Monday, July 13, 2009

প্রবাসের কথোপকথন - ১৭

– হে, ইশ! আর কতক্ষণ উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোরার পর আমাকে চিনবে?
: খুবই দুঃখিত, ডন। একটু বেখেয়াল ছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি ঠিক সাড়ে এগারোটায়ই আসবে। সেজন্য বাইরের দিকেই নজর ছিল। খেয়াল করি নি যে এসে বসে আছো।

– কোন ব্যাপার না। আমি মজা দেখছিলাম। আই ওয়াজ গোয়িং টু লেট ইউ ওয়ান্ডার অ্যাবাউট সাম মোর।
: দু’বছর পর আবার এলাম তো, এতদিনের চেনা লুই’স ক্যাফেও কেমন যেন অচেনা ঠেকছিল। শহরটা কত বদলে গেছে। এই সামনেই তো বিশাল একটা শপিং এরিয়া ছিল, এখন দেখি সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

– হ্যাঁ, গত দু’বছরে অনেক দালান-কোঠা হয়েছে। শহরটা খাপছাড়া রকম আধুনিক হয়ে গেল চোখের পলকে। কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। ক্যাটরিনার পর নিউ অর্লিয়েন্স তার সব জৌলুস হারালো, আর এদিকে ব্যাটন রুজে শুরু হল ঠিকাদারির ধুম।
: এটাই জগতের নিয়ম। তবে এবার দেখলাম গুস্তাভ অনেক গাছ-পালা ফেলে দিয়ে গেছে। আগে কত সবুজ ছিল ব্যাটন রুজ। কচু নামে একটা খাবার আছে আমাদের দেশে। লুইজিয়ানা বেড়াতে এলেই লোকে কচু তুলে নিয়ে যেতো। প্লেন থেকে তাকালে সবুজ সমুদ্র মনে হতো। এখন গাছ কমে গেছে অনেক। কিছু গেছে প্রকৃতির ঘূর্ণিঝড়ে, কিছু গেছে কংক্রিট মিক্সারের ঘূর্ণিতে।

– এটাই স্বাভাবিক। কোথাও কমতি হলে কোথাও বাড়তি হবেই। তুমি তো কিছুটা বদলেছো। শুকিয়ে গেছো আগের চেয়ে, লুকস-ও একটু ভিন্ন।
: ভেতরের পরিবর্তনের তুলনায় বাইরেরটুকু কিছুই না। এই দু’বছরে অনেক কিছু শিখলাম। অনেক নাইভ ছিলাম আগে। বিশ্বাস করে ঠকতে ঠকতে টনক নড়েছে।

– চিয়ার আপ। এটা কোন ব্যাপার না। ইউ আর নট ইভেন টুয়েন্টি ফাইভ।
: আই অ্যাম, অ্যাকচুয়ালি।

– সো ইউ জাস্ট টার্ন্ড টুয়েন্টি ফাইভ…
: মেক দ্যাট টুয়েন্টি সিক্স অ্যান্ড আ হাফ। এনিওয়ে, ইউ ওয়্যার সেইং…

– আমার এই শিক্ষাটা হয়েছিল ৪৭ বছর বয়সে। আমার অধীনস্থ লোকজন মিলে ভোট দিয়ে আমাকে বাদ দিয়ে দিলো। আমি তখন এলএসইউ-তে কাজ করি। কী এক কারণে টাকা কিছুটা কমে গেছে ডিপার্টমেন্টে। ওরা সবাই মিলে ঠিক করলো যে আমাকে বাদ দিয়ে আমার বেতনের টাকাটা সবাই মিলে ভাগ করে নেবে।
: এটা তো এমন ঘটনার জন্য খুবই বাজে সময়। ওই বয়সে মানুষ সংসার গুছিয়ে বসে, জীবনের শেষ অংশটার জন্য প্রস্তুতি নেয়।

– আমার দুই মেয়ের তখন ভার্সিটি শুরু করার সময়। আচমকা এক সকালে শুনি আমার চাকরি নেই। আমি আর আমার স্ত্রী তখন একেবারেই হতভম্ব। গতকাল বিকেলে যারা আমার সাথে এক সাথে বাজার করলো, লাঞ্চ খেলো, আমার মেয়েদের সাথে আহ্লাদ করলো, তারা আমাকে সকালে বলে যে আমার চাকরি নেই। উই আর স্যরি, ডন, বাট দেয়ার ইজ সামথিং উই গটা ডু।
: দুঃখজনক, খুবই দুঃখজনক। কী বলবো বুঝতে পারছি না।

– দুঃখের কিছু নেই। কিছু লোক খুব অমানবিক আচরণ করেছিল আমার সাথে। যা করেছে, শুধু তা নিয়েই রাগ ছিলো না। ওরা আমার চোখের দিকে তাকাচ্ছিলো না পর্যন্ত। আই ওয়াজ অ্যাংরি, আই ওয়াজ ভেরি অ্যাংরি।
: তোমার রাগ সম্পর্কে আমার ধারণা আছে। আড়াই বছর তোমার অধীনে কাজ করেছি, খুব একটা কম সময় তো না।

– আরে নাহ, তোমার সাথে তো আমি রাগ করিনি কোনদিন। অন্যদের উপর করেছি অবশ্য। তবে ঐ লোককে আমি একেবারে ধরাশায়ী করে ফেলতে পারতাম। দেয়ার উড বি টু ব্লোজ। ওয়ান ইজ মে হিটিং হিম, দি আদার ইজ হিম হিটিং দ্য ফ্লোর।
: এই বয়সেও তোমার যা শরীর, তুমি অনায়াসেই পারতে, সে-নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।

– আমি এখনও নিয়ম করে জিম-এ যাই। তাছাড়া জীবনভর পরিশ্রম তো আছেই। আমার শুরুটা কিন্তু খুব অনাড়ম্বর। ওকলাহোমার একটা পাড়াগাঁয়ে আমার জন্ম। বাবার সাথে কাজে হাত লাগাতে হতো। ছেলেবেলায় গরু চরিয়েছি, কাঠ কেটেছি। সেখান থেকে লেখাপড়া করে উঠে এসেছি এতদূর।
: আমার মত ফার্স্ট জেনারেশন ইমিগ্র্যান্টদের জন্য এই কাহিনীগুলো খুব প্রেরণাদায়ক। সবাই মনে করে এখানে ডলার গাছে ধরে, নয়তো যুদ্ধ করে এত উন্নতি হয়েছে। একটা দেশ গড়তে যে তোমার মত কত শত মানুষ প্রয়োজন, সেটা কেউ বোঝে না।

– সেই লোকগুলো এখন আর লুইজিয়ানায় নেই। একজন ওকলাহোমায়ই আছে বলে জানি। আমি তখন বলেছিলাম যে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় খুব ভাল কিছু বন্ধু আছে। আমাকে বাদ দেবে দাও, আমি শুধু কিছু ফোন কল করবো এরপর। করেছিলামও। এই অন্যায়ের জন্য আমি এল-এস-ইউ’কে স্যু করতে পারতাম। আই কুড ওউন দ্য ম্যাসকট, কিন্তু আমারই এক কাছের বন্ধুকে পাঠালো আমার কাছে। অনুরোধ করলো যেন আমি আইনী পথে না যাই, ওরা ব্যাপারটা নিজের মত মীমাংসা করবে।
: তাহলে তো বেশ ভাল ভাবেই উৎরে গেলে শেষ পর্যন্ত। ঝামেলা আরও অনেক দূর গড়াতে পারতো।

– তা তো পারতো অবশ্যই। তুমি বলেছিলে যে তুমি অ্যাকাডেমিয়ায় থাকার চিন্তা করছিলে, তাই বললাম। দু’টা কথা মনে রাখবে সব সময়। প্রথমত, এমন কিছু পড়বে যাতে সত্যিই আগ্রহ পাও। আদারওয়াইজ ইউ ও’ন্ট হ্যাভ আ রিজন টু ওয়েইক আপ এভরি মর্নিং। দ্বিতীয়ত, অ্যাকাডেমিয়ায় কাউকে বিশ্বাস করবে না। আমরা আগে অনেক দান-খয়রাত করতাম। অথচ ১০ বছর পরও দেখি, পিপল ইউ আর হ্যাভিং কফি উইথ ও ইউ মানি! মানুষ খুবই বিচিত্র।
: দুটোই আমি খুব মূল্য দিয়ে শিখেছি। এই যে রিসেশন, চাকরির বাজারে খরা, এরপরও টিকে আছি নিজের আগ্রহের কিছু নিয়ে পড়েছি বলে। হয়তো এই লাইনে টাকা-পয়সা পাইনি, তবুও মনে শান্তি আছে। দেখি, পিএইচডি’টা ঠিক মত সারতে পারি কিনা। আর অ্যাকাডেমিয়া কেন, কোন কিছুতেই কাউকে আর অন্ধভাবে বিশ্বাস করি না। আগে আগ বাড়িয়ে প্রতিটা মানুষের উপর কিছু বিশ্বাসের বিনিয়োগ করতাম, দেখতাম সেই বিশ্বাসের মর্যাদা কীভাবে দেয়। কেউ মর্যাদা না দিলে তাকে আর কাছের মানুষ মনে করতাম না। এখন কেউ বিশ্বাস অর্জন করে নিতে পারলে নিক, আমি সেধে বিশ্বাস করে ঠকতে নারাজ। কাছের মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা খুব খারাপ।

– এত হতাশাবাদী হয়ে গেলে কবে তুমি? নাহয় কিছুটা সময় নিজের ইচ্ছে মত যায়নি, তাই বলে এভাবে দেখতে হবে কেন?
: এই যে গত দু’বছর কেমন এলেবেলে কাটলো। গ্র্যাজুয়েট স্কুলে গিয়ে যেন এতিমখানায় পড়লাম। অ্যাডভাইজার জুটলো যা-গরু-চড়ে-খা জাতীয়।

– এটা কোন ব্যাপার না। ইট ওয়াজ দেয়ার লস, নট ইওরস। সময় হলে দেখিয়ে দিও। শিক্ষা ব্যাপারটা এখন ব্যবসা হয়ে গেছে। নির্দিষ্ট করে বললে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। তুমি যেমন গুরু-শিষ্য সম্পর্ক আশা করছিলে, সে-ধরনের অ্যাপ্রেন্টিসশিপ আর নেই। শুধুমাত্র টিয়ার-থ্রি’র কিছু স্কুলে গেলে এমনটা পাবে। সেখানে কামড়া-কামড়ি করে ফান্ড আনার চেয়ে নিজের ভাইকে শেখানোটা জরুরি বেশি। তবে সেটা নিয়ে তো এত বিরক্ত হলে চলবে না। নিজের কাজ করে যেতে হবে।
: নট দ্যাট আই অ্যাম প্রাউড অফ ইট, কিন্তু এই সিনিজম’টা এখন অস্তিত্বের অংশ হয়ে গেছে।

– হোল্ড অন আ মিনিট। টাইম-আউট। মাসে কয় বেলা খাও তুমি?
: দিনে তিন বেলা করে ত্রিশ দিনে ৯০ বেলা বলতে পারো।

– টুকটাক স্ন্যাক খাও না?
: অবশ্যই, তা তো থাকেই কিছু না কিছু।

– তবুও কি তুমি কখনও না কখনও দিস ইজ দ্য ওয়ার্স্ট মিল অফ মাই লাইফ বলো নি?
: সে তো হরদমই বলি।

– ওয়ান মিল আউট অফ অ্যাবাউট আ হান্ড্রেড ইজ ব্যাড, অ্যান্ড ইউ আর স্টিল কমপ্লেইনিং! এটা কি ঠিক হল? শ’এ একটা তো ভালো-মন্দ হতেই পারে। তুমি ৯০ বছর বাঁচবে জীবনে। নাহয় সেই লম্বা জীবনের দু’টা বছর একটু খারাপই গেল। এটা তো জীবনেরই অংশ। এটাকে এভাবে দেখার কিছু নেই। বাকি ৮৮ বছরের মধ্যে থেকে সেরাটা বের করে আনো।
: ইউ শিওর নো হাউ টু লিফট আ ম্যান’স স্পিরিট, ডন। কথাটা মনে থাকবে। এভাবে ভাবিনি কখনও। তোমার নাতি-নাতনিরা কেমন আছে? অনেক বড় হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। মাত্রই দু’বছর পর এলাম, তবু কোনো পিচ্চিকে চিনতে পারি না আর। সবাই এক মাথা পরিমাণ বড় হয়ে গেছে।

– আমার নাতনি ইসাবেলা’র কথা তোমার সবচেয়ে বেশি মনে থাকার কথা। ওর বয়স এখন পাঁচ বছর। প্রি-ম্যাচিউর ছিল, তাই কোমড়ের হাড় বাড়েনি, জানোই তো। ডাক্তাররা ওর উপর অনেক গুলো অপারেশন করবে সামনে। হাড়গুলো জায়গা মত বসাবে।
: এতটুকু বয়সে কী কষ্ট। ভাবলেই গা শিউরে উঠে।

– ওর কিন্তু তেমন বিকার নেই। ও টাবের উপর আরাম করে বসে থাকে। দুই হাত মাথার পেছনে দিয়ে শুয়ে শুয়ে পা দুলায়। দেখে বোঝার উপায় নেই যে ওর এত বড় সমস্যা আছে শরীরে। ওর বাবা খুবই ধারালো বুদ্ধি রাখে। ডাক্তারদের জেরা করে করে বের করেছে কী করতে যায়। একটা পর্যায়ে দেখে যে ডাক্তারের নিজেরই স্পষ্ট ধারণা নেই কী করবে, জটিলতা হলে কীভাবে সামলাবে, ইত্যাদি নিয়ে। হি ইজ ওয়েইটিং ফর অ্যানাদার ওপিনিয়ন নাউ।
: বোঝো কীভাবে এটা? এই যে, লোকজন কিছু না জেনেও মুখে মুখে হাতি-ঘোড়া মেরে ফেলে, এদের ধরো কীভাবে তুমি?

– যা বলছে, সেটার চেয়ে যা বলেনি সেটার উপর মনোযোগ দেবে বেশি। তোমার সাথে যখন কথা বলতে আসবে, তখন দে আর দ্য ওয়ানস ইন কন্ট্রোল অফ দ্য কনভার্সেশন। এই ব্যাপারটা থেকে বের হয়ে আসবে। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে কী বলছে, এরপর কিছু একটা উছিলা দিয়ে সরে যাবে। এক বেলা সময় নেবে। ভেবে দেখবে কী কী বলেনি তোমাকে। পরের বেলায় যখন কথা হবে, তখন ইউ উইল বি দ্য ওয়ান ইন কন্ট্রোল অফ দ্য কনভার্সেশন।
: রিডিং বিটউইন দ্য লাইনস। শিখতে পারলাম না জীবনে।

– অবশ্যই শিখবে। সময়ের সাথেই হবে। বয়স তো কম হলো না আমার। এখন এরকম কোন ফাঁক-ফোকর পেলেই আমি তার জন্য ফাঁদ পেতে বসে থাকি। একটা ‘উম’ দিয়ে বাক্য শুরু করলেই চেপে ধরি।
: এটা কেমন কথা আবার?

– ইফ ইউ স্টার্ট আ সেন্টেন্স উইথ ‘উম’, দেন ইদার ইউ ডোন্ট নো হোয়াট ইউ আর টকিং অ্যাবাউট, অর ইউ আর জাস্ট লাইং।
: এটা খেয়াল রাখতে হবে। আমার তো বাক্যের শুরুতে উম-আম করার স্বভাব অনেক পুরনো।

– বিলটা এদিকে দিও। মাই সান ইজ স্টিল আ স্টুডেন্ট, হি কান্ট পে।
: আমি জীবনের একেবারে শেষে গিয়ে একটা বই লিখবো, বলেছিলাম তোমাকে? সেখানে আমার দেখা কিছু অসামান্য মানুষের কথা লেখা থাকবে। তোমার জন্য একটা চ্যাপ্টার থাকবে সেখানে।

– এভাবে ভাবার কোন দরকার নেই। আমি ১১৬ বছর বাঁচবো। তোমাকে যেন ঠিকঠাক দেখি ততদিন। আমি এখন লেখালেখি করছি কোস্টাল এরিয়াগুলো নিয়ে। আজ থেকে ৬০ বছর আগে এই সমুদ্রতীর কেমন ছিল তা নিয়ে সাক্ষাৎকার নিচ্ছি সবার। তাঁদের জীবদ্দশায় কী পরিবর্তনগুলো এসেছে, তা নথিবদ্ধ করছি। পাশাপাশি সবাইকে একটা বাড়তি প্রশ্ন করছি। হোয়াট ডিড ইওর গ্র্যান্ড ফাদার টেল ইউ হোয়েন ইউ ওয়্যার ইয়াং।
: অপেক্ষায় থাকলাম বই বের হওয়ার। ছবি তুলে রাখি তোমার সাথে একটা। স্মৃতিগুলো আকার পাবে।

– অবশ্যই। ঐ মেয়েটাকে বলি ছবি তুলে দিতে। ক্যান ইউ টেক আ পিকচার অফ আস, প্লিজ। ইউ গেট এক্সট্রা পয়েন্টস ফর ফিগারিং আউট হু ইজ দ্য ওল্ডেস্ট!

No comments: