আমাদের পরিচিত জীবনধারাটি খুব বেশি যৌগিক। জীবন গঠনের মৌলিক উপাদানগুলোর সাথে আমাদের যোগাযোগ নেই অনেক দিন হয়। একটা সময় মানুষ জীবন নিয়ে খুব গভীর ভাবে ভাবতো। একেকটি নতুন অনুভবের সাথে ঝংকার তুলতে নিত্য-নতুন শব্দের জন্ম নিত। আজকাল কেউ আর এসব ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। জীবন অনেক দ্রুত এবং জটিল হয়ে গেছে, এমনটাই দাবি করি আমরা। ফলাফল অপ্রত্যাশিত নয়।
আগে মনের অবস্থা স্বাভাবিকের থেকে ভিন্ন হলে তাকে অনেক রকম নাম দিতাম। উদাস, উৎফুল্ল, প্রশান্ত, আশ্বস্ত, বিরহী, ব্যথিত, আড়ষ্ট, আতঙ্কিত, অভিমানী। এখন শুধুই ‘কেমন-কেমন’ লাগে। আগে গৃহের বাঁধন ছিড়ে বের হলে গন্তব্য হত নিরুদ্দেশ, অসীম, তেপান্তর, দিগন্ত, মহাকাল, সিদ্ধিলাভ। এখন শুধুই ‘এইতো সামনে’। আগে কিছু খাওয়ার জন্য মন উচাটন হলে সবকিছুর কথা আলাদা করে বলতাম। তেল, ঝোল, নুন, মশলা, মরিচ, রঙ, সুবাস, উত্তাপ। এখন খাবারটুকু ‘ইয়াম্মি’ হলেই খুশি। আগে পাশের মানুষটিকে বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন ভাবে দেখতাম। বন্ধু, সাথী, জীবনসঙ্গী, উপদেষ্টা, ভরসাস্থল, আত্মীয়, আপন, অচিন, আরাধ্য। এখন দু’টি করে হাত ও পা থাকলেই খুশি।
পাহাড়ে বসত করলে যৌগিক জীবনের মৌলিক উপাদানগুলো খুব বেশি বিশ্লিষ্ট হয়ে চোখে পড়ে। এখানে আবহাওয়া মানে শুধু ‘আহ্’ বা ‘ধ্যাত্’ নয়। একেকটি ঋতুর মাঝে বিভেদ খুব স্পষ্ট। একই ভাবে কোন সঙ্গীর সাথে পাহাড়ে দিনাতিপাত করলে কিছুদিন পরই জীবনে তার অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায়। ইন্দ্রিয়গুলোও স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে পাহাড়ি জীবনে। কখনো বুক ভরে শ্বাস নিলেই শরতের প্রাণ টের পাওয়া যায়। কখনো ভেজা বাতাসের স্পর্শ বলে দেয় বৃষ্টি এল বলে। কখনো হিমশীতল বাতাসের শনশন শব্দ শীতের উপস্থিতি জানান দেয়। কখনো ফুলেল গন্ধ বসন্তের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
পাহাড়ি জীবন সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করার জন্য রইলো বাকি দুই। একটি পঞ্চেন্দ্রিয়ের শেষটি, দৃষ্টি। অন্যটি বাবা আদমের আমল থেকে রক্তে বয়ে চলা আদিম রোগ, দৈনন্দিন সঙ্গীর অভাববোধ। আমার জানালাটা দৃষ্টিসুখের প্রয়োজন মেটায় খুব ভাল ভাবে। কম্পিউটারে কাজ করতে করতে পেছনে প্রকৃতির খেলা দেখা অনেক দিনের অভ্যাস হয়ে গেছে। একটা সময় অবিরাম তুষারপাত দেখতাম, এখন অঝোর বর্ষন দেখি। সকাল হলে এই জানালা দিয়েই সূর্য উঁকি দিয়ে ঘুম ভাঙায়। বছরের বিভিন্ন সময়ে এই জানালা দিয়েই পাহাড়ের রঙ-বদল দেখি। একাকী সেই দিনগুলোয় সাথে থাকতো আমার একমাত্র সঙ্গী, ছোট্ট একটা মাকড়সা।
জানালার এক কোণায় ছিল এই মাকড়সাটার বসবাস। কেউ কাউকে জ্বালাতাম না। কোন চিন্তায় আটকে গেলে ওর দিকেই তাকিয়ে বিড়বিড় করতাম আপন মনে। অজান্তেই একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। অনেক অলস দুপুর কেটেছে স্রেফ মাকড়সার লাফালাফি দেখে। আমিও ওকে ঘাটাতাম না, ও-ও জাল বুনে বিরক্তির কারণ হত না। অসম ও অস্বাভাবিক বিধায় বন্ধুত্ব ছিল না, কিন্তু শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। গতকাল মেজাজ খারাপ করে আমার একমাত্র সঙ্গীকে ফেলে দিয়ে এসেছি। অভ্যাসবশত, চোখ আজো ঘরে ঢুকেই কাউকে খোঁজে, বাসার অন্যতম প্রাণিটির অভাবে বিষণ্ণতা আরো বেশি গ্রাস করে।
মেজাজটা খারাপ হয়েছিল রাজাকারের হাতে মুক্তিযোদ্ধার লাঞ্ছনা দেখে। অক্ষম আমি সেই ক্রোধ ঝাড়লাম অবল এক মাকড়সার ওপর। আমার ঘর, আমার খাবার, আমার জানালা। কোনদিন তো আমার মত হবি না, আমার বন্ধু হবি না। তবে অযথা আমার জায়গায় ভাগ বসাচ্ছিস কেন? নিজের মত জায়গা খুঁজে নে, নয়তো দূরে গিয়ে মর। এই ভেবে কাগজবন্দী করে হতচ্ছাড়া মাকড়সাটা ফেলে দিলাম গতকাল। রাগ নেমে যাবার পর থেকেই মন বেশ খারাপ। কারো উপকারে আসতে না পারি, অন্তত কারো ক্ষতি করছিলাম না। হোক না সে ছোট্ট এক মাকড়সা।
আজকে সকাল থেকে বারবার চোখ যাচ্ছে জানালার কোণার দিকে। আমার চোখ শুধু পাহাড় নয়, মাকড়সাও দেখতো। শূন্যতা থেকে সেটাই বুঝতে পারছি। ক্রোধ আর নিঃসঙ্গতা মেশানো অস্বস্তিকর একটা অনুভূতিতে ডুবি-ভাসি করে কেটে গেল পুরো দিন। ভেবে মনে হল, স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের কাছে আমাদের ক্রমাগত পরাজয়ের পেছনে জীবনের যৌগিকতার কাছে পরাজয় একটি বড় কারণ।
যে-কোন কারণেই হোক, আমরা মূল্যবোধগুলোকে আর আলাদা করে চিহ্নিত করি না। স্বাধীনতা, বীরত্ব, দেশপ্রেম, সততা, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, কিংবা অধিকারবোধের চেয়ে ‘হবে একটা কিছু’ই বড় এখন। স্বাধীনতাবিরোধিতা তাই আমাদের রাগায় না, দেশদ্রোহিতা করে না উচ্চকণ্ঠ। ইতিহাসবিকৃতির কথা উঠলে আমরা সত্যভাষণের চেয়ে রাজনৈতিক দলাদলি করি বেশি, রাজাকারের আস্ফালন দেখে দায়িত্বহীনতার অভিযোগের আয়নাগুলো নিজের বদলে অন্যের মুখের সামনে ধরি।
খুব প্রত্যাশিত ফল হিসেবেই আত্মশুদ্ধি বা আত্মোপলব্ধির বদলে আমরা নিষ্ফল আক্রোশ প্রকাশ করি ভাঙচুর বা গালাগালির মাধ্যমে। আড়ালে ওরা আরো সংগঠিত হয়, আরো বেশি লজ্জা দেবার জন্য। রাজাকারের লাথিতে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজকে নিজের দায়িত্ব বলে জ্ঞান করে না, সুশীল সমাজ ঠুনকো বিভেদের উর্ধ্বে ওঠে না, হাইকোর্টে কমান্ডার নিজামির জামিন নামঞ্জুর হয় না, রাজনীতির নামে দুর্জনদের সাথে আঁতাতের জন্য বড় দলগুলো ক্ষমা চায় না, ধৃষ্টতার প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামি’র অফিসে একটা ঢিল পড়ে না, বিচারপতি জে আর মোদাচ্ছিরের বাসার দেওয়ালে কেউ রক্তাক্ষরে ‘ছিহ্’ লেখে না, মুক্তিযোদ্ধা যাদুঘরে একটা পয়সা অনুদান পড়ে না। অযথা নির্বিষ, নির্বান্ধব একটা মাকড়সার গৃহধ্বংস হয় দশ হাজার মাইল দূরে।
No comments:
Post a Comment