Tuesday, March 11, 2008

প্রবাসের কথোপকথন ১৩

“একুশে নিয়ে কী করতে চাও বলো, সময় হলে সাহায্য করবো।”
নাটক করা যায় একটা? আমরা সবাই মিলে চেষ্টা-চরিত্র করলে কিছু একটা দাঁড় করানো যায়। এই, তোর না কী আইডিয়া আছে বলছিলি।

“তেমন কিছু না। এবিসিডি কালচার, দেশকে ভুলে যাওয়া, এগুলা নিয়ে কিছু করার চিন্তা ছিল। সময় নেই হাতে একদম, এটাই ঝামেলা। রিসার্চের কাজ নিয়ে দৌঁড়ের উপর আছি একদম।”
তুই শুধু আইডিয়াটুকু বল। সেটাকে রিফাইন করে নাটক বানানোর দায়িত্ব আমরা ভাগ করে নেবো।

“নাটক করতে চাও তোমরা? সেটার জন্য তো অনেক প্রস্তুতি দরকার। মুনীর চৌধুরীর কবর করতে পারো। আমার কাছে তো কোন কিছু তৈরি নেই। তোমরা কবর যোগাড় করতে পারলে সেটা করতে পারতে ছেলেরা মিলে।”
খুঁজে দেখেছি, কিন্তু ইন্টারনেটে পেলাম না। দেশ থেকে আনাতে পারি, তবে সময় লাগবে অনেক। এমনই সাহিত্যজ্ঞান আমার, অন্য কোন নাটকও চিনি না যেটা একুশের সাথে যায়।

“সব ভাবী, বৌদিদের বল একটা করে গান গাইতে। ছেলেদের মধ্যে কেউ কবিতা, বা একুশে নিয়ে কিছু বলতে পারে কিনা দেখো। সময় কম, এটা মাথায় রেখো শুধু।”
সমস্যা অন্য জায়গায়। এবার একুশে পড়েছে বৃহস্পতিবারে। কাউকে পাওয়া যাবে না ঐ দিনে। মিডটার্মও চলছে এখনি। ধুর, একুশে যদি মার্চের ৩ তারিখে হত, তাহলে ঝামেলা হত না কোন। স্প্রিং ব্রেকে সময় নিয়ে কিছু করা যেত। আগে কী করা হত এখানে? লুইজিয়ানা থাকতে একুশেতে কিছু করা হত না, তবে স্বাধীনতা দিবস আর পহেলা বৈশাখ মিলিয়ে একটা অনুষ্ঠান করা হত বেশ জাঁকজমক করে।

“আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিটা ঠিক মত করি। এছাড়া এপ্রিলের দিকে স্ট্রিট ফেয়ারে দেশী খাবার বিক্রি করে ফান্ড জমাই। এই টাকা দিয়েই দেশের আমরা পরে দেশের জন্য কিছু করার চেষ্টা করি। একুশের দিনে আমরা স্টুডেন্ট সেন্টারের শো-কেইসে একটা শহীদ মিনার সাজাই। ওখানে বাংলা লেখা থাকে, আর একুশের ইতিহাস নিয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা থাকে।”
হ্যাঁ, দেখেছিলাম। এবারেও শো-কেস ভাড়া করা হয়েছে এক সপ্তাহের জন্য। ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন আছে একটা। কতটুকু লেখা হয় সাধারণত? মানে, পাকিস্তানিরা কিছু বলে না?

“মিথ্যা তো না, লিখতে কী? করার সময় খেয়াল ছিল না? আর, এটা তো এখন সারা দুনিয়ায় স্বীকৃত ইতিহাস। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।”
তাও কথা। যাক, দেখে নিবো নে আগের বছরের লেখাগুলো। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। সপ্তাহের মাঝখানে এভাবে কিছু একটা আয়োজন করা সম্ভব না। করলে পরের উইকএন্ডে করতে হবে। এত লোকের জমায়েত হলে একটু পরেই খাওয়া-দাওয়া নিয়ে একটা হুলস্থূল শুরু হয়ে যাবে। বুঝতে পারছি না কী করবো।

“কোন ধরনের খাওয়া-দাওয়ার কিছু করার দরকার নাই। অকারণে একটা হৈ-চৈ হবে। হালকা খাবার রাখবা। বিরিয়ানি রান্না করে তো একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করা যায় না। হালকা চিপ্‌স রাখতে পারো কিছু। সাথে চা। সব তুলে রাখবা অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পর্যন্ত। কাউকে ধরতে দেওয়া যাবে না।”
এখানেই তো সমস্যা। অনুষ্ঠান হোক আর না হোক, মুডটা হালকা করে দেওয়ার মত অনেক কিছুই আছে। খাবার থাকলে দেখা যাবে ছাত্রদের মধ্যেই কেউ ওগুলা বের করে ফেললো, অথবা বাচ্চার বাপ-মা এসে বলবে তাদের ছেলে-মেয়েকে কিছু দিতে। মশাল পার্টি চলে যাবে একটু পর পর বিড়ি ফুকতে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের পাশেই টেনিস কোর্ট। লাভের মধ্যে দেখা যাবে একুশেতে নীরবতা পালন করে সবাই মিলে ক্রিকেট খেলছি।

“না, এসব কিছু করতে দিও না। অনুষ্ঠান শেষ হলে যে যার বাড়ি চলে যাবে, কোন লাফালাফি নাই।”
আচ্ছা, আরেকটা সমস্যা। একুশেতে চিপ্‌স দিবো? কেমন হয়ে যায় না? কুড়মুড়ে খাবার যায় না মনে হয় ভাষা দিবসের সাথে।

“ঠিকই। তাহলে নুডুল্‌স দিতে পারো।”
এইটাও তো কেমন কেমন হয়ে যায়। যাক, তবু এটা আপাতত থাকুক। তবে আর যা-ই হোক না কেন, পটলাক্‌ করা হবে না। রান্না ভাগ-বাটোয়ারার ব্যাপার নাই কোন এখানে। সোডার বদলে অন্য কিছু দেওয়া যায়?

“মনে হয় না। সোডাই থাকুক। খাবারের ব্যবস্থা না থাকলে সময়ের ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি করতে হবে। বলে দিতে হবে যে ঠিক বিকেল ৫ টায় আসবো এবং সন্ধ্যা ৭ টার মধ্যে চলে যাবো। এর বেশি দেরি হলেই লোকে খাবার আশা করবে। সবাই একত্র হয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করবো। যারা গান জানেন, তারা দুইটা করে গান গাইলেই হয়ে যায়।”
যোগাযোগ করে দেখলাম এর মধ্যেই। অনেকেই ব্যস্ত। একেকজনের একেক রকম ঝক্কি। কাউকে জোরও করতে পারছি না। তবু বলে রেখেছি। কোন জায়গাও রিজার্ভ করতে পারছি না। বাসায় করলেই খাবার দেওয়ার ভদ্রতা করতে হবে।

“দেখো কী করতে পারো এই ব্যাপারে। যারা গান গাইবে, তাদের কিন্তু অনুষ্ঠানের ভাবগাম্ভীর্য মাথায় রেখে গান তুলতে বল। কেউ আধুনিক গান ধরে বসলে সমস্যা।”
অবশ্যই। ফাস্ট বিটের দেশাত্মবোধক হলেও সমস্যা। কেউ একুশেতে ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ধরে বসলে কেলেংকারি হয়ে যাবে।

“আগে থেকে প্রস্তুতি নিলে ভাল মত করা যেতো। একটা নাটক যোগাড় করতে পারলে হত। ডিসেম্বরের আগে বললে দেশ থেকে কেউ নিয়ে আসতে পারতো।”
গতস্য শোচনা নাস্তি। আপাতত এই দফা ড্যামেজ কন্ট্রোল করে নেই। আমারো ইচ্ছা ছিল রেডিও নাটক জাতীয় কিছু করার। স্ক্রিনিঙ্গের ঝামেলা থাকতো না, সহজে শেখানোও যেতো সবাইকে।

“আমার এক বন্ধু খুব ভাল গান গায়। সাংস্কৃতিক ব্যাপারে খুবই নাম। তবে মহা চাল্লু ছেলে। এসেছিলো জে-১ ভিসায়। কীভাবে যেন কায়দা করে থেকে গেছে।”
এটা কীভাবে সম্ভব? এক্সচেঞ্জ ভিসায় আসলে তো দুই বছর পর দেশে ফেরা বাধ্যতামূলক।

“উহু, ভুল জানিস তুই। একটা ফাঁক আছে। উনি মনে হয় ঐটাই কাজে লাগিয়েছেন। যেই লাইনে পড়াশুনা করেছেন, সেই লাইনে যদি নিজের দেশে কাজ না থাকে, তাহলে আমেরিকায় থেকে যাওয়া যায়।”
উনি না বললেন পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়েছেন? চালু মাল আসলেই।

“এখন তাকে হান্ড্রেড এইটি পে করে বছরে।”
বলেন কী? তার মানে মাসে কত করে পড়ে? নব্বই দুগুণে একশো আশি, পাঁচ আঠেরোং নব্বই, ছয় পনেরোং নব্বই, পনেরো হাজার কর মাসে!

“আজকে ক্যারিয়ার ফেয়ারে এই পোলা হাভাইত্যার মত জিনিস টোকাইসে পুরা।”
কী করবো? চাকরি তো দিবে না কেউ আমাকে। জিপিএর যা করুণ দশা, এই সিমেস্টার শেষ না হলে কিছু আশা করতে পারছি না। আপাতত সামার ধরে থিসিস লিখে ডিসেম্বরে মাস্টার্স করার চিন্তায় আছি। এরাও আমাকে চাকরি দিবে না, আমিও এদের কাছে চাকরি চাইছি না। চারটা ব্যাগ আর গোটা দশেক তাসের প্যাকেট এনেছি।

“এই বেকুব, ভিতরে না দেখেই এতগুলা প্যাকেট আনলি কেন? তাসের মধ্যে কোন ফোটা-ফাটি নাই। টুয়েন্টি-নাইন খেলতেও ব্রিজের মত কাগজ-কলম নেওয়া লাগবে। স্কোরিং করার কিছু নাই।”
শিট!

No comments: