Tuesday, March 11, 2008

নীড়ে ফেরাঃ গর্ভধারিণী পর্ব

প্রতীক্ষার প্রহর অনেক দিনের চাইলেই আবেগগুলোর বল্গা ছেড়ে দেওয়া যেত মুখোমুখি হতেই তবু দেওয়ালগুলো দাঁড়িয়ে গেল কীভাবে যেন কথাটা আমার মাকে বলা ভুললো না দূরত্বের ছলে আমিও চিরচেনা বড় ছেলের মত করেই আলাদা হয়ে গেলাম, চোখ সরিয়ে নিলাম, গাড়ির বুট থেকে মালপত্র নামাতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম এভাবেই শুরু চার দিনের এক ঝটিকা সফরের গর্ভধারিণী পর্ব দুষ্টুমিভরা বাঁকা হাসি মুখে নিয়ে বললাম, পঞ্চাশ হওয়ার আগেই আশি হয়ে গেলে দেখছি মাথাটা আলতো করে ঝাঁকিয়ে, একটু পেছনে হেলিয়ে, মুচকি হেসে এসে জড়িয়ে ধরলো, মাথায় হাত বুলালো

লুইজিয়ানা ছেড়েছি ঠিক সাত মাস আগে স্প্রিং-ব্রেকে অনেকটা ধুম করেই বেড়াতে চলে আসা মা অসুস্থ, মাঝে কিছু সময় হাসপাতালে ছিল ছোট ভাইটা ক্লাস আর কাজের ভাঁজে চিড়েচ্যাপ্টা অবস্থার মাঝেও যেটুকু পেরেছে করেছে পুরুজিত তো বন্ধুর মাকে নিজের মায়ের মত করে আগলে রাখছে অনেক দিন ধরেই একই দেশে আমি দূরে বসে কোন বেলায় মুড়ি-চানাচুর খাই, তো কোন বেলায় বসে বসে স্পেলবাইন্ডার দেখি চোখের আড়াল হতে পারলে জীবন কী সহজ, অনাবিল পড়তে ভাল লাগুক চাই না লাগুক, হোমওয়ার্ক শেষ হোক বা না-হোক, লেখাপড়াকে দায়িত্ব এড়ানোর উছিলা হিসেবে কী সহজে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায় পড়শি বাঙালিরা কেউ খাবার দিয়ে গেছেন, কেউ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছেন, কেউ দিনে কয়েক দফা করে খোঁজ নিয়ে গেছেন

এক বেডরুমের ছোট্ট বাসাটায় ঢুকতেই স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরলো যেন নাতিদীর্ঘ প্রবাসজীবনে একবার দেশে গিয়েছিলাম নস্টালজিয়া তেমন একটা কাবু করেনি শুধু কেমন যেন একটা অন্য রকম লাগা ছিল এবার লুইজিয়ানা ফিরে বুঝলাম, নীড় মানে নিজের দেশ, ঘর, আলো, বা বাতাস না মা যেখানে, নীড় সেখানেই; সর্বংসহা গর্ভধারিণীর স্মিত হাসি যেখানে, সেখানেই জীবন গুড়ি গুড়ি তেলাপোকাগুলো দেখে কত্ত দিনের চেনা মনে হচ্ছিল ফেলে যাওয়া শেভিং ক্রিমের কৌটায় তেলাপোকার ডিম, রংচটা কার্পেটে মশলার গন্ধ, পানির কলের বিকট আওয়াজ মনে হচ্ছিল যেন এই গতকালই এখানে ছিলাম আমি

হার্ভার্ড ব্র্যান্ডের আফটার শেভ’টা চোখে পড়ে গেলো দেশ ছাড়ার আগে বাবার দেওয়া ছেলে গায়ে-গতরে বেড়ে ওঠার প্রথম স্বীকৃতি ছিল সেটা সংসারের দায়িত্বের পালাবদল হতে হতে আজকের অবস্থা অনেক ভিন্ন আমার এককালের জাঁদরেল বাবা আজকে ফোন করে বলে মাকে দেখে রাখতে, মায়ের সাথে ঝগড়া করে দুই তরফ থেকেই ফোন করে অনুযোগ করে এমনতর কথা ভাবতে ভাবতে বসে পড়লাম ৩৫ ডলারে কেনা রিক্লাইনারটায় মাত্র একটা বছর আগে এখানেই একা বসে কাটিয়েছি জীবনের সবচেয়ে কষ্টের সময়টুকু পুরো দিন ঘুরে আমার প্রতীক্ষিতার জন্য বিয়ের আংটি কিনে এনে এই রিক্লাইনারে বসেই ফোন করে অঞ্জনের সুরে বলেছিলাম, আর মাত্র কয়েকটা মাস, ব্যাস্‌ এইতো সামনেই মা জিজ্ঞাসু চোখ নিয়ে বসেছিল এখানে বসেই জবাবে শুনেছিলাম, তোমাকে বলা হয়নি, আমি আমার এক ক্লাসমেটের সাথে আছি এখন, বিদায় সেই মুহূর্তটার আগ পর্যন্ত জানতাম আমাকে দিয়ে কোনদিন অভিনয় সম্ভব না হায় রে জীবন সেই দিনটায় সামান্য এক কৌটা ঝাঁঝালো সুগন্ধী পেয়েই কী খুশি হয়ে গিয়েছিলাম

আমার মাকে নিয়ে আমি কখনো লিখি না শুধুমাত্র কোথায় শুরু করবো জানি না দেখেই নানা পিএইচডি করার সময়টায় আমার মাকে গ্রামে থাকতে হয়েছে পাঁচ বছর লেখাপড়ার সেই ছেদ উত্তরণ করে অনার্স সেরেও মাস্টার্স করতে পারেনি আমি পেটে চলে আসায় মা-বাবা-ভাই বছর তিনেক আগে ডিভি পেয়ে আমেরিকা চলে এসেছে মা সেই থেকে আমাদের দুই ভাইয়ের পড়ার খরচ যোগাচ্ছে হাড়কেপ্পন এক চাইনিজ রেস্তোরাঁয় অহর্নিশ কাজ করে বকলে শুনে না, বারণ করলে মানে না বাসা ভাড়া, প্লেনের টিকেট, হরেক রকম বিল, ভার্সিটির টিউশন, ইত্যাদির সবকিছু আমরা দেই আমার মায়ের মাংস বেঁচে

বাবা দেশে আটকে আছে সরকারী চাকরি আর পেনশনের দুশ্চিন্তা নিয়ে মায়ের শরীরের ভাঙনটা শুধু সময়ের ব্যাপার ছিল শুকিয়ে আধখানা হয়ে যাওয়া আমার মাকে দেখে মনে পড়ছিল প্রথম দিকের দিনগুলোর কথা হিসপ্যানিক ম্যানেজার এক বেলায় ষোল থেকে কুড়ি বালতি বরফ টানাতো, আমি কাউন্টারের ওপাশে বসে দেখতাম ইংরেজি বলতে সংকোচের সুযোগ নিয়ে দাসের মত খাটাতো আমার মাও নিঃশব্দে শ্রম দিয়ে যেতো, স্বামী-সন্তানের স্বাচ্ছন্দ্যের স্বপ্ন নিয়ে রিৎজ্‌ কোম্পানির বিস্কুট ওয়ালমার্টগামী মাত্রই চেনেন স্যাম্‌স ক্লাব থেকে রিৎজের প্যাকেট নিয়ে আসতাম মা আমার সকাল-সন্ধ্যা কামলা খাটতো সেই বিস্কুট খেয়ে ভিড়ের দোহাই দিয়ে ম্যানেজার লাঞ্চ ব্রেক দিতো না, দোকানের খাবার খেলেও টাকা নিতো, মেপে মেপে ড্রিংক দিতো পকেটে লুকানো বিস্কুটগুলোই ছিল ভরসা আমরা দুই ভাই প্রেম আর বন্ধু নিয়ে মেতে থেকে জগৎ উদ্ধার করতাম লন্ড্রি থেকে কাপড় এনে রাগ হতাম মায়ের উপর, পকেট থেকে বিস্কুট বের করতে ভুলে গেছে দেখে ছোট ছোট প্যাকেটে ছোট্ট, গোল বিস্কুটগুলো আমার সেই মা’টা কেমন ছোট্ট, শুকনো আজকে

বহুদিন পর সামনে পেয়ে আলাপচারিতাগুলোও যেন কেমন হয়ে গেল

- না, বাবা তেমন কষ্ট হয় নাই এমনিই মাথা ঘুরাচ্ছিল খুব তোমার লোপা আন্টি এসে বললো, এভাবে বসে থাকার মানে নেই ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেল ওরা দেখে হাই-প্রেশার, ফ্লু ব্রেইনে স্ক্যান করে দেখলো সাইনাস ইন্‌ফেকশন ভর্তি করে রেখে দিলো কাজে যেতে পারলাম না সেদিন আর সাথে অ্যান্টিবায়োটিক এরপর কী একটা ওষুধ দিলো, শুধু ঘুমালাম কয়দিন

- হুম, ভাল হয়েছে দরকার ছিল বিশ্রামটা আমাদের কথা তো শুনবা না, এভাবেই ঘুম দরকার ছিল তোমার তো চিরকাল লো-প্রেশার ছিল, হঠাৎ উল্টাযাত্রা কেনো?

- আমি কী জানি! আমিও তো শুনে অবাক চোখের ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে সামনে আমার একটা চোখ নাকি সরে যাচ্ছে, অপারেশন করতে হবে ঠিক রাখতে দৃষ্টিশক্তি তেমন একটা ভাল হবে না আর থাক, কী দরকার এখন এসব করে টাকা নষ্ট করার?

- দেখা যাক আর কয়টা দিন সময় দাও, দেখি কী করা যায় আহা, মানা করলাম তো এটা নিয়ে কথা বলতে হাতের এই অবস্থা কীভাবে হল? রক্ত নিতে গিয়ে হাত এভাবে মোরব্বা বানানোর মানে কী? ধমকও দিতে পারলা না একটা মুখচোরাই থেকে গেলা আজীবন নিজের কথা মুখ ফুঁটে বলার সাহস কবে হবে তোমার?

- নতুন একটা নার্স, বলে ভেইন খুঁজে পায় না অযথা ওদের উপর রাগ কোর না ওরা অনেক যত্ন নিয়েছে আমার বিনাপয়সায় এরচেয়ে ভাল চিকিৎসা আশা করা ঠিক না

- কী করতে যে আমেরিকা আসলাম পেলাম তো না-ই কিছু, বরং হারালাম সবকিছু দেশের জীবন কত গোছানো ছিল কোন ভূতের কামড়ে যে আমি আমেরিকা আসলাম আমি না আসলে তুমিও সুরসুর করে এসে পড়তা না যৎসামান্য যা-কিছু ছিল, তাও গেলো

- এভাবে ভাবতে নাই আর সবার মত ভাবতে পারো না? ঐ এক দুঃখ বুকে নিয়ে নিজের জীবনটা নষ্ট করে দিবা এভাবে?

- আমি কিন্তু কোন পুরানো কথা তুলি নাই, মা আমি ভালই আছি

- আমার কাছে লুকানোর চেষ্টা করছো? একটা মেয়ের জন্য এভাবে সব ছেড়ে দিচ্ছো? দেখিয়ে দেওয়ার জেদ কাজ করে না বুকের মধ্যে? মনে হয় না, কোন একদিন যেন ভুল বুঝতে পারে?

- আমি তো প্রতিশোধ-তাড়িত মানুষ না! আমাকে দিয়ে এরকম চিন্তা আসে না আমার কষ্টটা শুধু আমি একা বুঝি আমার মত করে ছেড়ে দাও, প্লিজ আমি আমার জগৎটা একটু একটু করে আবার তৈরি করছি

- মাত্র দু-তিন বছর ধরে চেনা একটা মেয়ের জন্য এত কিছু ছেড়ে দিচ্ছো, একবার এই মা’র কথা মনে পড়ে না? আমি যে পঁচিশ বছর ধরে তোমাকে একটু একটু করে বড় করলাম, সেটার কী হবে? আমি যে সেই চার বছর বয়স থেকে সাথে সাথে ঘুরে তোমাকে লেখাপড়া করালাম, তার কী হবে? তোমার উপর ঐ মেয়ের দাবি আছে, আমার দাবি নেই?

সেই সে রিক্লাইনারে বসে জীবনের দ্বিতীয় ঝাঁকিটা খেলাম আমার মা আমার সামনে দাঁড়িয়ে তার পাওনাটুকু দাবি করছে, করতে হচ্ছে আর কীই বা করবে? ভাল রেজাল্ট চাইতো, পেতো অথচ কুসন্তান এই আমি তো কোনদিন মা-বাবাকে খুশি করার মানসে লেখাপড়া করিনি, করেছি ছেলেভুলানো এক সুন্দরীকে ঘরে তোলার স্বপ্নে বিভোর হয়ে এভাবে কেটে গেল প্রথম রাত

পরদিন ব্লাড টেস্ট করাতে নিয়ে গেলাম হাসপাতালে অপেক্ষা করতে করতে এক কাল্লুমামার কায়কারবার দেখছিলাম গাম চিবাচ্ছে, গাম বিলাচ্ছে, সবার কুশল জানতে চাচ্ছে, সবার সাথে হাত মেলাচ্ছে নাহ, আমেরিকার সাউথ আসলেই আলাদা দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছিলাম, বললো ভয় পায় না আর যাবার পথে মা বলছিলো গাড়ি চালানোর কথা

- আজকে আমি চালাই, তুমি দেখো তো আমার চালানোটা কেমন এখন আমি মাঝেমধ্যে একটু-আধটু শিখেছি

- নাহ, হাতটা ঠিকমত ঘুরানো শিখবা না তুমি কোনদিন এ কী, খালি পায়ে চালাচ্ছো কেন? পায়ে গরম লাগবে তো

- আমার এভাবেই সুবিধা আমাকে আমার মত একটু চালাতে দিয়েই দেখো না আহারে, আজমীরের ঐ গাড়িটা আর নাই, না? খুব মনে পড়ে ওটার কথা ওটায় করে আমাকে নিউ ইয়র্ক থেকে নিয়ে গিয়েছিল তোমাদের ওখানে

- আর বোল না ঐ পাগলের কথা আমারো খুব মন পড়ে ঐ গাড়িটার জন্য

- আচ্ছা, এবার যে তুমি আমাকে তেমন বকা-ঝকা করছো না?

- দেই নাই, তবে দিতে কতক্ষণ? রাস্তার দিকে চোখ রাখো আরেকটু জোরে চালাতে পারো, স্পিড লিমিট ৩৫ এখানে ওহ, আজকে বিকেলে তোমাকে সমুদ্রের পাড়ে নিয়ে যাবো কিন্তু

- জানো, সেদিন তোমার মঞ্জু আঙ্কেল একটা কথা বলছিল মানুষ তো মিড্‌ল-ইস্ট থেকে কত কত দিনার পাঠায়, তবু সবাই আমেরিকা আসতে চায় দামী জিনিসপত্র সব দেশ থেকেই যায়, তবু লোকে আমেরিকা আসতে চায় সুন্দর সুন্দর ছবি দেখে, ঘুরে বেড়ানোর গল্প শুনে ছবি দেখে দেশের লোক শুধু সমুদ্রের পাড়টাই জানবে, ভিতরের কষ্টগুলোকে জানবে না এর জন্য আমরাই দায়ী

চলছিলো এভাবেই আমাদের সেই টয়োটা ক্যামরি – আমার দ্বিতীয় বৌ, আমার আদরের আদমজী জুট মিল মা বলছিলো কুকুরের ডাক শুনে ভয় পেয়ে গাড়িটার রিয়ারভিউ মিররে ব্যাথা পাবার কথা আমি আফসোস করছিলাম কাল্লুদের হাতে হেনস্তা হবার দিনে গাড়িটা না থাকা নিয়ে হাঁটার সময় মা আর পিছিয়ে পড়ছিল না, হয়তো আমি তার তালে হাঁটার কারণেই একসাথে বাজার সারলাম শেষ বেলাটা কেটে গেল ঘরোয়া আলাপ করে

- ঘরে শানের শিক কাবাব মশলা আছে? না থাকলে নিয়ে রাখো কিছু গরুর মাংসে দিয়ো, কষানোর সময় অন্যরকম মজা

- বাসায় স্যামন ম্যারিনেট করে রেখেছি তোমাদের জন্য শরীর ভাল না দেখে তেমন কিছু করতে পারলাম না এবার, বাবা তোমার ছোট খালুর কাছ থেকে শিখেছি টেলিফোনে লেমন-পেপার আর মধু দিয়ে ম্যারিনেট করে রাখা আছে ঘরে গিয়ে বেক করবো

- না করে ভাল করেছো আমি তো এবার এসেছি তোমাকে খাওয়াতে এত এত লোক আমার রাঁধা বিরিয়ানি খেয়ে যায়, অথচ তুমিই বাদ থেকে গেলে শর্টকাট শিখেছি একটা তন্দুরী মশলা দিয়ে মুরগি ওভেনে বসিয়ে দিবা, আর রাইস কুকারে সিন্ধি মশলা দিয়ে বিরিয়ানি ৪৫ মিনিটে মামলা খতম গন্ধ বা নোংরার বালাই নেই

কোনদিন কি ভেবেছি এরকম ‘মেয়েলি’ আলাপ করবো আমি মায়ের সাথে? সাথে সাথেই মনে হল, অনুভূতিশূন্য হওয়ার মধ্যে আদতে কোন পৌরুষ নেই পেছনের দিকে তাকালে আফসোস হয় আড়ালে থাকার দিনগুলো মনে করে খেতে বসে মনে হচ্ছিল, কতদিন পর তিনজন একসাথে, কতদিন আব্বুসহ চারজন একসাথে খাই না মা চোখে পানি এনে বললো যেন দারুর দুনিয়া থেকে দূরে থাকি না, চেখে দেখার জন্যও না ১% অ্যালকোহল থাকলেও না অন্য সময় হলে আলাদা কথা ছিল, এখন তোমার মনে অনেক কষ্ট, এখন এটা নেশা হয়ে যাবে কী আশ্চর্য যুক্তিবাদী হয়ে গেছে আমার আবেগপ্রবণ মা, কত বড় হয়ে গেছে আমার ছোট ভাইটা

নীড়ে ফেরা বোধহয় একেই বলে

(প্রায় শেষ)

নীড়ে ফেরাঃ দ্বিচল সম্মেলন পর্ব

অ্যালাবামার অবার্নে যাবার সৌভাগ্য হলে একবার কদম ফেলে যাবেন সহ-সচল দ্রোহীর বাসায়। যেকোন দিন, যেকোন সময় দ্রোহীর দরজায় টাক্‌-টাক্‌ করে বলবেন, চাটনি আছে তো? কথাটা ঠাট্টা ভেবে উড়িয়ে দিলে নিজেই ঠকবেন।

স্প্রিং ব্রেকে লুইজিয়ানা যাবার পরিকল্পনা হাতে নিয়েই আমাদের সবার মাথায় হাত। যাত্রাপথ একেক দিকে এক হাজার মাইল করে। গুগুলের হিসেবে প্রায় ১৬ ঘন্টার মামলা। গাড়ি নাহয় ভাড়া করা গেল, কিন্তু এতগুলো গরুকে একরাত আশ্রয় দেবার মত গোয়াল কোথায় পাই? শুরু হয়ে গেল বিভিন্ন নেটওয়ার্কে পাত্তা লাগানো। সচলায়তনের সদস্যদের প্রোফাইল ঘেঁটে বের হল, দ্রোহীর বাস অবার্নে। আদর্শ বিশ্রামস্থল। ঠিক সাড়ে আট ঘন্টার দূরত্ব। ওদিকে আরেক বড় আপুও মিলে গেল। দ্রোহী তবু আধা-চেনা, দ্রোহীনি ভাবি তো একেবারেই অচেনা। প্রথম রাতে তাই তাঁদের জ্বালাতন না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। ঘুম-জড়ানো চোখে আপু আমাদের জন্য দরজা খুলে দিলেন ভোর সাড়ে চারটার দিকে। মধ্যাহ্নভোজের জন্য দ্রোহীর দরজায় হাজির হলাম পরদিন বেলা দেড়টার দিকে।

অধম ছিলাম চালকের আসনে। একে একে যে-ই নামছিলো, সবাইকে বলে দিচ্ছিলাম নিজেকে ইশতিয়াক বলে পরিচয় দিতে। কাজ হল না। সুজন চৌধুরীর অসামান্য স্কেচের বদৌলতে দ্রোহী আমার কুলার মত কানগুলোর ব্যাপারে বিশেষ ওয়াকিবহাল। কান দেখে চিনে ফেললেন। দ্রোহীর প্রতি আমার প্রথম কথা, আপনি তো অতটা ওবামার মত না। সশব্দ দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রোহী ইঙ্গিত করলেন দেওয়ালে ঝুলানো বিয়ের ছবির দিকে। বলতে বলতেই ভাবি হাজির। ভাবির প্রতি আমার প্রথম কথা, আপনিই দ্রোহীর সেই বউ!

আবজাবের বদৌলতে দ্রোহীর খান্ডারনি বৌয়ের গল্প সবাই জানেন। আসা-যাওয়ার পথে ভাবির সাথে দুই রাতে বেশ ক’ঘন্টা তুমুল আড্ডার পর বুঝলাম, দ্রোহী আসলে তোপসে নন, জটায়ু! সদাসহাস্য, প্রাণময়, পঁচানিস্ট ভাবির সাথে প্রথম কিছুক্ষণ কথা কম হচ্ছিল। দ্রোহীর সাথেই চলছিল আলাপ-সালাপ। বলছিলেন, তিনি খুবই সংগ্রামী মানুষ। জীবন গেছে ইধার-উধার ইতি-উতি করেই। অধমের সাথে মিলে গেল অনেক কিছুই। জেনে খুবই অবাক হলাম যে সেই বছর দু-তিন আগে বাতায়ন নিয়ে আমার আর হিমু ভাইয়ের নিরীক্ষার সময়েই তিনি অধমকে চিনেছেন। বাংলা ব্লগিং নিয়ে কথা হচ্ছিল। বাংলায় লিখতে পারার আনন্দ নিয়ে কথা হচ্ছিল। হিমু নামক এক হাঁটুপানির জলদস্যুর দুর্ধর্ষ ব্লগিঙের তোড়ে লিখতে বসলেই বিচিত্র সব অনুভূতির কথা হচ্ছিল। সাথে ছিল আবহাওয়া, রাজনীতি, স্কুল-কলেজের জীবন, দেশ, আর গাড়ি। একেবারেই নৈমিত্তিক পুরুষালি বাতচিত। ভাবির সম্মানে শুধু নারীপ্রসঙ্গ বাদ ছিল।

ঝড়ের পূর্বাভাষ ছিল, কিন্তু তাই বলে শিলাবৃষ্টি হবে ভাবিনি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হল খাদ্যবর্ষন। ভদ্রতা করে ভাবিকে বলেছিলাম যে আমরা চুলা থেকেই নিয়ে নিতে পারবো। ভাবি কপট হাসি দিয়ে বললেন, ছেলেমানুষের খাবলাখাবলিতে খাবার পড়ে ওনার ঘর নোংরা হবে, সেই ভয়েই টেবিলে দেওয়া। আত্মা কেঁপে উঠলো। জানতে চাইলেন কেউ বিশ্রামাগারে ঢুঁ মারতে চাই কিনা। পেট বেঁধে, কাষ্ঠ হেসে না বললাম। এবার হালকার উপর ঝাপসা ঝাড়ির ছলেই বললেন, গেলে ওনার সামনে দিয়েই যেতে এবং আসতে হবে, অতএব লজ্জার কিছু নেই। এবার আত্মা নীরবে চিৎকার দিয়ে উঠলো।

ভাবি এরপর শুরু করলেন গরমাগরম খাবারের ঢাকনা ওঠানো। মুরগি খেয়ে অভ্যস্ত, তাই মুরগি আছে। মুরগি খেয়ে বিরক্ত, তাই মাছ আছে। কাবাব আছে। সবজি আছে। সালাদ আছে। রাইস কুকারের আশীর্বাদে পেটে ভাতের চর পড়ে গেছে, তাই খিচুড়ি আছে। সাথে আছে চাটনি। এত কিছু দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ভাবি নিশ্চয় রান্নাবান্না খুব এনজয় করেন। মুহূর্তে খসে পড়লো সব পর্দা। হাসির বন্যায় ভেসে গিয়ে ভাবি বললেন, আই লাভ কুকিং! পরক্ষণেই আবার রাগত চেহারা করে হুকুম দিলেন, সব শেষ করে যেতে হবে, তাঁকে যেন বাসি খাবার খেতে বাধ্য করা না হয়। মমতায় নাকি খাবারের স্বাদ বাড়ে। টের পেলাম। অনেকটা পথ বাকি, তাই খেয়েই উঠে পড়তে হল। তিনজন চালক ছিলাম আমরা। পাল্লা দিয়ে ভাবিকে শাপ-শাপান্ত করেছি তিনজনেই বাকিটা পথ। খাবারের আরামে চোখ বুঁজে আসছিল ঘুমে। পাছে মুখ থেকে স্বাদ চলে যায়, এই ভয়ে প্রথম অনেকক্ষণ কেউ কফিও ছুঁয়ে দেখিনি।

ফিরতি পথেও যথারীতি অনেক রাত হয়ে গেল। পরদিন তাঁর মিডটার্ম পরীক্ষা, সহপাঠীদের সাথে রাতভোর ফাইট দেবার কথা, তবু দ্রোহীর কড়া হুকুম, রাতে তাঁর বাড়িতেই খেতে হবে। আগের দফায় ভাবি বলছিলেন, চাটনিটা ডালের সাথে খেলে মজা লাগতো। পাশ থেকে ওয়াসেফ ফরমায়েশ করে ফেলেছিল পরের বার ডাল রাঁধতে। এবারেও খাবারের বন্যা, তবে একেবারেই নতুন সব আইটেম। মাছ, ভর্তা, বড়ইয়ের আচার, চাটনি, ডাল, সবজি, আরো অনেক কিছু। জেনেবুঝেই ইলাস্টিকের কোমড়বিশিষ্ট প্যান্ট পড়ে এসেছিলাম এইবার। এবারে বলে দিতে হয়নি যে ভাবির রান্নায় লবণ কম, ঝাল বেশি। আমরা যে পশুরই উত্তরপ্রজন্ম, তার নিদর্শন রেখে রীতিমত যুদ্ধ করে খেলাম সবাই। হাত ধুতে গিয়ে দেখি গোলাপির রাজত্বে চলে এসেছি। বেরিয়ে এসে ভাবিকে বললাম, সচলায়তনে আপনার কথা লিখলে গোলাপি ভাবি নামে লিখবো। ভাবি হেসে বললেন, তাঁর প্রিয় রঙ অন্য, গোলাপি কোন কিছুই তাঁর কেনা না। মুরুব্বি তখন হামলে পড়লেন প্রতি বিন্দু গোলাপি রঙ কীভাবে সম্প্রদানের হাইওয়ে ধরে এথায় পৌঁছেছে তা ব্যাখ্যা করতে। আমিও ব্যাপক মনোযোগের সাথে ঠাকুর ঘরের কলার বয়ান শুনে গেলাম।

এরপর শুরু হল আড্ডা, এবং দ্রোহীর গোলাপি থেকে কমলা হয়ে লাল হওয়া। যাবার সময় তাড়াহুড়ার কারণে অনেকটা আচমকাই আড্ডা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। সেবার আজমীরকে দেখে দ্রোহী বলছিলেন, চেনা চেনা লাগে। ভাবিকে দেখে আজমীর বলছিলো, চেনা চেনা লাগে। কিয়ৎকাল পর কথাবার্তা ঘুরে গিয়েছিল এক কোণায় পড়ে থাকা কিছু ডাম্বেল, দক্ষিণের উষ্ণ আবহাওয়া, অসামান্য সুন্দরী মেয়েদের ছড়াছড়ি, আর কে বা কারা দেখতে চামচিকার পাছার মত হওয়ায়। এক ফাঁকে দ্রোহী ভাবিকে টিটকারি মেরে বলে বসলেন, সাত-সকালে তিনি রেয়াজ করার সময় নাকি পাশের বাড়ির বাঙ্গালি পড়শি দেওয়াল পিটিয়ে বলেন, বৌকে আর মারিস না! সেবার ভাবি শুধু ধরিয়ে দিয়েছিলেন যে সব রকম প্রাণির পশ্চাৎদেশের প্রতি দ্রোহীর বিশেষ মনোযোগ আছে। ওস্তাদের মার যদি শেষ রাতে হয়ে থাকে, তাহলে ওস্তাদের বৌয়ের মার ফজর ওয়াক্তে।

অভিব্যক্তিতে অসামান্য পারদর্শী গোলাপি/চাটনি ভাবি একের পর এক বলে চলছিলেন আমাদের প্রিয় দ্রোহীর যাপিত জীবনের বিবিধ কৌতূহল-উদ্দীপক ঘটনা। চুম্বক অংশে ছিল বিয়ের পর নতুন মানুষকে কাছ থেকে চেনার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার কথা। দ্রোহী বলছিলেন, ছেলেবেলা থেকে একা ঘুমিয়ে অভ্যাস। রাতে কারো গায়ে হাত লাগলেই নাকি সজোরে হাত চালিয়ে দিতেন। কোন এক কালে ঘুমের মধ্যে এক বড় বোনের গলা টিপে ধরেছিলেন! জানা গেল, রান্নাবান্নার হাতা/নাড়ানি যথাযথ ভাবে ব্যবহার করলে এহেন দুরন্ত পতিকেও শুধরে দেওয়া যায়। সমস্যা হল, হাত চালানো বন্ধ করা গেলেও আলাপচারিতা বন্ধ করা যায়নি অদ্যাবধি। এমনই এক গল্প দিয়ে শেষ করছি দ্বিচল সম্মেলন পর্ব।

ভাবি বলছিলেন ঘুমের মাঝে দ্রোহীর কথা শুনে প্রথমবার জেগে যাবার কথা। নিশিরাত। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। ডাকাডাকি শেষে ঝিঁঝিঁ থেকে কুকুর পর্যন্ত সবাই ক্লান্ত। এমন সময় নীরবতা খান্‌খান্‌ করে দ্রোহী বলে উঠলেন, বিলাইয়া দিয়ো! ধরফরিয়ে উঠে ভাবি জানতে চাইলে কী বিলাতে হবে। অচেতন দ্রোহীর সচেতন জবাব, ঐ যে ঝুলতেসে, যেটা পছন্দ, রেখে বিলায় দিয়ো! বোঝা গেল, বিয়ের উপহারের স্বপ্ন কথা বলছে। কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হয়ে ভাবি আবার শুলেন। এবার ঘুমন্ত দ্রোহীর সহাস্য চিৎকার, অনেক গুলা বৌ, হাঁটাহাঁটি করতেসে! বেচারি ভাবি আবারো উঠলেন, তবে এবার কৌশলে জানতে চাইলেন, তোমার বৌ কোনটা? লজ্জায় লাল হয়ে দ্রোহী বললেন, এই যে এইটা! অচেতন এই প্রেমের কাহানি শুনে আনন্দিত ও মুগ্ধ হয়েছিলাম সবাই।

নাহ, আরো দুয়েকটা বলে যাই। আরেক রাতে নাকি দ্রোহী ঘুমের ঘোরে বলছিলেন, আমি লাইব্রেরিতে! উপরে উঠি! কাগজ কাটি! আরেক রাতে বলে বসলেন, সিচুয়েশন বুঝতে হবে তো! অনেক অনেক ডাটা! বাকি গল্পগুলো নাহয় দ্রোহী ও তাঁর আবজাব সিরিজের জন্যই রেখে দেই।

ভাবি একের পর এক গল্প বলে যাবার সময় দ্রোহী শুধু মাথা নেড়ে বলছিলেন, ইজ্জত মেরে দিলো। হয়তো তা-ই। তবে সব কিছু ছাড়িয়ে গিয়েছিল অসামান্য প্রাণচঞ্চল ও অতিথিবৎসল দ্রোহী দম্পতির ছোট ছোট খুনসুটিগুলো। একজন বলেন আমার মত পাবা না, তো আরেক জন বলেন তোমার চেয়ে ভাল পাবো খুঁজলে। পঁচানোর প্রতিযোগিতার ফাঁকে ফাঁকেই চোখে পড়ে যাচ্ছিল অসামান্য মমতার চিহ্নগুলো। একদিন বেলা সাড়ে বারোটায় ফোন না আসলেই ভাবির অস্থির হয়ে পথে নামা, সুপার-গ্লু দিয়ে ভাবির দুই ঠোঁট লেগে যাবার ভয়ে দ্রোহীর টেনশনে অজ্ঞান হবার দশা, এমন অনেক খুচরো মুক্তায় ভরা ছিল আড্ডাটা।

ভাবির অনবরত হাসি দেখেই বুঝেছি দ্রোহী তাঁকে আনন্দে রেখেছেন। অন্যদিকে সুখী মানুষের নিদর্শন স্বরূপ দ্রোহী নাকি ঘুমের ঘোরে ইদানিং কথা ছেড়ে গান ধরেছেন। সমস্যা একটাই, গানের কথা শুধু বিটিভি-র মত একই ফ্রিকোয়েন্সির একটা পুউউ আওয়াজ।

(চলবে)

প্রবাসের কথোপকথন ১৩

“একুশে নিয়ে কী করতে চাও বলো, সময় হলে সাহায্য করবো।”
নাটক করা যায় একটা? আমরা সবাই মিলে চেষ্টা-চরিত্র করলে কিছু একটা দাঁড় করানো যায়। এই, তোর না কী আইডিয়া আছে বলছিলি।

“তেমন কিছু না। এবিসিডি কালচার, দেশকে ভুলে যাওয়া, এগুলা নিয়ে কিছু করার চিন্তা ছিল। সময় নেই হাতে একদম, এটাই ঝামেলা। রিসার্চের কাজ নিয়ে দৌঁড়ের উপর আছি একদম।”
তুই শুধু আইডিয়াটুকু বল। সেটাকে রিফাইন করে নাটক বানানোর দায়িত্ব আমরা ভাগ করে নেবো।

“নাটক করতে চাও তোমরা? সেটার জন্য তো অনেক প্রস্তুতি দরকার। মুনীর চৌধুরীর কবর করতে পারো। আমার কাছে তো কোন কিছু তৈরি নেই। তোমরা কবর যোগাড় করতে পারলে সেটা করতে পারতে ছেলেরা মিলে।”
খুঁজে দেখেছি, কিন্তু ইন্টারনেটে পেলাম না। দেশ থেকে আনাতে পারি, তবে সময় লাগবে অনেক। এমনই সাহিত্যজ্ঞান আমার, অন্য কোন নাটকও চিনি না যেটা একুশের সাথে যায়।

“সব ভাবী, বৌদিদের বল একটা করে গান গাইতে। ছেলেদের মধ্যে কেউ কবিতা, বা একুশে নিয়ে কিছু বলতে পারে কিনা দেখো। সময় কম, এটা মাথায় রেখো শুধু।”
সমস্যা অন্য জায়গায়। এবার একুশে পড়েছে বৃহস্পতিবারে। কাউকে পাওয়া যাবে না ঐ দিনে। মিডটার্মও চলছে এখনি। ধুর, একুশে যদি মার্চের ৩ তারিখে হত, তাহলে ঝামেলা হত না কোন। স্প্রিং ব্রেকে সময় নিয়ে কিছু করা যেত। আগে কী করা হত এখানে? লুইজিয়ানা থাকতে একুশেতে কিছু করা হত না, তবে স্বাধীনতা দিবস আর পহেলা বৈশাখ মিলিয়ে একটা অনুষ্ঠান করা হত বেশ জাঁকজমক করে।

“আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিটা ঠিক মত করি। এছাড়া এপ্রিলের দিকে স্ট্রিট ফেয়ারে দেশী খাবার বিক্রি করে ফান্ড জমাই। এই টাকা দিয়েই দেশের আমরা পরে দেশের জন্য কিছু করার চেষ্টা করি। একুশের দিনে আমরা স্টুডেন্ট সেন্টারের শো-কেইসে একটা শহীদ মিনার সাজাই। ওখানে বাংলা লেখা থাকে, আর একুশের ইতিহাস নিয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা থাকে।”
হ্যাঁ, দেখেছিলাম। এবারেও শো-কেস ভাড়া করা হয়েছে এক সপ্তাহের জন্য। ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন আছে একটা। কতটুকু লেখা হয় সাধারণত? মানে, পাকিস্তানিরা কিছু বলে না?

“মিথ্যা তো না, লিখতে কী? করার সময় খেয়াল ছিল না? আর, এটা তো এখন সারা দুনিয়ায় স্বীকৃত ইতিহাস। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।”
তাও কথা। যাক, দেখে নিবো নে আগের বছরের লেখাগুলো। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। সপ্তাহের মাঝখানে এভাবে কিছু একটা আয়োজন করা সম্ভব না। করলে পরের উইকএন্ডে করতে হবে। এত লোকের জমায়েত হলে একটু পরেই খাওয়া-দাওয়া নিয়ে একটা হুলস্থূল শুরু হয়ে যাবে। বুঝতে পারছি না কী করবো।

“কোন ধরনের খাওয়া-দাওয়ার কিছু করার দরকার নাই। অকারণে একটা হৈ-চৈ হবে। হালকা খাবার রাখবা। বিরিয়ানি রান্না করে তো একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করা যায় না। হালকা চিপ্‌স রাখতে পারো কিছু। সাথে চা। সব তুলে রাখবা অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পর্যন্ত। কাউকে ধরতে দেওয়া যাবে না।”
এখানেই তো সমস্যা। অনুষ্ঠান হোক আর না হোক, মুডটা হালকা করে দেওয়ার মত অনেক কিছুই আছে। খাবার থাকলে দেখা যাবে ছাত্রদের মধ্যেই কেউ ওগুলা বের করে ফেললো, অথবা বাচ্চার বাপ-মা এসে বলবে তাদের ছেলে-মেয়েকে কিছু দিতে। মশাল পার্টি চলে যাবে একটু পর পর বিড়ি ফুকতে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের পাশেই টেনিস কোর্ট। লাভের মধ্যে দেখা যাবে একুশেতে নীরবতা পালন করে সবাই মিলে ক্রিকেট খেলছি।

“না, এসব কিছু করতে দিও না। অনুষ্ঠান শেষ হলে যে যার বাড়ি চলে যাবে, কোন লাফালাফি নাই।”
আচ্ছা, আরেকটা সমস্যা। একুশেতে চিপ্‌স দিবো? কেমন হয়ে যায় না? কুড়মুড়ে খাবার যায় না মনে হয় ভাষা দিবসের সাথে।

“ঠিকই। তাহলে নুডুল্‌স দিতে পারো।”
এইটাও তো কেমন কেমন হয়ে যায়। যাক, তবু এটা আপাতত থাকুক। তবে আর যা-ই হোক না কেন, পটলাক্‌ করা হবে না। রান্না ভাগ-বাটোয়ারার ব্যাপার নাই কোন এখানে। সোডার বদলে অন্য কিছু দেওয়া যায়?

“মনে হয় না। সোডাই থাকুক। খাবারের ব্যবস্থা না থাকলে সময়ের ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি করতে হবে। বলে দিতে হবে যে ঠিক বিকেল ৫ টায় আসবো এবং সন্ধ্যা ৭ টার মধ্যে চলে যাবো। এর বেশি দেরি হলেই লোকে খাবার আশা করবে। সবাই একত্র হয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করবো। যারা গান জানেন, তারা দুইটা করে গান গাইলেই হয়ে যায়।”
যোগাযোগ করে দেখলাম এর মধ্যেই। অনেকেই ব্যস্ত। একেকজনের একেক রকম ঝক্কি। কাউকে জোরও করতে পারছি না। তবু বলে রেখেছি। কোন জায়গাও রিজার্ভ করতে পারছি না। বাসায় করলেই খাবার দেওয়ার ভদ্রতা করতে হবে।

“দেখো কী করতে পারো এই ব্যাপারে। যারা গান গাইবে, তাদের কিন্তু অনুষ্ঠানের ভাবগাম্ভীর্য মাথায় রেখে গান তুলতে বল। কেউ আধুনিক গান ধরে বসলে সমস্যা।”
অবশ্যই। ফাস্ট বিটের দেশাত্মবোধক হলেও সমস্যা। কেউ একুশেতে ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ধরে বসলে কেলেংকারি হয়ে যাবে।

“আগে থেকে প্রস্তুতি নিলে ভাল মত করা যেতো। একটা নাটক যোগাড় করতে পারলে হত। ডিসেম্বরের আগে বললে দেশ থেকে কেউ নিয়ে আসতে পারতো।”
গতস্য শোচনা নাস্তি। আপাতত এই দফা ড্যামেজ কন্ট্রোল করে নেই। আমারো ইচ্ছা ছিল রেডিও নাটক জাতীয় কিছু করার। স্ক্রিনিঙ্গের ঝামেলা থাকতো না, সহজে শেখানোও যেতো সবাইকে।

“আমার এক বন্ধু খুব ভাল গান গায়। সাংস্কৃতিক ব্যাপারে খুবই নাম। তবে মহা চাল্লু ছেলে। এসেছিলো জে-১ ভিসায়। কীভাবে যেন কায়দা করে থেকে গেছে।”
এটা কীভাবে সম্ভব? এক্সচেঞ্জ ভিসায় আসলে তো দুই বছর পর দেশে ফেরা বাধ্যতামূলক।

“উহু, ভুল জানিস তুই। একটা ফাঁক আছে। উনি মনে হয় ঐটাই কাজে লাগিয়েছেন। যেই লাইনে পড়াশুনা করেছেন, সেই লাইনে যদি নিজের দেশে কাজ না থাকে, তাহলে আমেরিকায় থেকে যাওয়া যায়।”
উনি না বললেন পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়েছেন? চালু মাল আসলেই।

“এখন তাকে হান্ড্রেড এইটি পে করে বছরে।”
বলেন কী? তার মানে মাসে কত করে পড়ে? নব্বই দুগুণে একশো আশি, পাঁচ আঠেরোং নব্বই, ছয় পনেরোং নব্বই, পনেরো হাজার কর মাসে!

“আজকে ক্যারিয়ার ফেয়ারে এই পোলা হাভাইত্যার মত জিনিস টোকাইসে পুরা।”
কী করবো? চাকরি তো দিবে না কেউ আমাকে। জিপিএর যা করুণ দশা, এই সিমেস্টার শেষ না হলে কিছু আশা করতে পারছি না। আপাতত সামার ধরে থিসিস লিখে ডিসেম্বরে মাস্টার্স করার চিন্তায় আছি। এরাও আমাকে চাকরি দিবে না, আমিও এদের কাছে চাকরি চাইছি না। চারটা ব্যাগ আর গোটা দশেক তাসের প্যাকেট এনেছি।

“এই বেকুব, ভিতরে না দেখেই এতগুলা প্যাকেট আনলি কেন? তাসের মধ্যে কোন ফোটা-ফাটি নাই। টুয়েন্টি-নাইন খেলতেও ব্রিজের মত কাগজ-কলম নেওয়া লাগবে। স্কোরিং করার কিছু নাই।”
শিট!