।
দ্য গলের সেই গল্প মনে পড়ে। সাথে কাকতালীয় ভাবেই ’০৮-এ মনে পড়ে শহীদ জননীর শেষ চিঠির একেবারে শেষ কথাগুলো। ফর সার্টেইন, ভিকট্রি উইল বি আওয়ারস।
Saturday, July 19, 2008
শূ্ন্য আটের দিনগুলিঃ ভাগ্যিস ’৭১ এ জন্মাইনি
সবাই শুধু নারীজীবনের দুর্দশার কথা বলে। অসাম্য, অবরোধবাস, অবিশ্বাস, আবেগপ্রবণতা, অযোগ্যতা, ইত্যাদির অনেক অভিযোগের কাঁটা বিছানো পথ পাড়ি দিতে হয় মেয়েদের। নারী হয়ে সফল হওয়া তাই খুবই দুরস্ত, দুষ্কর। অনেক কষ্ট, অনেক বৈষম্য, অনেক দুর্বলতা, অনেক খোটা। সমাজ ও সাহিত্যে এই সত্য আজ মোটামুটি সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে পূর্ণতার প্রশ্ন এলে জবাব খুব সহজ একজন নারীর জন্য -- মাতৃত্ব। এটি আত্মোৎসর্গকারী এমন এক নিম্নগামী আবেগ যার ঐশ্বরিকতাকে চেষ্টা করেও ধরাধামে নামানো যায় না।
পুরুষজন্ম সে-তুলনায় অনেক আরামের। প্রত্যাশার আঁতশকাচের নিচে বড় হতে হতে পুরুষমাত্রেই উচ্চাভিলাষী হয়ে যায় একটা সময়। আবেগজনিত কিছু নিয়ে তাদের চিন্তা করতে হয় না। ছকে বাঁধা জীবনে, ছাঁচে মাপা সাফল্য। কিন্তু পুরুষের পূর্ণতার একটি বিশেষ নির্ণায়ক আছে। একটি ছেলের জীবনের পরম আরাধ্য একটাই –- বাবার চোখে একজন যোগ্য মানুষ হওয়া। বাবার মুখে সামান্যতম প্রশংসাও তাই যে-কোন ছেলের কাছে অনেক, অনেক বড়।
আমার বাবা খুব খুঁতখুঁতে মানুষ। তার ছেলে হওয়াটা মহা ঝক্কির ব্যাপার ছিল। একটু এদিক-ওদিক হলেই শুনতে হত, আমার ছেলেদের এমন করবার কথা না। বলা হত একশ’ জনের চেয়ে আলাদা হবার কথা। অংকে ৯৮ পেলে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করা হত বাকি ২ নম্বর কোথাও গেল। বাবার আদরে-শাসনে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর একটি উক্তি খুব মনে পড়ে যায় –- দশের মধ্যে একজন হয়ো না, দশে এগারো হও।
বয়স তখন আমার বাও-তেও। কোন এক জাতীয় দিবসে একাত্তরের গণহত্যার চিত্র দেখাচ্ছে। কী বলছি, তা বুঝে ওঠার আগেই মুখ দিয়ে একটা কথা বেরিয়ে গেল -- ভাগ্যিস ’৭১-এ জন্মাইনি! অল্প বয়সে মারা যেতাম তাহলে!
সামান্যতম ত্রুটিও ধরে দেওয়া বাবা আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল নিঃশব্দে।
২.২
আলী আমান আজকে একজন রং মিস্ত্রি। সহায়-সম্বল নেই, ছেলের সংসারে থাকেন, দিনমজুরি করে পেট চালান। তিনি নিবন্ধিত জামাতীদের একটি প্রহসনমূলক অনষ্ঠানে একা গিয়ে হাজির হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছেন। রাজাকারের ফাঁসি চেয়েছেন। গগনবিদারী জয় বাংলা ধ্বনির কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। শাস্তিস্বরূপ তাঁকে প্রকাশ্যে লাথি খেতে হয়েছে। অন্ধকার ঘরে বন্দী থাকতে হয়েছে তিন ঘন্টার ওপর।
কোন জরুরী অবস্থা ভঙ্গ হয়নি তাঁর এই লাঞ্ছনায়। কোন সেক্টর কমান্ডার তাঁর সমর্থনে আসেননি। কোন সুশীল এগিয়ে এসে আলী আমানের লাঞ্ছনাকারীদের নারায়ে-তাকবীর ধ্বনির প্রতিবাদ করেননি। তবু আলী আমান পত্রিকা অফিসে এসেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে গেছেন।
একজন আলী আমান যতটা পুরুষ, আমরা সবাই ততটাই নপুংসক। প্রান্তিক মানুষ আলী আমানের এই সাহস সুবিধাভোগী এই আমাদের ভয় পাওয়ার অধিকার দেয় না।
শূ্ন্য আটের দিনগুলিঃ বুড়া মাইনষের মত কাশোস ক্যান?
দুষ্ট ছিলাম আজীবন, নষ্ট ছিলাম না। মৌলিক কিছু বিধিনিষেধ আর মূল্যবোধ মাথার ভেতর খুব পোক্তভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছিল বাবা-মা। তার উপর পড়াশুনা করেছি ক্যাথলিক স্কুলে। আমার দৌঁড় তাই উলটাপালটা দৌঁড়নো আর পিড়পিড় করে কথা বলা পর্যন্ত।
নষ্ট ছেলেপুলেদের দেখতাম মহা আনন্দে দিন কাটাচ্ছে। এরা স্যারদের পুচ্ছদেশে চকের গুঁড়ো মারতো, সহপাঠীদের বোন'দের দিকে কুনজর দিতো, ক্লাসে নোংরা বইপত্র নিয়ে আসতো। শাস্তির ভয় এদের কখনোই ছিল না। আমরা ডিটেনশনের নাম শুনেই আতঙ্কে কাঁপতাম, ওরা বেতের বাড়ি খেয়েও হিহি করে হাসতো আর নিজের মত বদমায়েশি করে যেত।
ওরা সংখ্যায় কম ছিল, বড়লোকের পোলাপান ছিল, শিক্ষক-ছাত্র নির্বিশেষে সবাই ওদের হাতে ছিল। খেলতে না পারলেও ওরাই বিভিন্ন টুর্নেমেন্ট আয়োজন করে টিম ক্যাপ্টেন হত। বাকিরা ছিল অচ্ছুৎ, খ্যাত। ওরা আমাদের সাথী ছিল না, কিন্তু কীভাবে যেন প্রতিনিধি হয়ে যেত খুঁটির জোরে। যাক যে কথা।
জানি নে কেন জানি মনে পড়ে গেল। একেবারেই কাকতাল, বিশ্বাস করুন।
১.২
ঠোঁট না নাড়িয়ে কথা বলা ছিল আমার প্রিয় দুষ্টামি গুলোর একটি। একবার ক্লাসে স্যার অংক করতে দিয়ে পায়চারি করছেন। পুরো ক্লাস জুড়ে পড়ানোর বদলে একটু আরামে সময়টা পার করে দেওয়া আর কি। অংক মিলে যাবার পর আমি মনে সুখে আড্ডা মারছি। আশপাশ দিয়ে গেলে গুমগুম আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষক মহাশয় ক্রমাগত আমার পাশ দিয়ে হেঁটে চলছেন। আমিও কথা বলছি, তিনিও বুঝতে পারছেন যে আমি-ই কথা বলছি। তবে ধরতে পারছেন না হাতে-নাতে।
হঠাৎ কাশি এল খুব। নেহায়েত নির্বিষ একটা কাশি দিলাম খুকখুক করে। তৎক্ষণাৎ ধুম করে এক কিল পড়লো পিঠে।
“এই ব্যাটা, বুড়া মাইনষের মত কাশোস ক্যান?”
এটাও কেন জানি মনে পড়ে গেল। কালতাল মাত্র, বিশ্বাস করুন।
Wednesday, July 16, 2008
রাজাকারের লাথিতে মাকড়সার গৃহধ্বংস
আমাদের পরিচিত জীবনধারাটি খুব বেশি যৌগিক। জীবন গঠনের মৌলিক উপাদানগুলোর সাথে আমাদের যোগাযোগ নেই অনেক দিন হয়। একটা সময় মানুষ জীবন নিয়ে খুব গভীর ভাবে ভাবতো। একেকটি নতুন অনুভবের সাথে ঝংকার তুলতে নিত্য-নতুন শব্দের জন্ম নিত। আজকাল কেউ আর এসব ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। জীবন অনেক দ্রুত এবং জটিল হয়ে গেছে, এমনটাই দাবি করি আমরা। ফলাফল অপ্রত্যাশিত নয়।
আগে মনের অবস্থা স্বাভাবিকের থেকে ভিন্ন হলে তাকে অনেক রকম নাম দিতাম। উদাস, উৎফুল্ল, প্রশান্ত, আশ্বস্ত, বিরহী, ব্যথিত, আড়ষ্ট, আতঙ্কিত, অভিমানী। এখন শুধুই ‘কেমন-কেমন’ লাগে। আগে গৃহের বাঁধন ছিড়ে বের হলে গন্তব্য হত নিরুদ্দেশ, অসীম, তেপান্তর, দিগন্ত, মহাকাল, সিদ্ধিলাভ। এখন শুধুই ‘এইতো সামনে’। আগে কিছু খাওয়ার জন্য মন উচাটন হলে সবকিছুর কথা আলাদা করে বলতাম। তেল, ঝোল, নুন, মশলা, মরিচ, রঙ, সুবাস, উত্তাপ। এখন খাবারটুকু ‘ইয়াম্মি’ হলেই খুশি। আগে পাশের মানুষটিকে বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন ভাবে দেখতাম। বন্ধু, সাথী, জীবনসঙ্গী, উপদেষ্টা, ভরসাস্থল, আত্মীয়, আপন, অচিন, আরাধ্য। এখন দু’টি করে হাত ও পা থাকলেই খুশি।
পাহাড়ে বসত করলে যৌগিক জীবনের মৌলিক উপাদানগুলো খুব বেশি বিশ্লিষ্ট হয়ে চোখে পড়ে। এখানে আবহাওয়া মানে শুধু ‘আহ্’ বা ‘ধ্যাত্’ নয়। একেকটি ঋতুর মাঝে বিভেদ খুব স্পষ্ট। একই ভাবে কোন সঙ্গীর সাথে পাহাড়ে দিনাতিপাত করলে কিছুদিন পরই জীবনে তার অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায়। ইন্দ্রিয়গুলোও স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে পাহাড়ি জীবনে। কখনো বুক ভরে শ্বাস নিলেই শরতের প্রাণ টের পাওয়া যায়। কখনো ভেজা বাতাসের স্পর্শ বলে দেয় বৃষ্টি এল বলে। কখনো হিমশীতল বাতাসের শনশন শব্দ শীতের উপস্থিতি জানান দেয়। কখনো ফুলেল গন্ধ বসন্তের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
পাহাড়ি জীবন সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করার জন্য রইলো বাকি দুই। একটি পঞ্চেন্দ্রিয়ের শেষটি, দৃষ্টি। অন্যটি বাবা আদমের আমল থেকে রক্তে বয়ে চলা আদিম রোগ, দৈনন্দিন সঙ্গীর অভাববোধ। আমার জানালাটা দৃষ্টিসুখের প্রয়োজন মেটায় খুব ভাল ভাবে। কম্পিউটারে কাজ করতে করতে পেছনে প্রকৃতির খেলা দেখা অনেক দিনের অভ্যাস হয়ে গেছে। একটা সময় অবিরাম তুষারপাত দেখতাম, এখন অঝোর বর্ষন দেখি। সকাল হলে এই জানালা দিয়েই সূর্য উঁকি দিয়ে ঘুম ভাঙায়। বছরের বিভিন্ন সময়ে এই জানালা দিয়েই পাহাড়ের রঙ-বদল দেখি। একাকী সেই দিনগুলোয় সাথে থাকতো আমার একমাত্র সঙ্গী, ছোট্ট একটা মাকড়সা।
জানালার এক কোণায় ছিল এই মাকড়সাটার বসবাস। কেউ কাউকে জ্বালাতাম না। কোন চিন্তায় আটকে গেলে ওর দিকেই তাকিয়ে বিড়বিড় করতাম আপন মনে। অজান্তেই একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। অনেক অলস দুপুর কেটেছে স্রেফ মাকড়সার লাফালাফি দেখে। আমিও ওকে ঘাটাতাম না, ও-ও জাল বুনে বিরক্তির কারণ হত না। অসম ও অস্বাভাবিক বিধায় বন্ধুত্ব ছিল না, কিন্তু শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। গতকাল মেজাজ খারাপ করে আমার একমাত্র সঙ্গীকে ফেলে দিয়ে এসেছি। অভ্যাসবশত, চোখ আজো ঘরে ঢুকেই কাউকে খোঁজে, বাসার অন্যতম প্রাণিটির অভাবে বিষণ্ণতা আরো বেশি গ্রাস করে।
মেজাজটা খারাপ হয়েছিল রাজাকারের হাতে মুক্তিযোদ্ধার লাঞ্ছনা দেখে। অক্ষম আমি সেই ক্রোধ ঝাড়লাম অবল এক মাকড়সার ওপর। আমার ঘর, আমার খাবার, আমার জানালা। কোনদিন তো আমার মত হবি না, আমার বন্ধু হবি না। তবে অযথা আমার জায়গায় ভাগ বসাচ্ছিস কেন? নিজের মত জায়গা খুঁজে নে, নয়তো দূরে গিয়ে মর। এই ভেবে কাগজবন্দী করে হতচ্ছাড়া মাকড়সাটা ফেলে দিলাম গতকাল। রাগ নেমে যাবার পর থেকেই মন বেশ খারাপ। কারো উপকারে আসতে না পারি, অন্তত কারো ক্ষতি করছিলাম না। হোক না সে ছোট্ট এক মাকড়সা।
আজকে সকাল থেকে বারবার চোখ যাচ্ছে জানালার কোণার দিকে। আমার চোখ শুধু পাহাড় নয়, মাকড়সাও দেখতো। শূন্যতা থেকে সেটাই বুঝতে পারছি। ক্রোধ আর নিঃসঙ্গতা মেশানো অস্বস্তিকর একটা অনুভূতিতে ডুবি-ভাসি করে কেটে গেল পুরো দিন। ভেবে মনে হল, স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের কাছে আমাদের ক্রমাগত পরাজয়ের পেছনে জীবনের যৌগিকতার কাছে পরাজয় একটি বড় কারণ।
যে-কোন কারণেই হোক, আমরা মূল্যবোধগুলোকে আর আলাদা করে চিহ্নিত করি না। স্বাধীনতা, বীরত্ব, দেশপ্রেম, সততা, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, কিংবা অধিকারবোধের চেয়ে ‘হবে একটা কিছু’ই বড় এখন। স্বাধীনতাবিরোধিতা তাই আমাদের রাগায় না, দেশদ্রোহিতা করে না উচ্চকণ্ঠ। ইতিহাসবিকৃতির কথা উঠলে আমরা সত্যভাষণের চেয়ে রাজনৈতিক দলাদলি করি বেশি, রাজাকারের আস্ফালন দেখে দায়িত্বহীনতার অভিযোগের আয়নাগুলো নিজের বদলে অন্যের মুখের সামনে ধরি।
খুব প্রত্যাশিত ফল হিসেবেই আত্মশুদ্ধি বা আত্মোপলব্ধির বদলে আমরা নিষ্ফল আক্রোশ প্রকাশ করি ভাঙচুর বা গালাগালির মাধ্যমে। আড়ালে ওরা আরো সংগঠিত হয়, আরো বেশি লজ্জা দেবার জন্য। রাজাকারের লাথিতে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজকে নিজের দায়িত্ব বলে জ্ঞান করে না, সুশীল সমাজ ঠুনকো বিভেদের উর্ধ্বে ওঠে না, হাইকোর্টে কমান্ডার নিজামির জামিন নামঞ্জুর হয় না, রাজনীতির নামে দুর্জনদের সাথে আঁতাতের জন্য বড় দলগুলো ক্ষমা চায় না, ধৃষ্টতার প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামি’র অফিসে একটা ঢিল পড়ে না, বিচারপতি জে আর মোদাচ্ছিরের বাসার দেওয়ালে কেউ রক্তাক্ষরে ‘ছিহ্’ লেখে না, মুক্তিযোদ্ধা যাদুঘরে একটা পয়সা অনুদান পড়ে না। অযথা নির্বিষ, নির্বান্ধব একটা মাকড়সার গৃহধ্বংস হয় দশ হাজার মাইল দূরে।
Thursday, July 03, 2008
নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্রঃ ৬
জাতিগতভাবে আমাদের বড় সীমাবদ্ধতাগুলোর একটা হল উদ্ভাবনী শক্তির অভাব। অন্যের অনুকরণেই শুধুমাত্র আমাদের সুকুমারবৃত্তিগুলো জেগে ওঠে। বিজ্ঞান থেকে সঙ্গীত পর্যন্ত সর্বত্রই এক অবস্থা। উদ্ভাবনের উপহার সবার মধ্যে থাকে না। এতে দোষেরও কিছু নেই। তবে যে-বিষয়টি ঐকান্তিক ভাবে প্রয়োজন, তা হল শূন্যতা সম্পর্কে সচেতনতা। উদ্ভাবকেরা শূন্যতাকে পূরণ করার উপায় বের করেন, আর শূন্যতা সম্পর্কে সচেতন মানুষেরা সেই উদ্ভাবনকে ছড়িয়ে দেন সর্বত্র। নেতৃত্বের ব্যাপারটাও অনেকটা সেরকম। বড় নেতা খুব কম মানুষই হতে পারেন। অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বহুযুগে একজন গান্ধী বা বঙ্গবন্ধু আসেন, তবে তাঁদের সাফল্য নির্ভর করে প্রজন্মের উপর। প্রস্তুত ও উপযুক্ত প্রজন্ম ছাড়া কোন নেতাই সফল হতে পারেননি। ইতিহাসের মহানায়ক বিরল ও দৈব হলেও ইতিহাসের সাক্ষী ও বাস্তবায়নকারীরা সাধারণ মানুষ। শূন্যতা নিয়ে সচেতন না হলে কোন জাতি প্রস্তুত হতে পারে না তার মহানেতার জন্য।
অনুকরণপ্রিয়তা থেকেই আমরা ভাবতে ভালবাসি যে গণতন্ত্র আমাদের শূন্যতাগুলো পূরণের জন্য শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা। এই ভাবনাটি ভুল, এমন কোন তত্ত্বের অবতারণা করছি না। তবে প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক, আমাদের গণতন্ত্রমুখীতার কতটুকু সচেতন। আমরা জানি যে আমাদের অঞ্চলে একনায়কতান্ত্রিক যেকোন শাসনব্যবস্থাই স্বৈরাচারী দৌরাত্ম্যের রূপ নিয়ে ফেলে। নোংরা সাম্রাজ্যবাদ বলতে যা বোঝায়, তা পশ্চিমেও ছিল। তবে রাজায় রাজায় যুদ্ধের যুগ পেরিয়ে এখন অনেক সভ্য ও শালীন ভাবে রাজনীতি পরিচালিত হয় পশ্চিমে। বিভিন্ন রকম ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও পাশ্চাত্য সমাজ অনেক সহনীয়, তাদের বেলায় এককেন্দ্রীক শাসনব্যবস্থা কার্যকর। অন্তত এমনটাই আমাদের ধারণা, আর এমনটাই পাশ্চাত্য প্রচার করে থাকে।
প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের তফাৎগুলোর জন্য রাজনীতি যতটা, তার চেয়ে পারিবারিক ব্যবস্থা হয়তো কিছুটা বেশি দায়ী। এক প্রজন্ম আগ পর্যন্ত সনাতন বাঙালি পরিবারে বাবার বয়স মায়ের বয়সের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। বন্ধু বা জীবনসঙ্গী হওয়ার আনন্দের চেয়ে অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নিয়ে পুরুষদের ভাবতে হয়েছে বেশি। বাঙালি পরিবারে স্বামী বা পিতা বা বড় সন্তানের অবস্থান তাই যতটা আহ্লাদের, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্বের। পরিবারের কর্তার জীবন কাটে হরেক রকম হিসেব-নিকেশে। ফলাফলস্বরূপ আমার মতই অনেকে বেশি বয়সে এসে বাবার চরিত্রের নরম দিকটির সাথে পরিচিত হন। তার আগ পর্যন্ত বাবা মানেই বিভীষিকা, বাবা মানেই বাঘের মত ভয় পাওয়া।
এতকিছুর পরও ছেলেবেলায় প্রিয় ব্যাক্তিত্বকে নিয়ে রচনা লিখলেই সবাই বাবা, নয়তো নবীজী (স) এর নাম লিখতাম। আমার বাবা অত্যন্ত সজ্জন মানুষ, তিনি মিঠে-কড়া শাসনে আমাদের লালন-পালন করেন, সকাল হলে বাবার আযানে ঘুম ভাঙে, সন্ধ্যা হলে বাবার সাথে মাগরিবের নামায পড়ি, রাতে বাবা আমাদের দুই ভাইবোনকে অত্যন্ত যত্নের সাথে লেখাপড়া করান, রাতের খাবারের পর বাবার তেলাওয়াত শুনতে শুনতে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি, ইত্যাদি কথা আমরা প্রত্যেকেই লিখেছি জীবনে কখনো না কখনো। বাবা নামক অনুপ্রেরণাদায়ী মহীরূহগুলো না থাকলে কি এই চোথামারা রচনাগুলো থাকতো না? খুব থাকতো। দেশ-বিদেশের শিক্ষা আর অগণন বর্ষা-বসন্ত পেরিয়ে এসে আজও প্রিয় ব্যাক্তিত্বকে নিয়ে রচনা লিখলে আমি আমার বাবার কথাই বলবো। শুধু আমি নই, প্রায় সবাইই লিখবেন। এই অনুপ্রেরণার ভূমিকা আমাদের সমাজে ব্যাপক। কঠোর, কর্কষ বাবাগুলো প্রাচ্যের পরিবারে যতটা একনায়ক, তার চেয়ে অনেক বেশি নায়ক।
প্রাচ্যের তুলনায় এই দিকে পাশ্চাত্য একেবারেই আলাদা। এখানে আদৌ এই ধরণের মধ্যযুগীয় বিষয়বস্তু দেওয়া হয় না। বাড়তি কিছু নম্বর পাওয়ার আশায় সেখানে ধর্মের চর্বিতে চুবিয়ে চুবিয়ে রচনা লিখতে হয় না। তবে প্রিয় ব্যাক্তিত্ব নিয়ে রচনা লিখতে দেওয়া হলে অনেক রকম প্রিয় ব্যাক্তিত্ব পাওয়া যাবে। হেমিংওয়ে থেকে জিম মরিসন পর্যন্ত অনেক রকম নাম ঘুরে-ফিরে আসবে। এখানে মানুষ নিজের ইচ্ছা আর স্বপ্নগুলোর সাথে মিলিয়ে ব্যাক্তিত্ব পছন্দ করে। আমি যে-পথে যেতে চাই, সে-পথের অগ্রণীই তো হবেন আমার আদর্শ। যারা ঝরে যাওয়ার চেয়ে মরে যেতে পছন্দ করে, তারা কার্ট কোবেইনকে প্রিয় ব্যাক্তিত্ব মানে। যারা বিশ্বশান্তির জন্য কাতর, তারা জন লেননকে স্মরণ করে। নারীবাদীরা আপাদমস্তক শ্রদ্ধাবনত হয়ে ওপরাহ্’কে মানে। প্রথাবিরোধী আর মুক্তিকামী মাত্রই চে গেভারা’র পোস্টারের দিকে তাকিয়ে নির্ঘুম রাত কাটায়। খোঁজ নিলে এরকম অজস্র পছন্দ পাওয়া যাবে পশ্চিমে।
এই স্বাধীন পছন্দগুলো পশ্চিমের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গণতান্ত্রিকতাকে ইঙ্গিত করে। ডিস্ট্রিবিউটেড ডেমোক্রেসির পশ্চিমে বিনয় জীবনের অংশ হিসেবেই আসে, আর অথরিটি আসে শাসনের পথ হিসেবে। পশ্চিমা সমাজে পরিবার অনেক বেশি গণতান্ত্রিক। স্ত্রী-পুরুষ-পুত্র-কন্যা-চাচা-মামা-বন্ধু নির্বিশেষে সবার মতামতের ভূমিকা আছে পরিবারে। হুকুম দেওয়া হয় অনুরোধের সুরে। আমার মনে হয় তোমার এই কাজটা করা উচিত, তুমি বোধহয় এটা করতে পারলে খুশি হবে, আমি হলে মনে হয় এভাবে করতাম কাজটা। এভাবেই কর্তৃত্বের বদলে অনুপ্রেরণা আর যুক্তি দিয়ে চালিত হয় জীবন।
প্রাচ্যের অবস্থা উলটো। একারণে এখানে এমন ব্যবস্থা দরকার, যা পূর্বের সামাজিক রীতিকে প্রতিফলিত করে। আমরা দু’টাকা বেশি জুটলেই ভাবি আত্মীয়-পরিজনের কথা। নিজের লোক ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করি না, মাইক ও ক্ষমতা পেলে ছাড়তে চাই না। নিজগৃহের দায়িত্ব ও কর্তৃত্বপরায়নতার রেশ চলে আসে আমাদের রাজনৈতিক জীবনেও। দেশটা পশ্চাৎপদ, আমাদের অনেক কাজ বাকি, সময় কম, মানুষের মাঝে শৃঙ্খলাবোধেরও অভাব ভীষণ। এরকম অবস্থায় কিছু মাত্রায় হলেও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা একটি প্রয়োজনীয় বাস্তবতা। সীমিত মাত্রায় এধরনের এককেন্দ্রিকতার প্রচলন করতে আমরা খুচরো নির্বাচনগুলোয় শুধু মূল নেতাকে নির্বাচিত করতে পারি। অতঃপর তাঁকে নিজের পছন্দমত লোক নিয়োগ করার অধিকার দেওয়া যায়।
বর্তমান ব্যবস্থায় সরকারী আমলারা একই জায়গায় থাকেন, শুধু তাঁদের মাথার উপর মনিব বদল হয়। এই ধারাটির পরিবর্তন করে প্রত্যেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে তাঁর পছন্দের লোকজনকে নিয়ে কাজ করার অধিকার দেওয়া উচিত। এতে করে মেয়াদশেষে তাঁর কাছে জবাবদিহিতা চাওয়াও অনেক সহজ ও স্বচ্ছ হবে। আগের আমলের রেখে যাওয়া আমলাতন্ত্রের কারণে কাজ গতিশীলতা পায়নি, এমনটা কেউ দাবি করতে পারবেন না তখন।
নেতার জন্যও এধরনের ব্যবস্থা উপকারী হওয়া উচিত। যোগ্য মানুষের সাহচর্য না পেলে যোগ্যতার অবস্থানে যাওয়া দুষ্কর। পথে-প্রবাসে অনেকের সাথেই আমাদের চেনা-পরিচয় হয় যাঁরা দেশ পরিচালনার কাজে সাহায্য করতে পারেন। তাঁদের ফেলে আমলাতন্ত্র বা দলীয় প্যানেল থেকে বেঁধে দেওয়া কাউকে নিয়ে প্রশাসনিক কাজ সমাধা করার পদ্ধতিটি আমাদের অহেতুক বিবাদ ছাড়া কিছু দিচ্ছে না। পারিবারিকতা আর স্বেচ্ছাচারে সম্মিলিত কুফল এমনিতেও থাকবে। আত্মীয়পরায়নতা কোন না কোন মাত্রায় বিদ্যমান থাকবেই আমাদের সমাজে। আমরা জোর করে এগুলো এড়াতে চাই, চাই জোর করে হলেও ঐক্য চাপিয়ে দিতে। বাস্তব হল, যেকোন কিছুই নিয়মে নিষিদ্ধ থাকলে তা নিয়ে ঝামেলা হয় বেশি। অনুশাসনের বাড়াবাড়ি ও তার কুফলগুলো আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়। নির্বাচিত হবার পর তাই সীমিত, নিয়ন্ত্রিত স্বেচ্ছাচারের অধিকার দেওয়া যায় রাজনীতিকদের।
নিজের মানুষ বা কাছের মানুষদের নিয়ে কাজ করবার অধিকারটুকু পেলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা লেগেসি নিয়েও চিন্তিত হবেন, যেমনটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যায় প্রশাসনিক বিভাগকে নিয়ে। নির্বাচনের পর রাষ্ট্রপতি নিজের দল ও মতের লোকেদের নিয়ে প্রশাসন সাজান। চাইলে পুরনো কর্মকর্তাদেরও রাখেন। এসব খুঁটিনাটি নিয়ে কেউ ঘাটায় না। শাসনকালের মেয়াদ শেষ হলে রাষ্ট্রপতিরা নিজের নামে লাইব্রেরি বা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন, লেখালেখি করেন, নয়তো বিশ্বময় ঘুরে বেড়ান শান্তির খোঁজে। ক্ষমতার পাশাপাশি দায়-দায়িত্বও ব্যক্তির ঘাড়ে দেখে এককেন্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দেরিতে হলেও লেগেসি নিয়ে চিন্তা দেখা যায়। একক ক্ষমতার মাদকতা থেকে কেউ সহসা বের হয়ে আসতে পারেন না। স্বল্পমেয়াদে তো নয়ই। তবু পৃথিবীর সব একনায়কই নিজের ভাবমূর্তি সম্পর্কে সচেতন। সিজার থেকে এরশাদ পর্যন্ত কেউ এর ব্যতিক্রম নন। যেখানে শাসনব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে হয়, সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই এই চেতনার উন্মেষ একটু দেরিতে হয়।
পশ্চিমের সমাজে বিভিন্ন রকম শাসনব্যবস্থায় এই রকম একনায়কতন্ত্র ছড়িয়ে আছে, যা সমাজের তৃণমূলের গণতান্ত্রিকতার সাথে এক ধরণের প্রয়োজনীয় বৈপরিত্য সৃষ্টি করে। যেখানে সমাজ গণতান্ত্রিক, সেখানে শাসনব্যবস্থা একনায়কতান্ত্রিক। প্রাচ্যে পরিবার কাঠামো থেকে মজ্জায় ঢুকে যাওয়া এক ধরণের প্রশাসনস্পৃহা আমাদের বিরত রাখে রাজনীতি কিংবা আইন প্রণয়ন থেকে। সেকারণে আমাদের দেশে সংসদের নিম্নকক্ষ কিংবা স্থানীয় সরকারে বিশ্লিষ্ট ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায় নিয়মতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র, দেওয়া যায় পরিমিত স্বেচ্ছাচারের সাময়িক অধিকার। রাজনীতি আর প্রশাসনের মাঝের খিচুড়ি সম্পর্কটি এভাবে পৃথক সম্ভব।
মোটা দাগে বিবেচনা করলে পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা শাসনব্যবস্থাগুলো সংসদীয়, নয়তো রাষ্ট্রপতিশাসিত। এই দুই শাসনব্যবস্থার মূল পার্থক্য লেজিসলেটিভ বনাম ইন্সপিরেশনাল। একটিতে অনেক সময় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে শুদ্ধ ও সঠিক আইন প্রণীত হয়। অন্যটিতে নেতার আদর্শে জাতি স্বপ্ন দেখে। সম্প্রতি হিলারি ক্লিনটন ও বারাক ওবামার মধ্যকার প্রাইমারি নির্বাচন এই বিষয়টি চোখের সামনে নিয়ে এসেছে দারুণভাবে। হিলারি ও ওবামার মধ্যে সবচেয়ে গভীর পার্থক্য ছিল চিন্তা ও কার্যধারায়। দু’জনেই অল্প সময় ধরে সিনেটর থাকলেও একজন বিভিন্ন রকম নেগোশিয়েশনে পারদর্শী, আরেকজন ইন্সপিরেশনে। একজন জনসভায় খুঁটিনাটি হিসেব করে করে বোঝাতেন কী করবেন এবং কেন, অন্যজন লোমহর্ষক বক্তৃতায় হাজার হাজার মানুষকে উজ্জীবিত করতেন আত্মোন্নতিতে নিয়োজিত হতে।
আমাদের শাসনব্যবস্থার তৃণমূল পর্যায়ে বাবার মতই একনায়ক আমরা। এই পর্যায়টায় সবাই প্রশাসনমনস্ক। পক্ষান্তরে উপরতলায় নিজ নিজ পরিবার ও পরিপার্শ্বের দেওয়া শিক্ষা নিয়ে দর কষাকষি করে আমরা সম্মিলিত সামাজিক মূল্যবোধের জন্ম দেই। আমাদের দেশটার জনসংখ্যা অনেক বেশি দেখেই আমাদের সমাজে অনুপ্রেরণার ভূমিকা প্রবল, ঠিক যেমন আমাদের পরিবারগুলো বড় দেখেই সেখানে বাবাতন্ত্রের প্রচলন বেশি। আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থার একক অংশগুলোকেও এভাবেই গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন শুধু কিছু নিঃসংশয়, নিঃসংকোচ মানুষের।
যদি বলেন বাঙালি সংশোধনের অযোগ্য একটি স্বার্থপর জাতি, তবে বলবো অন্ধকারের পরই প্রখরতম সূর্য আসে। যদি বিশ্বাস করেন যে বাঙালির স্পৃহা ও সম্ভাবনা অমিত, তবে হাল না ছেড়ে কণ্ঠ ছাড়ুন জোরে। হয়তো রাজনীতির পথে-প্রান্তরে আমার মতই আপনারাও স্রেফ নিজের মতে অত্যন্ত সরব থাকবেন। তবু আমারই মত বেহায়া স্বপ্নবাজি করে দিন কাটাবেন আপনারাও। বিবাদ হবে, ঝামেলা আসবে, ঝগড়া বাঁধবে, লাশ পড়বে। তবু বেহায়া বাঙালির বেহায়া স্বপ্ন থেমে থাকবে না। হতাশাবাদীরা যা-বলে বলুক না কেন, এখানেই আমাদের নিজস্বতা। স্বাধীনতা আর সমঝোতার এই মিশেলই আমাদের নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্র।