Saturday, July 19, 2008

শূ্ন্য আটের দিনগুলিঃ ভাগ্যিস ’৭১ এ জন্মাইনি

২.১
সবাই শুধু নারীজীবনের দুর্দশার কথা বলে। অসাম্য, অবরোধবাস, অবিশ্বাস, আবেগপ্রবণতা, অযোগ্যতা, ইত্যাদির অনেক অভিযোগের কাঁটা বিছানো পথ পাড়ি দিতে হয় মেয়েদের। নারী হয়ে সফল হওয়া তাই খুবই দুরস্ত, দুষ্কর। অনেক কষ্ট, অনেক বৈষম্য, অনেক দুর্বলতা, অনেক খোটা। সমাজ ও সাহিত্যে এই সত্য আজ মোটামুটি সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে পূর্ণতার প্রশ্ন এলে জবাব খুব সহজ একজন নারীর জন্য -- মাতৃত্ব। এটি আত্মোৎসর্গকারী এমন এক নিম্নগামী আবেগ যার ঐশ্বরিকতাকে চেষ্টা করেও ধরাধামে নামানো যায় না।

পুরুষজন্ম সে-তুলনায় অনেক আরামের। প্রত্যাশার আঁতশকাচের নিচে বড় হতে হতে পুরুষমাত্রেই উচ্চাভিলাষী হয়ে যায় একটা সময়। আবেগজনিত কিছু নিয়ে তাদের চিন্তা করতে হয় না। ছকে বাঁধা জীবনে, ছাঁচে মাপা সাফল্য। কিন্তু পুরুষের পূর্ণতার একটি বিশেষ নির্ণায়ক আছে। একটি ছেলের জীবনের পরম আরাধ্য একটাই –- বাবার চোখে একজন যোগ্য মানুষ হওয়া। বাবার মুখে সামান্যতম প্রশংসাও তাই যে-কোন ছেলের কাছে অনেক, অনেক বড়।

আমার বাবা খুব খুঁতখুঁতে মানুষ। তার ছেলে হওয়াটা মহা ঝক্কির ব্যাপার ছিল। একটু এদিক-ওদিক হলেই শুনতে হত, আমার ছেলেদের এমন করবার কথা না। বলা হত একশ’ জনের চেয়ে আলাদা হবার কথা। অংকে ৯৮ পেলে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করা হত বাকি ২ নম্বর কোথাও গেল। বাবার আদরে-শাসনে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর একটি উক্তি খুব মনে পড়ে যায় –- দশের মধ্যে একজন হয়ো না, দশে এগারো হও।

বয়স তখন আমার বাও-তেও। কোন এক জাতীয় দিবসে একাত্তরের গণহত্যার চিত্র দেখাচ্ছে। কী বলছি, তা বুঝে ওঠার আগেই মুখ দিয়ে একটা কথা বেরিয়ে গেল -- ভাগ্যিস ’৭১-এ জন্মাইনি! অল্প বয়সে মারা যেতাম তাহলে!

সামান্যতম ত্রুটিও ধরে দেওয়া বাবা আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল নিঃশব্দে।

২.২
আলী আমান আজকে একজন রং মিস্ত্রি। সহায়-সম্বল নেই, ছেলের সংসারে থাকেন, দিনমজুরি করে পেট চালান। তিনি নিবন্ধিত জামাতীদের একটি প্রহসনমূলক অনষ্ঠানে একা গিয়ে হাজির হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছেন। রাজাকারের ফাঁসি চেয়েছেন। গগনবিদারী জয় বাংলা ধ্বনির কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। শাস্তিস্বরূপ তাঁকে প্রকাশ্যে লাথি খেতে হয়েছে। অন্ধকার ঘরে বন্দী থাকতে হয়েছে তিন ঘন্টার ওপর।

কোন জরুরী অবস্থা ভঙ্গ হয়নি তাঁর এই লাঞ্ছনায়। কোন সেক্টর কমান্ডার তাঁর সমর্থনে আসেননি। কোন সুশীল এগিয়ে এসে আলী আমানের লাঞ্ছনাকারীদের নারায়ে-তাকবীর ধ্বনির প্রতিবাদ করেননি। তবু আলী আমান পত্রিকা অফিসে এসেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে গেছেন।

একজন আলী আমান যতটা পুরুষ, আমরা সবাই ততটাই নপুংসক। প্রান্তিক মানুষ আলী আমানের এই সাহস সুবিধাভোগী এই আমাদের ভয় পাওয়ার অধিকার দেয় না।

No comments: