Tuesday, March 11, 2008

নীড়ে ফেরাঃ দ্বিচল সম্মেলন পর্ব

অ্যালাবামার অবার্নে যাবার সৌভাগ্য হলে একবার কদম ফেলে যাবেন সহ-সচল দ্রোহীর বাসায়। যেকোন দিন, যেকোন সময় দ্রোহীর দরজায় টাক্‌-টাক্‌ করে বলবেন, চাটনি আছে তো? কথাটা ঠাট্টা ভেবে উড়িয়ে দিলে নিজেই ঠকবেন।

স্প্রিং ব্রেকে লুইজিয়ানা যাবার পরিকল্পনা হাতে নিয়েই আমাদের সবার মাথায় হাত। যাত্রাপথ একেক দিকে এক হাজার মাইল করে। গুগুলের হিসেবে প্রায় ১৬ ঘন্টার মামলা। গাড়ি নাহয় ভাড়া করা গেল, কিন্তু এতগুলো গরুকে একরাত আশ্রয় দেবার মত গোয়াল কোথায় পাই? শুরু হয়ে গেল বিভিন্ন নেটওয়ার্কে পাত্তা লাগানো। সচলায়তনের সদস্যদের প্রোফাইল ঘেঁটে বের হল, দ্রোহীর বাস অবার্নে। আদর্শ বিশ্রামস্থল। ঠিক সাড়ে আট ঘন্টার দূরত্ব। ওদিকে আরেক বড় আপুও মিলে গেল। দ্রোহী তবু আধা-চেনা, দ্রোহীনি ভাবি তো একেবারেই অচেনা। প্রথম রাতে তাই তাঁদের জ্বালাতন না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। ঘুম-জড়ানো চোখে আপু আমাদের জন্য দরজা খুলে দিলেন ভোর সাড়ে চারটার দিকে। মধ্যাহ্নভোজের জন্য দ্রোহীর দরজায় হাজির হলাম পরদিন বেলা দেড়টার দিকে।

অধম ছিলাম চালকের আসনে। একে একে যে-ই নামছিলো, সবাইকে বলে দিচ্ছিলাম নিজেকে ইশতিয়াক বলে পরিচয় দিতে। কাজ হল না। সুজন চৌধুরীর অসামান্য স্কেচের বদৌলতে দ্রোহী আমার কুলার মত কানগুলোর ব্যাপারে বিশেষ ওয়াকিবহাল। কান দেখে চিনে ফেললেন। দ্রোহীর প্রতি আমার প্রথম কথা, আপনি তো অতটা ওবামার মত না। সশব্দ দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রোহী ইঙ্গিত করলেন দেওয়ালে ঝুলানো বিয়ের ছবির দিকে। বলতে বলতেই ভাবি হাজির। ভাবির প্রতি আমার প্রথম কথা, আপনিই দ্রোহীর সেই বউ!

আবজাবের বদৌলতে দ্রোহীর খান্ডারনি বৌয়ের গল্প সবাই জানেন। আসা-যাওয়ার পথে ভাবির সাথে দুই রাতে বেশ ক’ঘন্টা তুমুল আড্ডার পর বুঝলাম, দ্রোহী আসলে তোপসে নন, জটায়ু! সদাসহাস্য, প্রাণময়, পঁচানিস্ট ভাবির সাথে প্রথম কিছুক্ষণ কথা কম হচ্ছিল। দ্রোহীর সাথেই চলছিল আলাপ-সালাপ। বলছিলেন, তিনি খুবই সংগ্রামী মানুষ। জীবন গেছে ইধার-উধার ইতি-উতি করেই। অধমের সাথে মিলে গেল অনেক কিছুই। জেনে খুবই অবাক হলাম যে সেই বছর দু-তিন আগে বাতায়ন নিয়ে আমার আর হিমু ভাইয়ের নিরীক্ষার সময়েই তিনি অধমকে চিনেছেন। বাংলা ব্লগিং নিয়ে কথা হচ্ছিল। বাংলায় লিখতে পারার আনন্দ নিয়ে কথা হচ্ছিল। হিমু নামক এক হাঁটুপানির জলদস্যুর দুর্ধর্ষ ব্লগিঙের তোড়ে লিখতে বসলেই বিচিত্র সব অনুভূতির কথা হচ্ছিল। সাথে ছিল আবহাওয়া, রাজনীতি, স্কুল-কলেজের জীবন, দেশ, আর গাড়ি। একেবারেই নৈমিত্তিক পুরুষালি বাতচিত। ভাবির সম্মানে শুধু নারীপ্রসঙ্গ বাদ ছিল।

ঝড়ের পূর্বাভাষ ছিল, কিন্তু তাই বলে শিলাবৃষ্টি হবে ভাবিনি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হল খাদ্যবর্ষন। ভদ্রতা করে ভাবিকে বলেছিলাম যে আমরা চুলা থেকেই নিয়ে নিতে পারবো। ভাবি কপট হাসি দিয়ে বললেন, ছেলেমানুষের খাবলাখাবলিতে খাবার পড়ে ওনার ঘর নোংরা হবে, সেই ভয়েই টেবিলে দেওয়া। আত্মা কেঁপে উঠলো। জানতে চাইলেন কেউ বিশ্রামাগারে ঢুঁ মারতে চাই কিনা। পেট বেঁধে, কাষ্ঠ হেসে না বললাম। এবার হালকার উপর ঝাপসা ঝাড়ির ছলেই বললেন, গেলে ওনার সামনে দিয়েই যেতে এবং আসতে হবে, অতএব লজ্জার কিছু নেই। এবার আত্মা নীরবে চিৎকার দিয়ে উঠলো।

ভাবি এরপর শুরু করলেন গরমাগরম খাবারের ঢাকনা ওঠানো। মুরগি খেয়ে অভ্যস্ত, তাই মুরগি আছে। মুরগি খেয়ে বিরক্ত, তাই মাছ আছে। কাবাব আছে। সবজি আছে। সালাদ আছে। রাইস কুকারের আশীর্বাদে পেটে ভাতের চর পড়ে গেছে, তাই খিচুড়ি আছে। সাথে আছে চাটনি। এত কিছু দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ভাবি নিশ্চয় রান্নাবান্না খুব এনজয় করেন। মুহূর্তে খসে পড়লো সব পর্দা। হাসির বন্যায় ভেসে গিয়ে ভাবি বললেন, আই লাভ কুকিং! পরক্ষণেই আবার রাগত চেহারা করে হুকুম দিলেন, সব শেষ করে যেতে হবে, তাঁকে যেন বাসি খাবার খেতে বাধ্য করা না হয়। মমতায় নাকি খাবারের স্বাদ বাড়ে। টের পেলাম। অনেকটা পথ বাকি, তাই খেয়েই উঠে পড়তে হল। তিনজন চালক ছিলাম আমরা। পাল্লা দিয়ে ভাবিকে শাপ-শাপান্ত করেছি তিনজনেই বাকিটা পথ। খাবারের আরামে চোখ বুঁজে আসছিল ঘুমে। পাছে মুখ থেকে স্বাদ চলে যায়, এই ভয়ে প্রথম অনেকক্ষণ কেউ কফিও ছুঁয়ে দেখিনি।

ফিরতি পথেও যথারীতি অনেক রাত হয়ে গেল। পরদিন তাঁর মিডটার্ম পরীক্ষা, সহপাঠীদের সাথে রাতভোর ফাইট দেবার কথা, তবু দ্রোহীর কড়া হুকুম, রাতে তাঁর বাড়িতেই খেতে হবে। আগের দফায় ভাবি বলছিলেন, চাটনিটা ডালের সাথে খেলে মজা লাগতো। পাশ থেকে ওয়াসেফ ফরমায়েশ করে ফেলেছিল পরের বার ডাল রাঁধতে। এবারেও খাবারের বন্যা, তবে একেবারেই নতুন সব আইটেম। মাছ, ভর্তা, বড়ইয়ের আচার, চাটনি, ডাল, সবজি, আরো অনেক কিছু। জেনেবুঝেই ইলাস্টিকের কোমড়বিশিষ্ট প্যান্ট পড়ে এসেছিলাম এইবার। এবারে বলে দিতে হয়নি যে ভাবির রান্নায় লবণ কম, ঝাল বেশি। আমরা যে পশুরই উত্তরপ্রজন্ম, তার নিদর্শন রেখে রীতিমত যুদ্ধ করে খেলাম সবাই। হাত ধুতে গিয়ে দেখি গোলাপির রাজত্বে চলে এসেছি। বেরিয়ে এসে ভাবিকে বললাম, সচলায়তনে আপনার কথা লিখলে গোলাপি ভাবি নামে লিখবো। ভাবি হেসে বললেন, তাঁর প্রিয় রঙ অন্য, গোলাপি কোন কিছুই তাঁর কেনা না। মুরুব্বি তখন হামলে পড়লেন প্রতি বিন্দু গোলাপি রঙ কীভাবে সম্প্রদানের হাইওয়ে ধরে এথায় পৌঁছেছে তা ব্যাখ্যা করতে। আমিও ব্যাপক মনোযোগের সাথে ঠাকুর ঘরের কলার বয়ান শুনে গেলাম।

এরপর শুরু হল আড্ডা, এবং দ্রোহীর গোলাপি থেকে কমলা হয়ে লাল হওয়া। যাবার সময় তাড়াহুড়ার কারণে অনেকটা আচমকাই আড্ডা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। সেবার আজমীরকে দেখে দ্রোহী বলছিলেন, চেনা চেনা লাগে। ভাবিকে দেখে আজমীর বলছিলো, চেনা চেনা লাগে। কিয়ৎকাল পর কথাবার্তা ঘুরে গিয়েছিল এক কোণায় পড়ে থাকা কিছু ডাম্বেল, দক্ষিণের উষ্ণ আবহাওয়া, অসামান্য সুন্দরী মেয়েদের ছড়াছড়ি, আর কে বা কারা দেখতে চামচিকার পাছার মত হওয়ায়। এক ফাঁকে দ্রোহী ভাবিকে টিটকারি মেরে বলে বসলেন, সাত-সকালে তিনি রেয়াজ করার সময় নাকি পাশের বাড়ির বাঙ্গালি পড়শি দেওয়াল পিটিয়ে বলেন, বৌকে আর মারিস না! সেবার ভাবি শুধু ধরিয়ে দিয়েছিলেন যে সব রকম প্রাণির পশ্চাৎদেশের প্রতি দ্রোহীর বিশেষ মনোযোগ আছে। ওস্তাদের মার যদি শেষ রাতে হয়ে থাকে, তাহলে ওস্তাদের বৌয়ের মার ফজর ওয়াক্তে।

অভিব্যক্তিতে অসামান্য পারদর্শী গোলাপি/চাটনি ভাবি একের পর এক বলে চলছিলেন আমাদের প্রিয় দ্রোহীর যাপিত জীবনের বিবিধ কৌতূহল-উদ্দীপক ঘটনা। চুম্বক অংশে ছিল বিয়ের পর নতুন মানুষকে কাছ থেকে চেনার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার কথা। দ্রোহী বলছিলেন, ছেলেবেলা থেকে একা ঘুমিয়ে অভ্যাস। রাতে কারো গায়ে হাত লাগলেই নাকি সজোরে হাত চালিয়ে দিতেন। কোন এক কালে ঘুমের মধ্যে এক বড় বোনের গলা টিপে ধরেছিলেন! জানা গেল, রান্নাবান্নার হাতা/নাড়ানি যথাযথ ভাবে ব্যবহার করলে এহেন দুরন্ত পতিকেও শুধরে দেওয়া যায়। সমস্যা হল, হাত চালানো বন্ধ করা গেলেও আলাপচারিতা বন্ধ করা যায়নি অদ্যাবধি। এমনই এক গল্প দিয়ে শেষ করছি দ্বিচল সম্মেলন পর্ব।

ভাবি বলছিলেন ঘুমের মাঝে দ্রোহীর কথা শুনে প্রথমবার জেগে যাবার কথা। নিশিরাত। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। ডাকাডাকি শেষে ঝিঁঝিঁ থেকে কুকুর পর্যন্ত সবাই ক্লান্ত। এমন সময় নীরবতা খান্‌খান্‌ করে দ্রোহী বলে উঠলেন, বিলাইয়া দিয়ো! ধরফরিয়ে উঠে ভাবি জানতে চাইলে কী বিলাতে হবে। অচেতন দ্রোহীর সচেতন জবাব, ঐ যে ঝুলতেসে, যেটা পছন্দ, রেখে বিলায় দিয়ো! বোঝা গেল, বিয়ের উপহারের স্বপ্ন কথা বলছে। কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হয়ে ভাবি আবার শুলেন। এবার ঘুমন্ত দ্রোহীর সহাস্য চিৎকার, অনেক গুলা বৌ, হাঁটাহাঁটি করতেসে! বেচারি ভাবি আবারো উঠলেন, তবে এবার কৌশলে জানতে চাইলেন, তোমার বৌ কোনটা? লজ্জায় লাল হয়ে দ্রোহী বললেন, এই যে এইটা! অচেতন এই প্রেমের কাহানি শুনে আনন্দিত ও মুগ্ধ হয়েছিলাম সবাই।

নাহ, আরো দুয়েকটা বলে যাই। আরেক রাতে নাকি দ্রোহী ঘুমের ঘোরে বলছিলেন, আমি লাইব্রেরিতে! উপরে উঠি! কাগজ কাটি! আরেক রাতে বলে বসলেন, সিচুয়েশন বুঝতে হবে তো! অনেক অনেক ডাটা! বাকি গল্পগুলো নাহয় দ্রোহী ও তাঁর আবজাব সিরিজের জন্যই রেখে দেই।

ভাবি একের পর এক গল্প বলে যাবার সময় দ্রোহী শুধু মাথা নেড়ে বলছিলেন, ইজ্জত মেরে দিলো। হয়তো তা-ই। তবে সব কিছু ছাড়িয়ে গিয়েছিল অসামান্য প্রাণচঞ্চল ও অতিথিবৎসল দ্রোহী দম্পতির ছোট ছোট খুনসুটিগুলো। একজন বলেন আমার মত পাবা না, তো আরেক জন বলেন তোমার চেয়ে ভাল পাবো খুঁজলে। পঁচানোর প্রতিযোগিতার ফাঁকে ফাঁকেই চোখে পড়ে যাচ্ছিল অসামান্য মমতার চিহ্নগুলো। একদিন বেলা সাড়ে বারোটায় ফোন না আসলেই ভাবির অস্থির হয়ে পথে নামা, সুপার-গ্লু দিয়ে ভাবির দুই ঠোঁট লেগে যাবার ভয়ে দ্রোহীর টেনশনে অজ্ঞান হবার দশা, এমন অনেক খুচরো মুক্তায় ভরা ছিল আড্ডাটা।

ভাবির অনবরত হাসি দেখেই বুঝেছি দ্রোহী তাঁকে আনন্দে রেখেছেন। অন্যদিকে সুখী মানুষের নিদর্শন স্বরূপ দ্রোহী নাকি ঘুমের ঘোরে ইদানিং কথা ছেড়ে গান ধরেছেন। সমস্যা একটাই, গানের কথা শুধু বিটিভি-র মত একই ফ্রিকোয়েন্সির একটা পুউউ আওয়াজ।

(চলবে)

No comments: