Thursday, January 24, 2008

বাঙ্গালির ডিখ্যাতিফিকেশন

১. খ্যাৎনামা
মানুষ হিসেবে আমি প্রাচীন, অচল। কমপক্ষে এক প্রজন্ম আগে আটকে আছি। আমার মারকুটে বাবা অত্যন্ত যত্নের সাথে শিখিয়েছিল, লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে। সকাল হলেই ছিল আমার নাম ধরে বিকট এক ডাক, আর সাথে ফ্যান বন্ধ করে দেওয়া। ঘুম ভেঙে বিবিসি রেডিও শুনতে পেতাম প্রতি সকালে। সরকারী চাকরিজীবি বাবার সিংহভাগ উপার্জন চলে যেত আমাদের দুই ভাইয়ের স্কুল আর প্রাইভেট টিউটরের পেছনে। ছোট মামা স্কলারশিপের টাকা দিয়ে একটা আটারি কিনে দিয়েছিল। বয়স তখন বছর সাতেক হবে হয়তো আমার। জীবনে আর কখনও কোন টিভি গেইম হাতে পাইনি। আমার মিতব্যয়ী বাবা প্রতি বছর হাজার কয়েক টাকা তুলে রাখতো একুশে বইমেলার জন্য, মেলা এলে পূর্ণ স্বাধীনতায় খরচ করতাম। ঘরে সম্পদ বলতে ছিল শুধু কয়েক শেলফ বই। প্রতি বেলায় এক তরকারি, এক ভাজি, আর ডাল ছিল মেন্যু। ভোগ বলতে জুম্মাবারে বুটের ডাল দিয়ে গরুর মাংস। আর প্রাত্যহিক বিনোদন বলতে বইগুলো নাড়াচাড়া করা। সান্ধ্য আইন মেনে ঘরে ফিরতে হত। হাজার অপছন্দ সত্ত্বেও ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত পড়ার টেবিলে বসে থাকতে হত। অন্যথায় শাস্তি ছিল বেতপেটা, আর মেনে চলার পুরস্কার ছিল সেই শাস্তি থেকে রেহাই।

এমনি করেই বেড়ে ওঠা এই আমি যে খ্যাৎ আর বিব্রতকর হব, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। প্রবাস বলতে সবাই বাইরের কোন দেশকে বোঝে। আমার কাছে প্রবাসের সংজ্ঞা মিলে যেতে না পারায়, স্বকীয়তাকে সংকুচিত করে রাখায়। সে-অর্থে আমার প্রবাস জীবনের সূচনা দেশে থাকতেই। উন্নত ব্যক্তি, সমাজ, ও রাষ্ট্রের উৎকর্ষের সামনে নিজেকে অপ্রস্তুত অবস্থায় আবিষ্কার করেছি অগণিত বার। খেতু থেকে আধুনিক হবার চেষ্টা খুব একটা গা লাগিয়ে করিনি, তবে চিনেছি অনেক খ্যাতাচারই। মনটা একদিকে ছোট হয়ে যায়, আবার আরেক দিকে ভেবে ভাল লাগে যে আমি অচল হলেও খুব দুর্লভ কোন প্রাণি নই।

২. কুলির কাপে ঝড়
আমি মানুষ হিসেবে ভীতু বলেই কিনা জানি না, আমার শখের বিষয় বা বস্তুগুলো কিছুটা নিরীহ। লোকের গাড়ি কেনার শখ থাকে, আমার শখ একটা সাইকেলের। কেউ সাগরপাড়ে বেড়াতে চায়, আমি চাই স্রেফ একটা ডিঙি নৌকা। সবাই বাড়ি চায়, আমি চাই ছোট্ট, সুন্দর একটা ছোটঘর। খালার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে একবার সুন্দর এক ‘বিশ্রামাগার’ ঢোকার সৌভাগ্য হল। আলতো করে এদিক-ওদিক হাত বুলাতে বুলাতে হাঁটছিলাম। হঠাৎ চোখ আটকে গেল বেসিনের উপর রাখা একটা ছোট্ট কাপে। গবেষণা করে বের করলাম, এই কাপের কাজ কুলকুচিতে সাহায্য করা। আজলা তুলে পানি নিয়ে কেউ কুলি করে না এই যুগে। শিখলাম।

৩. সুড়ুৎ সুড়ুৎ সুড়ুৎ
এবার বলছি চায়ের কাপের কথা। না, চা খাওয়ার সময় হাজারো আয়েশ সত্ত্বেও সুড়ুৎ করা যাবে না। নানি যদি কাপ থেকে পিরিচে ঢেলে দেয়, তাহলে হয়তো ফু দিয়ে খেয়ে নেওয়া যায়, তবে তা খুবই সন্তর্পনে হতে হবে। প্রকাশ্যে কখনো নাকি চায়ে ফু দেওয়া যায় না, পিরিচে নেওয়া তো দূরের কথা। মন যত উচাটনই হোক, এক থেকে দেড় চামচের বেশি চিনি নেওয়া যায় না। জ্বালার শেষ এখানেই নয়। আরামে নাকি সশব্দে আহ্‌ করাও বারণ। চা তবু গরম গরম পান করতে হবে। উফ, এত নিয়মের বালাই কেন?

৪. মন্ডা-মিঠাই যত চাও
মিষ্টি খাওয়ার বাতিক পেয়েছি দাদার কাছ থেকে। দাদা ছিল গ্রামের ডাক্তার। উত্তরাধিকারসূত্রে একটা শিক্ষিত বাপ, পরার্থপর হিসেবে রেখে যাওয়া সুনাম, আর কিছু বদভ্যাস ছাড়া এমনিতেও কিছু পাবার কথা না। দাদার উৎপাতে নাকি মিষ্টিওয়ালা গ্রামে ঢুকে মসজিদ পেরিয়ে বাড়ি পর্যন্ত যেতে পারতো না। তার আগেই হাঁড়ির মিষ্টি খতম। ম্যাট্রিকের রেজাল্টের পর বিষম আনন্দে আমার বাবা অনেক মিষ্টি এনেছিল। আমার আনন্দ দেখে সবাই খুব খুশি। আমি যে বেশি নম্বরের চেয়ে বেশি মিষ্টি দেখে আনন্দিত, তা খোলাসা করে বললে মনে হয় না আর লেখাপড়া করা হত। যাক সে কথা। মিষ্টিও নাকি এক বসায় বেশি খাওয়া অনুচিত। হাত লাগিয়ে খাওয়া তো চূড়ান্ত অসম্মানজনক। দাদার যুগই ভাল ছিল, এই ভাবতে ভাবতে চামচ তুলি আজও।

৫. টয়োটা ক্যামরি
সুযোগ হলে কেউ ‘ডুড, হোয়্যার ইজ দ্য পার্টি’ মুভিটা দেখে নিয়েন। দেসি কালচারের বীভৎস খ্যাতাচার নিয়ে তৈরি দুর্দান্ত কমেডি। চলচ্চিত্র থেকে ধার করেই বোঝাই এই খ্যাতাচার। উঠতি বয়সের কিছু ভারতীয় তরুণ গোরা মেয়ে বাগানোর জন্য পার্টি দিচ্ছে। কীভাবে যেন খবর পেয়ে চলে এসেছে তেলচপচপে খেতু থেকে শুরু করে গলায় মাথায় তিলক দেওয়া ভোলাভালা লোকজনও। আধুনিক প্রজন্মের তো জাত যায়-যায় অবস্থা। গেট ভেঙে যেন ঢুকে পড়বে সবাই। কী করা যায় এই ভিড় থেকে রেহাই পেতে? কীভাবে তাড়ানো যায় এত লোক? কী মতলব আঁটা যায় সবাইকে বের করে প্রপার স্ক্রিনিং করে লোক ঢোকানোর? চ্যাংড়া এক বান্দা মাইক্রোফোনে ঘোষনা দিল, মিস্টার প্যাটেল, ইয়োর টয়োটা ক্যামরি হেডলাইটস আর অন। মুহূর্তে ফ্লোর খালি হয়ে গেল। প্রবাসীমাত্রই এই ক্যামরি-প্রীতির সাথে পরিচিত। খেতু থেকে জাতে উঠতে চাইলে ক্যামরিবিনা চলতে হয়। তেলে নাহয় কম মাইল গেল, গাড়িও নাহয় বসে গেল বছর সাতেকের মাথায়। তবু নিশ্চয়ই খ্যাৎ থাকবেন না আপনি?

৬. ব্যবহার শেষে গোল বোতাম টিপুন
জনৈক বড়ভাই মাত্র এলেন দেশ থেকে। বলছিলেন এমিরেটস’এর টয়লেটের কথা। ঢুকেই নাকি বিশাল এক সাইনবোর্ড। বড় বড় হরফে একেক ভাষায় আকুতি জানানো হয়েছে, ব্যবহার শেষে যেন কোন এক গোল বোতাম টিপে দেওয়া হয়। ইংরেজি তো আন্তর্জাতিক ভাষা, তাই ক্ষমা করে দেওয়া যায়। সংযুক্ত আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্যীয় দেশ, তাই তাকেও কিঞ্চিৎ ক্ষমা করা গেল। তাই বলে বাংলা, হিন্দি, বা থাই ভাষাকে ক্ষমা করি কীভাবে? শুভ্র, সুন্দর একটা জায়গা বিশ্রী রকম ময়লা আর দুর্গন্ধযুক্ত করে আসার পর কারো যদি পানি ঢালার কথা খেয়াল না থাকে, তাদের জন্য কীই বা করার আছে বেচারা এয়ারলাইন্সের? ভাই সাহেব বলছিলেন, কোন জাতি কতটা সভ্য, বা সভ্য বলে পরিগণিত, তা জানার উপায় এমিরেটসের টয়লেট ঘুরে আসা। সাইনবোর্ডের ভাষাই যা বলার বলে দেবে।

৭. জান, জানু, জান্টু, জানেমান
আমার মা আদরে-আবদারে বাবাকে ডাকে ‘এই’। নাটকে দেখতাম ঝন্টুর বাবা জাতীয় কিছু, আর সিনেমায় লক্ষ্মী। স্থান-কাল-পাত্রান্তরে ওগো, হ্যাগো, সোনা, জাদু, হানি, ডিয়ার, সুইটি, লাভলির চলও প্রচুর। আমি কোনদিনই তাল খুঁজে পেতাম না এই সম্বোধনযুদ্ধে। নিতান্তই দৈবদুর্বিপাকে একটা বান্ধবী জুটেছিল জীবনে। পাখি আসতে আসতেই ফুরুৎ করে উড়ে চলে গেছে আরেক গাছে। তার এক বিশাল অভিযোগ ছিল তাকে জান বলে না ডাকায়। আমি বলেছিলাম গোপাল ভাঁড়ের ছেলের গল্প। বাজারের কোণায় দাঁড়িয়ে যেই সুপুত্র ‘গোপাল বাবা, গোপাল বাবা’ বলে চিৎকার করে গোপালের গাট্টা খেয়েছিল। ছেলের যুক্তি ছিল, বাবাকে যেমন নাম ধরে ডাকা যায় না, তেমনি ভরা মজলিশে স্রেফ বাবা বলে ডাকা যায় না। অতঃপর গোপাল বাবা ও গোপালের গাট্টা। না, পোষালো না। ভালবাসা তর্কের উর্ধ্বে হলেও আগ্রাসনের উর্ধ্বে নয়। বলেছিলাম আজকাল যে-সে জান ডাকে, কোন স্যাঙ্কটিটি নাই এধরনের গণসম্বোধনের। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আমার এককালীন পাখি এখন বেশ জানময় হয়ে আছে। ওহ, জানের সাথে আই লাভ ইউ’ও যুক্ত করে দিতে হয়। নাহয় আম-ছালা সব যাবে। অন্তত এই লাইনে আর খ্যাৎ নই, যদিও একটু বেশিই ক্ষতি হয়ে গেছে শিখতে শিখতে।

৮. খুউউঅল
না, শব্দটা কুল না। ক্যুল, কিউল, এবং কুঅল এর মাঝামাঝি উচ্চারণ হবে, আর ক-কে খ করে দিতে হবে। বহুমূল্য এই শিক্ষাকে পথের পাথেয় হিসেবে বিবেচনা না করলে এযুগে অযথা খ্যাৎ বলে গণ্য হবেন। যেকোন প্রকার সুন্দর ও সমর্থনযোগ্য ঘটনার পরেই এই শব্দ উচ্চারণ করতে হয়। সম্ভব হলে একই সাথে হাত মেলাতে হয় কিংবা পিঠ চাপড়ে দিতে হয়। ভালকে ভাল, সুন্দরকে সুন্দর, বা সুস্বাদুকে সুস্বাদু বলবার দিন আর নেই। সকল প্রকার ধনাত্মক বিশেষণের প্রতিস্থাপনের জন্য তৈরি শব্দ। আরেকটু জাতে উঠতে চাইলে বাক্যের আগে-পিছে-মাঝে-ভাজে লাইক যোগ করে বাক্যটি পরিবেশন করুন। কাজে না লাগলে পয়সা ফেরত।

৯. বোতলে বোতলে সুখ
আমি কোকাকোলার এক অন্ধ ভক্ত। প্রেমে পড়ার সময়টুকু বাদ দিলে আমার পঁচিশ বছরের জীবনে একমাত্র আসক্তি হল কোক। নানার বাড়ি বেড়াতে গেলে আমাকে দেখেই পাড়ার মুদির দোকানদার দুই বোতল কোক বের করে ফেলতো। ছয় টাকা বোতল দিয়ে শুরু, আজ এই প্রবাসে পঁয়ষট্টি সেন্ট ক্যান পর্যন্ত গিলে চলছি। চাবি নিয়ে ঘুরবার মত হিম্মত হবার পর থেকেই একটা বটল-ওপেনার থাকতো রিঙে। নেহায়েত আমার মত কুদ্দুস হয়ে না থাকলে কখনো বিয়ারের ক্যান এই ধরনের ওপেনার দিয়ে খুলতে যাবেন না। বিয়ার বস্তুটাই বেহুঁশ করার জন্য। সমুদ্র সৈকতে লোকে জামা-কাপড় ফেলে গেলেও বিয়ারের বোতল নিয়ে যায়। আমি বুঝে পেতাম না, যারা কাপড় ছাড়া সমুদ্রের পাড়ে যায়, তারা কীভাবে খেয়াল করে ওপেনার নিয়ে যায় সাথে করে? কালে জানলাম, বিয়ারের ছিপি খালি হাতে মোচড় দিলেই খুলে যায়। পকেটের ওপেনার বের করে রেখেছি তার পর থেকে। দারু না খেয়েও খেতুর গাল যে কত খেয়েছি, তাই ভাবি। খ্যাৎ, খুব খ্যাৎ।

১০. খেতু খ্যাদাও, দেশ বাঁচাও
যাক, এমনি করে এগুলে মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে যাবে। থাকুক নাহয় এটুকুই। যুগের সাথে সাথে দর্শনের পরিবর্তন দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাওয়া অনেক খেতুর একজন হয়েই নাহয় থেকে গেলাম। সব মানুষ আধুনিক হলে কি আধুনিকের মর্যাদা থাকে? নাহয় আমাকে দেখেই সবাই জানলো খেতু হবার জ্বালা কত। কীই বা ক্ষতি শখের বশে জগাখিচুড়ি গিটারিস্ট না হলে? কীই বা আসে-যায় ব্রেসিঙের যন্ত্রণায় যাবার বদলে দুটো বাঁকা দাঁত নিয়ে বসবাস করলে? জগতের তো কোন ক্ষতি হচ্ছে না আমি স্রেফ একটা মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে। আমি নাহয় শাহরুখের মত বুক-ফারা জামা না-ই পড়লাম। সাম্প্রতিক ইন্ডিয়ান আইডলের চেয়ে নাহয় সিএনএন-এর অ্যান্ডারসন কুপারকেই বেশি চিনলাম। কে বলেছে বাক্যপ্রতি গোটা চারেক ইংরেজি শব্দ না বলে বাঙ্গালি হওয়া যায় না? আমি শার্ট প্যান্টে গুঁজে পড়লে কার কী?

অপঘাত ও কিছু বানরের কীর্ত্তন

১.
সাদ্দামের দুই পুত্রকে মনে আছে? উদে ও কুসে। আনাড়ি হাতের কসমেটিক সার্জারির পর মোটামুটি ভদ্রস্থ চেহারার এই দুই পশুর মরদেহ দেখতে দেওয়া হয়েছিল মিডিয়াকে। এক ভাইয়ের বুকে লোহিত সাগর তো আরেক ভাইয়ের মুখের উপর দিয়ে রাজধানী এক্সপ্রেস। কাফনের কাপড় পড়ানো অবস্থায়ও মানচিত্রসুলভ বিভিন্ন আঁকিবুকি ছিল তাদের দেহে। একেকটি ক্ষত দেখে নিশ্চিত ভাবে বলে দেওয়া যায় তাদের আহত হবার ধরন ও কারণ।

পত্রিকার রিপোর্টের এক কোণায় ছোট্ট করে লেখা ছিল মৃত্যুর সময় তাদের সাথে থাকা বিভিন্ন জিনিসের তালিকা। একটি করে বন্দুক, সুগন্ধী, ব্যবহৃত কন্ডম, বাড়তি মোজা। জ্বী, আমিও ঝাকি খেয়েছিলাম। কোথায় যেন পড়েছিলাম, একজন মানুষ মৃত্যুকালে তার সাথে কী কী পাওয়া যায়, তা দিয়ে তার সারা জীবনের মানচিত্র খুব সহজে এঁকে ফেলা যায়। অব্যর্থ প্রমাণ পেয়ে গেলাম যেন।

২.
অপঘাতের ক্যাম্পাস হিসেবে ভার্জিনিয়া টেকের বেশ সুনাম হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। এই শরৎ পর্যন্ত পরপর তিন সিমেস্টার ধরে ক্যাম্পাসে কোন না কোন অপঘাতের ঘটনা ঘটলো। আমেরিকার সবচেয়ে নিরাপদ দশটি শহরের একটি হিসেবে বিশেষ গর্ব ব্ল্যাক্সবার্গের। সেখানে আচমকা এমন শনি লাগার কারণ কী কে জানে।

শুরুটা ছিল ২০০৬’এর শরতে। এক পাগলা খুনি জেল ভেঙে পালিয়ে গেল। মনে তার অসীম অশান্তি। শান্তি আর জ্ঞানের আলোর টানেই সম্ভবত সেই ব্যক্তি এসে ঘাপটি মেরে বসে থাকলো ক্যাম্পাসে। একাকিত্ব ঘোচানোর চেষ্টায় আরো কিছু মানুষকে জড়িয়ে ফেললো তার এই প্রয়াসের সাথে। ফলাফল, ক্যাম্পাস লকডাউন করে এই উন্মত্ত সিরিয়াল-কিলারকে খুঁজে বেরানো।

এর পরের ঘটনা জগৎ-বিখ্যাত। সাং-হুই চো নামে এক বিপ্লবী ব্যক্তি সাম্যের বাণিতে আদিষ্ট হয়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিলেন। বড়লোক বাপের বখে যাওয়া ছেলেপুলের বাড়াবাড়ি নিয়ে আমাদের সবার চাপা ক্ষোভ ও হিংসাকে অসামান্য নৈপুন্যের সাথে চো সামনে নিয়ে এলেন। শুইয়ে দিলেন ৩১ জনকে। কিছু সুন্দরীর ছবি দেখে মনে হচ্ছিল, বেকুবটা শোয়াতেও জানে না! হয়তো বাচ্চা মেয়েদের দিকে ব্যারেল-বুলেট তাক করার খুব আক্ষরিক অর্থ করে ফেলেছিল বেচারা। রাগলেও কিছু করার নেই। আমার অচল মস্তিষ্ক এগুলোই করে দিনভর। পরেরটুকুর জন্য নাহয় শক্তি জমিয়ে রাখুন।

৩.
তৃতীয় ঘটনা এই শরতেরই। আমার দুইটা হোমওয়ার্ক এক সপ্তাহের ওভারডিউ। দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে ফিফা ২০০৮ খেলছিলাম তুমুল উৎসাহে। এরই মধ্যে আমার রুমমেট ফোন করলো। ব্রাদার, সুইসাইড কেইস। লাফ দিসে নাকি লাউঞ্জ থেকে। চ্যাটকায় গেসে কিনা জানি না। দেখতে যাবা?

মুহূর্তের মধ্যে ঘরের সবাই যে যেই অবস্থায় আছি দৌঁড়ে বের হলাম। সাকুল্যে ৫ জন। তাজ্জব ব্যাপার হল, প্রত্যেকেই কোন না কোন কারণে দরজা থেকে ফিরে ঘরে গিয়েছিলাম। মৃত্যুর সাথে সাক্ষাৎ বলে কথা। জরুরী কিছু কি ফেলে গেলে চলে? আমরা পঞ্চ-বান্দর আমাদের যক্ষের ধন সমেত সেই ডর্মের কাছে গেলাম মিনিট পাঁচেকের মাঝেই। জানতে পারলাম যে মৃত্যুর পেছনে আত্মহত্যা, নাকি অসাবধানতা দায়ী তা নিশ্চিত করে জানার উপায় নেই এই মুহূর্তে। তবে বিশেষ কসরত ছাড়া ঐ লাউঞ্জ দিয়ে বের হওয়া দুষ্কর। জানলাম যে ১৯৯০’এর দশকে এরকম বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল। সম্ভবত একটি বছরে তিন জন ছাত্র এক কাতারে না হলেও কাছাকাছি সময়ে ঝাপ দিয়েছিল।

৪.
মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে পরের দিনগুলোয় পত্রিকা মারফত জেনেছিলাম কিছু। অপঘাতের হ্যাটট্রিক নিয়ে বেশ গর্বিত ছিলাম সবাই। এর মাঝেই খেয়াল হল বানরকূলের শেষ লাফগুলোর কথা। যদি ঠিক সেই অবস্থায় মারা যেতাম আমরা, তাহলে অচেনা কারো চোখে আমাদের জীবনের মানচিত্র কেমন হত?

দামাল ক্রিকেটার হাইব্যা মৃত্যুর পূর্বে বান্ধবীর কাছে তিন হাত ঘুরিয়ে একটি সাংকেতিক বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ঘরে ফিরে সাপ্লাই-ডিমান্ডের অন্যায্য স্থিতির কারণে বঞ্চিত হবার ভয়ে তিনি ভনেজের একটি ফোন সেট হাতে নিয়ে বের হয়ে আসেন। তার পরণে ছিল থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট ও স্যান্ডো গেঞ্জি। ইয়ো! লাশদর্শনের পর আড়ষ্ট হয়ে যাবার ভয়ে তিনি কিছু ব্যাক্তিগত কাজ দ্রুত সেরে নেন।

কুদ্দুস বের হবার আগে বক্সিং গ্লাভস না নিলেও চুল আঁচড়াতে ভোলেননি। উপরে উপরে কোলেস্টরেলের দোহাই দিলেও তিনি সম্ভবত ভিন্নতর কোন কারণে মাত্র চার মাসে ৫০ পাউন্ড ওজন কমানোর মত মহাযজ্ঞে মেতেছিলেন। বহুকাল পর ডর্মের সামনে যাওয়া এবং সেখানে ভেকেটেড অবস্থায় অপ্রস্তুত বসনে সজ্জিতা নারী হয়তো তার এই শেষ প্রসাধনে উপসর্গের ভূমিকা পালন করে থাকবে। স্বাভাবিক অবস্থায় স্যান্ডেলনির্ভর কুদ্দুসকে এদিন কেডস পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়।

অ্যাজমারোগী মোখলেছ প্রথমাবস্থায় উৎসাহের আতিসজ্যে জুতা-স্যান্ডেল ছাড়াই রওনা দিয়ে ফেলেছিলেন। পরবর্তীতে তাকে স্তূপ থেকে জুতা ও জ্যাকেট বের করতে দেখা যায়। এসময় তার কাছে ইনহেলার না থাকলেও একটি ফোন সেট ছিল। ধারণা করা যায় যে তিনিও বিশেষ কারণে দেশের সাথে প্রচুর যোগাযোগ বহাল রাখেন। তার হাতে একটি লাঠি পাওয়া গেলেও কোন উল্লেখযোগ্য পূর্ব-বেদনা দেখা যায়নি।

গাঞ্জুট্টির সাথে গাড়ির চাবি থাকলেও মোবাইল ফোন কিংবা ওয়ালেট ছিল না। তার ঊর্ধাঙ্গে ছিল একটি সাদা গেঞ্জি, আর নিম্নাঙ্গে ছিল একটি লাল বক্সার। গালে অনিঃশেষ দাড়ি থাকলেও তার পায়ে ছিল লেডিস চপ্পল। গাড়ির চাবির সাথে রিট্র্যাক্টেবল লাইটার থেকে ধারণা করা যায় তিনি বায়ুর পূজারি। তার হাতে একটি হ্যান্ডিক্যাম ছিল যাতে বিভিন্ন পার্টিতে তোলা নিরুদ্দেশ ভিডিওর সম্ভার মেলে।

বিল্লাল তাঁর লাল-নীল স্কোয়্যারবিশিষ্ট শার্টটি পরিধান করে সারতে পারেননি। রান্নার গন্ধের কাছে আস্ত একটি জ্যাকেট সঁপে দিলেও তিনি এই শার্টটিকে আগলে রেখেছিলেন। বাম পায়ে সজোরে বেঁধে রাখা পট্টি বিশেষ ইঙ্গিত করে যে তিনি মৃত্যুর কিছুকাল আগে পায়ে আহত হয়েছিলেন। খাবার সময় তিনি প্রচুর পানি পান করতেন, নয়তো পাহারাদার পুলিশ-কন্যা তাঁকে ব্যাপক মাত্রায় আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করেছিলেন। তার পকেটে অস্বাভাবিক পরিমাণ কিটক্যাট পাওয়া যায়। তাঁর ডান হাতের কিছু আঙুল অতিব্যবহারে বেঁকে থাকলেও বাম হাতে একটি পাঠ্যবই ও একটি কলম ছিল। মৃত্যুকালে তিনি ছোট ডায়েরি, কলম, চ্যাপস্টিক, রুমাল, ওয়ালেট, ফোন, চশমা, নকল দাঁত সহ অনেক হাবিজাবি বহন করলেও কোন টাকাপয়সা বহন করছিলেন না।

চ্যাটকানো মগজের অনুপস্থিতি, লাশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, এবং ঘটনাস্থলের বেশ অনেক গজের মধ্যে কাউকে ঢুকতে না দেওয়া সহ বিবিধ কারণে প্রাথমিক উদ্যোক্তা লিয়াকত তাঁর বান্ধবীর হোমওয়ার্কে পুনরায় মনোনিবেশ করাই উত্তম বলে বিবেচনা করেন।

ওওওওওবামা!

ইতিহাসটা শেষ পর্যন্ত হয়েই গেল।

স্বপ্নের রাজনীতি পৃথিবীতে বিরল না। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান বিখ্যাত 'মর্নিং ইন অ্যামেরিকা'য় স্বপ্ন দেখেছেন ছোট্ট পাহাড়ের উপর সুন্দর সূর্যোদয়ের। অন্য প্রান্তে বাংলাদেশের পতিত স্বৈরাচার স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে পীরের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। বিপরীতে আশার রাজনীতি বিরল। প্রতিশ্রুতির রাজনীতি থাকলেও আশার রাজনীতি ছিল না।

পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কম রাজনীতিকই স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আদর্শের কথা বলে গেছেন। প্রতিরোধ ছিল, প্ররোচনা ছিল, প্রলোভন ছিল। রাজনীতির প্রান্তরে বহু রাজনীতিক সত্ত্বা বিসর্জন দিয়ে গেছেন। এব্রাহাম লিংকনের মত একজন মানুষ বদলে দিতে পেরেছিলেন একটা প্রজন্ম। বহুকাল পর ইলিনয় আবারো পৃথিবীর রাষ্ট্রপতির আসনের জন্য কাউকে পাঠাল। প্রথম ঝাড়ুদারের মত করেই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ জিতলেন প্রাইমারি ইলেকশন।

যুদ্ধবাজি, টাকার খেলা, আর হুমকি-ধামকির মুখে আদর্শ আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা যায় আজও। তৃণমূল পর্যায়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষগুলোর নগণ্য অনুদানের টাকায় গড়ে তোলা ক্যাম্পেইনে সঙ্গী ছিল শুধু আদর্শটুকুই। ভাবতে অবাক লাগে। এযুগেও সম্ভব?

২০০২ সালে ইরাক যুদ্ধে যাবার বিপক্ষে পথে নামা একজন রাজনীতিক আজকে প্রাইমারি জিতেছেন।

বিনা প্রশ্নে শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে ইরান-কিউবা-উত্তর কোরিয়া সহ সব দেশের সাথে খোলা মনে কথা বলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সবার কাছে নিন্দিত হবার পরেও নিজের মতে অটল থেকেও বারাক ওবামা প্রাইমারি জিতেছেন।

মাঝের নাম 'হুসেইন', বাবা মুসলিম, শেষনাম ওসামা'র কাছাকাছি, ইন্দোনেশিয়ায় শৈশব কাটানো, হাওয়াইয়ে জন্ম নেওয়া একজন ব্যক্তি ফক্স নিউজের নিরন্তর টিটকারি উতরে এগিয়ে চলা রাজনীতিক প্রাইমারি জিতেছেন।

সবদিক থেকে নীতিবান ও সহিষ্ণু থাকার পরও ডেমোক্রেটিক পার্টির সমগ্র এস্টাবলিশমেন্টের বিষোদ্গার সহ্য করে শীর্ষে বারাক ওবামা। বিল ক্লিনটনের মত কাল্ট নেতার কটাক্ষও পারেনি সাধারন মানুষের পছন্দকে নাড়াতে। কৈশরে গাঁজা খাওয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করার পরেও না।

পৃথিবীর মানুষের সমালোচনাগুলো অবশেষে পথ খুঁজে পাচ্ছে আমেরিকার শাসনকেন্দ্রে। বলা হচ্ছে বারাক ওবামা আমেরিকাকে পৃথিবীর উপহার। বলা হচ্ছে সাম্প্রতিক ইতিহাসে পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন তোলার মত সবচেয়ে বড় ঘটনা এই প্রাইমারি ইলেকশন।

২০০৪ সালে জন কেরির ইলেকশনের সময় দেওয়া বিখ্যাত ভাষনে বলা 'দেয়ার ইজ নো রেড আমেরিকা, দেয়ার ইজ নো ব্লু আমেরিকা, দেয়ার ইজ ওনলি পার্পল আমেরিকা'র আহবান নিয়েও জেতা যায়।

অবিশ্বাস্য। অকল্পনীয়। লোমহর্ষক। আশাতীত।

মৌনচিত্র ৪

‘বি দাউ মাই ভিশন, ও লর্ড অফ মাই হার্ট, বি অল এলস বাট নট টু মি, সেইভ দ্যাট দাউ আর্ট...’

আলোটা সুন্দর। কেমন যেন অনধিকার চর্চা হয়ে যাচ্ছে না? কিছু না ভাবলেই হল। হোক দুপুর, তবু রবিবার তো। লোক থাকতে পারে। এত বেশি পাগল হওয়াও কি ঠিক? একদল দসাসই মুসলমান এভাবে গীর্জায় ঢুকে পড়লে পুলিশ ডাকে যদি? গানটা বাড়াবাড়ি রকম সুন্দর। পথ থেকে এমন গান শোনা গেলে যে-কেউ একটু থামতে বাধ্য। যাক, আসলাম যখন, শুনেই যাই আরেকটু। ভেতরে যাব কোন দিক দিয়ে? এতই কি বিধর্মী হয়ে গেলাম যে ভিন্ন বিধাতার অতিথি হয়েও ঢুকতে পারবো না? ওহ, এইতো দরজা!

‘বি দাউ মাই বেস্ট থট, বাই ডে অর বাই নাইট, বোথ ওয়েইকিং অর স্লিপিং, দাই প্রেসেন্স মাই লাইট...’

গানটা চেনা চেনা লাগছে কেমন যেন। হিম্‌ন তো কোনদিন শুনেছি বলে মনে পড়ে না। ছোটবেলায়? নাহ্‌। বাইরে এসেও তো শুনেছি বলে মনে পড়ে না। এক্সাম উইকে মাঝেমধ্যে মুফতে খেতে যেতাম চার্চে, কিন্তু সেখানে তো ডিয়ার লর্ড অ্যান্ড সেভিয়ার জিসাস ক্রাইস্ট ছাড়া কিছু শুনিনি। এটা আইরিশ হিম্‌ন। এটাও তো আমার জানার কথা না। বিদেশি কারো গাড়িতে? কোন রেস্তোঁরায়? কোন ফিউনেরালে? আহ্‌, ডায়ানার ফিউনেরালে। না, ওটায় তো এল্টন জনের গান ছাড়া তেমন কিছু ছিল না। দশ বছর পূর্তিতে! বি দাউ মাই ভিশন! আইরিশ হিম্‌ন!

‘বি দাউ মাই গ্রেট ফাদার, অ্যান্ড আই দাই ট্রু সান, বি দাউ ইন মি ডুয়েলিং, অ্যান্ড আই উইথ দি ওয়ান...’

কুফরি হয়ে যাচ্ছে নাতো? পরের ঘরে গিয়ে কিছু ভাল লেগে যাওয়া কি অন্যায়? উপাসনা করছি না, কিন্তু ভাল লাগছে। কেমন যেন শান্তি। কোন অস্থিরতা নেই, কোন দুশ্চিন্তা নেই। মন চাইছে শুধু শুয়ে থাকি লম্বা বেঞ্চগুলোয়। মুক্তি কি অনুশাসনে, নাকি অনুরণনে? কে জানে। হবে কিছু একটা। গীর্জায় এই প্রথম। এর আগে কখনো নাটকে দেখেছি কাঁটার মুকুট মাথায় যীশুর ছবি, কখনো স্থাপত্যকৌশলের বইয়ে চেয়ে দেখেছি বিভিন্ন যুগের নির্মাণশৈলী, কখনো ইতিহাসের বইয়ে পড়েছি পেটের দায়ে মহামনীষীদের ভ্যাটিকানের ফরমায়েশমত শিল্প তৈরির কথা। কেন নিজে থেকে ঘুরে দেখলাম না কখনো? সব স্রষ্টাই তো ব্যাপক, মহান। মন ভুলে যাবার ভয়ে কেন মন ভরাবো না?

‘রিচেস আই হিড নট, নর ম্যান’স এম্পটি প্রেইজ, বি দাউ মাইন ইনহেরিটেন্স, নাউ অ্যান্ড অলওয়েইজ...’

বিয়ের মন্ত্রগুলো এত অদ্ভূত সুন্দর হয় কেন? কেন যেন মনে হচ্ছে, মন্ত্রের সৌন্দর্য আনন্দে, বাণিতে না। এত খুশি কীভাবে হয় মানুষ? সাথে তো ক্যামেরা আছে, ছবি তোলা যাবে কিনা কে জানে। কিছু মনে করবে না হয়তো। আচ্ছা, গীর্জায় কি জুতা নিয়ে ঢোকা যায়? দেখে নিলাম নাতো। অজান্তে অবমাননা হয়ে থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। অসম্ভব উষ্ণ হলদে আলো। লাল-নীল কাঁচের মধ্যে দিয়ে কেমন করে যেন ঠিকরে আসছে রশ্মিগুলো। পরিপাটি করে গোছানো, ছবির মত সুন্দর। ইচ্ছে করছে না কেন যেন ছবি তুলতে। এই স্পর্শ, এই হাসি, এই বিশ্বাস, এই আশার কাছে সব সৌন্দর্য মলিন। কোন জাগতিক শক্তির সাধ্য নেই এই মুহূর্তকে ফ্রেমে বেঁধে রাখে। শুধু মনেই গেঁথে থাকুক। পবিত্র, স্নিগ্ধ, প্রাঞ্জল, জীবন্ত, মৌন।

‘হাই কিং অফ হেভেন, দাউ হেভেন’স ব্রাইট সান, ও গ্রান্ট মি ইটস জয়জ আফটার ভিকট্রি ইজ ওয়ান, গ্রেট হার্ট অফ মাই ওউন হার্ট, হোয়াটেভার বিফল, স্টিল বি দাউ মাই ভিশন ও রুলার অফ অল।’

জুম্মার নামায ও অখন্ড পাকিস্তানের শেষ দিনগুলি

বহুদিন পর জুম্মায় যাওয়া হল আজকে। জীবনকে সুন্দর, স্বাভাবিক, ও নির্ভার রাখতে বিশ্বাসের ভূমিকা আমি কিঞ্চিত অনিচ্ছার সাথে হলেও মেনে নেই। আঘাত, হতাশা, আর ব্যর্থতাগুলো অন্যের মর্জির উপর চাপিয়ে নিজের মত জীবন চালাতে পারা নিঃসন্দেহে যেকোন সচেতন মানুষের পরম আরাধ্য। ধর্ম যার যা-ই হোক না কেন, প্রতিটি মানুষই ধার্মিক। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লে দুষবার মত কাউকে খুঁজে বেরানোতে ধর্ম মিশে আছে। বিয়ান রাতে ঘুম ভেঙে গেলে বিরক্তির ঝাপটা কারো উপর দিয়ে চালাতে চাওয়া ধর্মের শিক্ষা। অন্ধকারে হাতরে পথ চলতে গেলে প্রতিটি অবয়বের মাঝে সুরাসুরের প্রতিভূ তৈরি করে নেওয়াও ধর্মেরই উপজাত অনুভূতি। জীবনের স্তরে স্তরে তাই সব মানুষই ধার্মিকভাবে কোন না কোন কাজ করে নিজের ক্ষুদ্রতাগুলো ভুলে থাকতে। আমিও ব্যাতিক্রম নই। কেউ হরেক রঙের তিলক দেয়, কেউ সেজদা দিতে দিতে কপালে তিলক এঁকে ফেলে, কেউ হুমায়ূনীয় কায়দায় কাগজ ছেড়ে, কেউ বৌ পেটায়, কেউ গাছের সাথে কথা বলে, কেউ গুনগুন করে। আমি ঘুমাই।

শীবের গীত ছেড়ে এবার ধান ভানায় ফিরি। ক্লাস, কাজ, ঘুম, ইত্যাদির আবেদন অগ্রাহ্য করে সপ্তাহ তিনেক পর আবারো জুম্মায় সামিল হলাম। শীতের ছুটিতে অনেকেই শহরে নেই। মেক-শিফট খতিবের খুতবা শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে ঝিমাচ্ছিলাম। চলছিল কথা ধর্ম নিয়ে। কীভাবে যেন মাঝে ঢুকে গেল ভারতে গরু-পূজা। এর মাঝেই গোবরের ইংরেজি ভুলে ‘আউটকাম অফ দ্য কাউ’ বলে নৌকা ভাসালেন খতিব সাহেব। এমন সময় পাশ থেকে এক বড় ভাই এগিয়ে দিলেন একটি বই। আমেরিকার মসজিদে বাংলা বই দেখে অবাক এবং খুশি হলাম বেশ। লেখক জি, ডব্লিউ, চৌধুরী নামক এক ব্যক্তি। কভার ফ্ল্যাপের ভেতরে প্রথম বাক্যেই পুরো বইটির মেজাজ বর্ণিত -- ‘কেন পাকিস্তান একটি জাতীয় সত্ত্বা অর্জনে ব্যর্থ হল?’ এই ঘরানার বই নিয়ে আমার আগ্রহে কমতি নেই কোনদিন। ইতিহাসের সুদীর্ঘ পরিসরে মানবমনের ভাল-মন্দ সব রকম প্রবৃত্তিই প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের মত এত কম সময়ে নয়। শুরু করলাম পড়া।

সামনের ফ্ল্যাপে সরাসরিই দাবি করা হয়েছে যে ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও আধুনিক যুগে এই দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি শেখ মুজিব ও জুলফিকার আলি ভুট্টোর সন্দেহজনক ভূমিকার জন্য। পড়ে অবাক বা আহত হইনি। সামরিক সরকারের সাবেক মন্ত্রীর দৃষ্টিকোণ থেকে দাবিটা অযৌক্তিক নয় মোটেও। কিন্তু কিছু পরেই বের হতে থাকলো আসল রূপ। আইয়ুবীয় গণতন্ত্রের বুনিয়াদ গঠনে বাঙালিদের কোন ভূমিকা না থাকার কারণেই এই বিভাজন। কৌতূহল থেকে পড়ার গতি বেড়ে গেল অনেক।

বক্তব্যগুলো খুব প্রচলিত প্রোপাগান্ডা। শেখ মুজিবকে সরাসরি দেশদ্রোহী, দালাল, আর বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে ডাকা হয়েছে। না, এতেও আমার কোন খেদ নেই। শেষের ফ্ল্যাপের একটি বাক্যে বইটির সারমর্মও নিহিত ছিল -- ‘ইহা কি বাংগালীদের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী-দাওয়া মেটাতে অপর্যাপ্ত ছিল, নাকি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংগালীরা ইতিমধ্যেই স্বাধীন রাষ্ট্রের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল?’। খুনে, বর্বর, মনুষ্যকূলে-অপাঙ্কতেয় জানোয়ারদের সাথে আলাপচারিতার দায়ে আমি এত ত্যাগের পরও শেখ মুজিবের উপর অভিমান করি। বুকটা বরং হালকা হচ্ছিল। বহু আগে থেকেই ভারতের সাথে যোগাযোগ, চীন-পাকিস্তান-আমেরিকা আঁতাত সম্পর্কে সজাগ করে দেওয়া, বাড়াবাড়ি রকম দেরি ও ঝামেলা হবার আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য প্রত্যাশা না করা, ইত্যাদি ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতিগুলো অনেকটাই মুছে দিল সেই জ্বালা।

খতিব সাহেব গরুর পিন্ডি চটকাতে একটু বেশিই ব্যস্ত ছিলেন। ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে নামাযের সময় পেরিয়ে এগিয়ে চলছে। ঢুকে পড়লাম বইয়ের ভেতর। হাইলাইটার দিয়ে দাগিয়ে দাগিয়ে পড়া। দেখে ভালই লাগলো। ভিন্ন মতের বইগুলো খুঁটিয়েই পড়া উচিত। এই ঘি বেশিক্ষণ সইলো না। ভেবেছিলাম কোন পাগলা জেনারেলের সিএসপি সাগরেদের আত্মজীবনী স্রেফ অনুবাদ করেছেন কেউ। ভেতরে অনুবাদকের কথা পড়ে সেই ভুলের পাহাড় ধূলায় মিশে গেল। শুরুতে বলা হল পাকিস্তান সৃষ্টিতে পূর্ব পাকিস্তানী তথা বাঙালি মুসলমানদের অধিকতর ভূমিকা রাখার কথা। তারপর শুরু হল ধোলাই। একজন ‘সাধারণ বাংলাদেশী’ নাকি প্রোপাগান্ডার চাতুরিতে এটুকুই জানেন যে ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়া এবং ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চের ‘পৈশাচিক আক্রমণের ফলেই’ বাংলাদেশের জনগণকে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে হয়েছিল। মূল বইটি পড়ে অনুবাদকের উপলব্ধি হয়েছে যে ‘বর্তমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্বন্ধে যে লেখকই যাই লিখুন না কেন তা ভরপুর থাকে প্রবল ভাবাবেগ রসে’। আরো কিছুদূর এগিয়ে তিনি খোশমেজাজে জানান দিলেন যে ‘লেখকের এ বইটি পড়ে [তাঁর] মনের অনেক প্রশ্নেরই সমাধান হয়েছে’। আমিও তৎক্ষণাৎ নিজের মনে গোলাম ওয়াহিদ চৌধুরী সাহেবের কোন এক নিকটাত্মীয়ার উপপতি থেকে খুশি মনে সিদ্দীক সালাম সাহেবের অন্ত্র-বিশেষ আলোকিত করতে লেগে গেলাম।

শেষ পর্যন্ত অনুবাদক সবক দিলেন যে ‘ঐতিহাসিক ঘটনাকে সত্যতার সাথেই জানতে হয় তা তিক্ত হলেও’। আরো জানালেন যে তিনি পাঠক হিসেবে তাঁর ‘তৃষ্ণা’ নিবৃত্ত করতে সক্ষম হয়েছেন এই বই পড়ে। শেষ ডিসেম্বরে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে আমি মনে মনে বললাম শুধু, তোর তৃষ্ণা কীসে মিটেছে তা গলা থেকে বের করে দেখ্‌, ছাগল।

বইটি ১৯৮৯ সালে লিখিত। ‘হক কথা প্রকাশনী’ নামক কোন এক আস্তাকূড় থেকে প্রকাশিত ১৯৯১ এর জানুয়ারিতে। কোন এক সচেতন বাঙালি কালের প্ররোচনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এক সাজানো গৃহযুদ্ধের ইতিহাস উন্মোচিত করেছেন। হাজার রঙে দাগিয়ে এই বই পড়েছেন আরেক সহৃদয় বাঙালি। বিশ্বাসের গতি-জড়তায় যদি এর কিছুমাত্রও গিলে ফেলি, সেই আশায় পাঠ শেষে অত্যন্ত উদার ভাবে তা গছিয়ে রেখে গেছেন মসজিদের লাইব্রেরিতে।

বইটি জ্যাকেটের ভেতরে করে নিয়ে এসেছি। খোদার ঘরে মনে মনে বলাৎকার করেছি। তাও আবার বেগানা পুরুষ মানুষকে ভেবে। দেবার জায়গা থেকে চুরি করে ভেগেছি। বিনিময়ে যেই নরক-যন্ত্রণা কপালে জুটালাম, তা অমৃত-সমান হবে; যদি পরবর্তীবার কোন বুকশেলফের সামনে গেলে আপনারাও খুঁজে দেখেন এমনি করে ঘাপটি মেরে থাকা কোন বই আছে কিনা।

প্রবাসের কথোপকথন ১১

“এত দেরি যে? ফোন পাসনি নাকি?”
- পেয়েছিলাম, কিন্তু একেক জন একেক জায়গায় ছিলাম। এক গাড়িতে আসলাম দেখে একটু সময় লেগে গেল। তার উপর ডাউনটাউনে ফায়ার সার্ভিসের দুইটা ট্রাক রাস্তা বন্ধ করে গান গাচ্ছে। ঘুরে আসতে হল অনেকটা পথ। এখনো কি ওটি-তে আছেন, নাকি বের হয়েছেন?

“ভাই-ভাবি দু’জনাই কেবিনে এখন। ভাইয়ের চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না, আর ভাবি খুব শকড মনে হচ্ছে।”
- স্বাভাবিক। অ্যাক্সিডেন্ট জিনিসটা একটু আপসেটিং এমনিতেই। তার উপর এটাই তো বোধহয় প্রথমবার। ড্রাইভিং শিখতে গিয়ে হয়েছে শুনলাম অ্যাক্সিডেন্ট?

“হ্যাঁ। ভাবি টার্ন নেওয়ার সময় নাকি ভাই বকছিলেন। ওতে নার্ভাস হয়ে গ্যাসে পা পড়ে গেছে। গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা খেয়েছে একটা গাছে। দু’জনের কারোই জ্ঞান ছিল না। পুলিশের গাড়ি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখে ৯-১-১ কল করেছে।”
- আউচ। আগলি অ্যাক্সিডেন্ট। তো আপনারা খবর পেলেন কীভাবে?

“পুলিশ ওনাদের বাড়ি গিয়েছিল। বাচ্চারা আমাদের ফোন করে দিলো, তখন পুলিশের কাছে শুনলাম।”
- বাসায় বড় কেউ ছিল না? সে কী কথা, ভাইকে কাজ থেকে আনতে ভাবি যাবেন, ভাল কথা, কিন্তু বাচ্চাদের ঘরে রেখে যাবেন কেন? আপনার বাচ্চাও ছিল? আপনিও কীভাবে রেখে গেলেন গিয়ে?

“আমি তো জানি না যে উনি বাইরে যাবেন। আমি নিজেই ছিলাম হাসপাতালে। ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম। ডাক্তার আমার অবস্থা দেখে ধরে-বেঁধে ভর্তি করিয়ে দিল। এর মধ্যে এই হাঙ্গামা। এই যে দেখো, স্যালাইন ধরে ধরে ঘুরছি। পুলিশ নাকি জিজ্ঞেস করেছিল বাসায় বড় কেউ নেই নাকি। তখন একজন বলে ফেলেছিল যে প্রায়ই এভাবে রেখে চলে যায় বাইরে।”
- পুলিশ এটা নোট করে নিয়ে গেছে? তাহলে তো সমস্যা হবে পরে অনেক। না, শেরিফের মর্জির উপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কিছু করার নেই এই মুহূর্তে। কোন যুক্তি দিয়েই এটা মানানো যাবে না। তের বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের একা রেখে গেলে বাচ্চার কাস্টডিই তো নিয়ে নেবে পুলিশ। সবচেয়ে বড়টা তো মনে হয় নয় বছরের ছিল। ঝামেলা হয়ে গেল। চিকিৎসার ধকল কাটলেই এই ধাক্কাটা আসবে। ওনাদের কিছু বলেননি তো এখনো, নাকি?

“নাহ, মাথা খারাপ? এমনিতেই তো বেশ নাজুক অবস্থা। অ্যাক্সিডেন্ট তেমন মেজর ছিল না। গাছে বাড়ি খেলেও মূল সমস্যা হয়েছে এয়ারব্যাগে। ওটার প্রেশারে মুখের বিভিন্ন জায়গায় ফেটে গেছে। ভাইয়ের তো মুখ-ঠোঁট ফেটে গেছে অনেকটা। ভাবির চেহারা দেখেও চেনার উপায় নেই। অয়েন্টমেন্ট দিয়ে রেখেছে। ভাই একটু হাঁটাহাঁটি করতে পারেন, তবে ভাবি বেডে।”
- একটু শেকেন-আপ হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। পুরো শহরই তো দেখি চলে এসেছে দেখতে। কী অদ্ভুত না এই ব্যাপারটা? দেশে একবার রাস্তার পাড়ে একটা লোককে খুলি-ফাটা অবস্থা পরে থাকতে দেখেছিলাম। নির্বিকার ভাবে পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেছিলাম। অথচ সাপের খেলা দেখতে দাঁড়িয়ে যেতাম যত্রতত্র।

“বিদেশের বাড়িতে তো স্বদেশী মানেই আত্মীয়। আমরা একজন আরেকজনের দুঃখ-কষ্টে পাশে না দাঁড়ালে তো চলে না। না রে, ভাবি তো বেশ কিছুদিন ধরেই চালান। খুব একটা আনাড়ি ড্রাইভার না। নতুন শিখছিলেন আর কি। এখনো ফুল লাইসেন্স নেননি। কিছুদিনের মধ্যেই নিতে যাবার কথা। এখন তো আর মনে হয় না ও’পথে পা বাড়াবেন।”
- ভাই বকছিলেন বললেন। কী নিয়ে বকছিলেন?

“টার্ন নেওয়ার সময় এক হাতের উপর দিয়ে আরেক হাত আনা না কী নিয়ে যেন বকছিলেন। আচ্ছা গাড়িটা ঘুরলেই তো হল, নাকি? এর মধ্যে এত ঝক্কি করা কেন?”
- এবার বুঝেছি। ভাইয়ের জায়গায় আমি থাকলে আমিও বলতাম ওটা নিয়ে। মেয়েদের শেখাতে গেলে এই সমস্যাটা হয় প্রায়ই। টার্ন করার সময় এক হাতে হুইলটা ঘুরিয়ে অন্য হাতে ওটা টেনে আনলে কন্ট্রোল বেশি থাকে। বিশেষ করে হাইস্পিডে। ছেলেরা এক টানে এই কাজটা করে, মেয়েরা বেবি-স্টেপস নিয়ে একটু একটু করে হুইল ঘোরায়। রাস্তার সব গাড়ি তো আর এক তালে চলে না। আচমকা হর্ন খেলে তখন নার্ভাস হয়ে যাওয়ার ভয় আছে। এই গলদটা গোড়ায় না শুধরালে পরে সমস্যা হয়।

“তুইও? তোদের সমস্যাটা কী বলতো? ড্রাইভিংয়ের সময় এভাবে একটা মানুষকে ধমকের উপর রাখলে সে চালাবে কীভাবে?”
- ধমক আলাদা ব্যাপার। আমি টেকনিকের কথা বলছিলাম। ধমকাধমকি হয় বরের কাছে ড্রাইভিং শিখতে গেলে। এজন্য আজকাল মেয়েরা অন্য কারো কাছে শেখে ড্রাইভিং। এক আন্টির কথা জানি যিনি রাস্তার মাঝে নেমে গিয়ে বলেছিলেন যে ড্রাইভিং শিখলে সংসার টিকবে না, এর চেয়ে উনি টাকা দিয়ে শিখে নেবেন বরং। শেষতক তাই করলেন।

“একদম ঠিক কাজ। এইটাই দরকার। হাসব্যান্ডের কাছে কিছু শেখা মানেই ঘরে অশান্তি। কত আশা নিয়ে শিখতে যাই, কিন্তু বকাঝকার চোটে পুরো দিনটাই মাটি হয়ে যায়। সবটাতেই শুধু ভুল ধরা আর বকা দেওয়া। আরে বাবা, আমরা ড্রাইভিং জানি না দেখেই তো শিখতে চেয়েছি, নাকি? এর মধ্যে এত তুলকালাম করার কী দরকার?”
- আপনার রাগের কারণটা বুঝতে পারছি, কিন্তু আমার বৌয়ের সাথে আমিও হয়তো একই কাজ করে বসবো। ব্যাপারটা এত খারাপ ভাবে না দেখলেও চলে। সব বরই চায় তার বৌ সব দিক থেকে পারফেক্ট হোক। এই চিন্তাটা এপ্রিশিয়েট করলে পারেন। তবে হ্যাঁ, আমি নিজেও এখন বলি যেন ভাবি-বৌদিরা বরের বদলে আমাদের কাছে শেখেন। লাভের মধ্যে আমরা কিছু বাড়তি খানা-পিনা পাই, আপনাদেরও বকাঝকা শুনতে হয় না।

“এই দিকে আজমীর সবচেয়ে ভাল। ওর গাড়িতে শেখার সময় অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেলেও ও খুব শান্ত থাকে। একবার তো এক বৌদি রাস্তা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আরেকজন তো পার্কিং লটেই আরেক গাড়িতে মেরে দিলেন। তবুও ও একদম শান্ত ছিল।”
- শয়তানের নাম নিতেই হাজির! জ্বী, পরে কথা হবে। আমি ওদিকে যাই। কী হে বান্দা, তুমি তো দেখি বেশ পপুলার ইন্সট্রাক্টর। সবাই তোমার শেখানোর নাম করে এত। তিন তিনটা রেকলেস ড্রাইভিংয়ের টিকেটের কথা জানে না নাকি কেউ?

“আরে জানে, জানে। আমি তো বলেই দেই, আই ডোন্ট ড্রাইভ ফাস্ট, আই ফ্লাই লো। প্রথম দিকে পুলিশ কোথায় থাকে সেটা না বুঝেই টানতে গিয়ে টিকেট খাইলাম এত্তগুলা। এখন আর ভুল হয় না। শুনবা আমার ড্রাইভিংয়ের গল্প? শুনো তাহলে...”

আয়না

১.
প্রবাস জীবনটা যেন আয়নায় ভরা। দেশে থাকতে কোনদিন খুব একটা আয়না দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বাইরে আসা অবধি তাই ক্ষণে ক্ষণে বিভিন্ন আয়নায় নিজেকে দেখার বিব্রতকর অভিজ্ঞতার সাথে খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করে চলেছি। দেশের আয়নাগুলোর ধরন ও অবস্থান আগেই জানা থাকতো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালে বেহায়া সিঁথি, টয়লেটে গেলে উঠতি ব্রন, টার্মের পর হাতে পাওয়া রিপোর্ট কার্ড, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার পর বাবার ‘শান্তি হয়েছে?’, শুক্রবার দুপুরে মাংসের বদলে সবজি দেখে উঠে যাওয়ার সময় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা মায়ের চোখ, তুচ্ছ কারণে গায়ে হাত তোলার পরও কুঁকড়ে থাকা কাজের ছেলেটার পিঠের কুঁজ, তিন টাকা ভাড়ার পথের রিকশা ধরার সময় পাশে দাঁড়ানো দারোয়ান চাচার নিঃশব্দে সরে যাওয়া, এরকম কিছু সহজে-উপেক্ষ আয়না ছিল আশে-পাশে।

প্রতিফলক হরদম মিলতো, আয়না ছিল এরকম অল্প কিছু। সব প্রতিফলনকে মানুষ ‘জাজমেন্টাল’ দৃষ্টিতে দেখে না, সেজন্যই সব প্রতিফলক আয়না না।কে জানে, খেয়াল করলে হয়তো অনেক কিছুই দেখা যেত এই চোখে। প্রবাসে এসে জীবন সীমিত হয়ে গেছে। যাবার জায়গা কম। কথা বলার লোক কম। বাসে চড়লে মন খুলে কথা বলা যায় না, রেস্টুরেন্টে বসলে বেশরমের মত খাওয়া যায় না। অনেক ঝক্কি। অনেক ভেবে চলতে হয়। অনুভূতিগুলো অনেক বেশি তীক্ষ্ণ যেন। নিজেকে উজার করে দেওয়া এত বেশি কঠিন বলে এই চূড়ান্ত বহির্মুখী আমিও আর সবার মত অন্তর্মুখী জীবন যাপন করে চলি। এর উপজাত হিসেবেই যেন চারপাশে এত আয়নার আধিক্য। যে-হারে নিজে অন্যকে বিচার করি, সে-হারে অন্যরা আমাকে বিচার করে হয়তো। হয়তো প্রতিটা দৃষ্টিবিনিময়ই একবার করে আয়না-দর্শন।

মনে পড়ে ২০০৫এর শীতে দেশে যাবার কথা। কুয়েত এয়ারওয়েজে গিয়েছিলাম। মধ্যপ্রাচ্যে যাত্রাবিরতি মানেই স্বজাতি ভাইদের কুলিগিরি করতে দেখা, বিমানবন্দর ঝাড়ামোছা করতে দেখা। অনেকেই সুপারভাইজরের চোখ এড়িয়ে এসে দু’কথা বলে যেতেন। কারো মুখে রাজনীতির কথা, কারো মুখে শোষিত জীবনের যন্ত্রনার কথা, আবার কেউ শুধুই পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন।আমিও এমনি শান্তিতে বসেছিলাম। দেশ সবাইকেই টানে। দেশের মানুষও অনেক বেশি টানে। কেন টানে, তার একটা কারণ সেদিন বুঝেছিলাম। নিজের আলো-হাওয়া-মানুষে কেউ আমার দিকে অনভ্যস্ত চোখে তাকাবে না, ঠিক মত চেনার আগেই আমাকে উপসংহারে পর্যবসিত করবে না। কী অদ্ভুত আরামের ছিল সেই অনুভূতি।

২.
সেই সফরেই আয়না-মুদ্রার অন্য পিঠও দেখেছিলাম। আটলান্টিকের এপার থেকে যাওয়া সব যাত্রীই কমবেশি বিরক্ত হই মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্লেন ভরে ফেলা ‘ফরেনার’ ভাইদের পানি-কম্বল-রশি-বাক্স দেখে। কেমন যেন একটা আভিজাত্য নিয়ে থাকি, চেনা-অচেনার মাঝামাঝি একটা দূরত্ব রেখে মিশি, আদেখলাপনা আর হ্যাংলামোর ভান্ডার থেকে দূরে সরে সরে থাকি। আমরা শিক্ষিত, মার্জিত, শোভন। আমরা গোল্ডের বার আর মোবাইল ফোন কিনি। এভাবেই চলছিল আমারো। উচ্চতর অবস্থান পেলে যা হয় আর কী, একটু পর আমার মনও অতি আরামে জাত্যাভিমানী হয়ে উঠলো। অস্ফুট স্বরে পাশের এক নীল পাসপোর্টধারী সহযাত্রীকে বললাম কিছু লোকের বিচিত্র পোশাকের কথা। চামড়ার প্যান্ট, মেরুন কোট, বেগুনী শার্ট, পাঞ্জাবির সাথে কেডস, কী নেই ডিপার্চার লাউঞ্জে। বড় ভাই নিজেও উচ্চতর মানসিকতার। হু হু করে সায় দিলেন। বাৎচিৎ সেরে কিছু পরে আমরাও হুড়মুড় করে ধাক্কিয়ে প্লেনে উঠলাম। আগে প্লেনে চড়ার অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত করে সাধ্যি কার, বলুন?

হুশ ফিরলো প্লেনে খাবার দেওয়ার সময়। শ্রমিক শ্রেণির এক সহযাত্রী কোমল পানীয় চাইলেন। চকচকে ত্বক, টুকটুকে লাল ঠোঁট, আর মাখনের মত পেট দেখিয়ে হেঁটে বেড়ানো এক বিমানবালা এক শ্রমিককে প্রকাশ্যেই কটাক্ষ করলো ‘ফ্যান্টা’কে ‘পান্টা’ বলায়। না, শুধরে বলার পরও বেচারার গলা ভেজানোর উপায় হয়নি। মুহূর্তে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। পরে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিতও হলাম। সেই সাইকেডেলিক রঙের পোশাক ছিল জীবনের উচ্ছিষ্টসম এই মানুষগুলোর শেষ রক্ষণব্যুহ। জামায় জাত প্রকাশ পেয়ে গেলে কুকুরের মত ব্যবহার করে এদের সাথে আরবগুলো। আমার সামনেই মেটাল ডিটেক্টরের মধ্যে দিয়ে যাবার আগে জুতা খুলতে ভুলে যাওয়ায় এক যাত্রীকে চড় মারতে হাত তুলে ফেলেছিল এক আরব পেয়াদা। যৎসামান্য সঞ্চয়ের টাকা উজাড় করে তাই এদের বেশি দামের পোশাক পরা। যেকোন ছুতায় সমাজের আয়নায় সম্মানীয় হওয়ার অক্ষম প্রয়াস।

রাগের আতিশয্যে পরবর্তী কিছুক্ষণ ধরে সবধরনের সৌন্দর্যের পিপাসু-চিবাসু-লেহসু এই আমি মনের ভেতর অনেক রকম উষ্ণ-আন্তরিক বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেললাম সেই বিমানবালাকে। তাকে পূর্ণ করে দিলাম আমার সকল শূন্য করে। চোখ খুলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেশের লাল আকাশ বিশাল এক আয়না হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল চোখের সামনে। প্রখর আলোয় বুক চিতিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেশকে কুর্ণিশ করছিল শুধু সেই পান্টা ভাইয়েরাই, যারা দশ টাকা আয় করলে সাড়ে নয় টাকা দেশে পাঠিয়ে দেশকে বাঁচায়। অধোবদন হয়ে চোখ ঢাকছিলাম আমরা বাকি সব উচ্চমার্গীয় মীর জাফরেরা।

বিমানবালাকে দেখলাম না কোথাও। মনে হয় গোঙাচ্ছিল কোন কোণায়। কল্পনার দেশপ্রেম যদি আমাকে এত অধিকার দেয় দেশ ও তার মানুষকে বিচার করার, তাহলে আমার ঘাম-ঝরানো প্রতিবাদে বিমানবালা একটু তো ব্যাথা পেতেই পারে। নাহয় সে-ঘাম কল্পনায়ই ঝরল।

মৌনচিত্র ৩

‘অনেক জোরে বাতাস। বানে ভাসায় নিয়া যাইতেসিলো সব। ছোট বইন আমার কোলে আসিলো। আর এই ভাইটা মায়ের কোলে…’

ভাল লাগে না এসব। খবরে দেখার কীই বা আছে আর। ঝড়ে ভাসা মানুষগুলোকে না দেখলে কী এমন ক্ষতি হয়? দেখে কষ্ট বাড়বে অযথা। থাকুক না। ত্রাণের টাকা জোগাড় করতে লেগে গেলেই হল। সকাল থেকে জ্বর, মাথা ব্যাথা। তাড়াতাড়ি কাজের কাজ সারি, খবর তো কতই দেখা যাবে।

‘টাকা কি এখনই যাবে, নাকি কোন ফান্ডে জমা পরে থাকবে? কেয়ারের এমনিতেই ১৫ মিলিয়ন ডলার আছে, এর মধ্যে আমাদের পাঁচ হাজার ডলার শুধু জমা পড়বে। খরচ হতে হতে মানুষ না খেয়েই মরবে আরো কয়েক হাজার। আগে ভোটাভুটি হোক, টাকা কি এখনই পাঠাবো, নাকি আরো টাকা জমিয়ে তারপর।’

যাক, খুঁটিনাটির ফয়সালা হল তাহলে। খাওয়ার পর টাকা তোলা যাবে। ইমেইলে কিছু খোঁজ নেওয়া দরকার আরো। আইডিয়া মন্দ না। জনপ্রতি কত টাকা করে লাগে সেই রকম একটা হিসাব ফ্লাইয়ারে দিতে পারলে ভাল হয়। সাথে ঘর তুলবার টিনের টাকা। সবার তো মাছের ব্যবসা ঐ দিকে। কত করে লাগে জানতে পারলে হত।

‘থ্যাংক ইউ ফর ইওর কোয়েরিজ। লিটল লেস দ্যান ফরটি ল্যাক পিপল আর অ্যাফেকটেড। ফর আ ফ্যামিলি অফ ফাইভ, উই নিড ফিফটিন থাউজ্যান্ড টাকা টু বিল্ড টিন-শেড শ্যাকস। এভরি ফিশারম্যান নিডস অ্যাট লিস্ট ফাইভ থাউজ্যান্ড টাকা টু বিগিন দেয়ার ফিশিং।’

কাল বাদে পরশু ব্ল্যাক ফ্রাইডে। ঘরে ফিরে কী কী কিনবো তার ফর্দ করা দরকার। বেস্ট বাইয়ের ডেস্কটপটা গত দুই বছর ধরতে পারিনি। কেন যে সেবার পেয়েও নিলাম না। কঞ্জুসী না করলেও পারতাম একবারের জন্য। থাক, আফসোস করে লাভ নাই। কপালে না থাকলে ঘি, ঠকঠকাইয়া হবে কী? এবার আগে গিয়ে দাঁড়াবো। আবহাওয়াও বেশ ভাল কিছুদিন ধরে। ঠান্ডা হবে বলছে, একটু কম করে হলেই হয়। এবার সার্কিট সিটিতে অল্প একটু বেশি টাকায় আরো ভাল কম্পিউটার দিচ্ছে। দুই শ’র বদলে দুই শ’ তিরিশ, সেলেরনের বদলে পেন্টিয়াম। ফেলি কী করে? শ’ তিনেকে ল্যাপটপ দিচ্ছে সব মিলিয়ে চারটা।

‘সাঁতরায় উইঠা দেখি বইনডা নাই আমার। খুঁজি অনেক, বইনরে দেখি না…’

এক ঘর মানুষ আমরা, মাত্র এই কয়টা টাকা তুললাম? এত সামর্থ্য আমাদের। এত এত টাকা দিয়ে একেক জন দুইটা-তিনটা করে কিনছি, আর চল্লিশ লাখ নিঃস্ব মানুষের জন্য লিখছি পঁচিশ-ত্রিশ টাকার চেক। কিছু একটা ভুল হচ্ছে কোথাও। কেন দেখতে হল এই নিউজ? কষ্ট দেখতে পাওয়ার কষ্ট তবু সহ্য হত। কষ্ট দেখেও বিকার না হওয়ার কষ্ট কি বিবেকে সয়?

‘মায় কইলো, তুই আমার মাইয়াডারে ফালাইয়া দিলি? আমি কইলাম আমি ফালাই নাই। ধইরা রাখসি, শক্ত কইরা। ঝড়ে লইয়া গেসে। আমার ছোড বইনডারে ঝড়ে লইয়া গেসে আমার হাত থেইকা…’

দেখতে চাই না বোনের মুখ। মুছে না কেন চোখ থেকে? থ্যাংকসগিভিঙের সেলের বদলে দুর্গতদের দিলেও কি এই ময়লা বিবেক পরিষ্কার হবে? কেন প্রথমেই মনে হল না এই কথা? দেখতে চাই না সেই মুখ। সরে না কেন এই ছবি আমার চোখের সামনে থেকে? ধুর…

হারিকেন সিডর -- আর্থিক সাহায্য পাঠানোর লিংক

প্রবাসী অনেক বাঙালি বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে দেশের এই দুর্যোগমুহূর্তে সাহায্য পাঠানোর উপায় জানতে চাইছেন। প্রতিবছর ভার্জিনিয়া টেকের ছাত্রদের উদ্যোগে দেশে আর্থিক ও সামাজিক সাহায্য দেওয়া হয়। টাকা পাঠানোর জন্য এই লিংক অনুসরন করুন।

http://www.bang.org.vt.edu/makhan.html

এই ওয়েবসাইটে PayPal-এ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে টাকা দেবার সুযোগ আছে। টাকা জমা হবে Association for Bangladeshi Students at Virginia Tech-এর অ্যাকাউন্টে। বিশ্বস্ততার প্রশ্নে দ্বিধা না থাকলে টাকা পাঠাতে পারেন।

আন্তর্জাতিক অনেক সাহায্য-সংস্থা থেকেও টাকা নেওয়া হচ্ছে। সকলকে অনুরোধ জানাচ্ছি নিজ নিজ পছন্দের চ্যারিটিতে টাকা জমা দেবার। দেশে টাকা পাঠানোই মুখ্য। আমরা আমাদের সঞ্চিত ফান্ডের টাকা এই মুহূর্তে পাঠাচ্ছি। বাকি টাকা নিয়ে এখানকার ছাত্ররা আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই দেশে যাচ্ছে।

PayPal-এর খাবলে খাওয়া ন্যূনতম ফাইন্যান্স চার্জ বাদ দিয়ে পুরো টাকাই আর্তদের সাহায্যে যাবে। বড় সংস্থার মত জৌলুস বা ওভারহেড খরচ থাকবে না আমাদের কার্যকলাপে। অনুগ্রহ করে এই লিংকটির কথা ছড়িয়ে দিন চেনা মহলে।

জিজ্ঞাস্য থাকলে মন্তব্যে প্রশ্ন রাখুন। সকলকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানাচ্ছি।

ধন্যবাদান্তে,

ইশতিয়াক রউফ
প্রেসিডেন্ট, এবিএস-ভিটি

মৌনচিত্র ২

আমি যেন এই সবুজ জামাটা বিকেলে না দেখি তোমার গায়ে। না, খবরদার কমলা গেঞ্জিটা পড়বা না তাই বলে। নীল শার্ট দিলাম যে, কালো চেক-চেক…’

না, ভাববো না। ঘুমাবো আমি! বাজুক আড়াইটা। জ্বলুক বাতি। উঠবো না। কোন চিন্তা আসতে দেবো না মাথায়। তোমার চিন্তাও না। ছেড়ে দাও, প্লিজ। চলে যাও। আমি অ্যাক্যুস্টিকের টুং-টাং শুনতে শুনতে ঘুমাই। নাম কী এটার? শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না। সত্তরের ঘরের হতেই হবে। আহ, কমিউনিকে। নিউজ? নাহ, শুনি নি আগে। না, ঘুমাবো আমি। দেখবো না কিছু। খুলবো না চোখ। খুঁজবো না লিরিক।

‘শি টেল হিম দ্যাট হি’জ ক্রেইজি। ইয়েস শি’জ সেয়িং লিসেন, বেবি। আই’ম ইয়োর ওয়াইফ। ইয়াহ শি টেল হিম দ্যাট হি’জ ক্রেইজি ফর গ্যাম্বলিং উইথ হিজ লাইফ…’

কিছু শুনছি না আমি। কোন খুঁত ধরছি না। আর ধরি না খুঁত। আর বলে না কেউ স্থির হতে। আর কেউ ভ্রুকূটি করে না শিশুতোষ দুরন্তপনায়। না, আমি কোন মুখ ভেসে আসতে দেবো না। ঘুমাবো আমি। কত রাত ঘুমাই না! না, দেখবো না আমি । উহু, হাসলেও দেখবো না। আমার জন্য হাসলেও না।

‘হি স্টিকস টু হিজ গানস। হি টেকস দ্য রোড অ্যাজ ইট কামস। ইট টেকস দ্য শাইন অফ হিজ শুজ। হি সে ইটস এ শেম…’

আমার জন্য হাসলেও দেখবো না? সেই যে হাসিটা, কত্তদিন দেখি না। না! হাসি থাকুক! রাগ দেখবো না। বদলায় না কেন চেহারাটা? এটা দেখবো না। আমি যেমন চাই, তেমনটাই কেন হয় না?

‘না, সব শেষ। আরো অনেক আগেই।’

না, এসব কেন? আমি ঘুমাবো। প্লিজ! চাইনা ভাবতে। কোন কিছুই না। না, দেখতে চাই না। না, এই চেহারা না। কান্না দেখবো না। না, রাগও না। হাসিটা চলে গেল কোথায় যেন। ধুর, কী সব ভাবছি এসব। ঘুমাবো আমি। আমি কিছু দেখছি না। দেখতে পারি না। আমার চোখ বন্ধ। সব অন্ধকার। না, কেউ নেই। আমি একা এখানে। বেড়ার ভেতর একশ’ ভেড়া। একটা ছুটলো। ঐ যে আরেকটা।

‘ঘর থেকে বের হবার আগে আয়নার দিকে একবার তাকাতে এত কষ্ট কেন তোমার? গালের অবস্থা শুকিয়ে কাঠ, একটা ক্রিমও নাই ঘরে? দাঁড়াও! দেখুক যে দেখার! ’

দরকারের সময় ভেড়াগুলো কোথায় গেল সব? না, আমি দেখবো না। আমি কিছু দেখবো না। ঘুমাবো। আলো জ্বললে তো প্রেত কাছে আসার কথা না। না, আমি নিজের মনেও কিছু দেখছি না। অন্ধকার, সব অন্ধকার। আর সব মনের ভুল। ভুল কি শুধুই মনের? উফ, নাহ, সব মনের ভুল। চুপ! সব চুপ! ঐ যে ভেড়া! সাতানব্বই… পঁয়ষট্টি… আটাশ…

মৌনচিত্র ১

উহু, থামবে না মনে হয়। থামতেও পারে। হয়তো চেনা মুখ ছিল, তাই এগিয়ে গিয়ে গিয়ে হাত মেলাচ্ছিল। আমার দিকে আসার কোন কারণ নেই।

‘ব্রাদারস অ্যান্ড সিস্টারস ইন ইসলাম, অলদো মেনি অফ দ্য মুসলিমস ওয়্যার অ্যাংরি ওভার দ্য অ্যাপারেন্টলি লুজিং ট্রিটি অফ হুদায়বিয়া, আওয়ার প্রফেট-পিস-বি-আপন-হিম কল্ড ফর পেশেন্স…’

নাহ, এই লোককে তো চেনা হতেই পারে না। এটা কম করে দুই মহাদেশ ওপাড়ের লোক। কী সুন্দর হাসি! যেন কত দিনের চেনা। আহ্লাদে আটখানা হয়ে হাত মিলিয়ে যাচ্ছে একের পর এক। বয়স আর বছর ত্রিশেক বেশি হলে বলতাম রাজনীতিতে নামবে। নাহ, এই রকম করে কেউ হাত মেলালে তাকে বিনা চিন্তায় ভোট দিয়ে দিতাম। আহা, আসে না কেন আমার দিকে? আয় না রে! কোলে নিবো, গাল টিপে দেবো।

‘আমিন! লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদ-অর-রাসূলল্লাহ। আকিমুস-সালাত…’

থাক, বাবুটা হয়তো নামাযের সময় হয়ে না গেলে আসতো আমার কাছেও। অর্ধেক মসজিদের সাথে একা হাত মেলালো, আর আমি বুড়া ব্যাটা কোণায় বসে ঝিমালাম, ছি! কেন যে সামনে বসলাম না। আরেক দিন ওর সামনে গিয়ে বসবো। দেখে রাখলাম।

‘লাইলাতুল কাদরি খাইরুম মিন আলফি শাহর…’

এ কী আমার কাছে দৌঁড়ে চলে এলি নামাযের মধ্যে? ওরে গুলটুশটা রে। আহারে, ভয় পেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি ফেরত যা! বাবা বকবে নইলে নামায শেষে। যা! নাহ, নামাযে মন দেওয়া উচিত। প্রে অ্যাজ ইফ ইট ইজ ইওর লাস্ট প্রেয়ার। হোক। শেষ দেখা এমন একটা মুখকেই দেখে যাই না। আড়চোখে একটা ছবি তুলে রাখি মনের অ্যালবামের জন্য।

ওস্তাদের মাইর শেষ রাইতে (The Over-Trump)

আচমকা মাথা-চাড়া দেওয়া অসংখ্য বদ-চিন্তার একটির সমাপ্ত রূপ। ঈদের অনুষ্ঠানে ছাত্রদের পরিবেশনা।

সময়টা আমাদেরই থাকুক, প্লিজ

[দৈনিক আমাদের সময়ে পাঠানো চিঠি। সেপ্টেম্বরের ১ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন নিয়ে। আদৌ কেউ এটি দেখবেন কিনা জানি না, তাই নিজের ব্লগেই লিখে রাখলাম মতটুকু।]

আমি আমাদের সময়ের। অধিকারের সাথেই ভাবি এমনটা। অধিকারটা অর্থ বা অর্জনের অধিকার না, আন্তরিকতার। ছুটির দিনেও প্রকাশিত হয় এবং সবার আগে ইন্টারনেটে প্রকাশিত হয় দেখেই প্রবাস থেকে আমাদের সময় পড়া শুরু আমার। মৌলিক কিছু গুণাবলি ভাল লাগতো দেখে দিন কয়েকের মধ্যেই আমি আমাদের সময়ের নিয়মিত পাঠক হয়ে উঠি। চটুল নিরপেক্ষতার নামে পাঠকের সাথে এক্কাদোক্কা খেলার চেষ্টা ছিল না, নিজেদের ভুল বুঝতে পারার সাথে সাথে অনুকরণীয় রকম নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা ছিল, পত্রিকার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ও সমালোচনাগুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা ছিল। কে কী ভাবলো তা নিয়ে ভীত না হয়ে বিবিধ রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির কথা আগাম জানাতো পত্রিকাটি। পর্দার অন্তরালের হিসেব-নিকাশগুলো জেনে আমার মত সাধারণ পাঠক আলোকিত হতে পারতো। সেই বিশ্বাসে বড় একটা ধাক্কা লাগলো পহেলা সেপ্টেমরের প্রধান প্রতিবেদন দুটোয়। ‘যে সভার খবর মিডিয়ায় আসেনি’ শীর্ষক অবমূল্য প্রতিবেদন এবং তার সাথে সাথে সম্পাদকের আন্দাজনির্ভর লেখা পড়ে দুঃখ পেলাম খুব। মেলাতে পারছি না আমাদের সময়ের সাথে।

উক্ত প্রধান প্রতিবেদনের মূল সুর এটাই ছিল যে, একটি সম্মেলনে কিছু শিক্ষক বিদ্যমান সামরিক শাসন নিয়ে বিরুদ্ধমত প্রকাশ করেছেন। ইঙ্গিত করা হয়েছে যে এমনতর মতপ্রকাশের কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা দেশে ছাত্র-জনতা বিস্ফোরিত হয়েছে প্রতিবাদে। চর্বিমুক্ত বিশ্লেষন এটুকুই বলছে আমাকে। উক্ত শিক্ষকেরা দায়ী, কারণ তারা প্রকাশ্যে সেনাশাসন নিয়ে তাদের অসন্তোষ ও বিরুদ্ধমত প্রকাশ করেছেন। এটি কি কোন রাজনৈতিক সমাবেশ ছিল? ‘ছাত্র রাজনীতি, সিভিল মিলিটারি রিলেশন ও বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যা’ নিয়ে হচ্ছিল আলোচনা। উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন জেনারেলরা। মত রাখলেন শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিনিয়র শিক্ষকেরা। এখানেও বলা যাবে না যে এই দেশের জন্য সেনাশাসন ভাল নয়? বলা যাবে না যে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সাধারণ মানুষ ভাল ভাবে নেয় না? এখানেও বলা যাবে না যে সরকার ও সেনাবাহিনী নগ্ন রকম পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে? বলা যাবে না যে উর্দি পরে যুদ্ধ করার অধিকার থাকলেও রাজনৈতিক বক্তৃতা দেবার অধিকার নেই সেনাপ্রধানের? কাকে বলবো এই কথাগুলো? কোথায় বলবো? এটা যদি উষ্কানি হয়ে থাকে, তাহলে প্রতিবাদ বা সমালোচনা কী?

সেই সভার কথাগুলো তো মাঠ কাঁপানোর জন্য বলা হয়নি। মিডিয়াতেও আসেনি এই কথা। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের ভূমিকা আলোচনা-সমালোচনার দাওয়াতে এসেও ভুল ধরিয়ে দেওয়া যাবে না? কী ভাষায় বর্ণনা দিলেন এই সমালোচনার? পর্দার অন্তরালে টাকা ঢেলে কে কী করলো তা আমি জানতেও চাই না। আমি শুধু এটুকু বুঝি যে দেশ নিয়ে আমারো সমধর্মী কিছু সমালোচনা আছে। আমি বুঝি যে সাধারণ্যে ক্ষোভ না থাকলে টাকা ঢেলেও আন্দোলন তৈরি করা যায় না।

সভ্য সমাজের সদস্য হিসেবে আমি আমার মত প্রকাশের কথা ভাবি কোন ফোরামে বলবার সুযোগ এলে। আপনাদেরই ডিসেম্বরের প্রবাসী বাঙ্গালিদের সম্মেলনে যদি মুখ ফস্কে বলে বসি এরকম কিছু? এই কথাগুলো তো বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায়। উপেক্ষিত অসন্তোষগুলো সম্পর্কে সজাগ করে দিলে কি আমার মান-সম্মান ধরেও এভাবেই টান মারবে আমাদের সময়? পদে পদে সেনাবাহিনীর ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ গালি খেয়ে আমি কার কাছে অভিযোগ করবো? আমার দেশের সেনাবাহিনী যখন দেশরক্ষা বাদ দিয়ে নিজের ওয়েবসাইটে দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের বিষোদ্গার করবে তখন আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো? আমি সেনাশাসন বিরোধী হলেও ভুলেও প্রবাসে দেশের সমালোচনা করি না পাছে কেউ শুনে ফেলে ভেবে। ওদিকে আমারই বিদেশী বন্ধুরা সেনাবাহিনীর ওয়েবসাইট দেখিয়ে বলে, তোমাদের আর্মি নিজের দেশের শিক্ষকদের নিয়ে এগুলো কী ছেপেছে? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো?

যে সভার কথা মিডিয়ায় আসেনি, তেমনি আরেকটি সভার কথা বলি। ব্যারিস্টার মঈনুল ভান ধরেছিলেন জামাতে ইসলামীর সেক্রেটারিকে না চেনার। অথচ কিয়ৎকাল পরই তার মিথ্যাচারের প্রমাণ বেরিয়েছে। তিনি ছাত্র শিবিরের অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে হাজির হয়েছিলেন, এমন ভিডিও বেরিয়েছে। তাঁর বামের তিনটি চেয়ারে যথাক্রমে উপবিষ্ট ছিলেন মীর্জা আব্বাস, মতিউর রহমান নিজামী, এবং আলী আহসাম মোঃ মুজাহিদ। দেশের একটি মাত্র পত্রিকা ছোট্ট করে এর কথা লিখেছে। আমাদের সময় কি পারবে এই সভার কথাও প্রথম পাতায় প্রকাশ করতে? পাঠক হিসেবে আদরের পত্রিকার এই পরীক্ষা নিতে চাইতেই পারি আমি। যাচাই করে দেখার জন্য দেখুন এখানে -- http://www.esnips.com/web/ishtiaqrouf/

সময়টা সততা এবং সত্য উন্মোচনের। আমাদের সময় কি এই সময়ের থাকতে পারবে? পারবে নিজেকে সেনাসরকারের মুখপাত্র হওয়া থেকে বিরত রাখতে?

প্রবাসের কথোপকথন ১০

“সুপ্রভাত। তুমিই কি আমাদের নতুন ছাত্র?”
জ্বী, আজকে ইন্টারভিউ দিতে আসলাম মাত্র। অথম্যান (উসমান) আমাকে জেরা করছে এই মুহূর্তে।

“ব্যাপার না। আশা করি চাকরিটা পেয়ে যাবে তুমি। আমার নাম ডন ডেভিস। আমি এই অফিসের ডিরেক্টর। চাকরি পেয়ে গেলে আমার সাথেই কাজ করতে হবে তোমাকে। অথম্যান মাইক্রোসফটে চলে যাচ্ছে, জানোই তো মনে হয়। একদম ক্যাডিলাক জেতার মত ব্যাপার। তা তোমার নাম কী? ইশ? ওয়েইট, আমি পুরোটা ঠিক মত উচ্চারণ করবই। ইশ-ঠি-আক। কাছাকাছি যেতে পেরেছি? যাক, ইশ থাকুক আপাতত।”
হ্যাঁ, ইশ থাকুক। আমি এবার সফোমোর ইয়ারে উঠলাম। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি। এসেছি বাংলাদেশ থেকে। হ্যাঁ, আমার একটু একটু শীত লাগছে। আবহাওয়াটা নিজের দেশের মত হলেও ঠান্ডা একটু বেশি লাগছে। আমিও আশা করছি গা সয়ে যাবে কিছুদিন পরে। নট দ্যাট ইট ইজ অ্যান অপশন, এনিওয়ে।

“আমি তোমার শিক্ষাগত কোন ব্যাপার নিয়ে কোন প্রশ্ন করবো না। উই অল লার্ন অন-দ্য-জব। তুমিও শিখে যাবে, আমি নিশ্চিত। আমি শুধু তোমাকে খুব মৌলিক কিছু ব্যাপারে বলবো। সব সময় এগুলো মনে রেখে চলবে, তাহলে তোমার সাথে আমার কোন রকম ঝামেলা হওয়ার কারণ নেই।”
অবশ্যই। বলে যাও, আই অ্যাম অল ইয়ারস।

“এই যে যন্ত্রটা দেখছো, এটা একটা টেলিফোন। এটায় দূর থেকে কথা বলা যায়, চাইলে চোখের অনেক আড়াল থেকেও যোগাযোগ করা যায়। আর এই যে আমার ডেস্কের উপর বিশাল কাগজটা দেখছো, এটা আমার প্ল্যানার। এটার খুব হাবিজাবি অবস্থা, কারণ আমি খুব ব্যস্ত মানুষ। তুমি যদি আমাকে বল তুমি সকাল সাড়ে নয়টায় আসবে, তাহলে আমি তোমার জন্য নয়টা পয়ত্রিশ পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। তুমি দশটায় আসলে আমাকে পাবে না, কারণ দশটায় আমি আরেকজনকে সময় দেবো। তুমি যদি যেকোন কারণে আটকে যাও, আমাকে প্রথম সুযোগে জানাবে।”
অবশ্যই। এটা তো সাধারণ ভদ্রতা। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করবো। কী বল, আর্মির ছাত্রকে নিয়ে সমস্যা হয়েছিল? তাও পাঙ্কচুয়ালিটি নিয়ে? না না, আমার উপর রাগ হয়ে ফোন ভাঙার মত কিছু হবে না, আশা করি। দেরি হলে আমি জানাবো আগেই। তবে আমি যেমন কাছাঢিলা মানুষ, তাতে অনেক কিছুই ভাঙার মত অবস্থা হতে পারে।

“এর চেয়েও জরুরী হল দ্বিতীয় ব্যাপারটা। তুমি পাশের ঘরের মেয়েটাকে দেখেছো? ও আমাদের সাথে আছে আজকে পাঁচ বছরের বেশি। প্রথম যখন এসেছিলো, তখন কম্পিউটারের কিছুই জানতো না। ওকে কাজের শেষে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসবে। এটাই তোমার একমাত্র কাজ। এই কাজটা নিয়মিত ঠিক মত করতে পারলে তোমার আর কোন চিন্তা নেই। আমি এক জোড়া মেয়ে পেলে বড় করেছি। টাইমস আর নট দ্য সেইম এনিমোর।”
অবশ্যই মনে থাকবে। হ্যাঁ, ও মানা করলেও জোর করে দিয়ে আসবো গাড়ি পর্যন্ত। কোন ভয় নেই, ভুল হবে না এই ব্যাপারে আমার। আমার বিপদচেতনার মাত্রা আরেকটু বেশি হলেও আমি ব্যাপারটা খেয়াল রাখবো।

“ভেরি ওয়েল, দেন। তুমি প্রথম মাস ছয়েক এখানেই কাজ কর, তারপর বাসা থেকেই কাজ করতে পারো চাইলে। কাজের সময় নিয়ে চিন্তা কোর না। তুমি চাইলে রাতে রাতেও কাজ করতে পারো। অথম্যান আর আমার তো ভোর চারটায় দেখা হয়। ও বাড়ি ফেরে, আমি কাজে ঢুকি।”

...

“কী ব্যাপার, মন খারাপ কেন?”
আমার প্রথম ইলেকট্রনিক্স পরীক্ষার খাতা দিল। বীভৎস অবস্থা।

“আরে এগুলো কোন ব্যাপার না। কত পরীক্ষা আসবে যাবে। আমি জানি তুমি ভালই করবে। তোমার মাথা ভাল।”
লক্ষণে তো তেমন বলছে না। আমি আসলে এই প্রথম অনলাইনে গ্রেড পোস্ট হতে দেখলাম। শুরুতে স্রেফ শূন্য দেখাচ্ছিলো। পরীক্ষা খুব খারাপ দিয়েছিলাম। কোন প্রশ্নেরই পুরো উত্তর ঠিক করতে পারিনি। পার্শিয়াল মার্কের ভরসায় ছিলাম। জীবনে কখনো শূন্য পাইনি। কাল ঘাম ছুটে যাচ্ছিল আমার। একটু পরে দেখি ৬৯ হল সেটাই।

“হাহ হাহ, তুমি তাহলে গ্রেড পোস্টিং শেষ হওয়ার আগেই সিমেস্টার বুক দেখছিলে? একই সাথে তুমি আর ইন্সট্রাক্টর। মজাই। আমাদের কালেই ভাল ছিল। আমি পড়ানোর সময় খাতা নিজের হাতে দিলাম, ওল্ড স্কুল, ওল্ড ডেইজ। তখন এসব ঝামেলা ছিল না। অযথা তোমার কত্ত টেনশন গেল। অন্তত খাতা পাওয়ার আগ পর্যন্ত ছাত্ররা শান্তিতে ঘুমাতে পারতো।”
শূন্য পাইনি, এটা বিরাট একটা সান্ত্বনা, কিন্তু তবুও সি দিয়ে শুরু করলাম অযথা। নিজের উপর মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে আছে।

“আমি কীভাবে গ্রেডিং করতাম সেই গল্প বলি তোমাকে। ধর একজন ছাত্র তিন পরীক্ষায় ডি, সি, এ পেল। ফাইনালেও এ পেলো। সিমেস্টার গ্রেডে আমি তাকে এ দিতাম। কারণ, শুরুতে কিছুটা কম বুঝলেও শেষতক সবটা বুঝে নিয়েছে, এমন কাউকে আমি কেন প্রথম পরীক্ষার জন্য বি দেবো, বল?”
আহা, আমাদের টিচাররা যদি এমন হত! এখন তো একটা বাজে পরীক্ষা দিলেই হিসেব করতে বসি আদৌ কোর্স রাখবো, নাকি ড্রপ করে দেবো।

“নাহ, এভাবে ভেবো না। আমার এক শিক্ষক আমাকে একবার বলেছিলেন, দ্য ডিফরেন্স বিটউইন অ্যান এ অ্যান্ড এ বি ক্যান বি ইওর মেন্টাল হেলথ।”
ওয়াও! খুবই ওজনদার কথা। একটু ভাল লাগছে তোমার কথা শুনে। থ্যাংক্স, ডন। আমি কাজে ফেরত যাই এবার।

“উহু, একটু দাঁড়াও। এই যে দুই টাকা। ছোট বেলার কথা মনে আছে? যখন বাসার পাশ দিয়ে টুংটাং আওয়াজ করে আইসক্রিমের গাড়ি যেতো, বাবা আইসক্রিম কিনে দিলে খুশিতে লাফাতে? মানুষের ভেতর থেকে এই ব্যাপারগুলো কোনদিন যায় না। গো হ্যাভ সাম আইসক্রিম। ভাল লাগবে।”
না না, এটার কোন দরকার নেই। মেন্টাল সাপোর্টটার জন্য অনেক ধন্যবাদ। নিজের মত হজম করার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু এক পর্যায়ে গিয়ে আর না বলে পারলাম না।

“বলে খুব ভাল করেছো। ব্যাথাগুলো কখনো বুকে চেপে রাখতে নেই। তুমি ক্যাম্পাসে একটু হাঁটাহাঁটি কর আর কিছু আইসক্রিম খাও গিয়ে। না, আমি কোন কথা শুনবো না। তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো যে আমি তোমার বস। আই অ্যাম অর্ডারিং ইয়ু টু গো অ্যান্ড টেক এ ওয়াক অ্যারাউন্ড দ্য ক্যাম্পাস। ডোন্ট বদার অ্যাবাউট দ্য ক্লক। আইল পে ইয়ু ফর ইট।”
আরে! ৮৯! কার্ভ! জীবনে এই প্রথম অন্যের দুঃখে সুখী হলাম।

“হ্যাঁ, দেখবে অনেক কিছুই এরকম। তুমি মনে হয় কার্ভ পাওনি তোমাদের ওখানে। এনিওয়ে, টাইম ফর সাম আইসক্রিম।”

...

“তুমি দেখলাম এই সপ্তাহে কম ঘন্টা কাজ করেছো। শরীর খারাপ নাকি?”
না, টাইমশিটে প্রতি মিনিটের হিসাব ঠিক রাখার চেষ্টা করেছি। শেষ দিকে এসে ঘন্টাগুলো পোষাতে পারিনি।

“ডোন্ট বদার। শুধু এখানে কাজ করা সময়টুকু ধরবে না। আমার মতে, তুমি যেই সময়টায় কাজ নিয়ে ভাবছো, সেই সময়ের জন্যও পয়সা পাওয়া উচিত। কাজের সময় যদি নিজের কাজ করা দোষের হয়, তাহলে নিজের সময়ে কাজ করলে কেন স্যালারি পাবে না, বলো?”
পৃথিবীর সব বস যদি তোমার মত করে চিন্তা করতো!

“জীবন নিয়ে কিছু মৌলিক ব্যাপার বলি। দু’তিনটা অভ্যাস কষ্ট করে হলেও করবে। প্রথমটা হল, লার্ন টু লিভ ইয়োর ওয়ার্ক ইন দি অফিস। আমি এই টেবিল থেকে ওঠার পরে কাজ নিয়ে কিচ্ছু ভাবি না। আমি অনেক ভোরে উঠি। বয়স তো কালে কালে বাহাত্তর হয়ে গেলো। কিছু জগিং করি, গোসল করি, তারপর কাজে চলে আসি সকাল সাতটার আগে। চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে উঠি, এবং এরপর আগামী দিনের আগে কাজ নিয়ে কিচ্ছু ভাবি না।”
এই ব্যাপারটা আমার জন্য কষ্টের। করতে পারলে খুব ভালো হত। আমার জীবনটা বিভিন্ন রকম কারণে খুব জট পাকিয়ে আছে। সবদিকের নিজের সবটুকু দিচ্ছি, কিন্তু অহেতুক অনেক ঝামেলা এসে জড় হয় বারবার। ছাত্রজীবন এমনিতেও এভাবে কাজ ছেড়ে দেবার মত না।

“তা ঠিক। সে-কারণেই আমরা আমাদের অফিসের নিয়মগুলো এভাবে ঠিক করেছি। তোমার লেখাপড়া সবার আগে। কাজগুলো এমন জরুরী কিছু না যে সেটা তৎক্ষণাৎ করতে হবে। ঘন্টা পুরো করার চেয়ে কাজ সমাধা হওয়া জরুরী বেশি। যখন খুশি, যেখানে খুশি, যেভাবে খুশি কাজ করবে। কাজ হবে আনন্দের।”
চেষ্টা করে দেখতে হবে। এটার সুফল হিসাবে জীবনটাও হালকা হওয়া উচিত, আশা করি। পেপার লেখার চাপ এসে পড়লে একটু বেশিই এলোমেলো হয়ে যায় আর কি সব। না, বল নি তোমার ডিসারটেশন লেখার গল্প। ক্লজেটে ঘুমাতে? কোথায়? ডিপার্টমেন্টের ক্লজেটে হয়ে থাকলে তো ঝাড়ুদারের সাথে ভালো খাতির ছিল তোমার। এসি ছিল না? এটাও নাহয় সহ্য করা যায়। আমি তো গরম দেশ থেকেই এসেছি। না, শেষটা বিশ্বাস করতে পারলাম না। এক রাতে পুরো ডিসারটেশন? রাত নয়টা থেকে ভোর চারটার মধ্যে ডিসারটেশন লেখাটা মোটামুটি ইনসেইন একটা ব্যাপার।

“ইউ গটা ডু হোয়াট ইউ গটা ডু।”

...

“অসংখ্য ধন্যবাদ আমার বাসায় আসার জন্য। আমার নিজেকে খুব বেকুবের মত লাগছে। এত সাধারণ ব্যাপারে তোমাকে ডেকে আনলাম।”
উহু, এটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার একদমই কারণ নেই, ডন। আমার কাছে এগুলো খুব একটা ট্রিকি কিছু না। উই অল হ্যাভ আওয়ার পেট প্যাশনস। এটা সেরকমই। তোমার নাতি-নাতনির ছবিগুলো খুব সুন্দর। দাঁড়াও, পিকাসা ইনস্টল করে দেই। খুবই গোছালো অ্যাপ্লিকেশন। আরে এত উচ্ছসিত হওয়ার কিছু নাই। ক্রেডিট আমার না, গুগুলের।

“তুমি জানো না আমার কাছে এটার মূল্য কতটুকু। এই ছবিগুলো আমি অনেক দিন ধরে খুঁজছিলাম। এরকম সফটওয়্যার খুঁজলে অনেক মিলবে। তবে এটা ব্যাবহারের চিন্তাটুকু তোমার মাথায় আসাটা একটা লাইফ-সেভিং ব্যাপার আমার জন্য।”
দ্য প্লেজার ইজ অল মাইন।

“এই নাও, এটা রাখো।”
আরে এ কী? ইউ আর ফ্যামিলি, ডন। আমি এই সামান্য কাজের জন্য তোমার কাছে টাকা নেবো কেন? আমি তো মলের দিকে আসছিলাম এমনিতেই। আমার মায়ের কাজ শেষ, তুলে নিয়ে যেতে আসতাম।

“তুমি কি আমাকে মৃত দেখতে চাও? আমার বৌ আমাকে স্রেফ মেরে ফেলবে। শি ক্যান বি প্রিটি মিন সামটাইমস।”
তোমার মত দুর্ধর্ষ মানুষও এরকম করে বলছে, শুনে মজা লাগছে খুব।

“হিয়ার ইজ এ সিক্রেট ফর ইউ। তুমি সেদিন বুঝবে তুমি বড় হয়েছো, যেদিন তুমি মুখ বন্ধ করে মনে মনে এক থেকে বিশ পর্যন্ত গুনতে পারবে।”
এটা আবার এমন কী?

“এটা বিশাল ব্যাপার। এটা সংসারে শান্তির প্রথম শর্ত। আমি খুব রাগী মানুষ। আমার মুখের একদম আগায় সব আগ্রাসী কথাবার্তা বাসা বেঁধে বসে থাকে। কিন্তু কখনো কখনো আমি জিভ কামড়ে মনে মনে চুপ করে থাকি, গুনতে থাকি এক থেকে। এগারো-বারো আসলে দেখবে রক্তগুলো মাথা থেকে একটু একটু করে নামছে, পনেরর দিকে এসে শরীর একটু ঠান্ডা লাগে, আঠারোর দিকে আসলে দেখবে পৃথিবী আসলে খুব সুন্দর একটা জায়গা।”
আমি বহু চেষ্টা করলেও হয়তো সাত পর্যন্ত যেতে পারবো। সাইলেন্স ইজ ব্লিস। বোবার কোন শত্রু নাই। এমনি এমনি তো আর বলে না।

“দেন কিপ ওয়ার্কিং অন ইট।”

আমি ছাত্র, তাই

মাঝে মধ্যে মনে হয় স্রেফ বসে থাকি। কিচ্ছু না করে, কোন দিকে না তাকিয়ে, কোন চিন্তায় না ভেসে। স্রেফ বসে থাকি। অলস, অচল, অসার সময় কাটাই কিছু। জানি ভুল, তবু সময় নষ্ট করি হেলায়। আবার কখনো খুব বেশি ইচ্ছা করে কিছু করতে। ‘কিছু’। কী, জানি না। তবে ‘কিছু একটা’। খুব অস্থির লাগে। কখনো উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেঁটে বেড়াই, কখনো পথের পাড়ে অচেনা কারো সাথে আড্ডায় মশগুল হয়ে যাই, কখনো ঘাসের পালঙ্কে শুয়ে আকাশ দেখি।

কোন কোন দিন এক রিকশায় চার-পাঁচ জন চড়ে বসি। জান্তব ফোঁসফোঁস আওয়াজে দম নিতে নিতে এগিয়ে চলে রিকশা। আমরা তখন হুডখোলা রিকশায় নগরদর্শনে ব্যস্ত। উঁচু দালানগুলোর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হই, গল্প করি দূর ভবিষ্যতে কে কেমন দালান বানাবো তা নিয়ে। রিকশাওয়ালার পিঠবেয়ে নেমে আসা ঘামের রেখাগুলো ধীরে ধীরে মূর্ত হয়ে ওঠে চিত্রকল্পের মত। এই চিত্র কিছু পরেই বদলে যায়, চোখে পড়ে না আমাদের। এই আমিই কখনো বিকেল কাটাই তাদের সাথে। বুড়ো চাচাকে বলি আমার পাশে সিটে বসতে, জিজ্ঞেস করি কোথায় ঘুমান উনি, কত টাকা জোটে দিনে, কোনদিন পকেট উলটে শেষ পয়সাটাও দিয়ে দেই।

একেকদিন মেয়ে-ছেলে দেখে লোলুপ চোখে তাকাই। চোখ দিয়ে চেটে দেই যেন। পাশের বন্ধুকে বলি বিশ্রী সব চিন্তার কথা। শিশ বাজাই, চোখ মারি, কামাতুর হয়ে ঠোঁট কামড়াই। এই আমিই বাসে গর্জে উঠি মেয়েদের গায়ে কেউ হাত লাগালে। আমারই সামনে অন্য কেউ শিশ বাজালে এই আমারই কেন যেন গা জ্বালা করে।

বাজারে গেলে হাত নিশপিশ করে যা পাই তা কিনতে। কিনতে না পারি তো মনে হয় স্রেফ আলগোছে মেরে দেই। খুব উশখুশ লাগে। নিষিদ্ধ রোমাঞ্চে কেমন যেন হাল্কা লাগে পা জোড়া। স্বপ্নে ভেসে যাই। এই আমিই আদ্ধেকটা খেয়ে খাবার দিয়ে দেই পাশের নাকশি ভেজা, পেটফোলা, ছেঁড়া হাফপ্যান্ট পড়া কৌতূহলী জীবটাকে।

আয়না সামনে পেলেই কেমন যেন পালোয়ান হয়ে যাই। কখনো ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন তো কখনো মাসুদ রানা। আলতো শ্যাডোর সাথে উড়ে যায় ম্যাচজয়ী ছক্কাগুলো, মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে সোহানা চৌধুরীরা। ওয়েস্টার্ন মুভি মনে পড়ে। ঘোড়া ছুটিয়ে যাই ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্টের মত। হাইয়ো সিল্ভার, আওয়ে! সামান্য ঝগড়া থেকে বন্ধুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি প্রায় বিকেলেই। এক বেলা জিতি তো আরেক বেলা হারি। গতরে না পারলে বচনে পুষিয়ে দেই। কখনো বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে বীর, কখনো ছায়ার সাথে। তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর ঘটনায়ও আমি হাতা গুটিয়ে এগিয়ে যাই দু’কদম। আবার এই আমিই কখনো পিঠ পেতে ঠেকাই নিপীড়িত বন্ধুকে। একটুও ফিরে তাকাই না, একবারের জন্যও প্রত্যাঘাত করি না। আঘাত করতে যাবার ফাঁকে যদি আমার আশ্রিত বন্ধুর গায়ে লাঠি পড়ে, সেই ভয়ে পরম স্নেহের বাতাবরনে ঢেকে রাখি তাকে।

ঘরে বাবার চেয়েও আমার দাপট বেশি। বাবা যতই উপার্জন করুক, আমার ভাগের খাবারটাই সময় মত আসা চাই। আমার ভাগের রুটিটাই গোল হতে হবে, আমার রুটিটাই পোড়া হতে পারবে না। কোনবেলায় আমিষ না থাকলে আমার মুখ ভার হয়ে থাকে। সবজি মানুষে খায় কিনা, এই নিয়ে আমি ক্ষিপ্ত মত রাখি। এই আমিই বাঁকা-ত্যাঁরা রুটি বানাই বন্যার্তের জন্য। পঁচা পানি ভেঙে মিশে যাই বানভাসির সাথে। এই আমিই সব অহম জলাঞ্জলি দিয়ে প্রবাসের পথে বসে ভিক্ষা করি দেশের জন্য দুটো টাকা জোগাড় করতে।

পড়ার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াই সবান্ধব। ক্লাস বাদ দিয়ে টুয়েন্টি-নাইন খেলি ক্যাফে কাঁপিয়ে। ক্লাসে যাই তো নাক ডেকে ঘুমাই। জেগে থাকলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করি কল্পনাযোগ্য সব রকম নষ্টামি করে। বিকেল হলে দল বেঁধে মাঠে যাই খেলতে। সন্ধ্যা হলে আড্ডায় জমে যাই চা-বিস্কুট সমেত। রাত বাড়লে কোনদিন তেহারি তো কোনদিন বিরিয়ানি। খেলা দেখবো বলে ক্লাস ফাঁকি দেই। বড় কিছু হলে হল্লা-হুল্লোড় করে সব বন্ধ করে দেই। এই আমিই রাত জাগি সমীকরণ সমাধান করতে। গন্ডা খানেক টিউশনি আর পানসে ডালে ভর করে এই আমিই একটি একটি করে দিন অতিপাত করি নতুন দিনের আশায়। জীবনের গতির সাথে তাল রাখতে না পারলেও জীবনের গভীরতা চিনতে চাই কেন যেন।

একটু চাপ আসলেই আমি ঝোপ খুঁজে বসে পড়ি। দেওয়াল দেখলে চতুষ্পদের মত নিজের উপস্থিতির চিহ্ন রেখে যাই। কেউ গাছের ছেলা বাকল দেখে আমাকে মনে করে, কেউ দেওয়ালপাড়ের গন্ধে বাধ্য হয় আমাকে মনে করতে। আমি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ফেলি ইমারতের প্লাস্টার। আবার পুরনো দালানগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আমিই গর্বিত হই এর ঐতিহ্যের অংশ হতে পেরে। আমিই দেওয়াল দাগাই, আমিই দেওয়ালে চড়ি, আমিই দেওয়াল ভাঙি, আমিই দেওয়াল হয়ে দাঁড়াই।

একটু চোখ রাঙালেই আমি চুপ হয়ে যাই, আবার ট্রাক-ট্যাঙ্কের সামনে আমি দাঁড়িয়ে যাই জগতের সবটুকু প্রতিবাদের মূর্তি হয়ে। আমি পথে ধাক্কা দিয়ে চলে যাই, বাসে সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমি শাহরুখের মত বুকফাড়া জামা পড়ি, আবার রাতজেগে বসে থাকি নববর্ষ বরণ করতে।

আমি পানির মত ভাসমান কখনো। বাঁধনগুলো আমি বাতাসের মত এড়িয়ে যাই কখনো। ধরিত্রীর মত সহিষ্ণু এই আমিই আগুনের মত জ্বলে উঠি অপমানের বদলা নিতে। নিজে না খেয়ে যাকে খাওয়াই, তাকেই প্রতিরোধ করতে আমি দেহের প্রতিটি উপশিরাকে মেরুদণ্ডে পরিণত করি কখনো। অনেক দুর্নীতি দেখেও আমি নিথর, আবার সামান্য অপনীতি দেখেও আমার চামড়ার ভেতরে-বাইরে জ্বলে ওঠে একসাথে।

অনেক দ্বন্দ্ব আমার। আমি ছাত্র, তাই।

প্রবাসের কথোপকথন ৯

“ইয়া, গিম্মি আ ডা’ খৌক উইথ দ্যাট প্লিজ।”
ডা’... আহ, কম্বো অ্যান্ড ডায়েট কোক, দ্যাট’ল বি সিক্স ফিফটি সেভেন ফর ইয়ু, ম্যাম।

“আ’ল লাভ ইয়ু ফর লাইফ ইফ ইয়ু কুড অ্যাড সাম রুট বিয়ার টু ইট।”
কোন ব্যাপার না। আপনার জন্য সব সই। পারি তো খাবারটাও মুফতে দিতাম। ছয় টাকা সাতান্ন পয়সা। অশেষ মেহেরবানি আপনার, হ্যাভ আ নাইস ওয়ান!

“ওহ, দ্যাটস সো সুইট অফ ইয়ু। ইয়ু হ্যাভ আ নাইস ওয়ান ঠু, হানি।”
(আহ, আই লাভ দ্য সাউথ! ধরায় কোথায় এমন চপলা, হেলিয়া দুলিয়া, হাসিয়া ঢুলিয়া, কহিবে অধমে প্রেম জাগাইয়া, শুধাইছো আমায় এত যতনিয়া!)

“আই বাইট!”
(ডাকু মেয়ে! বুকে লিখে ঘোষণা দিয়ে কামড়ায়! তাকাতে দেখে ফেললো না তো? আমার দোষ কী? আমি তো মাথা উঁচু করেই আছি! আমার মাথা অতটুকু যাওয়া তো আমার দোষ না। নাহ, ছয়ফুটিদের দেশে সাড়ে পাঁচ হওয়ার মত কিছু নাই।)

“স্টেয়ার অ্যাট ইওর ওউন রিস্ক!”
(মজার মেসেজ। নাহ, এর পরেরটার দিকে আর তাকানো যাবে না। বেশি খেতে গিয়ে না শেষে ঝামেলায় পড়ি।)

“ঐ লাল সসটা আছে? ঐ যে, মিষ্টি মিষ্টি সস একটা। লাল রঙ।”
সুইট অ্যান্ড সাওয়ার সস। আছে, এই যে নাও। আর কিছু?

“ওহ, আই লাভ ইট। এগ রোল খুবই মজা এটার সাথে।”
কী জানি, আমার তো ভাল লাগে না অত। ঝাল খাও? ঝাল খেলে চিলি সস নিয়ে দেখতে পারো। ওটা বেশি মজা ভাজি কিছুর সাথে।

“ওরে বাবা। নাহ, আমি ঝাল খেতে পারি না তেমন একটা।”
কোন ব্যাপার না। এখানে সবাই খুব মাইল্ড খাবার খায়। তোমরা যেটাকে স্পাইসি বল, সেটা আমাদের কাছে কিছুই না।

“ও বৌ, কী নিবা তোমার খাবারের সাথে? একটা বড় মিস্টার পিব আমাদের জন্য? এই যে দেখ, এই ছেলেটা এখনই টাকা চাবে। এরা শুদ্ধু আমার টাকা চায়। শুনো, এই যে বললো...”
ইয়ু হ্যাড আ নাইস ডে, স্যার?

“হাহ, হাহ, হাহ...”
ইটস স্টিল থার্টিন ফিফটিন, দো!

“হে, হোল্ড দি আইস, ম্যান।”
জ্বী, বুঝলাম না, স্যার। বরফগুলো তো ঠান্ডাই আছে। বিশেষ কিছু করতে হবে? না, মানে আর কী করতে হবে বুঝলাম না।

“হি মিনস নো আইস, প্লিজ।”
ওহ! থুক্কু। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ, ম্যাম। বেকুবের মত একটা প্রশ্ন করে ফেলেছিলাম। বাঁচালেন।

“অয় মাইট, অ্যাভিং আ গ্র্যান্ড ডে দেয়ার? বিজি? লুকস লাইক বিজনেস ইজ গুড টুডে।”
হ্যাঁ, চলে যায়। লোক ভালই। লম্বা দিন। আমাদের জন্য তো একই রকম, তবে ম্যানেজার খুবই খুশি। ডগমগ করছে, দেখছো না? আমাদের তো আর শনিবারে কোন কমিশন নেই। বরং ভাল কাজ করলে যেন শাস্তি হিসাবে শনিবারে ডেকে আনা হয়।

“রিফিল প্লিজ, স্যার।”
ফিফটি সেন্টস, প্লিজ।

“হোয়াট? হাউ মাচ?”
ফিফটি সেন্টস। ফিফটি সেন্টস। এর... ফিট্টি সেন’স, স্যার। কোন ধরনের ড্রিঙ্ক দিবো?

“আহ, ফিট্টি সেন’স। রু বিয়াহ, প্লিজ।”
এই যে আপনার রুট বিয়ার।

“আই মে নট বি পারফেক্ট, বাট পার্টস অফ মি আর প্রিটি অসাম।”
(সুন্দরী, তোমার মত পুতুলও যদি এরকম বলে, তাহলে যাই কোথায়?)

“তোমাদের এখানে কোন ভেজিটেরিয়ান মিল আছে?”
ভাত আছে, লোমেইন নুডুলস আছে, এবং কিছু মিক্সড ভেজিটেবল আছে। এতে হবে? না, এগ রোলেও কিছু চিকেন আছে। ভেজিটেবল এগ রোল করে দিতে পারি কিছু। স্যার, ইয়ে, কিছু ক্র্যাব র্যা ঙ্গুন নিতে পারেন। দুঃখিত। আমি শুনেছি যে আপনি সবজি খাবেন শুধু। ওটায় কোন কাঁকড়া নেই। শুধু ক্রিম চিজ। আমি তো নাম দেই নাই এরকম। ম্যানেজার বলতে পারবে হয়তো।

“আই অ্যাম ব্যাড উইথ নেমস, ক্যান আই জাস্ট কল ইয়ু ব্যাডঅ্যাস?”
না, মিষ্টি আলু ঠিক চাইনিজ খাবার না। সকালে বিক্রি করি নাস্তার জন্য। জানি, জানি। আমারও বেশ মজা লেগেছিল প্রথমে। তবে খেতে খুব মজা। চেখে দেখবেন একটা? মজা না? জানতাম পছন্দ হবে। দিয়ে দেই কিছু? মাত্র এক ডলার বেশি লাগবে মাত্র। পছন্দ হবে তোমার। নাও তো। পঞ্চাশ পয়সা দিয়ো নাহয়।

“গিম্মি ব্যাঁক?”
এক্সকিউজ মি! দিলাম তো তোমার খুচরা পয়সা। এই যে, তিন টাকা তেতাল্লিশ পয়সা।

“নোঁ, ইয়ু গিঁভ মি ব্যাঁক টুঁ ক্যাঁরি?”
আহ, ব্যাগ! স্যরি অ্যাবাইট ইট, ম্যাম। হিয়ার ইয়ু গো।

“ইয়ু ওঁয়ার্ক ছাইনিজ, ইয়ু নোঁ আন্ডাস্ট্যাঁ?”
ভুল হয়ে গেছে। আসলে, লোকজন বেশি তো, একটূ অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম। আগের জনের সাথে মিলিয়ে ফেলেছিলাম। কিউট ড্রেস, বাই দ্য ওয়ে!

“আই অ্যাম নট অ্যাজ ইয়ু ড্রাঙ্ক অ্যাজ থিঙ্ক আই অ্যাম।”
মজার লেখা। হ্যাঁ, টি-টা সুন্দর। নাহ, দিন ভালই। তা একটু ব্যস্ত, তবে আরো ব্যস্ত দিন যায়। অবশ্য সেটা শপিং মলে না। ক্যাম্পাসের পাশে। খেলার সময়। ওহ, ম্যান। এই সিজন পুরা ঝাকানাকা হবে। জামার্কাস কি ড্রাফটে নাম্বার ওয়ান হবে বলে মনে হয় তোমার? আমারো মনে হয় ওর হওয়া উচিত। তবে ভয় একটাই। ওকল্যান্ডে যে যাবে তারই ক্যারিয়ার নষ্ট, এইটাই সমস্যা। এক দিকে প্রেস্টিজ, আরেক দিকে প্রতিভার অপচয়। এক্সাক্টলি! আমিও তাই বলি...

“হে আমিগো, ...”
জ্বী, আমি স্প্যানিশ বুঝি না। কী ড্রিঙ্ক নেবেন? জ্বী, বুঝলাম না ঠিক।

“হাবলা এস্পানিওল?”
না। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশ। ঐ যে, ইন্ডিয়ার পাশে। আমি স্প্যানিশ বলি না। আমি স্বজাতবিদ্রোহী না। সত্যি বলছি। কী ড্রিঙ্ক নেবেন, প্লিজ?

“কক! কক ফর মাই ফ্রেন্দ তু।”
হোয়াট? ওহ, ইয়েস। আপনার জন্যও কোক? আপনিও। জ্বী, আপনার জন্যও। এই যে চার গ্লাস কোক। না, না। কোন ব্যাপার না। আমি কিছুই মনে করি নাই। আমার আসলে কিছু স্প্যানিশ শেখা দরকার চাইনিজে কাজ করার জন্য।

“কী, ভাই, বেচাকিনি কেমন? রাইন্ধা কুলাইতে পারতেসি না, বোজলেন নি?”
এই তো চলে। কিচেনে কী অবস্থা? ভীড় তো ভালই মনে হচ্ছে। স্যাম্পল এই হারে দিলে আরো লোক আসবে। আপনি তো ভিতরে আছেন, ঝামেলা বেশি হবে আপনার। অন্যভাবে দেখলে, একটু হলেও তো বসতে পারেন। আমার তো একটানা দিতে দিতে জান শেষ। এত করে বলি একটা লোক নিতে, তবু খাটাশের মত খাটাবে আমাকে একাই। কিপটার জাত সব। আমারও মাজায় ব্যাথা রে ভাই। এই একবেলায় পনের বালতি বরফ টানলাম।

“হে ম্যান, আমাকে কিছু বাড়তি দাও না। খাস দিলে দোয়া করবো। আরে ম্যানেজার আছে তো কী হয়েছে? দাও তো আরেকটু। ঐটাই ম্যানেজার? হোক। দাও তো একটু বেশি। নাহ, তুমি মানুষ ভাল না। ড্রিঙ্কের জন্যও টাকা দিতে হবে? ডাকাত নাকি তোমরা?”
মিডিয়াম কুলেইড, রাইট, স্যার? হাউ ডু আই নো? ডোন্ট ওয়োরি অ্যাবাইট ইট। জাস্ট এনজয় দ্য মিল। কীভাবে জানি? তিন ঘন্টা ড্রিঙ্ক ঢাললেই বুঝে যাবেন আপনিও। উহু, তেমন কিছু না। নেক্সট ইন লাইন, প্লিজ।

“কেমনে বোজলেন কী নিবো? আপনে তো দেহি কওনের আগেই ঢাইলা ফেলেন।”
গায়ের রঙ। কালোরা সোডা খায় না। সবার আগে নিবে কুলেইড বা ফ্রুট পাঞ্চ। না থাকলে লেমোনেড অথবা অন্য যেকোন রঙ্গিন পানীয়। তাতেও না হলে স্প্রাইট। এর বাইরে কখনই না। সাদা মেয়েরা নিবে ডক্টর পেপার। অখাদ্য, কিন্তু তবু ওটাই নিবে। বয়স্ক মহিলারা নিবে পানি নয়তো ডায়েট কোক। পেট দেখা গেলে ডায়েট কোক, দেখা না গেলে আইস ওয়াটার। ছেলেরা নিবে কোক। আমেরিকান বাদে যেকেউ শুধুই কোক নিবে। সবজিরা বরফ ছাড়া, বড়সড় মহিলারা বেশি বরফ দিয়ে, কালো লোকেরা কম বরফ দিয়ে। ভারতীয় আর মেক্সিকান হলে আলাদা করে চিলি সস নিবে, সাদা মেয়ে হলে সুইট অ্যান্ড সাওয়ার সস চাবে।

“সেইভ দ্য ড্রামা ফর ইয়োর মামা।”
কী ড্রিঙ্ক নেবেন বুঝতে পারছেন না? ইয়ু ওয়ান্ট আ মিস্টার পিব, ম্যাম। ইয়া, ইটস দ্য সেম অ্যাজ ডক্টর পেপার। হাউ ডু আই নো? হাহ, হাহ। না, আপনার বয়ফ্রেন্ড তো বয়ফ্রেন্ড বলেই জানে না। আমি ড্রিঙ্ক সার্ভ করি বলেই আমি জানি আপনি এটা নেবেন। এগ রোল দেই একটা সাথে? মাত্র ভেজে আনলো। বেশি না, মাত্র নাইন্টি নাইন সেন্টস। সাথে কিছু ট্যাক্স, অফ কোর্স। ক্যাশ অর ক্রেডিট? আমরা পঁচিশ পয়সা চার্জ করি ক্রেডিট কার্ডের জন্য। গোস্যা করবেন না তো এটায়? সাকুল্যে সাত টাকা সাতাত্তর পয়সা। না, ফোর নাইন্টি নাইন তো ড্রিঙ্ক ছাড়া। সাথে বাড়তি এগ রোল আর কার্ড প্রোসেসিং ফি। দাম বেশি? ওয়াও, জামাটা কার জন্য কিনলেন? বয়ফ্রেন্ড? আমারো একটা ছিল এমন।

“মাস্তি মে হো, সাহাব?”
মাস্তি? নট অন দিস সাইড অফ দ্য কাউন্টার, ব্রাদার! এ কী, এই মাংস নিলে কেন? হ্যাঁ, এটা চিকেন, কিন্তু এটাতে তো কুকিং ওয়াইন দেয়। ভেজি এগ রোল তো ভাজে পর্ক এগ রোলের তেলেই। পর্ক এগ রোল? ওহ, ঐ যে চিকেন বলে বিক্রি করছে, ওটাই পর্ক। ভাত বা নুডুলস নিয়ে সস দিয়ে খাও। এই দোকানের ভাত কিন্তু ভাল। বাঙ্গালি ভাই রান্না করেন পিছনে। আরে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নাই। ব্রাদার হারাম খেলে তো আমিই জাহান্নামে যাবো।

“নামাসঠে! আপ খ্যায়সে হো?”
বাহ, ভাল হিন্দি জানেন তো আপনি। ছিলেন নাকি ওখানে? ইয়া, নামাস্তে টু ইয়ু ঠু।

“আপ হিন্ডি বোলটে হো?”
আমি টুকটাক বুঝি, তবে বলি না। না, বুঝলেও বলি না। আই ॥মেক আ ফুল অফ মাইসেলফ ইনাফ টাইমস আ ডে। হোয়াই বদার ডুইং ইট ওয়ান্স টু মেনি?

“আই উইশ মাই বয়ফ্রেন্ড’স ওয়ালেট ওয়াজ অ্যাজ বিগ অ্যাজ হিজ বাকল।”
না, ফর্চুন কুকি ফ্রি না। মাফ করে দেন, ম্যাম। আমি আসলেই জানি না কেন ফ্রি না। টেক্সাসে ফ্রি হলে আমি কী করবো, বলেন? আমি তো ছাপোষা লোক। আচ্ছা ঠিক আছে, এই যে নেন। না, দাম দিতে হবে না। আমি টিপ জার থেকে কিছু রেখে দিচ্ছি এখানে। বেস্ট অফ লাক!

“হৈ! কিয়ারলেন এইডা? আপনের বাশক থেইক্কা নিয়া রাখলেন ক্যান?”
এমনি। কী দরকার ঝামেলা করে, বলেন? আর, কয়টাই বা পয়সা। অযথা দোকানের বদনাম। না দিলে নাই। আমি তো বাড়তি টাকা চাই না এটার জন্য। মামুলি কয়টা পয়সার জন্য লোকগুলো অযথা আমাকে গালি দিবে সারাজীবন। আমাকে দিলেও ঝামেলা ছিল না, দিবে তো আমাদের পুরা জাতকেই। বাকিরা কী করে জেনে কী লাভ, বলেন? আমার মন চাইলো, দিয়ে দিলাম।

“এই, কী কর এগুলো? আমার গায়ে গরম মাংস ফেললে কেন?”
আমি তো শুধু ফ্রেশ মাংসের ট্রে বসালাম, ম্যাডাম। এখান থেকে তো আপনার গায়ে মাংস পড়ার কথা না।

“আ পিস অফ হট মিট ফেল অন মি!”
পড়ে থাকলে আমি খুবই দুঃখিত, ম্যাডাম। আমি সাবধানেই রাখছিলাম। রাখার আগে তো আপনাকে একটু পেছনে সরে যেতেও বললাম, যাতে কিছু না লাগে।

“আমার গায়ে গরম মাংস পড়েছে! আমার জিন্সের উপর পড়েছে এটা। পুড়ে গেছে ভেতরে। আমাকে বেশি করে মাংস দাও, আর সাথে একটা ফ্রি এগ রোল দাও। ম্যানেজারকে ডাকবো আমি নয়তো। সিকিউরিটি কোথায়?”
(কপাল ভাল তোকে আমি কোন দিন আরামবাগের চিপায় পাবো না। ছাল তুলে ফেলতাম, বেটি। জামায় দাগ নাই, ফ্লোরে মাংস নাই, আসছেন উনি একটা সোরগোল তুলে আমার চাকরি খেতে। সাধে লোকে দেখতে পারে না তোদের? ঠিকই করে ম্যানেজার। এমনই করা দরকার তোদের সাথে। ধ্যাৎ, মুডটাই মেরে দিলো। ভাল্লাগে না আর এই সব। আমার পাখিশাস্ত্র নিয়ে থাকাই ভাল ছিল। আউচ, দুর্ধর্ষ পাখি আসছে একটা।)

“গেট আ লাইফ!”

প্রবাসের কথোপকথন ৮

“ঈদ মুবারক, দুবলা!”
ঈদ মোবারক, ভাইয়া। এই নিয়ে ছয়বার হল একদিনে।

“কী করবো বল? প্যাদরা নাই, ঘটি নাই, তাই তোমাকেই বলি বারবার।”
সেটাই। আপনি আর আমি ছাড়া এই ঘরে কেউ নাই।

“এই ব্যাটা, ভাগ! কী সব অশ্লীল কথাবার্তা বলিস।”
মন বড়ই উতলা, ভাইয়া। আর কাউকে তো কিছু বলার নাই। তাই আপনার সাথেই ঈদের দিনের আন্তরিক সময় কাটাই।

“হ্যাঁ, কেউ নাই আসলে এই ঈদে।”
মন খারাপ, হানি? ব্যাপার না। আসেন আপনি আর আমি মিলেই ঈদাঈদি করি।

“এই, তোর সমস্যাটা কী বল তো? আজকে এমন আমেরিকান হয়ে গেছিস যে? বিয়ার-টিয়ার খেয়ে আসছিস নাকি বাইরে থেকে?”
নাহ, বাইরে আর গেলাম কখন। মন ভাল না আসলে, ভাইয়া। সেই জন্যই ইয়ার্কি-তামাশা করছিলাম। দেশের বাইরে ঈদ, অল্প কয়টা মানুষ আমরা, তবুও আমরা দুইজন একা বসে আছি। কতক্ষণ আর অন্য কথা বলে আসল ব্যাপার এড়াবো, বলেন? সবাই মিলে ঈদে ঘুরতে গেল, আমাদের একবার বললোও না।

“তা ঠিক। এই ভাবে দেখার কিছু নাই। আফটার অল, এটা ওদের চয়েস।”
তা তো অবশ্যই। কিন্তু তবুও তো মনটা একটু কেমন কেমন লাগে, তাই না? আমি নাহয় অল্প দিন হয় এসেছি, আপনি তো আজকে সাড়ে চার বছর ধরে এদের সাথেই আছেন। আপনাকেও বললো না?

“নাহ, আমার এসব আর গায়ে লাগে না। অভ্যাস হয়ে গেছে। আমার ভালোও লাগে না এত হইচই।”
উপেক্ষিতের আত্মপ্রবোধ। সত্যিটা আপনি-আমি দুই জনেই জানি। আর সবার সাথে তফাৎ এখানেই যে, আমাদের দুই জনের গাড়ি নাই। সকালে ঈদের জামাতের জন্য জাগিয়ে দিতে হবে দেখেই যেন সাথে করে নিয়ে গেল। আর এই বেলায় একই আসর থেকে সবাই উঠে দাওয়াতে গেল এমন কায়দা করে যাতে আমরা দুই জনেই আলাদা থেকে যাই। কালকেই আবার শুনাবে আমরা গেলাম না কেন, আমাদের দাম বেড়ে গেছে নাকি, ওদেরকে ভাল লাগে না নাকি। বিরক্ত এসব দেখে দেখে।

“উহু, এই ভাবে চিন্তা করতে নাই। আল্লাহ ওদের দিয়েছে, ওরা এনজয় করছে। এগুলা আমি পাত্তা দেই না। আমার যেটুকু আছে সেটা নিয়েই আমি খুশি।”
তবুও তো খারাপ একটু লাগেই। প্রথম ঈদের কথা মনে পড়ছে, জানেন? বড় বেশি দোটানার ছিল ঈদটা। জীবনে প্রথম শার্ট-প্যান্ট-সোয়েটার পড়ে ঈদের নামাজ পরলাম সেবার। নামাজ সেরে ঘরে এসেই ক্লাসে দৌঁড়ানো। বিকালে ছাত্ররা মিলে জমায়েতটা ভাল ছিল, কিন্তু দেশের তুলনায় কিছুই না। মা ফোন করে খুব কাঁদছিল। বকেছিলাম খুব। কিন্তু ফোনটা রাখার পর বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা মোচড় দিলো। অথচ আগের রাতেই অনেক রোমাঞ্চিত ছিলাম। একা ঈদ করবো। নিজের মত ঘুরে বেড়াবো। কেউ ডাকবে না, কেউ বকবে না। সেটাই বিকাল নাগাদ আফসোস হয়ে ফেরত আসলো। কেউ ডাকলো না, কেউ বকলো না!

“আরে তুমি তো অনেক খুশি ছিলা সেই ঈদে। আমরা বলাবলি করছিলাম তুমি একা ঈদ করেও এমন খুশি, ব্যাপারটা কী। নতুন ছাত্ররা আরেকটু মনমরা থাকে।”
সিদ্ধি, সিদ্ধি। সাধনার সিদ্ধি।

“সিদ্ধি? এটা তো জিআরই বাংলা বললা। আমি তো বাইরে বড় হওয়া মানুষ, এত কঠিন বাংলা বুঝি না।”
হাহ, হাহ। আমি বাচ্চা কাল থেকে একটা মেয়েকে পছন্দ করি। পাত্তা না পেয়ে মনের দুঃখে বাইরে চলে আসলাম। সেই ঈদের দিন সকালে দেখি ইমেইল করে প্রেমের কথা বলছে।

“ওয়াও! ছক্কা! এই কথা আগে বললা না কেন? আমরাও মজা করতাম। লাভ-লেটার লিখছিলা তাহলে বসে বসে ঈদের দিনে।”
উহু। বলেছিলাম, ভাল মত ঈদ কর। আমিও ঈদটা ঠিক মত করে নেই। তারপরে জবাব দিবো।

“বল কী? রাগ করে নাই?”
করে নাই মানে? এই যে দাগটা দেখছেন না? দেশে গিয়ে সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম যে। এইটা হল ওনাকে এক দিন অপেক্ষা করানোর শাস্তি।

“প্যাদরারটার মত তাহলে। ব্যাটার বৌ আসার পরপর দেখি মুখে কাটাছাটা দাগ। জিজ্ঞেস করলাম, কী রে ব্যাটা, বেশ সুখে আছিস মনে হয়? বলে, না না, দরজায় বাড়ি খেয়েছি!”
হ্যাঁ, মনে আছে। তবে আরো মজার ছিল ভাবি আসার আগে ওনার সাঁতার কাটা বেড়ে যাওয়া। সপ্তাহে নিয়ম করে বারো বার সাঁতার কাটতে যেতেন। দেখেও না দেখে থাকতাম আর কী। এখন তো আর চিনেই না আমাদের। আচ্ছা, কোথায় কোথায় বেড়াচ্ছে এখন মনে হয়?

“লেটস নট টক অ্যাবাউট ইট। আজকে বৌ নাই ইন্টারনেটে? কথা হয় নাই আজকে?”
ছিল কিছুক্ষণ। ঘুরতে বের হয়ে গেছে বন্ধুদের সাথে। উনি আমার জন্য আর কোন কিছু তুলে রাখতে নারাজ।

“দেন লেটস নট টক অ্যাবাউট দ্যাট অ্যাজ ওয়েল। ঢাকায় কেমন কাটতো ঈদের দিন তোমাদের? আমি তো আফ্রিকায় বেবুনের সাথে উগাবুগা করে করে দিন কাটাতাম।”
দেশে থাকতে কত মজার ছিল ঈদের দিনগুলো। একা বের হতে দিত না, তবে আত্মীয়দের বাড়ি ঘুরতে যাওয়া হত। ঈদের সকালে স্পেশাল চটপটি বানাতো মা। নানার বাসায় কোর্মা করতো শুধু আমার জন্য আলাদা করে। বেশি মিষ্টি দিয়ে জর্দা-সেমাই বানাতো।

“এই ব্যাটা, ক্ষুধা লেগে যায় তো। চুপ থাক। খাওয়ার কথা বলবি না।”
দুই বাড়িতে ছাত্রদের জন্য দাওয়াত জোগাড় করেছিলাম। সবাইকে ফোন করে জানালাম, অথচ নিজেই বসে আছি এখন একা একা। ধ্যাৎ।

“বললাম না এসব মাথায় আনতে না? গ্রো আপ। লাইফে এরকম অনেক কিছুই হয়।”
আমার বেলায়ই এরকম বিব্রতকর ব্যাপারগুলো হয় শুধু। উফ, ক্ষুধায় পেটে বোমা ফুটছে।

“আরে আস্তে বল, ব্যাটা। দেখা যাবে ধরে নিয়ে যাবে শেষে। তখন মামুর বাড়ির মিষ্টি খেয়ো বসে বসে।”
খারাপ না আইডিয়াটা। কেমন না এই অতিসাবধানতা? এই যে সাধারণ কথাবার্তার সময়ও চোরের মত থাকা। মাঝেমধ্যে মনে হয় আসলেই কিছু একটা করে ফেলি। ভুগবো যখন, দোষ করেই ভুগি।

“এসব ভেবে লাভ নেই। এটুকু ঝামেলা মেনে নিতেই হবে এখন। ঘটি তো নিজের নামের সামনে থেকে মুহাম্মদই সরিয়ে ফেললো ভয়ে। ভীতু একটা। আমাদের আরেক বড় ভাই ছিল। সিটিজেন এই দেশের। তবুও ব্যাটা ভয়ে বের হত না ঘর থেকে প্রথম প্রথম।”
মেনে নিতেই হয় এখন। তবুও ভালো আমাদের দেখে ইন্ডিয়ান বলে, মুসলিম না। এই একটা দিকে সবজিদের কাছে আমাদের ঋণ শোধ হবার না। নাহলে খবরই ছিল। আরবগুলো তো বদমাইশি করলেও ওদের ব্যাকিং আছে অনেক। ধরপাকড়ের সময় তো আমাদের উপর দিয়েই যায় সব।

“আমার তো এক সিমেস্টারের টিউশন ফি আটকে দিয়েছিল। আমার বাবার নামে এক লোকের নাম আছে বলে ওয়াচলিস্টে। আর যায় কই। এই দিকে আমাকে তো টাকার জন্য বের করার অবস্থা। শেষে ক্রেডিট কার্ডে কাজ সারলাম। পরে টাকা রিলিজ হল ছয় মাস পর।”
আহারে বেচারা। আমাকে তো পাঠানোর সময় এক সিমেস্টারের টাকা দিয়ে বলেছিল যে এটাই শেষ। বাকিটা নিজেরই যোগাড় করতে হয়েছে। আমেরিকা দেখেই পেরেছি। যত যাই বলেন, ছাত্রদের জন্য এরচেয়ে ভালো জায়গা নাই আর কোন।

“বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। ভালই। ঘুম দিবো নে একটা। ক্ষুধাটাই সমস্যা। গান গাও তো দেখি একটা।”
আমি? গান? বের করে দেবে বাসা থেকে তাহলে। এখন কে অশ্লীল কথা বলছে? এর পরে কী বলবেন? বাইজির মত নাচবো? আপনি বরং গিটার খেলেন।

“লজ্জা দাও, না?”
লজ্জা পেলেই লজ্জা। আমি তো শুধু আপনার কথা আপনাকে মনে করিয়ে দিলাম।

“আমার কী দোষ? ইংলিশে বলে প্লেয়িং দ্য গিটার, আমি তাই বাংলায় গিটার খেলা বলে ফেলেছিলাম। পরে বুঝলাম যে এটা ভুল। বাংলা অনেক কঠিন ভাষা।”
তা ঠিক। তবে, আপনাদের ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা শুনে অসম্ভব মজা লাগতো। সাতার কথা মনে আছে? ঐ যে, দাওয়াতে গিয়ে বলেছিলেন, সাতা আসে? এইটা মনে থাকবে কেন, বলেন? ছাতা চাইলেন আর ট্র্যাশ ধরিয়ে দিল, এমন দৃশ্য বিরল।

“হ্যাঁ, দ্যাট ওয়াজ ভেরি এমব্যারাসিং। জন্ম বাংলাদেশে, বড় হয়েছি আফ্রিকায়, পড়ি আমেরিকায়, এর উপর আবার আরবি শিখতে হয়েছে। ছ উচ্চারণ করা খুবই কঠিন। আমার চেয়ে ভাল জানে না এটা কেউ। বহু কষ্টে এখন ছ বলি।”
তা আর আমি জানি না? যাক, পেট ডাকছে। বার্গার কিং বন্ধ হয়ে যাবে। সলেন!

“হ্যাঁ, সলো! কিন্তু টাকা আছে তো? আমার হাত একদম ফাঁকা।”
আমার কাছে সাড়ে পাঁচ টাকা আছে সাকুল্যে। বার্গার হবে একটা, ড্রিংক ভাগ করে খাবো নে। তবে এই দফায় আপনার সানডে পাই হচ্ছে না।

“ইশ, বৃষ্টি নেমে গেলো। একটু বসে যাই।”
আর দেরি করা যাবে না। পিছনের মাঠটা দিয়ে শর্টকাট মারলেও বন্ধ হওয়ার পাঁচ মিনিট মত আগে ঢুকতে পারবো।

“তাহলে কী আর করা। এ কী, ব্যাটারা ছাতাগুলোও নিয়ে গেছে?”

প্রবাসের কথোপকথন ৭

“...তো সেই দাওয়াতে উনি বলছিলেন আমেরিকা এসে কত জায়গায় থেকেছেন, কী কী কাজ করেছেন, কতগুলো ডিগ্রি নিয়েছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।”
হ্যাঁ, উনি তো মনে হয় কয়েকটা করে মাস্টার্স আর পিএইচডি করেছেন। একটা মানুষ যে কত পড়াশুনা করতে পারে! আমার তো একটা ব্যাচেলরর্স করতেই তেল বের হয়ে যাচ্ছে।

“আরে কারণ আছে। ঐ দাওয়াতের কিছুদিন পরেই আরেক দাওয়াতে সেই কথা তুলে এক ভাই বলছিলেন এত সাফল্যের উৎস কী।”
তাই নাকি? কেমন? জানা দরকার। আমার মত লোকেদের যদি অবশেষে সিদ্ধিলাভ হয় শুনে, মন্দ কী?

“ওনাদের বাড়ি তো যমুনা নদীর পাড়ে। বন্যায় ভেসে যায় প্রতি বছর। বলছিলেন যে ওনার বাবা নাকি ওনাকে ছোটবেলায় নদীর পাড়ে নিয়ে ঘাড় ধরে পানির উপর ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। বলেছিলেন, ঠিক মত লেখাপড়া করবি, নয়তো এই নদীতে মাঝিগিরি করতে হবে। এরপর বাকি জীবন শুধু পড়াশুনার উপরেই আছেন উনি। এমন শিক্ষা কি সহজে ভুলা যায়?”
অসাধারণ ব্যাখ্যা। আমার এক বন্ধু আছে এই রকম। খুবই পড়ুয়া। ব্যাটা কিছুদিন আগে জিআরইতে ৮০০ স্কোর করলো ভার্বালে।

“বল কী? জিআরই-তে ৮০০? তাও ভার্বালে? পাগল নাকি? আমাকে তো সিপাই-বন্দুক দিয়ে পাহারা দিয়ে পড়ালেও আমি এমন কিছু করতে পারবো না!”
আর বলবেন না। পাগলই ব্যাটা। মাত্র তিন সপ্তাহের পড়ায় এমন স্কোর, বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে আমার। আমার জানা মতে আর কোন খাস বাঙ্গালি প্রোডাক্ট এত স্কোর করে নাই।

“তা ওকে কোন নদীর পাড়ে ঝুলিয়ে রেখেছিল ওর বাপ?”
কী জানি। নারায়নগঞ্জ বাড়ি। শীতলক্ষ্যার উপর হবে হয়তো।

“এটা তো পত্রিকায় দেওয়ার মত অর্জন। সবাইকে বলা দরকার এটা নিয়ে।”
হ্যাঁ, সেটাই। বেশি বিনয়ী, তাই বলে না। হবেই না কেন? এটুকু না থাকলে তো আমার-আপনার সাথে তফাৎ থাকতো না। জাত লাগে আসলে।

“সেটাই। সবার জন্য সব না। এরকম বড় বড় কিছু করতে হলে জাত লাগে অন্য রকম। যাক, খুব ভাল লাগলো শুনে। আমাদের জন্য তো এই দেশে এটাই আছে শুধু। লেখাপড়া দিয়ে কিছু অর্জন করা, একটু নাম কামানো। লেগে থাকতে বল, বড় কিছু হলে আমরা বলতে পারবো।”
এই জায়গাটায়ই খারাপ লাগে। এই দেশে যতদিনই থাকি, যতকিছুই করি, কোনদিন পলিসিমেকার জাতীয় কিছু হতে পারবো না। আমাদের সুযোগ আর সবার সমান, রেজাল্ট আর সবার চেয়ে ভাল, সবাই নামও করে অনেক। কিন্তু তবু যেন কেমন কেমন লাগে একটু।

“সব সময় না। সুযোগ যে কখন এসে পরে, তা কেউ বলতে পারে না। এই যে বাঁধ ভাঙ্গলো, এটা বানিয়েছিলো আর্মির ইঞ্জিনিয়াররা। এক রিটায়ার্ড অফিসার পত্রিকায় লিখেছিলেন যে উনি আগেই প্রেডিক্ট করেছিলেন এমন একটা সমস্যার কারণে বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। ঐটা আমার রিসার্চের মধ্যেই পড়ে। লোকটার কথা পুরা ভুল ছিল। আমি পত্রিকায় চিঠি লিখলাম। প্রথমে তো আমার কথা কেউ পাত্তাই দিতে চায় না। আমি বাইরের দেশের এক প্রোফেসর, আমি কী জানি, বলো? পরে অনেক রিপোর্ট হল এটা নিয়ে, শেষ পর্যন্ত সেই আর্মি অফিসার মেনে নিলেন যে ভুল তাঁরই ছিল।”
একই ব্যাপার তো এলএসইউ হারিকেন সেন্টারের ডঃ ভ্যান হিয়েরডেনকে নিয়ে হয়েছিল শুনেছিলাম। উনি বলেছিলেন যে বড় হারিকেন আসবে, তাই যেন আগে কিছু তাঁবু কিনে রাখে সরকার। ওনার সাউথ আফ্রিকান অ্যাক্সেন্ট শুনে ফিমার অপারেটর বলেছিলো, আমেরিকানরা তাঁবুতে ঘুমায় না। এই ব্যাপারগুলোই খারাপ লাগে। যত কিছুই করেন না কেন, সারা জীবন সেকেন্ডক্লাস সিটিজেনের তকমা গায়ে লেগে থাকবে।

“ঠিক কথা। এই যে আমি এই এলাকায় আছি, তবু কেমন যেন লাগে। এই শহরের এটা সবচেয়ে দামী এলাকা। আমার রিসার্চ নিয়ে মিডিয়ায় অনেক রকম রিপোর্ট হচ্ছে, তবুও আমি ঘর থেকে বের হলেই মনে হয় যে পাড়াভর্তি সাদার মধ্যে আমি একটা কালো চামড়ার লোক।”
এই কথাই আমি বাইরে আসার কিছুদিন পর আমার হিন্দু বন্ধুদের বলছিলাম। সংখ্যালঘু জীবন কী জিনিস, সেটা বাইরে এসে বুঝেছি আমি। সংখ্যালঘু জীবনের দহনগুলো চামড়ার নিচে। উপর থেকে মনে হয় যেন সবই ভাল, সবাই সমান, সবই ঠিক। কিন্তু ভেতরের জ্বালাটা কাউকে ভাষায় বোঝানোর না। আমেরিকায় এত সমতা, আইনে এত নিরপেক্ষতা, তবুও এটা মনে হয়। আমাদের দেশে কী করতে বাকি রেখেছি আমরা সংখ্যালঘুদের উপর!

“কী বলে শুনে তারা?”
কী আর বলবে। শুকনা একটা হাসি দিয়ে বলে, বুঝলা তাহলে এতদিন পরে। আমি এই জন্যও বলি যে আমাদের দেশের মানুষের কিছুদিন বাইরে ঘুরে আসা উচিত। তাতে যদি স্বভাব একটু ঠিক হয় বাঙ্গালির।

“নাহ, সেটা হওয়ার না। বাঙ্গালি উলটা যেখানে যায়, সেই জায়গাই নষ্ট করে দেয়। দুইটা বাঙ্গালি এক হলেই শুরু হয়ে যায় হিংসা আর দলাদলি। চরিত্র বদলাবে না বাঙ্গালির কোনদিন।”
সেটা খুব একটা ভুল বলেন নাই। আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আমাদের শুধু আরো বেশি করে ধার্মিক করে দেয় বাইরে আসলে। দেশে মানুষ মোল্লা হয়ে যায় আইডি প্রকাশ পেয়ে গেলে, আর বাইরে এসে মোল্লা হয়ে যায় আইডি খুঁজে না পেলে।

“দেশে আইডি প্রকাশ পেয়ে যায় কীভাবে?”
জেলে গেলে! পত্রিকা খুললেই দেখেন না, এক সপ্তাহ রিমান্ডে গেলেই কেমন নূরানী দাড়ি নিয়ে বের হয় সব।

“ঠিক, ঠিক। তবে আইডি ক্রাইসিস আছে বলেই মাইনরিটিরা লেখাপড়ায় মনোযোগী হয় অনেক। ছেলেমেয়েদের অনেক যত্ন করে পড়ায়। এটা এই দেশের লোকেরা করে না। করার দরকারও নাই তেমন। দেশ তো এদেরই। এত্ত সম্পদ। ঝুট-ঝামেলার কাজ করে দেওয়ার জন্য তো আমরা আছিই।”
হ্যাঁ, তবে আমরাও মাইনরিটি, কালোরাও মাইনরিটি, হিসপ্যানিকরাও মাইনরিটি, ঐদিকে আবার ইহুদিরাও মাইনরিটি। অথচ তফাৎটা কেমন আকাশ-পাতাল।

“ইহুদিদের কথা আলাদা। ওরা পাঁচ হাজার বছর ধরে মাইনরিটি। সার্ভাইভাল স্কিল ওদের চেয়ে ভাল জানে না কেউ। ওরা যেখানে যেতে হয় যাবে, যা করতে হয় করবে। ওদের পা-ধোয়া পানি খাওয়ার যোগ্যতাও নাই আমাদের।”
এটা ঠিক বলেছেন। আমরা কথায় কথায় গালি দেই ওদের ঠিকই। কিন্তু নিজেরটা কীভাবে আদায় করে নিতে হয়, সেটা ওদের কাছ থেকে শেখার আছে আমাদের। আর, ওদের কেউ কোন কিছু হাতে তুলে দেয় নাই। কখনও জোর করে, কখনও পরিশ্রম দিয়ে, কখনও কৌশলে ওরা নিজেদেরটা ঠিকই আদায় করে নিয়েছে।

“আমি আর সব মুসলমানের মত ইহুদিদের কথায় কথায় গালি দেই না। আমি তো বরং বলি যে আমাকে দশটা ইহুদির সাথে বোতলে ভরে ঝাঁকায় না কেন? তাহলে যদি আমি ওদের কাছে কিছু শিখতে পারতাম। এরা যে কী পরিমাণ পরিশ্রম করে, আর কত আন্তরিকতা নিয়ে কোন কাজ করে, সেটা না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না।”
মুসলমানদের চেয়ে তো ওদের ক্রিশ্চিয়ানদের সাথে ঝামেলা বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু কীভাবে ঘাড়ে চড়ে গেছে সব ক্রিশ্চিয়ান দেশের। ওদের হয়ে আমেরিকা যুদ্ধ করে পথে বসে, ওদিকে ওরা আরো জাঁকিয়ে বসে নিজের দেশে। পুরো মধ্যপ্রাচ্যের যেই একটা মাত্র জায়গায় তেল নাই, সেখানে বসে পুরা আরব শাসন করছে। স্টেটসম্যানশিপ শেখার আছে অনেক ওদের কাছে।

“আমি তো অ্যাকাডেমিক লাইনে দেখছি। সব উঁচু ইউনিভার্সিটির প্রোফেসররা ইহুদি। নোবেল পুরষ্কার এরাই পায় সব। সেই রকম কাজগুলো এরাই করছে। আমরা শুধু পাশের মানুষটার দোষ খুঁজি আর ফালতু সব ব্যাপারে দুনিয়া মাথায় তুলে ফেলি। এসব করি, আবার দাবি করি আমরাই নাকি শ্রেষ্ঠ জাতি।”
কাজে আর কথায় ফারাকটা তো নতুন কিছু না। আমার সেই বন্ধুই বলছিলো যে ৬২% এর বেশি নোবেল লরেট নাকি ইহুদি।

“খুবই স্বাভাবিক। আমার সাথের এক প্রোফেসরের কথা বলি। ইরান থেকে এসেছে এই লোক। আমি দেখি তার কাছে-ধারে যায় না ডিপার্টমেন্টের কেউ। কারণ জানতে চাইলাম এক আমেরিকান প্রোফেসরের কাছে। বলে যে তাদের মনে হয় ঐ লোকের মাথায় দোষ আছে একটু। একবার নাকি টয়লেটে ওযু করার সময় সিঙ্কে পা তুলে দিয়ে পা ধুচ্ছিলেন। চিন্তা কর, একটা লোক সিঙ্কে পা ধুচ্ছে, আবার পাশের লোকটার দিকে তাকিয়ে বলছে, আমি তোমার চেয়ে উত্তম, আমি বেহেশতে যাবো। একই কাজ যে কত বাঙ্গালিকেও করতে দেখেছি, তার কোন হিসাব নাই।”
আমাদের দেশে হবে সেই মুমিন কবে, কথায় না বড় হয়ে নিচে পা ধুবে!

“এই দেশের মানুষ ইহুদিদের দেখতে পারে, তা না। সেই জন্যই ক্ষমতায় ওরা উঠতে পারে না, কিন্তু সবকিছুর উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ঠিকই রেখেছে ওরা। শেখার আছে আমাদের অনেক এই দিকে।”
আমার চোখে ইহুদিদের একটা বড় গুণ হল, তাদের নিয়ে কেউ কিছু বললেও ওরা সেটা গায়ে মাখে না। নিজের কাজ করে যায়। বরং নিজেরাই নিজেদের নিয়ে এত ঠাট্টা করে, যে আর কারও কিছু বলার নাই। আর আমরা মুসলমানরা সামান্য কিছুতেই অযথা লাফ দিয়ে উঠি। এত্ত বেশি হুজুগে আমরা সবাইই যে বলার মত না।

“সার্ভাইভাল মেকানিজম। ঐ যে বললাম, পাঁচ হাজার বছরের মাইনরিটি। ওরা জানে যে এসব নিয়ে পড়ে থাকলে ওদেরই ক্ষতি। এই জন্যই এত বেশি কাজের মধ্যে থাকে ওরা।”
আরেকটা ব্যাপার হল ইসরায়েলের প্রতি এদের ডিভোশন। পৃথিবীর যেই প্রান্তেই থাকুক না কেন, এরা এদের আয়ের একটা অংশ ইসরায়েলকে দেয় প্রতি বছর। স্যাবাটিকাল লিভ কাটায় ইসরায়েলি ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়ে। এমন কি ভারতীয়রাও এটা করে। করি না শুধু আমরা।

“আমাদের সমস্যা তো গোড়াতেই। আমরা আমাদের সব ব্যার্থতার জন্যই অন্য কাউকে দোষারোপ করে অভ্যস্ত। এজন্যই আমরা এত পিছনে।”
এটা নিয়ে আমার সেই বন্ধু একটা মজার কথা বলেছিল। ফ্যামিলি গাই-তে নাকি একবার স্টুয়ি ইহুদি হওয়ার জন্য গিয়ে দেখে অপ্টিমাস প্রাইম স্কালক্যাপ পরে বসে আছে।

“ফ্যামিলি গাই? অপ্টিমাস প্রাইম? এগুলা আবার কী?”

প্রতি-ইতিহাসঃ প্রথম ইরাক যুদ্ধ

কিছুদিন হয় রবার্ট ফিস্কের ‘দ্য গ্রেট ওয়ার ফর সিভিলাইজেশন – দ্য কঙ্কার অফ দ্য মিডল ইস্ট’ পড়ছি। পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ঘটনাবহুল এক জীবনের বিভিন্ন বিবরণ। ১ম বিশ্বযুদ্ধের এক আহত সৈনিকের ছেলের মূল্যবোধের কথা। ২য় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার ছায়ায় গড়ে ওঠা এক বালকের বেদনার কথা। মধ্যপ্রাচ্যের তুমুল ডামাডোলের মাঝে দিনাতিপাত করা এক সাংবাদিকের অভিজ্ঞতার কথা।

প্রাথমিক পর্যায়ের অনেকটা জুরে আছে ওসামা বিন লাদেনের সাথে ফিস্কের সাক্ষাৎ ও সাক্ষাৎকার। ইতিহাস কত রহস্যময়, আর মানুষ কত অর্বাচীন, সেকথা ঘুরে-ফিরে মনে আসছে বারবার। প্রথম ইরাক যুদ্ধের কথা আমরা জানি সবাই। জর্জ বুশ সিনিয়র ইরাকে তাঁর সৈন্য পাঠিয়েছিলেন সাদ্দাম হোসেনকে কুয়েত থেকে বিতাড়িত করতে। সেই যুদ্ধে সাদ্দাম পরাজিত হন, নিজ দেশের সীমানার মধ্যে অন্তরীণ হন, আফগানিস্তানে তালেবান ছত্রচ্ছায়ায় ওসামা বিন লাদেন তাঁর সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন, আমেরিকায় আক্রমণ হয়, আফগানিস্তান নিরস্ত হয়, ইরাক দখল ও সাদ্দামের ফাঁসি কার্যকর হয়।

আজকে পশ্চিমা বিশ্বের মাথাব্যাথা ইরাক ও আল-কায়েদার সম্ভাব্য যোগাযোগ নিয়ে। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস অন্য ভাবেও রচিত হতে পারতো। বিন লাদেন সৌদি আরব থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নেন সুদানে। অথচ এই সুদান ছিল তাঁর অপছন্দের তালিকার রাষ্ট্র। সাদ্দাম কুয়েত দখলের পর মুখ্য ভয় ছিল সৌদি আরব দখলের দিকে এগিয়ে যাবার। সেই সময় বিন লাদেন তার মুজাহেদিনদের নিয়ে সাদ্দামের মুখোমুখি হতে চেয়েছিলেন। সৌদি বাদশা মার্কিন সৈন্য প্রবেশ করতে দেওয়ার কথা বিবেচনা করলে এই বিন লাদেনই সাবধান করেছিলেন, মার্কিন সেনা কোনদিন পারস্য উপত্যকা ছাড়বে না। প্রেসিডেন্ট বুশের লিখিত প্রতিজ্ঞার উপর ভরসা করে সৌদি বাদশা মার্কিনি সাহায্য নিলেন, দেশছাড়া করলেন বিন লাদেনকে। যুদ্ধ হল, প্রতিজ্ঞা রইলো না।

ইতিহাস যদি অন্যভাবে রচিত হত, তাহলে কেমন হত আজকের মধ্যপ্রাচ্য? বিন লাদেন তাঁর উগ্র মৌলবাদ বজায় রাখতেন, এটা নিয়ে সন্দেহ নেই আমার। কিন্তু রাজনীতির বাকি চেহারা আদতে কতটা ভিন্ন হত? বিন লাদেনের জেহাদের সূচনা এবং মুখ্য লক্ষ্য তো মার্কিনমুক্ত আরব বিশ্ব। এই পালে কি আদৌ হাওয়া পড়তো সাদ্দাম বনাম বিন লাদেন যুদ্ধ হলে? বিন লাদেনকে কি আফগানিস্তানে আশ্রয় নিতে হত? তালেবানরা তো বিন লাদেনের পছন্দের তুলনায়ও কট্টর ছিল!

কুয়েত ক্রস-ড্রিলিং করছিল ইরাকে, তাই সাদ্দাম নাকি জর্জ বুশের দেওয়া অস্ত্র ও অনুমতি নিয়েই আক্রমণ করেছিলেন। এরকমটা শুনেছি এক কালে। সাদ্দামকে ঝুলানো হল ১৯৮৮এর আগের অন্যায়ের দায়ে। খুব আশায় ছিলাম সাদ্দামের বিচারকার্যের মধ্যে দিয়ে সেই সময়ের রাজনীতি পরিষ্কার হবে। হল না। তাহলে কি আরব বিশ্বে ঘাঁটি গড়বার মাস্টার প্ল্যান থেকেই সাদ্দামকে অস্ত্র দেওয়া, অনুমতি দেওয়া, যুদ্ধে হারানো, এবং তাঁর মুখ বন্ধ করে রাখা?

যাক, অত্যাচার হোক যথা তথা, মৃত্যু হোক ঝুলে।

প্রবাসের কথোপকথন ৬

“এলে অবশেষে?”
কাজ থেকে বের হতে হতে সোয়া নয়টা বেজে গেলো। এরপর বাসে আরো চল্লিশ মিনিট।

“কোন ব্যাপার না। খাওয়া সব ঠান্ডা হয়ে গেছে। গরম দেবো? সবাই খেয়ে নিয়েছে। নিজের মনে করে নিয়ে খেয়ো কিন্তু।”
উহু। নিজের মনে করে খেয়ে ঠকবো নাকি? নিজের মনে করে খেলে তো এক প্লেট ভাত তিন দিন ঘুরবে। পরের মনে করে গোগ্রাসে গিলবো। দাওয়াত দেখে দুই বেলা না খেয়ে বসে আছি!

“আহা রে। ছাত্রজীবনে একটু কষ্ট করতেই হবে। আমাদেরও বেশ কষ্টের সময় গেছে। তোমার আংকেল তো ছাত্র অবস্থায় বিবাহিত ছিল। দেশে বুড়ো বাপ-মার দেখভাল করতে হয়েছে। চাকরি পাওয়ার পরও আমরা ছাত্রদের মত ফার্নিচার কুড়িয়ে চলতাম। বিত্তবৈভব করতে পারতাম, কিন্তু সামান্য একটু বিলাসিতার মোহ ত্যাগ করতে পারলে কতগুলো মানুষের উপকার করা যায়।”
সেটাই। এই ভাবনাটা শিক্ষিত প্রবাসীদের মধ্যে খুব বিরল। যদিও হওয়ার কথা ছিল উল্টাটা। যেই মানুষগুলো কামলা খেটে টাকা কামায়, তারাই দেশে টাকা পাঠায়। তাদের তুলনায় তো পেশাজীবিদের সামর্থ্য অনেক বেশি। কিন্তু তারা দেশে কিছুই পাঠায় না।

“ছেলেপুলে বড় করার ব্যাপার আছে তো, তাই অনেকেই এখানে থিতু হয়ে যায়।”
সেটাই। তবে তার পরেও করা যায়। সবজিরা করে, হালাপিনোরা করে, ব্রকলিরা করে। করি না বলতে আমরা বাঙ্গালিরাই।

“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি। চিরদিন তোমার আকাশ...”
ওহ, গান শুরু হয়ে গেলো? আমি খাওয়া সেরে আসরে আসি, আপনি গলা মেলান গিয়ে।

“মা তোর মুখের বাণী আমার কানে বাজে সুখার মত। মরি হায়, হায়রে ও মা হুহু হুহু...”
(জাতীয় সঙ্গীতের জন্য দাঁড়িয়ে ভাত খাচ্ছি, এর মধ্যে গানের কথা ভুলে যেতে হল? কেউ ধরে দেয় না কেন? আমার কানে লাগে, বাজে না। মা তোর বদন খানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি।)

“আমরা বড়রা তো গান গাইই। আজকে নতুক কিছু করা হোক। বাচ্চারা গান করুক আগে।”
এটা ভাল বলেছেন। ইস, রেকর্ড করে রাখা গেলে ভাল হত।

“ফুরযাপতি, ফুরযাপতি, কোতায় পেলে বাই এমনো রঙ্গিন পাখা।”
খুব ভাল গেয়েছো, ভাইয়া। গানটার মানে জানো তুমি? এটা বাটারফ্লাই নিয়ে লেখা খুব সুন্দর একটা গান।

“হ্যাঁ, জানি।”
বলতো পাখা মানে কী?

“এটা তো সহজ। ইট দ্য লেগ!”
ইয়ে... আসো আমরা পরের গানটা শুনি। আমার কোলে বসে শুনবে? ওকি! কোথায় যাচ্ছো? পোকিমন? ঠিক আছে, দেখ গিয়ে।

“ভাবী, আকাশের ঐ মিটিমিটি তারা গান।”
(এহ, দিলো মুডটা নষ্ট করে। আর গান পাওয়া গেল না? কী যেন নাম এই গানের শিল্পী নায়িকার? যাক, চেহারা মনে করেই কেমন কেমন লাগছে। নাম মনে না পড়াই ভাল।)

“বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, করেছো দান।”
(গানগুলো সব এমন কেন? বেছে বেছে আজকেই বৃষ্টিতে পেতে হল সবাইকে?)

“আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে। এই নিরালায়...”
(আহা, এতক্ষণে মনের মত গান একটা। যাব না এই মাতাল সমীরণে আজ...)

“আচ্ছা, এবার কিছু নজরুল গীতি হোক। এই সুজন, গাও তো কিছু গান। না, না। আমরা কিছু শুনবো না। গাইতেই হবে গান।”
আরে পড়বে। গাইলেই গান মনে পড়বে। আমরা তো আছিই। লাইন মনে করিয়ে দিবো। না, শ্মশানে জাগিছে মনে নাই আমার। থাক, নজরুল ভুলে গেলে ঠাকুরই মারো এই বেলা।

“একটা কাগজ আর কলম দেন তো। গানটা লিখে নেই।”
কী গান লেখো? রবীন্দ্রসঙ্গীত? আইয়ূবের আমলে তোমার মত প্রতিভা যে কোথায় লুকিয়ে ছিল!

“এসো শ্যামল সুন্দর, আনো তব... পরের লাইন যেন কী?”
বকুল মুকুল রেখেছে গাঁথিয়া...

“ও হ্যাঁ। আচ্ছা, লিখে রাখি এটুকু।”
রবীন্দ্রনাথ এখানে থাকলে বলতো, ধরিত্রী দ্বিধা হও, তোমার মাঝে আমি হান্দায়া যাই! মতিন ভাই, আপনি শুরু করেন আপনার ব্যান্ডের গান।

“আরে না, না। আমি কি আর গান পারি?”
না পারলে আর কী করার আছে, ভাইয়া? সুজনের কাছে শুনতাম আপনি টয়লেট কাঁপিয়ে ফেলেন আজম খানের গানে। যাক, আমরা নাহয় আবৃত্তি শুনি কারও গলায়।

“ঠিক আছে, তোমরা যখন এত সাধাসাধি করছো, গেয়েই শুনাই কিছু গান।”
কিছু? কিছু তো একটু বেশি হয়ে যায়। না, ভাইয়া। থাকুক না। পরে কখনও হবে নাহয়।

“আমি যেই গানটা গাবো, সেটা যিনি গেয়েছেন, তাঁকে বাংলাদেশের অনেকেই গুরু বলে ডাকেন...”
এদিকে আসেন সবাই! মতিন ভাই গান গাবে!

“তিনি গান শুরু করেন সত্তরের দশকে। তখনও বাংলাদেশে ব্যান্ড সঙ্গীত তেমন জনপ্রিয় হয়নি।”
ভাইয়া, আমরা তো আজম খানকে চিনি। শানে নুযূলটা বাদ দেওয়া যায় না?

“ঐ পোলা, আমাগো আজম খান চিনাস? প্যাঁচাল না পাইরা গান ধর!”
(এইবার ঠিক আছে। একেই বলে ওপার বাংলার মুখে এপার বাংলার গালি।)

“রেল লাইনের ঐ বস্তিতে, জন্মেছিল একটি ছেলে। মা তার কাঁদে।”
(পকেটের রুমালটা শক্ত করে কামড়ে অন্য দিকে চেয়ে থাকা।)

“সে যে ব্যথিত হৃদয় আছে বিছায়ে...”
এটা কোত্থেকে আসলো?

“এই সুজন, তুমি গানে মাজখানে কী শুরু করলা? কিছু বুজো না!”
(চিড়িয়াখানা হয়ে গেল ঘরটা। হায়রে গৃহদাহ!)

“কত আশা ছিল তার জীবনে। ছেলেটি মরে গেল। তার সব আশা শেষ হয়ে গেল। মা তার কাঁদে!”
জ্বী, আমরা এবার অন্য গানে যাই। পাপ্পু ভাই, আপনি কী যেন গাবেন বলছিলেন।

“চল আমরা জেমস গাই। দাদা, আপনি গান ধরেন, আমি টান লাগাই।”
হ্যাঁ, সেভেনটিস থেকে আমরা নাইনটিসে আসি এবার।

“দুঃখিনী দুঃখ কোর না...”
সবাই এত দুঃখের গান কেন গাচ্ছে আজকে?

“আমরা এবার একটু ওয়ারফেজ গাই।”
হাহ হাহ, আরো কয়েক বছর সামনে গেলাম, তাই না?

“আচ্ছা, এখন দেশে কারা হট?”
জানি না। আমি আসার আগে তো অর্থহীন খুব চলছিল। আমি ত্রিমাত্রিক নিয়ে এসেছিলাম সাথে করে। এর পরে বাংলার কিছু গান শুনলাম। মাঝে ব্ল্যাক সহ আরো কিছু বেশ উঠে গেছে শুনলাম। সেটাও তো বছর তিনেক আগের কথা।

“আমি দেশ ছেড়ে আসার আগে সিলসিলা বের হয়েছিল, বুঝলে? আমরা সবাই দেখা এক খোয়াব তো গেয়ে গেয়ে ভার্সিটির মেয়েদের বিরক্ত করে ফেলেছিলাম। তোমরা কত আধুনিক, দেশ সম্পর্কে কত জানো, কত যোগাযোগ তোমাদের।”
এটা ঠিক যে আমাদের ইন্টারনেট আছে, ফোন আছে। কিন্তু দেশের খবর ওগুলোয় পাওয়া গেলেও দেশের জোশটা পাওয়া যায় না। এই জন্যই আমরা গানগুলো পেলেও বুঝি না কোন গান কোথায় এবং কতটা জনপ্রিয়।

“ফেরদৌসির একটা গান আছে। কী যেন নাম ছায়াছবিটার? এই নীল নীল নির্জন নিরজনে...”

প্রবাসের কথোপকথন ৫

“তুমি কি এই ক্লাসে?”
জ্বী, আমি ইংলিশ ১০০৫ এর রুম খুঁজছি।

“হ্যাঁ, এটাই। কিন্তু তুমি ১০ মিনিট লেট।”
দুঃখিত। আমি ১০০৪ এর ক্লাসে চলে গিয়েছিলাম ভুলে।

“তুমি কি একটা সিট নেবে?”
ধন্যবাদ।

“ক্লাস, আমরা এখন একটা খেলা খেলবো। খেলায় খেলায় আমরা পরিচিত হব সবার সাথে। সবাই ডেস্কগুলো একপাশে সরিয়ে গোল হয়ে দাঁড়াই আমরা।”
(এ কোন নতুন কুঁড়ির পাল্লায় পড়া গেল!)

“আমি শুরু করছি। আমি মিস কার্নি।”
(উফ! সুন্দরীরা কেন জোড়ায় জোড়ায় ঘোরে? ক্লাসের পিছনে আসলাম সুন্দরীর গন্ধ শুঁকে শুঁকে, তবু লাভ নাই।)

“এবার তোমরা যার যার নাম, কোন দেশ থেকে এসেছো, এবং কী পড়তে চাও বল। কেউ চাইলে অন্য কোন গল্পও বলতে পারো।”
(এত্ত সুন্দরী মহিলা, বয়স মনে হচ্ছে ৩০ এর একটু ওদিকে হবে। কোরিয়ান চেহারা। কী সুন্দর! হাতে আংটি নাই কেন? ধুর, সম্ভাবনার কী নিদারুণ অপচয়!)

“আমার নাম ঝঁন। আমি সাউত খোইয়া থেকে এসেছি। পিএইচডি করতে এসেছি। আমার একটা বৌ আর একটা বাবু আছে দেশে। আই রাইক আমেলিকা।”
(ঝঁন? ওহ, জন! যাক, উচ্চারণ নিয়ে আমাকে না ভাবলেও হবে। এত হাসছে? আশ্চর্য। আমারই লজ্জা লাগছে বুড়া বয়সে এই শিশুতোষ ক্লাস করতে। যাক, শিক্ষনীয়।)

“আমি ম্যাগি। আমি বুলগেরিয়া থেকে। ক্রিমিনোলজি পড়বো। আর নয়তো সাইকোলজি। নয়তো বায়োলজি। আমি সাইলেন্স অফ দ্য ল্যাম্বস ১২ বার পড়েছি। আমি ধনু রাশির জাতিকা।”
(ওয়াও! একে দিয়েই হবে। ডার্ক টেইস্ট, খুল্লামখুল্লা রূপ, চোখেমুখে পূর্ব ইউরোপের সপ্রতিভ চঞ্চলতা। রাশিও এক।)

“আমি ডিনা। কোলোম্বিয়া থেকে এসেছি। লাইফ সায়েন্সে পিএইচডি করতে। আমার বরও এখানে পড়ে।”
(আমরা সবাই কত্ত বুড়া। এই দেশিগুলো কত অল্প বয়সের। আমরা সব আদুভাই এসে জুটেছি। ধ্যাৎ!)

“আমি সাইফ। আমি স্কেটবোর্ডিং করি। আমি ১৩ বছর বয়সে হাইস্কুল পাশ করেছি। আর... আই লাভ স্কেটবোর্ডিং।”
(১৩ বছর বয়সে আমি সেভেনে পড়ি। মর শালা! মেয়েগুলা যাও বা একটু তাকাচ্ছিল, এই বাচ্চা এখন সব নিয়ে গেল।)

“এবার তোমার নাম বল।”
আমার নাম ইশতিয়াক রউফ।

“ওয়ো! আস্তে, আস্তে। আবার বল।”
ইশ...তি...আক রো...উফ।

“ইটঠাক?”
ইশশশ...তি...আক।

“তোমার নাম অনেক ডিফিকাল্ট।”
বুঝতে পারছি। ছোট ছোট অংশে ভেঙ্গে চেষ্টা করে দেখতে পারো। আমার বন্ধুরা আমাকে ইশতি ডাকে। তোমরাও তাই ডেকো।

“ইত্থি?”
ইশশশ...তি!

“ইশঠি?”
আই এস এইচ টি আই।

“আইশঠি, রাইট?”
ইউ নো হোয়াট, এত কষ্ট করতে হবে না। আমাকে স্রেফ ইশ ডেকো তোমরা।

“আই এস এইচ। ওহ, এটা অনেক সহজ। আইশ, অর ইশ?”
(রক্ষা কর মাবুদ। বাপ-মা যে কেন আমার নাম জন ডো রাখলো না?)

“ইসশ, ওকে? এটাই ডাকবো তোমাকে।”
এখানেই এক বড় ভাই থাকেন। ওনার নামও ইশতিয়াক। উনি ফিশ লেখা একটা বেল্ট পড়ে ঘুরেন। এখন বুঝতে পারছি কারণটা।

“আমরা খুবই দুঃখিত। তোমার নামটা বুচার করছি আমরা। আসলে, নামটা একটু আনকমন তো।”
ব্যাপার না। সহজ করে দিচ্ছি। আমাকে শুধু আই ডেকো। নামের বাকি সব ভুলে যাও।

“এটা বেশ মজার। আই! আমি তাহলে মিস সি এখন থেকে।”
সেটাই। খারাপ না। এই ক্লাসটাকে চিরজীবন মনে রাখার মত একটা কাহিনী পেয়ে গেলাম প্রথম দিনেই।

“আর! এই আর! তুমি কোন দেশ থেকে এসেছো বললে না?”
তা মিস সি, আপনি কতদিন এই দেশে?

“ম্যাগি একটা প্রশ্ন করেছিল তোমাকে, আই।”
ওহ, ওটা আমাকে বলেছিল?

“ওহ। আই! ধুর! ভুল করে ফেলেছিলাম।”
কোন ব্যাপার না। তুমি আমাকে যা খুশি ডাকতে পারো। চাইলে ‘হে!’ বলে ডেকো। চাই কি হাতের কাছে যা পাও ছুঁড়ে মেরো।

“বাট হে ইজ ফর হর্সেস!”
(তোমার মত সুন্দরীর জন্য শুধু ঘোড়া কেন, খচ্চরও সই!)

“তোমার জামায় কি ওটা তোমার দেশের নাম লেখা? লম্বা নাম। ব্যাং... লা...”

একটি জাতির পরিচয় কিসে?

একটি জাতির পরিচয় কিসে? আমরা কতটুকু ছাড় দিতে পারি সেটায়, নাকি আমরা কতটা ছাড় দেই না সেটায়? কেমন জাতি আমরা? আজ থেকে শত বছর পর কী দিয়ে চেনা যাবে আমাদের? জবাব হয়ত ইতিহাসেই সুলভ। প্রশ্ন হল, আমরা কি ইতিহাসসুলভ?

ব্রাজিলের মারাকানা স্টেডিয়ামের কথা জানি সবাই। ফুটবলপাগল এই জাতি তার সমস্ত সঞ্চয় উজার করে ১৯৫০ এর বিশ্বকাপের জন্য তৈরি করেছিল এই স্টেডিয়াম। কোন মান্যগণ্য ব্যক্তি নয়, নামকরণ হয়েছিল পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীটির নামে। বহতা নদী, ইতিহাসের সাক্ষী নদী, সমালোচনার ঊর্ধ্বে নদী, প্রাণের নদী, প্রাণদায়ী নদী। পেছনে ছিল রাফায়েল গাল্ভাও আর পেদ্রো বেরনার্দেস বাস্তোসের স্বপ্নের স্থাপত্য আর সাড়ে নয় কোটি হতদরিদ্র মানুষের ভালবাসা।

দুই লক্ষ দর্শক দিনান্তে দুঃখ ভুলে মেতে উঠতো এখানে, প্রিয় স্বদেশ হেরে গেলে নিস্তব্ধ হয়ে যেত একসাথেই। কেউ পতাকা জড়িয়ে কাঁদতো, কেউ পতাকা পোড়াতো, কেউ স্রষ্টাকে দুষতো, কেউ মদের বোতল ছুঁড়ে ফেলতো, বাঙ্গালি ঘরানার দু-চারজন থেকে থাকলে হয়তো বোতলে মূত্রত্যাগ করে নিচে ছুঁড়ে ফেলতো। এভাবেই গড়ে উঠে অন্য রকম এক দেশাত্ববোধ, ব্রাজিলিয় দেশাত্ববোধ। এখানেই বেড়ে ওঠে রোনাল্ডো, রোমারিও, সক্রেটিস, কার্লোস আলবার্তো, কাফু, রবার্তো কার্লোস, ফ্যালকাও, পেলে, রিভালদো, জিকো। কেমন অদ্ভুত না?

আমরা কিসের জন্য এত দাম দিয়েছি? দেশটাকে পাবার জন্য দিয়েছি, হ্যাঁ, কিন্তু সে তো ৩৬ বছর আগের কথা। দেশকে গড়বার জন্য কী করেছি? পরিচয় তৈরি করবার মত কী করেছি? কী দেখে যেকেউ বুঝবে এখানে বাংলা এসেছিলো, বাঙ্গালি এসেছিলো?

পরিচয় বদলাবো, উপদেশ চাই

এক বান্দার কথা শুনেছি বন্ধুমুখে। দেশের বাইরে গিয়ে ডকুমেন্টস হারানোতে আমেরিকা আসতে ঝামেলা হচ্ছিল তার। লোকটা ঢুকতে সুবিধার জন্য নিজেকে ইহুদি বলে পরিচয় দিল। কোন প্রকার কাগজ, বাক্স, সরঞ্জাম লাগলো না। উলটো বিশেষ আপ্যায়ন করে আমেরিকা আনা হল তাকে। আমেরিকা আসার পরেও দেখে তার যত্নআত্তির শেষ নেই। সেই লোক এখনও ক্যাথলিক, তবে মাথায় একটা স্কাল ক্যাপ পড়ে ঘুরে শুধু ইহুদি হিসেবে সুবিধা পাবার জন্য।

দাঁড়ি রাখি না আমি। ইচ্ছা ছিল, চেষ্টা ছিল। কিন্তু মোঁচ আর দাঁড়ির মাঝের সাঁকোটা অনেক কষ্টেও তৈরি করতে পারলাম না। তদানিন্তন বৌন্ধবীর হুঙ্কার, ম্যানেজারের ভ্রুকুটি, এবং বিরক্তিকর ঘ্যাসঘ্যাস চুলকানিরও ভূমিকা ছিল। টুপি পড়লে মাথা চুলকায়, যেটুকু চুল আছে তাও লেপটে যায়। মোঁচেও কোন রকম নূরানি আমেজ নেই। আলখাল্লা পড়াটা কষ্টকর, কিন্তু সেটা নিজের গায়ের গন্ধেরই ভয়ে। তবু জামাতি হওয়ার আবেদনটুকু অনস্বীকার্য। দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নেও মোল্লাদের কেউ ঘাঁটায় না। এমন কি এই আমেরিকাতেও না। যাদের দাঁড়ি আছে, তারা সাচ্চা মুসলিম, তারা কোন সাতে-পাঁচে নেই। ঝামেলা তো করে যত ক্লিন-শেভড মুসলিমগুলো।

কী দেশ, কী বিদেশ, কট্টরেরাই ভাল আছে। মইত্তা রাজাকার ভাল আছে, কমান্ডার নিজামি ভাল আছে, হুজুরেরা ভাল আছে, আলেমেরা ভাল আছে, র‌্যাবাইরা ভাল আছে, প্যাস্টরেরা ভাল আছে। ভাবছি আমিও পরিচয় বদলাবো। কোন বেশ ধরা যায় বলতে পারেন কেউ?

লুইস, হায় লুইস

গত সাড়ে তিন বছর ধরে বসবাস আমার লুইজিয়ানায়। দেশ থেকে দূরে, তবু যেন দেশেই ছিলাম। গরম, গরীব, গতানুগতিক। বরফ পড়েনি এখানে কখনও। চামড়া পোড়ানো গরম। আর্দ্রতা কম বলে ঘাম কিছু কম হয়, এটাই পার্থক্য। আরও একটা পার্থক্য আছে। শীতল বাতাস দেহ জুড়ায় যেকোন দালানে ঢুকলেই, এটা বড় সুবিধা। আমি খুব সাধারণ, ভেতো বাঙ্গালি। শীতের চেয়ে গরম সয় বেশি। আমার হতাশা অন্য।

এখানেও পথহারা পথিক পথে বসে থাকে। জীবনযুদ্ধে শ্রান্ত, পরাজিত মানুষ খুব একটা দুর্লভ না এখানে। বিদেশে একটা দেশ-দেশ ভাব থাকা ভাল। প্রাথমিক ধাক্কাটা সইতে সহজ হয়। আমার জন্যও ব্যাপারটা সেরকম ছিল। ব্যাটন রুজে আছি শুনে লোকে ঠাট্টা করে বলতো, গ্রামে আছি। তেমন কোন হাই-রাইজ নেই। স্কাই-স্ক্রেপার নেই। সাবওয়ে তো দূরের কথা, ইজ্জতসম্পন্ন একটা বাস সার্ভিসও নেই। বড় ফ্র্যাঞ্চাইজ নেই। বিনোদন নেই। হোটেল নেই। পার্ক নেই। স্থাপত্য নেই। যাদুঘর নেই। টুকটাক বার আছে, তবে একটা স্ট্রিপ ক্লাবও নেই! নেই বলেই লুইজিয়ানাকে ঘিরে আমার এত স্বপ্ন। কারণ এই নেইগুলোর জন্যই লুইজিয়ানা আমার কাছে বাংলাদেশের প্রতিভূ। এখানে যা সম্ভব, তা বাংলাদেশেও সম্ভব। আকার এক রকম, পরিবেশ এক রকম, সামর্থ্য এক রকম, মানুষ এক রকম। দুঃখের কথা, রাজনীতিকগুলোও এক রকম। এই চাঁড়ালগোত্রীয়দেরই কিছু কথা জানাই।

টেক্সাস আর লুইজিয়ানা পাশাপাশি অঙ্গরাজ্য। আকারে দুটোই বেশ বড়। লুইজিয়ানাকে ফ্রান্সের কাছ থেকে কেনা হয় ১৮০৩ সালে। এই ক্রয়ের প্রধান কারণ ছিল নিউ অর্লিয়েন্সের নৌবন্দর। মিসিসিপি নদী এদেশের অর্থনীতির প্রাণ। তাই সেই নদীর উপর নিয়ন্ত্রণ পেতে নিউ অর্লিয়েন্সকে নিয়ন্ত্রণে আনা। আজও এই বন্দর ভৌগোলিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবু কত মলিন, কত অযন্তলালিত এই শহর, তা সবাই দেখেছেন হারিকেন ক্যাটরিনার পর। কারণ, অব্যাবস্থাপনা। অপরপক্ষে পাশেই গ্যাল্ভাস্টোন বন্দর কাজে লাগিয়ে টেক্সাস এগিয়ে গেল।

টেক্সাস ও লুইজিয়ানায় একই সময়ে বিপুল পরিমাণ তেলের সন্ধান মেলে। টেক্সাস সেই তেলের টাকায় বিশাল সব রাস্তা বানায়, ট্রান্সপোর্টেশন ইন্সটিটিউট তৈরি করে, পাবলিক এজুকেশন রিফর্ম করে, এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। তাকিয়ে দেখুন ফলাফল টুকু। পাশেই লুইজিয়ানা সেই টাকা খাটায় একের পর এক ক্যাসিনো বসিয়ে। কারণ, অদূরদর্শিতা।

পুরো আমেরিকায় লুইজিয়ানার খ্যাতি আছে এর জোচ্চোর রাজনীতিবিদদের জন্য। টেক্সানরাও বেশ খ্যাত, তবে গোঁয়ার ও মাথামোটা হিসাবে। কিছুদিন আগে লুইজিয়ানার ডেমোক্রেটিক কংগ্রেসম্যান জেফারসনের অফিসের ফ্রিজ থেকে এক লাখ ডলার পাওয়া গেছে। তদন্ত চলছে। এর মাঝে নির্বাচন হয়েছে। তিনি পুনর্বার জয়ীও হয়েছেন। টাকা কোথা থেকে এসেছে তিনি জানেন না, তবে এটুকু জানেন যে টাকাগুলো পবিত্র। লুইজিয়ানাকে আজ বাকি আমেরিকা টাকা দিতে চায় না দুর্নীতির ভয়ে। কারণ, রাজনীতিকের অস্বচ্ছতা।

পরের ঘটনা এই সেদিনের। ধর্মান্ধ রিপাবলিকানদের দল থেকে সমকামীতাবিরোধী ও গর্ভপাতবিরোধী এক কট্টর সিনেটর ডেভিড ভিটার ফেঁসে গেছেন নেগোশিয়েবল ভালবাসায় গা ভাসানোর দায়ে। তিনি নির্বাচনের সময় নিজেকে আর দশজন মানুষের চেয়ে অতি উচ্চ মূল্যবোধের বলে দাবি করে অপদস্থ করেছেন অনেককে। সেই তাঁরই নাম ফাঁস করে দিয়েছে ল্যারি ফ্লিন্টের হাসলার ম্যাগাজিন। ভিটার ১৯৯৯-২০০০ সালে নিউ অর্লিন্সের এক বিশেষ শ্রেণীর সমাজকর্মীনীদের নিয়মিত সেবা করতেন, নিতেন। তিনি এতই উঁচু মাপের সমাজঅন্তপ্রাণ ছিলেন যে তাঁকে ব্যাক্তিগত সেবা দিতে সমাজকর্মীনির দল প্রায়ই লটবহর সহ চলে আসতেন গাড়ি করে। এই খবর বের হবার পর তিনি বলেন, এই পাপের জন্য তিনি তাঁর স্ত্রী এবং ইশ্বরের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন, এবং দুজনের কাছেই ক্ষমা পেয়েছেন। মানুষ হিসেবে আমি এমনিতেই নাফারমান। ভাবছি ইশ্বরের সাথে এই সুবাদে আমিও একটু সাক্ষাৎ করে ফেলি। লুইজিয়ানাকে কেউ গুরুত্বের সাথে দেখে না। কারন, ভণ্ডামি।

এক কালে বন্ধুমহলে বলেছিলাম, নারীমাত্রই দেবী, দেবীমাত্রই আরাধ্য, আরাধ্যমাত্রই দ্রষ্টব্য, আর দ্রষ্টব্যমাত্রই ধর্তব্য। সেই আমিই ভাগ্যের ফেরে লুইজিয়ানায় এলাম কিছুকাল পর। এখানকার রাজনীতি দেখে বন্ধুদের বলা কথাটাই আমিও বললাম সেদিন মনে মনে। লুইস, হায় লুইস।

এই হল আমার আবাস। আমেরিকার মধ্যেও ছোট্ট এক টুকরো বাংলাদেশ। এত কিছুর পরও জায়গাটা ভাল, এখানকার জীবনটা ভাল, সাধারণ মানুষগুলো ভাল। এখানেই লুইজিয়ানায় বসে আমার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা। বাংলাদেশ যদি অন্তত লুইজিয়ানা হত!

দ্বিতীয় দৃষ্টি

বরাবরের মত বাস আজকেও সময় মত এল না। আজকে মিনিট দশেক দেরি। শহরটা ছোট, সীমিত, সবুজ। মূলধারার আমেরিকান শহর। হলিউডি চমক-জমক নেই এখানে। ঘামের শহর, নামের নয়। লোকসংখ্যা খুব একটা বেশি না। লাখ তিনেকের মত হবে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এখানে খুবই দীন। তবে কারণটা মানুষের সংখ্যা নয়, মানুষের ধরন। সাদা আর কালো। বেশি বেশি কালো, কম কম সাদা। কারও হাতে বেশি বেশি সম্পদ, কারও হাতে একেবারেই কম। সম্পদশালীরা শুধুই সাদা। দুস্থরা শুধুই কালো। পাবলিক তাই কালো। পাবলিক ট্রান্সপোর্টও তাই। বাসগুলো যেন সভ্যতার চিড়িয়াখানা। দারিদ্র্যের ভ্রাম্যমান যাদুঘর। যারা চড়ে তারা আমার মত। ঠিক যেমন আমিও আর সবার মত।

ডিপ সাউথের শহর। দুর্বলতম অঙ্গরাজ্য। দুই মহা-হারিকেনের দ্বৈত দাপটে অধুনা তারকাখ্যাতি পাওয়ার পরও বদলায়নি লুইজিয়ানার কোন কিছুই। এর রাজধানিতে রাজা আছে, ধন নেই। তবু পাথরের বুক চিরে পানি আনার কড়কড়ে সবুজ নেশায় আমিও চড়লাম বাসে। বরাবরের মত শেষের এক কোণায়। নিরাপদ দূরত্বে বসে মানব দেখে মানস চেনার অক্ষম চেষ্টা। সংখ্যালঘুর অবসর। ঘন্টাখানেক অনেক সময়। একে একে বাসে চড়লো অনেকে। কেউ বানর, কেউ বিড়াল, কেউ বেজি। মানুষের পূর্বপুরুষ সবাই, কিন্তু কেউ মানুষ না।

বানরটা ব্যাস্ত বেশ। ঝুলে পড়া জিন্সের হাফপ্যান্ট এক হাতে মুঠ করে ধরা। গায়ে হাতাকাটা গেঞ্জি। মাথায় বারান্দাওয়ালা টুপি। মুখে ললিপপ। হাঁটুর নিচের পকেটে ঝুনঝুন করছে খুচরা পয়সা। পায়ে দুধের মত সাদা কেডস। ঝুলছে অনেক। দুর্বোধ্য হিপহপের সাথে সাথে আওয়াজ দিচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ। পাশের লোকটার দিকে ফিরে কিছু বললো। ইবনিক্স। ভাষার দাস্ত থেকে জন্মানো দুর্বোধ্য কিছু ধ্বনিমালা। আলাপন শেষে বিশেষ অঙ্গভঙ্গি ছাড়া এর অর্থ পূর্ণ হয় না। উল্টা দিকে বসা বাচ্চা ছেলেটার সাথে জমেছে মনে হয় বেশ। বাচ্চাটা বাসের ফ্লোরে গড়াচ্ছে, বানর উৎসাহ দিচ্ছে, বাচ্চার বাপ গর্বিত চোখে ছেলের কীর্তি দেখছে।

বিড়ালটার সাজ অনেক। রাঙ্গানো নখ, বাঁধানো দাঁত, পাঁকানো চুল। নকল নখের উপর টকটকে লাল পলিশ। দাঁতে পিতলের আচ্ছাদন। চুলগুলো লালচে, রুক্ষ। জিভে আংটি। হাতে ছয়টা। একেক কানে চারটে করে ছিদ্র অলংকৃত হয়ে আছে বিবিধ আকারের ধাতুতে। এর উপরই ঠেসে ধরে আছে মোবাইলটা। তারস্বরে বকছে কাউকে। ঐ প্রান্তের হতভাগা কী পাপ করেছিলেন বোঝার জো নেই। তবে এটুকু জানা গেল যে ঐ প্রান্তে পুরুষ কেউ এবং তার জন্মপরিচয় কিছুটা ধোঁয়াশা। লোকটার মা তেমন সুবিধার মহিলা নন। কয়েদি ও নাবিকদের লোকটার সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত। পরবর্তী দেখায় লোকটার তোবরানো গাড়িটা তার পশ্চাৎদেশ দিয়ে প্রবেশ করানো হবে। এহেন আরো অনেক অনাহূত তথ্যে ভেসে গেলাম চোখের পলকে। বড় জাঁদরেল বিড়াল।

বেজির হাতে একটা ব্যাগ। তাতে দুটো গোলাপি টুপি, কয়েক ফাইল মাথাব্যাথার ওষুধ, চার হাত লম্বা কিছু টি-শার্ট, মাছের আঁশের মত ডিজাইনের একটা হাতব্যাগ, ডজন খানেক সিগারেটের প্যাকেট। লজেন্সও আছে কিছু। সাধছে এক মহিলাকে। মানা করায় ক্ষেপে গেল খুব। যেন সাধিবামাত্র কিনিতে বাধ্য থাকিবে। না, মহিলা তবু কিনছে না। নিজেই সাবার করে দিল এবার লজেন্সটা। খোসাটার ঠিকানা হল পাশের সিট, আর মুখের গামটা লেগে গেল সিটের নিচে। উঠে গিয়ে আরেক জনের পাশে বসলো। এবারে সফল। এক শিশি টাইলানল। দামটা বেশি মনে হল একটু। কে জানে, শিশিতে কী বেঁচলো। দাওয়াই, নাকি রোগ।

আমার দিকেই আসছে। কিছু বলবে মনে হয়। কিছু বললো মনে হয়। কিছু শুনবার অপেক্ষায় মনে হয়। প্রথম নিয়ম খাটে না এরকম অবস্থায়। চলন্ত বাসের ভেতর আটকা। দুঃখিত বলে দ্রুত হেঁটে চলে যাবার পথ নেই। দ্বিতীয় নিয়মও অচল। জনসমাবেশে নিরাপত্তা খোঁজার অবস্থা নেই এখানে। সেফটি ইন নাম্বারস কথাটা খাটে না এই চিড়িয়াখানায়। অগত্যা তৃতীয় নিয়ম। ফেস ইওর ফিয়ার উইথ এ গ্রেশাস স্মাইল। স্থিরদৃষ্টে চেয়ে রইলাম বেজির চোখের দিকে। আলতো করে মাথা দুলিয়ে বললাম, নো থ্যাংকিউ। আরেক পশলা ইবনিক্স। আমার ভাণ্ডার থেকে বেজির জন্য আরও কিছু স্মিত হাসি। হাত মেলাতে চায়। যাক, নিরীহ বেজি। কিছু উপদেশ দিয়ে গেল। ইউ বি গুড ছাড়া কিছু উদ্ধার করতে পারলাম না। দূর থেকে ইশারা করছে। জবাবের ভঙ্গি জানা নেই। হাসিই সই।

বিদীর্ণ ঘরবাড়ি, সতের ইঞ্চি সাইজের কাস্টম হুইল, আর বুক কাঁপানো বেজ। কাল্লুপাড়ায় এসে গেছি। ভরে গেল বাসের সবটা। আমার পাশের সিটটা খালি থাকলেই হয়। সবার গায়ে কাজের পোশাক। সবার হাতে ফোন। সবার আলগা নখ। সবার নিম্নার্ধ্ব কুশ্রী রকম মোটা। প্রতি তিনজনে একজন হাসলে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে পিতলের সূর্যে। ছেলেগুলো সবাই যেন বিড়ালটার প্রতিবিম্ব। কারও হাতে ওয়েলফেয়ারের টাকায় কেনা ঘড়ি। কেউ বাস্কেটবল খেলছে ছায়ার সাথে।

মেয়েটার রং বেশ সুন্দর। কিছু কালোর গায়ের রং সাদাদের মত হয়। তাই বলে এতটা? নাহ, সাদাই তো। চুল পরিপাটি করে বাঁধা। জুতার ফিতে বাঁধা। জামাটা প্যান্টে গোঁজা। কিন্তু এই মেয়ে এখানে কেন? বুঝলাম ফ্রি কান্ট্রি, তাই বলে এই এলাকায় সাদা মেয়ে কেন? ব্যাগটা দেখে মনে হচ্ছে না তেমন অবস্থাসম্পন্য। ভাড়া কম দেখে এখানে থাকে হয়তো। এভাবে দেখা ঠিক না। বাইরের দিকে চেয়ে সুর ভাজি কোন কিছুক্ষণ। মেয়েটার চুলে সিঁথি ছিল। ক্লিপ দিয়ে আটকানো ছিল। প্যান্টটা কি পরিষ্কার ছিল, নাকি ময়লা? ময়লা হলে এপাড়ায় বিবাহিত, পরিষ্কার হলে ভাগ্যাহত। টিকেট কি প্রিপেইড কার্ডে পাঞ্চ করলো, নাকি কয়েনে দিল? কার্ডে দিলে এখানেই থাকে, কয়েনে হলে কোন কাজে এসেছিল।

পাশে গিয়ে বসলেই পারি। আড়চোখে দেখে নেওয়া যাবে। চাই কি বৃত্তান্ত জেনে নেওয়াও যেতে পারে। পুরো বাস ভরা হলেও মেয়েটার পাশের সিটটাও খালি।