হারানোর আগ পর্যন্ত নাকি মানুষ তার সবচেয়ে বড় সম্পদকে চেনে না। দেশপ্রেম তেমনই ব্যাপার। দেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত খুব কম মানুষই নিজের দেশ, আলো-হাওয়া, মাটি, আর মানুষকে প্রাপ্য সম্মান ও ভালবাসা দিতে পারে। ইংরেজিতে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ যাকে বলে, তেমনই এক অনুভূতি কাজ করে সবার মাঝে দেশ নিয়ে। বাইরে এলে সবকিছু মেলে, শুধু আপনজনকে অবহেলা করার এই সুযোগটুকু বাদে। সারা পৃথিবীর সাথে ভদ্রতার প্রতিমূর্তি হলেও আমরা যেমন মায়ের কাছে দুর্বিনিত, আমাদের কাছে দেশও তেমনটাই অবহেলিত।
দেশ মানে স্রেফ একটি ভূখণ্ড না, দেশের অর্থ অনেক বড়। বাঙালিরা মুষ্টিমেয় সেই জাতিগুলোর একটি, যাদের স্বাধিকার আন্দোলন উৎসারিত হয়েছিল নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরবার মানস থেকে। বাঙালি সংস্কৃতি তাই আমাদের কাছে শুধু ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যম নয়, পরিচয়ের উৎসও। ঠিক-ভুল যেমনটাই হোক না কেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের আগে ধর্মের ভিত্তিতে দেশবিভাগের আন্দোলনও ছিল পরিচয়ের সাথে জড়িত। ফলশ্রুতিতে এই দুই পরিচয়ই কম-বেশি রয়ে গেছে আমাদের মাঝে।
দেশে থাকার সময়টুকুতে আমরা নিজের মন ও মতের মানুষের সাথে মিশে থাকি। নেতৃস্থানীয় কোন অবস্থায় আমরা থাকি না। হাওয়া যেদিকে বয়, সেদিকেই পাল তুলি। কোন বেলায় আশরাফুলের অল্প রানে আউট হওয়া নিয়ে কথা বলি, কোনদিন সংসদে হাসিনা-খালেদার ঝগড়া নিয়ে কথা বলি, কোনদিন হয়তো নতুন কোন নাটকে দেখানো কিম্ভূতকিমাকার ফ্যাশন নিয়ে। বাইরে এলে মূলধারার এই নির্বোধ স্বাভাবিকতা থাকে না। না চাইলেও নেতা গোছের কিছু হয়ে যেতে হয়।
প্রবাসে এলে আমাদের কাজকর্ম দিয়েই যার যার সংস্কৃতির স্বরূপ নিরূপিত হয়। বিশাল পৃথিবীতে আমরা প্রতিটি প্রবাসী যেন ডেকচি থেকে বের করে টিপেটুপে দেখা ভাত। অন্যের ভুলের জন্যও আধাসেদ্ধ থাকার সুযোগ নেই, কারণ একটু এদিক-ওদিক হলেই দোষ পড়বে বাঙালির, ভারতবর্ষের, কিংবা মুসলমানদের। নেতাকে যেমন নিজের আচরণ দিয়ে সবাইকে পথ দেখাতে হয়, তেমনি প্রতিটি প্রবাসীকেও দেশ-ভাষা-ধর্মের স্বার্থে সমঝে চলতে হয়।
এই বাস্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার মত ঘটনা হয়েছিল দু’বার। প্রথমবার মাত্র আমেরিকা আসার পরপর, লুইজিয়ানায়। দুপুরে ক্লাস সেরে ঘরে বসে আছি। হঠাৎ ধপধপে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, আর হাতে বাইসাইকেল। নাম বলার পর জানতে চাইলো কোন ভাষার শব্দ। বাংলা বলতেই ধরিয়ে দিল প্রভু যীশুর বাণি – বাংলায়। আমার জন্য, আমার ভাষার জন্য আলাদা করে লেখা আসে সবকিছু। বাঙালি পরিচয়ে পরিচিত হতেই আমি স্বচ্ছন্দ বেশি, তাই এই শ্লাঘা অস্বাভাবিক ছিল না। তুলনায় দ্বিতীয় ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ বেশি।
রমজান এলেই বাঙালি সমাজ মসজিদ-ভিত্তিক হয়ে যায়। নেকির প্রশ্নে নির্মোহ হয়ে রোজা না রেখে থাকা যায়, কিন্তু বিনামূল্যে ইফতারের ব্যাপারে প্রশ্নে আপোষ নেই। বিকেল হলেই তাই ভিড় করি মসজিদে। মুসলমান ব্রাদারহুডের জয়জয়াকার চারিদিকে। সাধারণত স্টুডেন্ট ইউনিয়নে মুসলিম স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন থেকে ইফতার দেওয়া হয়। গত রোজায় সামনে পড়লো এমন এক ভ্রাতা। জানালেন, তিনি পাকিস্তানি। কথাপ্রসঙ্গে জানলেন, আমি বাংলাদেশের। চূড়ান্ত ধৃষ্টতা দেখিয়ে সেই লোক মিষ্টি হেসে বলে বললো, তুমিও তো তাহলে পাকিস্তানিই। উদ্দেশ্য, আমাকে ভারতীয়দের থেকে আলাদা করে তার সাচ্চা ব্রাদারের সম্মান দেওয়া। বিরক্ত হয়ে বললাম, যদি আমি পূর্বপরিচয়ের সূত্রেই পরিচিত হব, তবে ব্রিটিশ না হয়ে পাকিস্তানি কেন? তুমি মুড়ি দিয়ে ইফতার খাও, আমি গেলাম।
প্রবাসে এসে আচমকা সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়াটা একটি বিরাট ধাক্কা দেয় অনেককে। এই ধাক্কা সামলানোর জন্য মানুষ পরিচয় খোঁজে, নিজের একটি স্থান খোঁজে। আমিত্বের ধারণাটির পেছনে স্বকীয়তা যতটা, তার চেয়ে বেশি কাজ করে প্রশ্নাতীত অধিকার। পরিচয় খুঁজবার সময় এলে মানুষ তেমনই কিছু খোঁজে। ধর্ম ও সংস্কৃতি উভয়ই তেমন সুবিধা দেয় মানুষকে। আমি বাঙালি ও মুসলমান, আমার এই দু’টি পরিচয় নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না, কোন ধরনের সামাজিক বাস্তবতা আমার এই পরিচয়গুলোকে হেয় কিংবা খাটো করতে পারবে না।
এ-পর্যায়ে প্রশ্ন জাগে, সংস্কৃতি বা ভাষার পরিচয় বাদ দিয়ে মানুষ ধর্মের দিকে ঝোঁকে কেন। উত্তর খুব সহজ। প্রচার-প্রসারের তুলনামূলক সুবিধা। ভাষার ভিত্তিতে যে-পরিচয়, তা প্রদর্শন করতে হলে গান, আবৃত্তি, নাচ, কিংবা অন্য কোন ধরনের সুকুমারবৃত্তির অধিকারী হতে হবে। ধর্মের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সহজতর। দু’-দশ মাইল পর পর মসজিদ আছে, সেখানে নিয়মিত জড়ো হওয়া মুসল্লি আছে, আছে হালাল দোকান ও দোয়ার আসর। পরিচয়ের আভিজাত্যও থাকে, পরকালের নিশ্চয়তাও বাড়ে।
প্রবাসের আলো-হাওয়ায় দিনাতিপাত করলেও কম-বেশি প্রত্যেকেই সে-দেশগুলোর সংস্কৃতিকে সমর্থন করেন না। সন্তানদের সবাই গড়ে তুলবার চেষ্টা করেন স্বদেশী রক্ষণশীলতা ও সংযমের সাথে। সে-ক্ষেত্রে সংস্কৃতির শিক্ষা দেওয়া অনেক দুষ্কর, তুলনায় ধর্ম অনেক সহজ। ধর্মের পথ বিস্তারিত ভাবে সংজ্ঞায়িত হওয়াও এর পেছনে ভূমিকা পালন করে।
এভাবে ভাবার ভেতর ক্ষতির কিছু নেই। সাধারণ ভাবে বাইরে এলে সবাই একটি বেশি নামাযি হয়ে যাওয়াতেও ভ্রুকুটি করবার কিছু নেই। নিঃসহায় অবস্থায় মনকে স্থির ও শান্ত রাখতে ধর্মের উপযোগিতা অনস্বীকার্য। আমি আমার মুসলমান পরিচয় নিয়ে আর দশ জনের মতই গর্বিত। তবুও গোল বেধে যায় বাঙালি আর মুসলমান পরিচয় দু’টির মাঝে। আমার মায়ের মত ধর্মভীরু অনেকে খুব নির্বিষ ভাবেই মুসলমান পরিচয়কে বাঙালি পরিচয়ের আগে রাখেন। এভাবে ভাববার অসারতা আমার চোখে প্রকাশ পেয়েছিল উপরে উল্লেখকৃত দ্বিতীয় ঘটনার সময়। শুধু মুসলমান বলেই আমি কোন পাকিস্তানি বা রাজাকারের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে পারবো না। আমার বাঙালি ও বাংলাদেশি পরিচয়গুলো কোথায় যেন পীড়া দেয় আমাকে মনের ভেতর। সেই মর্মবেদনা থেকেই আমি জানতে পারি আমার প্রথম পরিচয় কী।
পরিচয়ের এই দ্বন্দ্বগুলো সাধারণত মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নিজের মানুষ ও ভূমি থেকে বিচ্যুত হবার পর। এই ধারার বিপরীত একজন মানুষের সাথে আমার পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়েছিল অনেক বছর আগে। আমার প্রবাসে আসবার পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিলেন অনেক শ্রদ্ধার নাভেদ ভাই। বিতর্কসংশ্লিষ্ট সবাই তাঁকে এক নামে চেনেন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক হিসেবে। ২০০৩ সালের কথা। নাভেদ ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলছি ভর্তির বিভিন্ন খুঁটিনাটি নিয়ে। এমন সময় ইটিভি’তে শুরু হল মাহমুদুজ্জামান বাবুর কণ্ঠে বাংলার গান। নাভেদ ভাই বলে উঠলেন, ইশতি একটু ধরো, গানটা শুনে আসি; এই গান শুরু হলে আমি সব ফেলে রেখে একবার গানটা শুনি।
দেশটা ছেড়ে চলে যাবো কিছুদিন পর, এই বাস্তবতা মাথায় তখনই প্রথমবার আঘাত করে। সেই গানটির কারণেই পুরো একটি প্রজন্ম বাংলায় গান গায়, বাংলার গান গায়, বুঝে-শুনে গায়। শুধু আমি নই, কম-বেশি প্রতিটি মানুষেরই জীবন বন্দী হয়ে আছে এই গানের মধ্যে। প্রতুলের অসামান্য মূল গানটির চাইতে অনেকাংশে ভিন্ন হলেও বাবু’র গানটি যেন দাবানলের মত ঘিরে ফেলেছিল সবাইকে। এই গানটি না থাকলে পরিচয়ের যুদ্ধে বাংলা অনেকটাই পিছিয়ে যেত।
বাংলার গানে তাই শুধু জীবন নয়, আমার সম্পূর্ণ অস্তিত্বই বন্দী।
প্রতুলের কণ্ঠে বাংলার গানঃ
|
মাহমুদুজ্জামান বাবু'র বাংলার গানঃ
ফুয়াদের ঝালমুড়ির কৌটায় বাংলার গানঃ
Ami Banglay Gaan Gai - Laboni - Fuad Featuring
No comments:
Post a Comment