Monday, July 13, 2009

জালাল ভাইকে নিয়ে প্রথম আলোতে একটি লেখা


অনেকেই হয়তো দেখে থাকবেন, শ্রদ্ধ্বেয় জালাল ভাইকে নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় একটি লেখা ছাপা হয়েছে। লেখাটি লিখেছেন সেলিম রেজা নূর।

সচলায়তন কিংবা আন্তর্জালে ঘুরে বেড়ানো অনেকের কাছে জালাল ভাইয়ের কীর্তি অচেনা নয়। একটি ছন্নছাড়া দেশের ভুলে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ইতিহাস তিনি সংগ্রহ করেছেন পরম যত্নে। কোনো প্রকার পৃষ্ঠপোষকতা বা উৎসাহ ছাড়াই গড়ে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নিজস্ব এক যাদুঘর।

ব্যাক্তিগত আলাপে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জালাল ভাইয়ের কাজের ধরন ও পরিধি জানার সুযোগ হয়েছে আমার। নিভৃতে, কোনো রকম সাধুবাদের তোয়াক্কা না করে আমাদের জালাল ভাই মাল-মশলা জুগিয়ে যাচ্ছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস প্রতিষ্ঠার জন্য।

জালাল ভাইয়ের এই নিরলস সাধনা ও অন্তহীন দেশপ্রেমের কথা আন্তর্জালে অনেকেই জানি আমরা। দুঃখজনক সত্য হলো, অনেক সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ-ব্যবসায়ী তাঁর তথ্য-ভাণ্ডার ব্যবহার করলেও তাঁর নামটি প্রচার করেন না। আন্তর্জালের বাইরের অনেকের কাছেই জালাল ভাইয়ের নামটি তাই অপরিচিত।

আচমকা এই লেখাটি দেখে অনেক আনন্দ জেগে উঠলো মনে। সচলায়তন নামটির সাথে জড়িতরা অন্তত জানুক জালাল ভাইয়ের কথা। সে-উদ্দেশ্যেই তুলে দিলাম লেখাটি।

মূল লেখার লিংকঃ http://www.prothom-alo.com/mcat.news.details.php?nid=MTY0MjIx&mid=NA http://www.eprothomalo.com/index.php?opt=view&page=11&date=2009-07-08

উদ্ধৃতি


প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের তথ্যভাণ্ডার
- সেলিম রেজা নূর

টেলিফোনের শব্দে কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল। ‘কলার আইডি’ দেখে বুঝলাম আমার অগ্রজ ফাহীম ফোন করেছে। কোনো প্রয়োজন ছাড়া এত রাতে ওঁর ফোন করার কথা নয় ভেবেই ফোনটি কানে তুলে নিলাম। ও প্রান্ত থেকে জানতে চাইল, "তোর কাছে এমন কোনো তথ্য আছে, যা থেকে প্রমাণ হবে কবে আল-বদর বাহিনী গঠিত হয়, আর এর সাথে মতিউর রহমান নিজামীর সংশ্লিষ্টতা"? জবাবে বললাম, এ মুহুর্তে আমার হাতে সে রকম কিছু না থাকলেও জোগাড় করে দেওয়া যাবে। ব্যস্ত হয়েই অগ্রজ জানতে চাইল, "কোথায় পাবি"? জানালাম, ডালাসের জালাল ভাইয়ের কাছে নিশ্চয়ই কিছু আছে। ওখান থেকে জোগাড় করা যাবে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত বিশ্বকোষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাস-প্রবাসী মোহাম্মদ মাহ্বুবুর রহমান জালাল খাঁটি দেশপ্রেমের তাগিদেই নিজের অর্থ ও সময় ব্যয় করে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক তথ্য ও দলিলের এক অভুতপূর্ব সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে। যে সংগ্রহশালা গড়ে তোলার কথা ছিল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়, সেটি বাংলাদেশে হয়নি। পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে স্বদেশের ইতিহাস বিকৃতির যে ধারা শুরু হয়, তারই পথ ধরে বিভিন্ন পাঠাগার ও প্রচারমাধ্যমে সংরক্ষিত আমাদের গৌরবগাথা মুক্তিযুদ্ধের তথ্য ও দলিলগুলো নষ্ট করা শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের সহজে শনাক্ত করা না যায়−গণহত্যার দোসর রাজাকার, আল-বদরদের আর চিহ্নিত করা না যায়, সেটাই ছিল লক্ষ্য। ফলে স্বদেশে মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত দলিল ও প্রামাণ্য তথ্যগুলো আজ খুঁজে পাওয়া ভার! এসব তথ্যের জন্য আজ দেশের বাইরে খোঁজখবর করতে হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাস-প্রবাসী এম এম আর জালাল প্রায় বিস্মৃতির অতলে ডুবে যাওয়া ইতিহাসের একেকটি অধ্যায় সিন্ধু সেচে মুক্তা আহরণের মতোই পরম যত্নে সংগ্রহ করছেন। করছেন প্রবাস-জীবনের চরম ব্যস্ততার মধ্যেও। আমার মতো শুধু প্রবাসীরাই নয়; বরং বাংলাদেশের বহু বরেণ্য ব্যক্তি, গবেষক ও প্রচারমাধ্যমের সংশ্লিষ্টরা প্রায়শই মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত তথ্যের জন্য জনাব জালালের শরণাপন্ন হন। মাঝরাতে এম এম আর জালাল ঢাকার কোনো সাংবাদিকের ফোন পান, যাতে মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত কোনো বিশেষ তথ্য ও দলিলপ্রাপ্তির অনুরোধ থাকে। সাত্ তাড়াতাড়ি নিজের সময় ও অর্থ ব্যয় করে পরম আনন্দে বসে পড়েন সেসব তথ্য-দলিল পিডিএফ ফাইলে পরিবর্তিত করে ই-মেইলে সেই সাংবাদিকের কাছে পাঠানোর জন্য। প্রচারবিমুখ জনাব জালাল এই আত্মপ্রচারণার যুগে কখনোই এ তথ্য সরবরাহের বিনিময়ে নিজের নামজারি তথা খ্যাতি অর্জনের কোনো চিন্তাই করতে পারেন না। তাঁর তথ্যভান্ডার নিয়ে অন্যে নাম কামাচ্ছে, এমনকি বিনিময়ে সামান্য কৃতজ্ঞতাটুকুও প্রকাশ করছে না। আর এটা যে অন্যায়, এ জাতীয় অনুযোগ নিকটজনদের কাছ থেকে বহুবার শুনলেও হূষ্টচিত্তে নির্বিকার জনাব জালাল "চাহিবামাত্রই পাওয়া যাইবে" নীতি অবলম্বন করে চলেছেন। কারণ, তাঁর বিশ্বাস "কোনো স্বত্বাধিকার নয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের জাতীয় গৌরব ও সম্পদ"।

নিজ ব্যয়ে ও উদ্যোগে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় প্রামাণ্য তথ্যগুলো ইলেকট্রনিক সংস্করণে রূপান্তরিত করেছেন জনাব জালাল একে সহজলভ্য করার নিমিত্তে। নিউইয়র্ক-ভিত্তিক বাংলা অনলাইন পত্রিকা এনওয়াই বাংলা নিউজ-এ প্রতি সপ্তাহে বিষয়ভিত্তিক ও সময়ভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দলিল ও তথ্য উপস্থাপনার মাধ্যমে নতুন প্রজন্নকে অন্ধকার থেকে আলোর পথের যাত্রী হিসেবে গড়ে তুলছেন। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামসংক্রান্ত সমুদয় সংবাদ জনাব জালালের সংগ্রহে আছে, যা থেকে বেরিয়ে আসবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও এর গতিপ্রকৃতি এবং কখন কোথায় কে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন সেসব তথ্য। এ ছাড়া একাত্তরে মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে যে শুনানি (হেয়ারিং) হয়, তার বিশদ বর্ণনা সংরক্ষিত আছে। মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত পাঁচ শতাধিক বই আছে, যেগুলো ইংরেজি, বাংলা ও উর্দু ভাষায় রচিত, যা জনাব জালালের সংগ্রহশালায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এসব সংগ্রহে বন্ধুবান্ধব ও বিশেষভাবে শ্বশুরকুলের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন সে কথা হূষ্টচিত্তেই স্নরণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে দেশের প্রকৃত ইতিহাস অবিকৃতভাবে তুলে ধরাই তাঁর উদ্দেশ্য। তবে জনাব জালাল আরও বিশ্বাস করেন, এসবের মধ্য দিয়ে শুধু বীরত্বের কথা নয়; বরং যেটি বিশেষ করে জানার দরকার সেটি হলো, কারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, একাত্তরে কাদের প্রচ্ছন্ন মদদে শান্তি কমিটি, আলবদর, রাজাকার আল শামস বাহিনীগুলো গঠিত হয় এবং মানবতার বিরুদ্ধে কী জঘন্য অপরাধ করে এবং হানাদারদের দোসর জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী ও মুসলিম লীগের নেতারা সেদিন দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে কী ভুমিকা নিয়েছিল, সেসব তথ্য আজকের আলো-আঁধারিতে ঘেরা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের বিশেষভাবে জানা দরকার। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের জন্য কে শত্রু আর কে মিত্র, সে সম্পর্কে পরিষ্ককার ধারণা থাকাটা একান্ত জরুরি বলেই জনাব জালাল বিশ্বাস করেন। আর সেই তাগিদেই জাতীয় এই গুরুদায়িত্ব নিজের ক্ষুদ্র কাঁধে তুলে নিয়েছেন।

তিনি চান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সবার নাগালের মধ্যে এনে দিতে। এসবের ডিজিটাল কপি ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে। আর সেই লক্ষ্যে "সেন্টার ফর বাংলাদেশ জেনোসাইড রিসার্চ" নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাসংক্রান্ত যেকোনো বই, সিনেমা, ছবি, গান, পোস্টার, দেশি-বিদেশি দলিল, সংবাদপত্রের কাটিং তার সংগ্রহে চা-ই চাই। কিন্তু বিনা পয়সায়, বিনা শ্রমে তো এগুলো হয় না। প্রবাসের ব্যস্ত ও সীমাবদ্ধতার জীবনে তাই পরিবার ও ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের সঞ্চয় ভাঙিয়েই এ কাজ তাঁকে করতে হয়। তবুও এতে তাঁর ক্লান্তি নেই, আছে সীমাহীন গর্ব।

No comments: