Monday, July 13, 2009

প্রবাসের কথোপকথন - ১৮

– বোর্ডিং পাস আর আইডি দেখাও।
: লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটা পঙ্গু, অথর্ব মানুষ আমি। এত জায়গায় আইডি দেখালাম, এখন প্লেনের দুয়ারে এসেও ঝামেলা করতে হবে, তাই না? কত যে ঘাঁটাতে পারো তোমরা!

– এই ছোকরা, ফেলে চলে যাবো কিন্তু তাহলে। আমি মানুষ খুব খারাপ।
: আচ্ছা দেখো, দেখো। হুঁ, আমি জানি সিট কোথায়। বেছে বেছে সামনের দিকের আইল সিট নিয়েছি। এখন এই নরাধমকে দেখতে দেখতে যেতে হবে তোমার।

– দেখা যাবে কী হয়। এ কী, লাঠি হাতে রেখেছো কেনো? ওটা কোথাও সরিয়ে রাখতে হবে। কষ্ট করে উপরে তুলবার দরকার নেই। আমি আমার কোট ক্লজেটে রাখছি। প্লেন থামলে এনে দেবো।
: তথাস্তু। এই নাও। তোমাদের প্লেনে তো সামনের দিকেও অনেক আওয়াজ দেখছি।

– ব্যাপার না। এই ব্রাউনিটা একটু চেখে দেখো তো। আজকের বিশেষ খাবার এটা। বয়ফ্রেন্ডের জন্য কিছু নিয়ে যাবো কিনা ভাবছি।
: ভুল মানুষকে দিলে। আমি চিনি বেশি খাই। এক কাপ চায়ে চার-পাঁচ চামচ পর্যন্ত নিয়ে ফেলি। অন্য কাউকে দাও।

– কেউ তো নিচ্ছে না দেখি। তা তুমি এমন বেজার মুখ করে বসে আছো কেনো? ঝামেলা হয়েছে কোনো?
: নাহ, তেমন কিছু না। ট্রাভেল কিট-এ আমার সবকিছু থাকে, তবুও কী সব নিয়মের জন্য একটা একটা করে বের করে জিপলক ব্যাগে ঢুকাতে হল। এবারে দেখলাম নেল-কাটার, সেফটি-রেজার, ইত্যাদি নিতে দিচ্ছে। আমার একটা ৭ আউন্সের কৌটায় কয়েক ফোঁটা আফটার-শেভ ছিলো, সেটা নিতে দিলো না। বলে, কৌটার ভেতরে যতটুকুই থাকুক, কৌটার আকার ৩ আউন্সের বেশি হতে পারবে না। যন্ত্রণার শেষ নেই।

– মন খারাপ কোর না। কী ড্রিংক নেবে তুমি? বাড়তি একটা কোক রেখো তাহলে। তোমার দুস্থ অবস্থার সম্মানে।
: চিয়ার্স টু অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন!

– কেনো, এমনিতে কি বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়া যায় না? যাক, কাজে নামি আমি এবার।
: তা তো অবশ্যই। তোমার গৎবাঁধা কথাগুলো বলে নাও। আমি পালাচ্ছি না।

– উপস্থিত সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি মেমফিস থেকে গ্রিন্সবোরো পর্যন্ত এই ফ্লাইটে। আমাদের আনুমানিক যাত্রাকাল সাড়ে ছয় ঘন্টা…
: সে কী? টিকেট তো বলছে দেড় ঘন্টা!

– গত ফ্লাইটের কথা ভুলে গেছো? মিসিসিপি’র উপর ঝড়-বাদলা হওয়ায় গত ফ্লাইটে আমাদের আকাশে চক্কর দিতে হয়েছে আড়াই ঘন্টা। এক ঘন্টার ফ্লাইটের জন্য আড়াই ঘন্টা বাড়তি দেরি হওয়ায় তোমরা সবাই বিরক্ত, তাই এবারে আমি একটু বেশি করে বলে দিলাম আর কি।
: গড ফরবিড। মনে হয় না এমনটা হবে এবার। এদিকের আকাশ পরিষ্কার দেখলাম রওনা দেওয়ার আগে।

– সিট বেল্ট ও ইমার্জেন্সি বিষয়ক খুঁটিনাটিগুলো মেনে চলার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। আমার পক্ষে যদি আপনাদের এই যাত্রা কোনভাবে আনন্দদায়ক করা সম্ভব হয়, তবে নিঃসংকোচে জানাবেন। আপনাদের মনোরঞ্জনের জন্য আমি যেকোন কিছু করতে প্রস্তুত। এনিথিং টু মেইক ইয়োর ফ্লাইট এনজয়েবল অ্যান্ড কমফোর্টেবল… উইদিন রিজন। আই ডোন্ট ডু ফুট মাসাজ; নট এনিমোর। সো, ডোন্ট অ্যাস্ক। একটু পর তোমাদের আমি কিছু খাবার দেবো। তারপর সময় করতে পারলে গল্প শোনাবো, আর সবশেষে থাকবে গান।
: বিমানবালা বেশ রসিক দেখছি। আপনি তো মনে হয় অনেক ঘুরে বেড়ান। সব সময়ই কি এমন?

– সব সময় না। তবে এই জন তো অনেক বেশিই খোশ মেজাজে আছে মনে হয়। বাকি পথ আরামে কাটলেই হয়। তুমি ছাত্র?
: জ্বী, আমি ভার্জিনিয়া টেকে গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট। তড়িৎকৌশলের ছাত্র। আপনিও কি গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট?

– নো, বাট আই হ্যাভ আ বিয়ার্ড! আমি কর্নেল থেকে পাশ করেছিলাম। আমিও একই বিষয় নিয়ে পড়েছি। প্রায় বিশ বছর আগের কথা। আমার এখন নিজের ব্যবসা আছে একটা। বিছানা বানাই। ঐ যে, পার্টনার ফোন করেছে।
: কর্নেলে আমার খুব কাছের এক বন্ধু পড়ে, প্রশংসা শুনেছি খুব। কান তো বন্ধ রাখা যায় না, তাই তোমার ফোনের কথাবার্তা কিছুটা শুনে ফেলেছি বলে দুঃখিত। তোমার ব্যবসা ভালই চলছে মনে হলো। এই মন্দার মধ্যেও তো বেশ লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছো।

– আমি অসুস্থ আর প্রতিবন্ধীদের জন্য বিছানা, হুইল-চেয়ার, ইত্যাদি বানাই। ব্যবসার ধরনটাই এমন যে এটার উপর মন্দা তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। আমরা মূলত ডিজাইনের কাজটুকু করি। প্রতি ইউনিটে বেশ ভালই লাভ থাকে।
: ভালই তাহলে। এবারেও কি বিজনেস ট্রিপ ছিলো?

– উহু, এটা ছিল এমনি বেড়াতে যাওয়া। এক সপ্তাহ ফ্লোরিডায় ছুটি কাটিয়ে এলাম।
: বেশ ভালোই তাহলে। প্লেন মনে হচ্ছে একটু পরেই ছাড়বে। আমাদের আগে যা লম্বা লাইন দেখতে পাচ্ছি! দেড় ঘন্টার ফ্লাইট হওয়ার কথা। এখন দেখি ছাড়তে ছাড়তেই দেড় ঘন্টার উপর হয়ে গেল ভিড়ের কারণে। বিমানবালা আসছে আবার, কিছু বলবে মনে হয়।

– জরুরি কোনো কাজে ব্যস্ত না থাকলে একটা প্রশ্ন করতাম আপনাকে।
: না, ব্যস্ত নই। বলে ফেলো। আমার লাঠি ফেরত দেবেন?

– না, তোমাকে না। তোমার পাশের ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করছিলাম।
: বলুন কী প্রয়োজন। কোনো সমস্যা হয়নি তো?

– আপনি কি আপনার স্ত্রী সহ এসেছেন?
: জ্বী, আমার স্ত্রীও এই প্লেনেই আছেন।

– আপনি চাইলে তাঁর সাথে বসতে পারেন। আমি সিট বদলে দিতে পারি আপনাদের সুবিধার্থে।
: সে-কষ্ট করতে হবে না। আমি বেশ আছি। ধন্যবাদ।

– ঠিক আছে তাহলে। আপনার স্ত্রী বলছিলেন, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম। আমি অন্য দিকে যাই তবে। প্রয়োজন পড়লে জানাবেন…
: আপনার স্ত্রী ডাকলেন, তবু গেলেন না?

– আমার স্ত্রী আছে, তবে আমার ছেলে সহ। যে-ভদ্রমহিলার কথা বিমানবালা বলছিলো, তিনি আমার স্ত্রী নন। বিমানবালা ভুল করে আমাকে ডাকছিলো। ভদ্রমহিলা সুন্দরী বেশ। পাশে বসতে পারলে মন্দ হতো না, কী বলো?
: তাহলে তো মিস করে ফেললে। চলে যেতে। স্ত্রী জিজ্ঞেস করলে বলতে, বিমানবালার ভুল।

– স্ত্রীর সামনে এই কাজ করা যায় নাকি? বাসায় গেলে তো আমাকে নাইনটি ডে’স, নো ইন্টারেস্ট প্রোগ্রামে ফেলে দেবে। ক’দিন পরেই ২৫ বছর পূর্তি।
: হাহ হাহ, মনে হয় না এই বয়সে এসে এমন ব্যাপারে সুযোগ নেবে তুমি।

– তা আর বলতে। যাক, ভালো লাগলো তোমার সাথে কথা বলে। আমার কার্ড রাখো, কখনও দেখা হবে আবার।
: না হলেই ভালো। তোমার কাজের যা ধরন, তাতে দেখা না হওয়াই সুলক্ষণ।

– আই’ল কাট ইউ আ ডিল, তবে আশা করি আসলেই দেখা হবে না আর।
: আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমাকে তো চিনবে না, তবু পারলে ওদিকটায় বেড়াতে যেয়ো, ভালো লাগবে। বিমানবালা এবারে কী বলে শুনে দেখি।

– আমাদের সাথে এই ফ্লাইটে থাকবার জন্য অনেক ধন্যবাদ সবাইকে। আমার আতিথেয়তা যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে, তবে মন খুলে উপহার দিতে পারেন। আই ওনলি এক্সেপ্ট ডায়মন্ড নেকলেস, গোল্ড ব্রেইসলেট, অ্যান্ড রুবি রিংস। তোমাদের গল্প বলতে গিয়েছিলাম, কিন্তু দেখতে পেলাম তার আগেই অনেকে ঘুমিয়ে গেছো। তাই সে-চেষ্টা আর করলাম না। আই ডিড সিং ফর ইউ, দো। আই স্যাং সোলো। পারহ্যাপ্স সো লো দ্যাট ইউ ডিড নট হিয়ার মি। শুভ হোক তোমাদের বাকি দিন।

No comments: