পরীক্ষিত ও প্রমাণিত কিছু মেয়েলিপনা আছে আমার। মুরুব্বিদের দেখে জেনেছি, নারীমন ভাল করে দেওয়ার অব্যর্থ উপায় হল বাজার করা। এই রোগ আমারও আছে। এমনিতে প্রতিটা পয়সার হিসেব টুকে রাখলেও মন খারাপ হলে কেমন যেন হয়ে যায় সব। যেই আমি কেউ কিছু চাইলে খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করে জেনে নেই, কিছু কিনবার আগে তার যাবতীয় তত্ত্ব-তালাশ করি, সেই আমিই দুই হাতে খরচ করি, সবার ইচ্ছাপূরণ করে দেই বিনাপ্রশ্নে। এমনই এক দুর্বল মুহূর্তে জীবনের প্রথম সাউন্ড সিস্টেম কিনি। চিরকঞ্জুস আমার এই বিরাট খরচের পেছনের কারণ ছিল বিরাট এক অপমান।
আমেরিকা এসে প্রথম কাজ পেয়েছিলাম একটি খাবারের দোকানে। নাম শুনে হাসা নিষেধ – উইনারশ্নিটজেল। মালিক এক পাকিস্তানি লোক আর তার দূরপ্রাচ্যীয় (পড়ুন চিংকু) স্ত্রী। বেতন খুবই কম, ঘন্টায় মাত্র সোয়া পাঁচ ডলার। নগদে কাজ, তাই খাটনির মাত্রা ছিল অমানুষিক। ডেলিভারি ট্রাক থেকে মালপত্র নামিয়ে ফ্রিজারে সাজাতে হত, সকাল-বিকালে দোকানের ভেতর-বাহির ঝাড়তে হত, পার্কিং লট থেকে গুদাম পর্যন্ত সাফ করতে হত, আর খাবার তৈরি ও বিক্রি তো আছেই। লোকলজ্জায় বেসবল ক্যাপ দিয়ে প্রায় নাক পর্যন্ত ঢেকে নিঃশব্দে কাজ করে যেতাম।
জাত্যভিমান মানুষকে কতটা অন্ধ ও কট্টর করে তোলে, তা খুব চোখে পড়তো। একবার এক খদ্দের খাবার ফেরত দিয়ে গেলেন, আমার হাতে তৈরি দেখে। একই সাথে মুদ্রার অপর পিঠও সেখানেই দেখলাম। আমার সাথের কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েটি চাকরির ঝুঁকি নিয়েও সেই খদ্দেরকে তাড়িয়ে দিল দোকান থেকে। আরেকবার এক খদ্দের “হেই” বলে সম্বোধনের পর সেই মেয়ে রুদ্রমূর্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মুখ ঝামটা দিয়ে বললো, “হেই ইজ ফর হর্সেস, অ্যাড্রেস প্রপারলি।” কৃষ্ণাঙ্গদের উচ্চারণ ঠিকমত বুঝে উঠিনি তখনও। একদিন খদ্দেরকে টাকা ফেরত দেওয়ার সময় এক সহকর্মিনী বলে উঠলো, “ডু ইউ হ্যাভ এনি পিনিস?” আমি স্রেফ বেকুব বনে গেলাম। আমতা আমতা করতে করতেই সেই মেয়ে বলে উঠলো, “দ্যাটস ওকে, আই গট ওয়ান।” এবার আমার আরও তব্দা খাওয়ার পালা। শেষ পর্যন্ত মেয়েটি তার পকেট থেকে ছোট্ট-গোল এব্রাহাম লিংকন বের করার বুঝলাম পেনি চাইছিল।
সেই দোকানে যারা কাজ করতাম, তারা সবাই ছিলাম জীবন সংগ্রামে বিভিন্ন ভাবে বিপর্যস্ত মানুষ। কমিউনিটি কলেজে পড়ুয়া কিছু মেয়ে ছিল, কিছু ছিল হাইস্কুল ড্রপ-আউট। ম্যানেজারকে লুকিয়ে কাজের অবসরে লুকিয়ে তারা হোমওয়ার্ক করতো, কোনদিন টুকটাক অংক দেখিয়ে নিত। সেই সময়টায় সবাইকে আগলে রাখতেন বয়স্ক এক মহিলা। আফ্রিকার কোন এক দেশ থেকে আমেরিকা এসেছিলেন। স্বামীর সাথে। কিছুদিনের মধ্যেই সেই স্বামী পরের ঘরে চলে গেছে, ফেলে গেছে স্ত্রী আর তিন ছেলে-মেয়ে। সে-ভদ্রমহিলা সন্তানের স্নেহেই আমাদের দেখে রাখতেন। দিনের শেষে গ্রিজ জমে থাকা পাতিল নিজেই সাফ করতেন, আমাদের সুবিধার জন্য বেশিক্ষণ কাজ করতেন, ম্যানেজারকে লুকিয়ে প্যাকেটে ভরে খাবার দিয়ে দিতেন রাতের জন্য। হয়তো আজও তিনি “ইশ”কে মনে রেখেছেন, অথচ আমি তাঁর নাম ভুলে গেছি ঠিকই। কনভিনিয়েন্ট অ্যামনিশিয়া।
কাজ সেরে ফিরছিলাম এক রাতে। ২৫শে এপ্রিল, ২০০৪। রবিবার রাত সাড়ে এগারোটা। সপ্তাহান্তের ফুর্তি সেরে সবাই যার যার ঘরে ফিরে গেছে। ক্যাম্পাসের এক পাশ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ডর্মিটরির সামনেই মাঠ, মাঠের পাশে রাস্তা, রাস্তার একপাশে ছোট্ট মসজিদ। সামনে পড়লো তিনটি ছেলে। সৌজন্যবোধক ভাবে মাথা নাড়িয়ে হেঁটে চললাম। হঠাৎ শুরু হল গালাগালি। দ্রুত পা চালিয়ে কেটে পড়ার চেষ্টা করলাম। সাথে পেছনের পায়ের আওয়াজও দ্রুততর হল। সাথে বেড়ে গেল গালির তোড়। বাধ্য হয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। এতে কাজ হল কিছুটা। একজন একটু পৃথুল হওয়ায় বাকি দু’জন ক্ষান্ত দিল, তবে তাই বলে উৎপাত বন্ধ হল না। রাস্তার পাড়ের কাঁকড় তুলে ছুঁড়ে মারতে লাগলো। মাথায় জ্যাকেটের হুড তুলে দিয়ে রক্ষা পেলাম। প্রবাসে এসে মসজিদেরই সামনে হেনস্তা হলাম। দুঃখ, হতাশা, আর রাগ মিলিয়ে কেমন যেন এক অনুভূতি কাজ করছিল। সেই দুঃখ থেকেই অধমের অ্যালটেক লান্সিংয়ের ফাইভ-পয়েন্ট-ওয়ান সারাউন্ড সাউন্ড সিস্টেম কেনা। সামনে পেয়ে মনে হয়েছিল, কী লাভ এত সঞ্চয়ী আর সুশৃঙ্খল থেকে? জীবন তো এমনিতেও কষ্টের, ওমনিতেও কষ্টের।
তখন চলছিল স্করপিয়নসের ক্রেজ। দেশ ছাড়ার আগে সবেমাত্র ডিভিডি কিনেছি কনসার্টের। বাইরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই অ্যাক্যুস্টিক ভার্সন যোগাড় করেছিলাম। ঠিক করলাম, রক ইউ লাইক আ হারিকেন দিয়েই উদ্বোধন করবো। তালে তালে ভুলে যাবো মাথায় তাল পড়ার কথা। সব ঠিকঠাক করে গান ছেড়ে দেখি তেমন কোন তফাৎ বুঝছি না। কিছুক্ষণ গুঁতাগুঁতি করে টের পেলাম, সাউন্ড কার্ডই কম্প্যাটিবল না। অতঃপর আবারও মন খারাপ, আবারও ধুম করে কিছু খরচ করে ফেলা। শেষতক সাউন্ড কার্ডও কেনা হল, এবং সেটার উদ্বোধন রক অই লাইক আ হারিকেন দিয়েই হল।
বড় বড় ব্যান্ডের কনসার্টে যাওয়ার শখ মিটবে, বৈশ্বিক ঘটনাবলির ঠিক মাঝখানে থাকবো, বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র ঘুরে বেড়াবো, অ্যামিউজমেন্ট পার্কে ফুর্তি করবো, প্রশস্ত রাস্তায় গাড়ি চালাবো, ফ্রেন্ডসের জোয়ি’র মত হাউ-ইউ-দুইং বলে বেড়াবো – এই ছিল দেশ ছাড়ার সময় বুকের ভেতর কুসুম কুসুম স্বপ্ন। হয়েও হল না।
খুব প্রিয় এই গানটা এভাবেই জড়িয়ে আছে জীবনের খুব অপমানজনক একটি অধ্যায় আর ভেঙে যাওয়া অনেক খুচরো স্বপ্নের সাথে।
2 comments:
মুগ্ধ হয়ে পড়লাম আর মাথা নাড়লাম।
অশেষ ধন্যবাদ। প্রিয় লেখক ও মানুষের কাছে এমনটা শুনলে যে আনন্দ হয়, তা ভাষায় বর্ণনার শক্তি এখনও হয়নি আমার। :)
Post a Comment