২. খরবায়ু বয় বেগে
বাংলায় কিশোর সাহিত্য বেশ অবহেলিত। সবাই শুধু বড়দের জন্য লিখতে চায়, বড়দের কথা লিখতে চায়। বড়দের লেখার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। বয়সের সাথে সাথে অনুভূতিগুলো গাঢ় হয়, মানুষ অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়। সেই চিন্তাগুলো সাহিত্যে স্থান পেলে সাহিত্যই মহিমান্বিত হয়। পরিণত সাহিত্য তাই খুবই জরুরী। তবে তাই বলে যে কিশোর সাহিত্যকে অবহেলা করতে হবে, এমন তো কথা নেই।
সাহিত্যের কাজ মূলত দু’টি – অভ্যস্ত জীবনের বাস্তবতাগুলো তুলে ধরা, নয়তো কল্পণার কোন জীবনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। অধিকাংশ সাহিত্যিকই কল্পণার রাজ্য নিয়ে লেখেন। দুই বাংলা মিলিয়ে যেই উপন্যাসগুলো সবচেয়ে বেশি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, তার সবগুলোই লেখকের নিজের জীবন নিয়ে, অথবা নিজের জীবন থেকে লেখা। বড়দের লেখায় এটি আর দেখা যায় না। সবাই কল্পিত ঘটনা নিয়ে লেখেন। একলা ঘরে একটি নারী কার কথা ভাবে, নিঃসঙ্গ পুরুষ কীভাবে পরনারীতে স্বস্তি খোঁজে, ইত্যাদি বালছাল লেখায় ভরা চারদিক। এই সব প্যানপ্যানে ঘটনার চেয়ে প্রথম কৈশোরের কুকর্মগুলো অনেক উপাদেয় ছিল। স্কুল পালানো, পড়শি মেয়ের দিকে চোখ মারা, রগরগে নীল ছবি দেখা, নিষিদ্ধ বিনোদন, ইত্যাদি নিয়ে অকপটে লিখলে লেখকের সুশীলতা অক্ষুণ্ন থাকে না। কিশোর সাহিত্য অবহেলিত হওয়ার পেছনে হয়তো এটা অন্যতম কারণ।
খোলামেলা লেখার দায়ে ‘সেবা’ প্রকাশনীর বই পড়তে হলে মায়ের কাছ থেকে অনেক ভাবে লুকাতে হত। প্রকাশ্যে পড়ার মত বলতে ছিল সত্যজিৎ রায় আর শাহরিয়ার কবিরের লেখা বই। স্কাউটিং, প্রবাস ভ্রমণ, উঠতি বয়সের কুসুম কুসুম প্রেম, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, ইত্যাদি নিয়ে জানতে পারতাম শাহরিয়ার কবিরের বই খুললে। এভাবে কেটেছে আমার প্রথম কৈশোর। সে-সময়ের খুব প্রিয় বইগুলোর একটি ছিল ‘নিকোলাস রোজারিওর ছেলেরা’।
নিজে মিশনারি স্কুলে পড়েছি, তাই বাড়তি আকর্ষণ ছিল বইটির প্রতি। মন যেন হারিয়ে গিয়েছিল সমবয়সী একদল কিশোরের মাঝে। কেউ বাড়ি থেকে অনুমতি পাচ্ছে না, কেউ চাঁদার টাকা জোগাড় করতে পারছে না, কেউ অন্যের ছায়া থেকে বের হয়ে আসতে ছটফট করছে। বুক ভারি হয়ে যেত গল্পের চরিত্রগুলোর কচি সংগ্রামে। হায় সে কী উৎকণ্ঠা!
সম্ভবত সেখানেই পড়েছিলাম, গল্পের কোন এক বখাটে বড় ভাই বছরের পর বছর ধরে স্কাউটিং ক্যাম্পে ‘খরবায়ু বয় বেগে’ গেয়ে যেত। তখন পর্যন্ত শুধু গানটির দু’লাইন জানতাম। বই পড়েই খুঁজে-পেতে পুরো গান শুনেছিলাম। শাহরিয়ার কবিরের বই পড়ার অনুভূতিগুলো যেন সেই থেকেই আটকে গেছে ‘খরবায়ু বয় বেগে’র মধ্যে।
প্রথমে মনে পড়ে ‘নিকোলাস রোজারিওর ছেলেরা’র কথা। এরপর একে একে মনে পড়ে যায় নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়, পাথারিয়ার সোনার খনি, কার্পেথিয়ানের কালো গোলাপ, বার্চবনে ঝড়, সীমান্তে সংঘাত, অনীকের জন্য ভালবাসা, লুসাই পাহাড়ের শয়তান, ব্যাভারিয়ার রহস্যময় দুর্গ, হানাবাড়ির রহস্য।
সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, ইত্যাদি নিয়ে অনেক তর্ক চলে বড়দের মহলে। খুব বড় একটা ব্যাপার ভুলে যায় সবাই। মানুষের মনন স্থায়ী রূপ নিয়ে ফেলে তার কৈশোরে। শত চেষ্টায়ও এরপর আর তার চিন্তা-চেতনার পরিবর্তণ সম্ভব না। বিশ্বাসের মধ্যাকর্ষণের কাছে জ্ঞানের বহুমুখী বিস্তার মার খেয়ে যায়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তণ, রাজসভায় মিছিল-সমাবেশ, বা মিডিয়ায় জ্ঞানগর্ভ আলোচনা কৈশোরোত্তীর্ণ মানুষের মনের উপর খুব কমই প্রভাব রাখতে পারে।
উঠতি প্রজন্মের কাছে কৈশোরের মৌলিক কিছু অনুভূতি তুলে ধরেছিলেন সত্যজিৎ রায়, শাহরিয়ার কবির, আর মুহম্মদ জাফর ইকবালের মত লেখকেরা। অধীর আগ্রহে তাঁদের নতুন বইয়ের অপেক্ষা, আর বই এলেই গোগ্রাসে গিলে ফেলার সেই সময়টা মনে আটকে আছে ‘খরবায়ু বয় বেগে’র মাঝে। কৈশোরের দ্বন্দ্ব আর ভয়গুলোর শৃঙ্খল বারবার ঝনঝন করে ওঠে এই একটি গানে। নিজের মনে প্রশ্ন জাগে, কতটুকু আসতে পেরেছি সেই দিনগুলো থেকে। স্বপ্নগুলো স্বপ্নই থেকে গেল। কান পাতলেই ঝন, ঝন, ঝন।
Friday, November 14, 2008
গানবন্দী জীবনঃ সে যে বসে আছে একা একা
০. ভূমিকা
জীবনের গতিময়তা, আকস্মিকতা, আর গভীরতার সাথে সবাই কমবেশি পরিচিত। বহুবার চেষ্টা করেও জীবনকে থামাতে বা ফেরাতে পারিনি। অথচ সেই জীবন যেন নিজে থেকে এসে আটকা পড়েছে কিছু গানের মাঝে। স্মৃতির স্ফটিক হয়ে যাওয়া জীবনের ভগ্নাংশগুলো খুব বেশি জীবন্ত হয়ে ফিরে আসে সেই গানগুলোর সাথে সাথে। কিছু গান, আর তার মাঝে আটকা পড়া জীবন নিয়েই এই প্রলাপ-সিরিজ।
১. সে যে বসে আছে একা একা
সবেমাত্র নিজের একটা ঘর পেয়েছি তখন। আমেরিকা এসেছি প্রায় ৬ সপ্তাহ হয়ে গেছে। প্রথম ক'দিন খুব বাজে কেটেছিল। প্রথম যে-বাসায় উঠলাম, সেখান থেকে তিন দিনের মাথায় বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। বিচিত্র এক অভিজ্ঞতা ছিল সেই ক'দিন। জেটল্যাগে মারা যাচ্ছি এমন সময় সাত-সকালে উঠিয়ে দিয়ে বাড়ির মালিক বললেন, আমি বাইরে যাবো, তুমি বের হও বাসা থেকে। সেই দিনটা কাটলো পার্কের বেঞ্চে বসে। সে-বাসার একটা ঘর খালি ছিল, তবু সেখানে ঢোকা বা শোয়া বারণ। যাঁর ঘর, তিনি দূর থেকেই মানা করে দিয়েছেন ফোন করে। উঠেছিলাম অস্থায়ী ভাবে, তবু তিন দিনের মাথায় বলে দেওয়া হল লিভিং রুমে শাওয়ার কার্টেইন টাঙিয়ে থাকার কথা। শর্ত মানলে এক-তৃতীয়াংশ ভাড়া দিয়ে থেকে যাওয়া, না মানলে সে-রাতেই অন্যত্র জায়গা খোঁজা। বের হয়ে গিয়েছিলাম।
হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম পথে পথে। জানুয়ারির সকাল। কী প্রচণ্ড শীত। দু'হাতের গিঁটের চামড়া ফেটে রক্ত ঝরছে শীতের প্রকোপে। এরই মাঝে আরেক স্বদেশী উদ্ধার করলেন। নিয়ে গেলেন তাঁর বাসায়। থাকতে দিলেন দু'সপ্তাহ। সে-বাসায় শোওয়ার ঘর তিনটি, কিন্তু মানুষ থাকে মাত্র সাতজন। এক বাঙালি নিজের ঘরে, বাকি দুই ঘর মিলিয়ে ছয় নেপালি। একটা ঘরে বিশাল উঁচু এক বিছানা। পথে-ঘাটে যত ম্যাট্রেস ফেলে রাখা ছিল, তার সব কুড়িয়ে এনে স্তুপ করা হয়েছে সেই ঘরে। ফলাফল, প্রায় চার ফুট উঁচু বিছানা। সেই ঘরে থাকতো দুই জন।
অন্যঘরটি আয়তনে বড়, সাথে লাগোয়া বাথ, ড্রেসিং। সে-ঘরে থাকতো চারজন। কোন আসবাব নেই। এক কোণায় কিছু বই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। চাদর পেতে বিছানা বানানো। একজন ঘুমিয়ে উঠে গেলে আরেকজন এসে ঘুমায়। খুব একটা অর্থকষ্টের কারণে যে এই ব্যবস্থা, তাও না। তবু অবাক হয়ে ভাবছিলাম, দু'জন বাঙালিকে আজ পর্যন্ত এক ঘরে থাকতে দেখলাম না। নিজের একটা ঘরের মূল্য আমাদের কাছে অপরিমেয়। অথচ মুদ্রার অন্য পিঠে একই এলাকা থেকে উঠে আসা এই ছাত্রেরা।
চার সপ্তাহ পর এক অ্যাপার্টমেন্টে একটা ঘর খালি হল। উঠলাম সেখানে। নিজের ঘর। বিছানা হিসেবে ব্যবহারের জন্য আমিও একটা ম্যাট্রেস কুড়িয়ে নিলাম। সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম ৩৫০০ ডলার। স্কলারশিপের পরও নিজের পকেট থেকে হাজার তিনেক টাকা দিতে হত বিশ্ববিদ্যালয়কে। বাকি টাকা থেকে ৪০০ ডলার দিয়ে একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার কিনলাম। বাধ্য হয়েই কিনতে হল। ঠান্ডা বয়ে দু'মাইল হেঁটে লাইব্রেরিতে যেতে পারি না। সেই কম্পিউটার রাখবার জন্য টেবিলের প্রয়োজন। ওয়ালমার্ট থেকে বিশাল একটা টেবিল কিনলাম। অল-পার্পাস টেবিল হিসেবে ব্যবহারের জন্য। সেই দিন থেকে ৪ বছর ধরে লেখাপড়া, খাওয়াদাওয়া, কাপড় ইস্ত্রি করা, ইত্যাদি সব কাজই করেছি ৫৮ ডলারে কেনা সেই টেবিলে। আজকে আমি ভার্জিনিয়া, লুইজিয়ানায় সেই টেবিল আজও আছে।
রাত জেগে নাট-বল্টু লাগাচ্ছিলাম সেই টেবিলের। শ্রান্ত হয়ে বিরতি নিয়েছিলাম একটু। এক বন্ধু বললো, নতুন একটা গান শুনে দেখতে। অর্ণবের "সে যে বসে আছে" সেই প্রথমবারের মত শুনলাম। কোথায় যেন একটা মোঁচড় লাগলো। একটা কোণায় গিয়ে পা ছড়িয়ে বসলাম। দেওয়ালে হেলান দিয়ে পুরো রাত কাটিয়ে দিলাম গানটা শুনতে শুনতে।
এইতো সেদিন ওয়াশিংটন ডিসি গিয়েছিলাম অর্ণবের কনসার্ট দেখতে। শেষদিকে যখন সবাই গলা মিলিয়ে গাইছে, তখন আমি আনমনে ফিরে গেছি আমার সেই প্রথম দিকের দিনগুলোয়। সেই দিনের প্রতিটা অনুভূতি যেন অনেক বেশি জীবন্ত হয়ে ফিরে এসেছিল গানটার সাথে। শত মানুষের মাঝেও যেন একা একা বসে ছিলাম, রঙিন স্বপ্ন বুনছিলাম, জানালার পাশে বসে মেঘ গুনছিলাম। ঘাড় ফেরালেই জীর্ণ বিছানা, হাত বাড়ালেই কোণায় পড়ে থাকা ওটমিল বিস্কুট।
জীবনের গতিময়তা, আকস্মিকতা, আর গভীরতার সাথে সবাই কমবেশি পরিচিত। বহুবার চেষ্টা করেও জীবনকে থামাতে বা ফেরাতে পারিনি। অথচ সেই জীবন যেন নিজে থেকে এসে আটকা পড়েছে কিছু গানের মাঝে। স্মৃতির স্ফটিক হয়ে যাওয়া জীবনের ভগ্নাংশগুলো খুব বেশি জীবন্ত হয়ে ফিরে আসে সেই গানগুলোর সাথে সাথে। কিছু গান, আর তার মাঝে আটকা পড়া জীবন নিয়েই এই প্রলাপ-সিরিজ।
১. সে যে বসে আছে একা একা
সবেমাত্র নিজের একটা ঘর পেয়েছি তখন। আমেরিকা এসেছি প্রায় ৬ সপ্তাহ হয়ে গেছে। প্রথম ক'দিন খুব বাজে কেটেছিল। প্রথম যে-বাসায় উঠলাম, সেখান থেকে তিন দিনের মাথায় বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। বিচিত্র এক অভিজ্ঞতা ছিল সেই ক'দিন। জেটল্যাগে মারা যাচ্ছি এমন সময় সাত-সকালে উঠিয়ে দিয়ে বাড়ির মালিক বললেন, আমি বাইরে যাবো, তুমি বের হও বাসা থেকে। সেই দিনটা কাটলো পার্কের বেঞ্চে বসে। সে-বাসার একটা ঘর খালি ছিল, তবু সেখানে ঢোকা বা শোয়া বারণ। যাঁর ঘর, তিনি দূর থেকেই মানা করে দিয়েছেন ফোন করে। উঠেছিলাম অস্থায়ী ভাবে, তবু তিন দিনের মাথায় বলে দেওয়া হল লিভিং রুমে শাওয়ার কার্টেইন টাঙিয়ে থাকার কথা। শর্ত মানলে এক-তৃতীয়াংশ ভাড়া দিয়ে থেকে যাওয়া, না মানলে সে-রাতেই অন্যত্র জায়গা খোঁজা। বের হয়ে গিয়েছিলাম।
হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম পথে পথে। জানুয়ারির সকাল। কী প্রচণ্ড শীত। দু'হাতের গিঁটের চামড়া ফেটে রক্ত ঝরছে শীতের প্রকোপে। এরই মাঝে আরেক স্বদেশী উদ্ধার করলেন। নিয়ে গেলেন তাঁর বাসায়। থাকতে দিলেন দু'সপ্তাহ। সে-বাসায় শোওয়ার ঘর তিনটি, কিন্তু মানুষ থাকে মাত্র সাতজন। এক বাঙালি নিজের ঘরে, বাকি দুই ঘর মিলিয়ে ছয় নেপালি। একটা ঘরে বিশাল উঁচু এক বিছানা। পথে-ঘাটে যত ম্যাট্রেস ফেলে রাখা ছিল, তার সব কুড়িয়ে এনে স্তুপ করা হয়েছে সেই ঘরে। ফলাফল, প্রায় চার ফুট উঁচু বিছানা। সেই ঘরে থাকতো দুই জন।
অন্যঘরটি আয়তনে বড়, সাথে লাগোয়া বাথ, ড্রেসিং। সে-ঘরে থাকতো চারজন। কোন আসবাব নেই। এক কোণায় কিছু বই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। চাদর পেতে বিছানা বানানো। একজন ঘুমিয়ে উঠে গেলে আরেকজন এসে ঘুমায়। খুব একটা অর্থকষ্টের কারণে যে এই ব্যবস্থা, তাও না। তবু অবাক হয়ে ভাবছিলাম, দু'জন বাঙালিকে আজ পর্যন্ত এক ঘরে থাকতে দেখলাম না। নিজের একটা ঘরের মূল্য আমাদের কাছে অপরিমেয়। অথচ মুদ্রার অন্য পিঠে একই এলাকা থেকে উঠে আসা এই ছাত্রেরা।
চার সপ্তাহ পর এক অ্যাপার্টমেন্টে একটা ঘর খালি হল। উঠলাম সেখানে। নিজের ঘর। বিছানা হিসেবে ব্যবহারের জন্য আমিও একটা ম্যাট্রেস কুড়িয়ে নিলাম। সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম ৩৫০০ ডলার। স্কলারশিপের পরও নিজের পকেট থেকে হাজার তিনেক টাকা দিতে হত বিশ্ববিদ্যালয়কে। বাকি টাকা থেকে ৪০০ ডলার দিয়ে একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার কিনলাম। বাধ্য হয়েই কিনতে হল। ঠান্ডা বয়ে দু'মাইল হেঁটে লাইব্রেরিতে যেতে পারি না। সেই কম্পিউটার রাখবার জন্য টেবিলের প্রয়োজন। ওয়ালমার্ট থেকে বিশাল একটা টেবিল কিনলাম। অল-পার্পাস টেবিল হিসেবে ব্যবহারের জন্য। সেই দিন থেকে ৪ বছর ধরে লেখাপড়া, খাওয়াদাওয়া, কাপড় ইস্ত্রি করা, ইত্যাদি সব কাজই করেছি ৫৮ ডলারে কেনা সেই টেবিলে। আজকে আমি ভার্জিনিয়া, লুইজিয়ানায় সেই টেবিল আজও আছে।
রাত জেগে নাট-বল্টু লাগাচ্ছিলাম সেই টেবিলের। শ্রান্ত হয়ে বিরতি নিয়েছিলাম একটু। এক বন্ধু বললো, নতুন একটা গান শুনে দেখতে। অর্ণবের "সে যে বসে আছে" সেই প্রথমবারের মত শুনলাম। কোথায় যেন একটা মোঁচড় লাগলো। একটা কোণায় গিয়ে পা ছড়িয়ে বসলাম। দেওয়ালে হেলান দিয়ে পুরো রাত কাটিয়ে দিলাম গানটা শুনতে শুনতে।
এইতো সেদিন ওয়াশিংটন ডিসি গিয়েছিলাম অর্ণবের কনসার্ট দেখতে। শেষদিকে যখন সবাই গলা মিলিয়ে গাইছে, তখন আমি আনমনে ফিরে গেছি আমার সেই প্রথম দিকের দিনগুলোয়। সেই দিনের প্রতিটা অনুভূতি যেন অনেক বেশি জীবন্ত হয়ে ফিরে এসেছিল গানটার সাথে। শত মানুষের মাঝেও যেন একা একা বসে ছিলাম, রঙিন স্বপ্ন বুনছিলাম, জানালার পাশে বসে মেঘ গুনছিলাম। ঘাড় ফেরালেই জীর্ণ বিছানা, হাত বাড়ালেই কোণায় পড়ে থাকা ওটমিল বিস্কুট।
বৃন্দাবনে জগন্নাথ
সপ্তাহ খানেক আগের কথা। পুরুষ দেহের সবচেয়ে ঘাউড়া অঙ্গের সাথে ঘন্টা কয়েক সময় কাটালাম একান্তে। প্রবাসে একলা আছি অনেক দিন। মনের ক্ষুধাগুলো কোন ভাবে চেপে রাখা গেলেও দেহের ক্ষুধাকে খুব বেশি দিন চেপে রাখা যায় না। হাতে কাড়ি কাড়ি ডলার থাকলে কোন চিন্তা নেই, কিন্তু আমার মত হতদরিদ্র ছাত্র হলেই বিপত্তি। কপাল ভাল থাকলে হয়তো একই ঝাঁকের আর কোন পাখি মিলে যেতে পারে। যাদের সেই ভাগ্যও নেই, তাদের ‘আপনা হাত জগন্নাথ’। আমি শেষ দলের মানুষ।
প্রথম চিন্তাই ছিল, কোন হাত? দীর্ঘদিনের অনভ্যাসজনিত কারণে ভ্যাবলার মত তাকিয়ে ছিলাম দুই হাতের দিকেই। কিছুক্ষণ হাওয়ায় হাত মকশো করলাম। অনেকটা শ্যাডো প্র্যাকটিসের ঢঙ্গে। নাহ, তবু মনে পড়ে না। অগত্যা বাধ্য হলাম সীমিত আকারে অডিশন দিতে। মানুষ আমি ডানহাতী। প্রত্যাশিত ভাবেই ডান হাত হল ব্যাটম্যান, আর হতভাগা বাম হাত হল রবিন।
অধম এই আমি ইবলিশ হলেও মোনাফেক নই। ইবলিশের আদর্শ অনুসরণ করে আমি ভাল-মন্দ নির্বিশেষে সব কাজ করি বিসমিল্লাহ বলে। ব্যতিক্রম হল না এবারও। বাড়ন্ত প্রত্যাশা, শুকনো কাপড়, আর এক রোল টয়লেট পেপারসহ ঢুকে পড়লাম বৃন্দাবনে। রুমমেটের সাথে চোখাচোখি হয়ে গিয়েছিল মাঝপথে। চোখ টিপে বললাম, হে বন্ধু, বিদায়। বাচ্চা ছেলে। ভদ্রতা করে হাসি চেপে শুধু বললো, বেস্ট অফ লাক, ব্রাদার! জবাবে বললাম, বিসমিল্লাহ বলে নিয়েছি, রাখে আল্লাহ মারে কে?
আমার যুদ্ধক্ষেত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল। দেহ থেকে সুতা খসে গেল, হাতের নাগালের সবটুকু জায়গা ঢেকে দেওয়া হল টয়লেট পেপারে। দুস্থ, রুক্ষ, আগাছামণ্ডিত চেহারাটা আয়নায় দেখলাম কিছুক্ষণ। নাহ, বেসিনের উপরের ছোট আয়নায় পোষাচ্ছে না। বিব্রতকর অবস্থায় যাবার আগেই খেয়াল হয়েছিল, ভাগ্যিস। দৌঁড়ে ঘরে গেলাম, টেনে নিয়ে আসলাম ঢাউশ আয়নাটা। এবার হয়েছে। দৃষ্টিসুখ যেন সৃষ্টিসুখ। আগডুম-বাগডুম ভাবতে ভাবতে দাঁড়ালাম আয়নার সামনে। এবার খেলা ভাঙার খেলা।
চলছিল ভালই। তবে কিছুদূর এগিয়ে মনে হল, একটু ভিজিয়ে নিলে মন্দ হত না। নয়তো বলি এক, করে আরেক। আলতো করে হাত বুলিয়ে একদিকে আনার বেলায় ঠিক আছে, কিন্তু স্বাভাবিকের চেয়ে একটু ভিন্ন কোন অবস্থানে নিতে গেলেই তিড়িং করে আরেক দিকে চলে যায়। এতক্ষণ কাজের কাজ তো হলই না, উলটা ধস্তাধস্তি করেই ঘেমে গেলাম পুরো। ভিজিয়ে নেবার পর দুঃসময়ের সঙ্গী হিসেবে এগিয়ে এল টয়লেট পেপারগুলো। প্রায় আধ ঘন্টা পর দেখা গেল এক ঘর টিস্যুর মধ্যে বসে আছি ক্লান্ত আমি। বড় বড় শ্বাস পড়ছে সশব্দে, অসম্পূর্ণ কাজের বিরক্তিকর নিদর্শন ছড়িয়ে আছে আশেপাশে। মনের ভেতর একটা কণ্ঠ বলছে বাদ দিতে। সবার জন্য সব না। পরে কোনদিন হবে নাহয়। সাথে সাথেই অন্য অংশ প্রতিবাদ করে উঠলো। না, পারতে হবে। এত আয়োজন তো সবদিন হয় না। এক রুমমেট বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি, আরেকজনকে দিয়ে বৃন্দাবনের কাজ সারিয়েছি আগেই। এই কষ্ট বৃথা যেতে দেওয়া যায় না।
যুদ্ধজয়ের প্রথম শর্ত মানচিত্রজ্ঞান। ভেবে বুঝলাম, মানচিত্রজ্ঞানের অভাবই আমার দুরবস্থার কারণ। মাঝপথে কিছুটা স্কাউটিং সেরে নিলাম। যুদ্ধক্ষেত্রটা অনেকটা বটগাছের মত। গোড়ার দিকে শক্ত মাটিতে শেকড় ছড়িয়ে আছে। চাইলেও তাকে তৎক্ষণাৎ ঘায়েল করা আমার কম্মো না। যদি কখনও আগ্রাসী ও আগ্রহী কোন সুন্দরীর সান্নিধ্য পাই, তাহলে তাকে দিয়েই করিয়ে নিতে হবে।
মূলের সাথে লেগে থাকা কাণ্ডটাই সবচেয়ে বেয়াড়া। পিছলে যায়, ফসকে যায়। চাপাচাপি করে তবুও কিছুটা সামাল দেওয়া যায়। আপোষের সাথেই কাজ এগিয়ে নিলাম। বটের মতই দু’পাশ বেয়ে ঝুল নেমে আছে কিছু। আর বাকি আছে গাছের আগার সাথে সম্মুখ-সমর। ঝুলগুলো একেবারেই নিরীহ। এরা দৃষ্টিসীমায় থাকলেও বৃষ্টিসীমায় থাকে না। এদের ছেড়ে গেলেও চলতো, তবু লেগে গেলাম। করবো যখন, ঠিকমতই করি। এমনিতেই মাসে একবার এমন সুবর্ণ সুযোগ মেলে।
যেমনটা বলছিলাম, আসল যুদ্ধ গাছের আগায়। ঝুলে হাত পড়তেই ফোঁস করে উঠলো সেটা। আমিও তাই বলে ছেড়ে দেবার পাত্র না। কৌশলটা কঠিন না তেমন একটা। শক্ত মুঠি করতে হয় শুরুতে। পিছলে যেতে চায়। চাবেই তো। মানবদেহের সব অনুষঙ্গেরই নিজস্ব প্রাণ আছে। শক্ত করে ধরতে হয়। গোড়া শক্ত না হলে আগার পরিচর্যা হবে কীভাবে? চলছে আমার কাজ। শরীর ভার হয়ে ছিল, একটু একটু করে হালকা হচ্ছি। আহা, কী আরাম। ছিলাম টম ক্রুজ, হয়ে যাচ্ছি ড্যানিয়েল ক্রেগ। ছন্দে ছন্দে হাত দু’টো দুলছে। আমি মুগ্ধ চোখে নিজেকে দেখছি জোড়া আয়নায়। এমন সময় ঠক্-ঠক্-ঠক্। ভাইয়া, আন্টি তোমার খোঁজ করছে।
আমার মা চিরদিনই কিছুটা বেরসিক। তারচেয়েও বাজে তার সময়জ্ঞান। আমি কোন কুকাজে রত হলেই আমাকে তার মনে পড়তে হবে। বইয়ের ভাজে বই নিয়ে কাঁথার নিচে ঢুকতে গেলেই আচমকা উদয় হয়ে বলে, টেবিলে বসে পড় বাবা, আমি গরম দুধ এনে দেই। জমানো টাকায় মোড়ের ভিডিও গেমের দোকানে যেতে গেলে বলে, মসজিদে যাও, সাথে খুচরা টাকা থাকলে দান-খয়রাত কোর। দশ মিনিট ধরে হেয়ার-জেল লাগিয়ে বের হওয়ামাত্র মাথায় এক আজলা পানি ঢেলে দিয়ে বলে, জমজমের পানি এটা, একটু দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দেই, মাথা ঠান্ডা হবে। অতএব, এ-রকম সময়ে আমার মায়ের আমাকে মনে পড়তেই হল।
আমিও এ-যুগের ছেলে। জননীর চেয়ে মান-ইজ্জত বড়। তারচেয়েও বড় ব্যক্তিগত বিলাস। অতএব, রুমমেটকে বলে দিলাম মাকে অপেক্ষা করতে বলতে। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন। এক হাত ধুয়ে, দরজার ফাঁক দিয়ে ফোন নিলাম। শীতের ভোরের মত প্রশান্ত আর শরতের মেঘের মত ভেসে যাওয়া একটা কণ্ঠে বললাম, হুম। মা অবাক হল এই আনন্দে। এ-আনন্দের স্বাদ আমার পাবার কথা না। একটু উদ্বিগ্ন হয়েই প্রশ্ন, কী করছো?
এজবাস্টনের টাই ম্যাচে ফিফটি করার পরের স্টিভ ওয়াহ’র মত চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, একা একা চুল কেটে সারলাম, কী যে শান্তি!
প্রথম চিন্তাই ছিল, কোন হাত? দীর্ঘদিনের অনভ্যাসজনিত কারণে ভ্যাবলার মত তাকিয়ে ছিলাম দুই হাতের দিকেই। কিছুক্ষণ হাওয়ায় হাত মকশো করলাম। অনেকটা শ্যাডো প্র্যাকটিসের ঢঙ্গে। নাহ, তবু মনে পড়ে না। অগত্যা বাধ্য হলাম সীমিত আকারে অডিশন দিতে। মানুষ আমি ডানহাতী। প্রত্যাশিত ভাবেই ডান হাত হল ব্যাটম্যান, আর হতভাগা বাম হাত হল রবিন।
অধম এই আমি ইবলিশ হলেও মোনাফেক নই। ইবলিশের আদর্শ অনুসরণ করে আমি ভাল-মন্দ নির্বিশেষে সব কাজ করি বিসমিল্লাহ বলে। ব্যতিক্রম হল না এবারও। বাড়ন্ত প্রত্যাশা, শুকনো কাপড়, আর এক রোল টয়লেট পেপারসহ ঢুকে পড়লাম বৃন্দাবনে। রুমমেটের সাথে চোখাচোখি হয়ে গিয়েছিল মাঝপথে। চোখ টিপে বললাম, হে বন্ধু, বিদায়। বাচ্চা ছেলে। ভদ্রতা করে হাসি চেপে শুধু বললো, বেস্ট অফ লাক, ব্রাদার! জবাবে বললাম, বিসমিল্লাহ বলে নিয়েছি, রাখে আল্লাহ মারে কে?
আমার যুদ্ধক্ষেত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল। দেহ থেকে সুতা খসে গেল, হাতের নাগালের সবটুকু জায়গা ঢেকে দেওয়া হল টয়লেট পেপারে। দুস্থ, রুক্ষ, আগাছামণ্ডিত চেহারাটা আয়নায় দেখলাম কিছুক্ষণ। নাহ, বেসিনের উপরের ছোট আয়নায় পোষাচ্ছে না। বিব্রতকর অবস্থায় যাবার আগেই খেয়াল হয়েছিল, ভাগ্যিস। দৌঁড়ে ঘরে গেলাম, টেনে নিয়ে আসলাম ঢাউশ আয়নাটা। এবার হয়েছে। দৃষ্টিসুখ যেন সৃষ্টিসুখ। আগডুম-বাগডুম ভাবতে ভাবতে দাঁড়ালাম আয়নার সামনে। এবার খেলা ভাঙার খেলা।
চলছিল ভালই। তবে কিছুদূর এগিয়ে মনে হল, একটু ভিজিয়ে নিলে মন্দ হত না। নয়তো বলি এক, করে আরেক। আলতো করে হাত বুলিয়ে একদিকে আনার বেলায় ঠিক আছে, কিন্তু স্বাভাবিকের চেয়ে একটু ভিন্ন কোন অবস্থানে নিতে গেলেই তিড়িং করে আরেক দিকে চলে যায়। এতক্ষণ কাজের কাজ তো হলই না, উলটা ধস্তাধস্তি করেই ঘেমে গেলাম পুরো। ভিজিয়ে নেবার পর দুঃসময়ের সঙ্গী হিসেবে এগিয়ে এল টয়লেট পেপারগুলো। প্রায় আধ ঘন্টা পর দেখা গেল এক ঘর টিস্যুর মধ্যে বসে আছি ক্লান্ত আমি। বড় বড় শ্বাস পড়ছে সশব্দে, অসম্পূর্ণ কাজের বিরক্তিকর নিদর্শন ছড়িয়ে আছে আশেপাশে। মনের ভেতর একটা কণ্ঠ বলছে বাদ দিতে। সবার জন্য সব না। পরে কোনদিন হবে নাহয়। সাথে সাথেই অন্য অংশ প্রতিবাদ করে উঠলো। না, পারতে হবে। এত আয়োজন তো সবদিন হয় না। এক রুমমেট বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি, আরেকজনকে দিয়ে বৃন্দাবনের কাজ সারিয়েছি আগেই। এই কষ্ট বৃথা যেতে দেওয়া যায় না।
যুদ্ধজয়ের প্রথম শর্ত মানচিত্রজ্ঞান। ভেবে বুঝলাম, মানচিত্রজ্ঞানের অভাবই আমার দুরবস্থার কারণ। মাঝপথে কিছুটা স্কাউটিং সেরে নিলাম। যুদ্ধক্ষেত্রটা অনেকটা বটগাছের মত। গোড়ার দিকে শক্ত মাটিতে শেকড় ছড়িয়ে আছে। চাইলেও তাকে তৎক্ষণাৎ ঘায়েল করা আমার কম্মো না। যদি কখনও আগ্রাসী ও আগ্রহী কোন সুন্দরীর সান্নিধ্য পাই, তাহলে তাকে দিয়েই করিয়ে নিতে হবে।
মূলের সাথে লেগে থাকা কাণ্ডটাই সবচেয়ে বেয়াড়া। পিছলে যায়, ফসকে যায়। চাপাচাপি করে তবুও কিছুটা সামাল দেওয়া যায়। আপোষের সাথেই কাজ এগিয়ে নিলাম। বটের মতই দু’পাশ বেয়ে ঝুল নেমে আছে কিছু। আর বাকি আছে গাছের আগার সাথে সম্মুখ-সমর। ঝুলগুলো একেবারেই নিরীহ। এরা দৃষ্টিসীমায় থাকলেও বৃষ্টিসীমায় থাকে না। এদের ছেড়ে গেলেও চলতো, তবু লেগে গেলাম। করবো যখন, ঠিকমতই করি। এমনিতেই মাসে একবার এমন সুবর্ণ সুযোগ মেলে।
যেমনটা বলছিলাম, আসল যুদ্ধ গাছের আগায়। ঝুলে হাত পড়তেই ফোঁস করে উঠলো সেটা। আমিও তাই বলে ছেড়ে দেবার পাত্র না। কৌশলটা কঠিন না তেমন একটা। শক্ত মুঠি করতে হয় শুরুতে। পিছলে যেতে চায়। চাবেই তো। মানবদেহের সব অনুষঙ্গেরই নিজস্ব প্রাণ আছে। শক্ত করে ধরতে হয়। গোড়া শক্ত না হলে আগার পরিচর্যা হবে কীভাবে? চলছে আমার কাজ। শরীর ভার হয়ে ছিল, একটু একটু করে হালকা হচ্ছি। আহা, কী আরাম। ছিলাম টম ক্রুজ, হয়ে যাচ্ছি ড্যানিয়েল ক্রেগ। ছন্দে ছন্দে হাত দু’টো দুলছে। আমি মুগ্ধ চোখে নিজেকে দেখছি জোড়া আয়নায়। এমন সময় ঠক্-ঠক্-ঠক্। ভাইয়া, আন্টি তোমার খোঁজ করছে।
আমার মা চিরদিনই কিছুটা বেরসিক। তারচেয়েও বাজে তার সময়জ্ঞান। আমি কোন কুকাজে রত হলেই আমাকে তার মনে পড়তে হবে। বইয়ের ভাজে বই নিয়ে কাঁথার নিচে ঢুকতে গেলেই আচমকা উদয় হয়ে বলে, টেবিলে বসে পড় বাবা, আমি গরম দুধ এনে দেই। জমানো টাকায় মোড়ের ভিডিও গেমের দোকানে যেতে গেলে বলে, মসজিদে যাও, সাথে খুচরা টাকা থাকলে দান-খয়রাত কোর। দশ মিনিট ধরে হেয়ার-জেল লাগিয়ে বের হওয়ামাত্র মাথায় এক আজলা পানি ঢেলে দিয়ে বলে, জমজমের পানি এটা, একটু দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দেই, মাথা ঠান্ডা হবে। অতএব, এ-রকম সময়ে আমার মায়ের আমাকে মনে পড়তেই হল।
আমিও এ-যুগের ছেলে। জননীর চেয়ে মান-ইজ্জত বড়। তারচেয়েও বড় ব্যক্তিগত বিলাস। অতএব, রুমমেটকে বলে দিলাম মাকে অপেক্ষা করতে বলতে। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন। এক হাত ধুয়ে, দরজার ফাঁক দিয়ে ফোন নিলাম। শীতের ভোরের মত প্রশান্ত আর শরতের মেঘের মত ভেসে যাওয়া একটা কণ্ঠে বললাম, হুম। মা অবাক হল এই আনন্দে। এ-আনন্দের স্বাদ আমার পাবার কথা না। একটু উদ্বিগ্ন হয়েই প্রশ্ন, কী করছো?
এজবাস্টনের টাই ম্যাচে ফিফটি করার পরের স্টিভ ওয়াহ’র মত চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, একা একা চুল কেটে সারলাম, কী যে শান্তি!
Subscribe to:
Posts (Atom)