৩.১
গল্পটা সম্ভবত নানার কাছে শুনেছিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের গল্প। ইউরোপ তখন সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার ভয়ে কাঁপছে। বিভিন্ন দেশে গুপ্ত সমাজতন্ত্রী সন্দেহে উইচহান্ট চলছে। এরই মাঝে খবর বেরোলো, ফ্রান্সের অধিপতি চার্লস দ্য গলের ছেলে নাকি তালিকাভুক্ত সমাজতন্ত্রী। এক সাংবাদিক এ-নিয়ে প্রশ্ন করলেন তাঁকে। দ্য গল জবাবে বললেন, আমার ছেলে যদি আঠারো বছর বয়সে সমাজতন্ত্রী না হয়, তাহলে বুঝতে হবে তার কোন সমস্যা আছে। যদি সে চল্লিশ বছর বয়সেও সমাজতন্ত্রী থাকে, তাহলেও বুঝতে হবে তার কোন সমস্যা আছে।
বয়সের সাথে সাথে কিছু মানুষ শক্তিশালী হয়, আর কিছু মানুষ হয় সাবধানী। চেতনার যে-বীজ মানুষের ভেতর শৈশবে উপ্ত হয়, কেউ বয়সের সাথে সাথে তার বাস্তবায়নের জন্য শক্তি সঞ্চয় করেন, বিপর্যয় আর প্রলোভনের ঊর্ধ্বে উঠে নিজের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করে যান। আবার কেউ বয়সের সাথে সাথে কেমন যেন মিইয়ে যান। তাঁরা কখনো সুশীল, কখনো মধ্যপন্থী, কখনো জাতির বিবেক।
দুটোর মাঝে অনেক মিল থাকা সত্ত্বেও স্বপ্ন পানির চেয়ে মূল্যবান। দুটোই বিনামূল্যে পাওয়া যায়, দুটোই মানুষ হেলায় হারায়। তবে পানির পরিশোধনাগার থাকলেও স্বপ্নের পরিশোধনাগার নেই। বাস্তবায়ন করতে হলে স্বপ্নকে বেহায়ার মত আঁকড়ে ধরে থাকতে হয়। বয়সের সাথে অনেক স্বপ্নের পঁচন ধরে, অনেক সদিচ্ছা হারিয়ে যায়। নির্লিপ্ততার জং ধরে যায় স্বপ্নগুলোর মধ্যে। কিছুদিন না যেতেই এককালের স্বপ্নবাজেরা হয়ে যান অক্ষম পরাজয়ের পূজারী। তেমনটা হয়ে যাওয়াই সাফল্য, হতে না পারাটা সমস্যা। অন্যথায় রাষ্ট্রযন্ত্র বিব্রত হবে, এর আপদকালীন শান্তিব্যবসায়ীদের বাজার নষ্ট হবে।
৩.২
আইনের প্রয়োগ আদালতে হলেও এর জন্ম মানুষের মনে। নিজের মনে প্রতিটি মানুষ জানে কোন কাজটি অন্যায় কিংবা কার ভোগবিলাস অন্যায্য। মানুষ দূরদর্শী হলেও ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নয়। সে-কারণেই অন্যায়ের প্রতিবিধান করবার জন্য আইনের সংশোধন হয়। রাষ্ট্র এতে বাধা দেয়, অহেতুক দুর্যোগের ভয়ে কেউ কেউ গালভরা বুলি ছড়িয়ে শান্ত হতে বলেন। ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রয়াস বা ইচ্ছাপ্রকাশকে এঁরা বাহুল্য মানেন। পাপাচারীর সানন্দ উপস্থিতি এঁদের কাছে সহনীয়। দু’চারটে চড়-থাপ্পড় মেরে দেওয়া কিংবা উকিল বাপের উপস্থিতিতে হালকা করে বকে দেওয়াই এঁদের কাছে সহজ সমাধান। এরপর যে বিধির হাতে বিধান ছেড়ে দিয়ে বালিতে মুখ গুঁজে সাহিত্যরস আস্বাদন করা যায়!
মাত্র সাঁইত্রিশ বছর গেল। গোলাম আযম নাগরিকত্ব পেয়েছে, শাহ আজীজ সংসদ ভবন চত্বরে শায়িত হয়েছে, কামারুজ্জামান মন্ত্রী হয়েছে, নিজামী রাজসিক অভ্যর্থনার সাথে কারামুক্ত হয়ে রাজনীতিতে ফিরেছে। রাষ্ট্র এদের ব্যাপারে সবসময়ই নীরব। ঝুঁকি নিয়েও এদের প্রাপ্য বিচারের দাবি তুলেছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। জনতার আদালতে দেওয়া হয়েছিল মৃত্যুদণ্ড, ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল তাদের কুশপুত্তলিকা। বুঝিবা সাহিত্যচর্চায় ব্যাঘাত ঘটার ভয়েই সুশীলেরা জাহানারা ইমামের উপরও ছিলেন বিরক্ত।
আমি মনে করি না শহীদ জননীর সে-প্রয়াস শুধুই স্বামী-সন্তান হারানোর বেদনা থেকে ছিল। যে-মা হাসিমুখে সন্তানকে যুদ্ধে পাঠাতে পারেন, তিনি স্রেফ আবেগের বশবর্তী হয়ে সংগ্রামের ডাক দিতে পারেন না। তাঁর কাছে স্বাধীন বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় ছিল, মুক্তি সবচেয়ে বড় আরাধ্য ছিল। কোন দুর্যোগের ভয় তাঁকে বিরত করেনি তাই। সুবিধাবাদীদের দাপট সত্ত্বেও তিনি লড়ে গেছেন একা। স্বপ্নের সাথে আপোষ না করা এই মহীয়সী শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বলে গেছেন যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির কথা।
দ্য গলের সেই গল্প মনে পড়ে। সাথে কাকতালীয় ভাবেই ’০৮-এ মনে পড়ে শহীদ জননীর শেষ চিঠির একেবারে শেষ কথাগুলো। ফর সার্টেইন, ভিকট্রি উইল বি আওয়ারস।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment