Tuesday, August 04, 2009

ডিজিটাল বাংলাদেশঃ ২ [জাতীয় পরিচয়পত্র]


জাতীয় পরিচয়পত্র ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট

ভাবতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্য যে ডিজিটাল দেশ গড়ার প্রথম শর্ত হলো প্রতিটি নাগরিককে একটি নম্বরে বন্দী করা। দ্বিতীয় কাজ হলো এই নম্বরটিকে যথাসম্ভব নিরাপদ করা। তৃতীয় কাজ হলো প্রতিটি নম্বরের মালিককে যথাসম্ভব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া। বহু বছরের চেষ্টা শেষে গত নির্বাচনের আগে এই প্রথম ধাপটি অতিক্রম করলো বাংলাদেশ। রাজা থেকে উজির পর্যন্ত প্রত্যেকেরই একটি পরিচয়পত্র আছে। এতে ছবি আছে, আছে শনাক্তকরণের জন্য কিছু তথ্য। এই নম্বর বর্তমানে পাসপোর্ট থেকে নির্বাচন পর্যন্ত সর্বত্র ব্যবহার হচ্ছে।

দুর্বৃত্তের কবল থেকে বর্তমান ধাঁচের পরিচয়পত্র খুব বেশিদিন নিরাপদ রাখা যাবে না। পৃথিবীময় তাই অনেক রকম প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে এই নম্বর বা পরিচয়পত্রগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। দিন দিন যুক্ত হচ্ছে অনেক রকম ইলেকট্রনিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম। যে-দেশে গলাকাটা পাসপোর্টের প্রতুলতাই রোধ করার উপায় নেই, সে-দেশে স্রেফ ছবি দেখে শনাক্তকরণের উপর ভরসা রাখা দুষ্কর।

পরিচয়পত্র নিরীক্ষার বর্তমান পদ্ধতি শুধুমাত্র ছবি মিলিয়ে দেখা। সরকারের কাছে একটি ছবি থাকে, আর ব্যবহারকারীর কাছে থাকে কার্ড। চোখের দেখায় ছবি মিলিয়ে রহিমকে রহিম বলে শনাক্ত করা হয়, করিমকে করিম বলে। এক্ষেত্রে জালিয়াতি প্রধানত দু’রকম হতে পারে।

যেখানে কেন্দ্রীয় ভাবে সংরক্ষিত ছবির সাথে মিলিয়ে দেখা হয় – যেমন নির্বাচন কমিশন – সেখানে রহিমের মূল ছবিটি বদলে করিমের একটি ছবি রেখে দেওয়া দুষ্কর কিছু নয়। এরপর রহিমের অজান্তেই তার পরিচয়ে জীবন চালাতে পারে করিম।

দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হলো নিজের ছবি তুলে একটি পরিচয়পত্র তৈরি করে ফেলা। এটি ব্যবহার হতে পারে এমন স্থানে যেখানে ছবি ব্যবহার হলেও কেন্দ্রীয় ভাবে সংরক্ষিত ছবির সাথে মিলিয়ে দেখা হয় না – যেমন, বাজার-ঘাটে পরিচয় দেওয়া, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সময় পরিচয়পত্র দেখানো, ইত্যাদি।

এই দুর্বলতা নিরসনে ভবিষ্যতে এমন কার্ড দরকার যা তার চুম্বক-স্মৃতিতে কিছু মৌলিক তথ্য সংরক্ষণ করবে। এটি হতে হবে এমন তথ্য যা শুধু সেই পরিচয়পত্রের প্রকৃত মালিক জানবেন। ধরা যাক রহিম ও করিমের একজনের গুপ্ত সংকেত ১২৩, অন্য জনের ৪৫৬। শুধু এটুকু তথ্য থাকলে তা খুব সহজেই জেনে যাওয়া সম্ভব। প্রয়োজন তাই আরেকটু কঠিন কিছু।

একটি পদ্ধতি হলো কেন্দ্রীয় সার্ভারে সংরক্ষিত ছবির সাথে স্বয়ংক্রিয় ভাবে মিলিয়ে নেওয়া। একটি স্ট্যাম্প-সাইজ ছবিতে প্রায় ৮০৪ পিক্সেল পরিমাণ তথ্য থাকে। এই পরিমাণ তথ্য ও আনুষাঙ্গিক প্রক্রিয়াকরণ দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে কেন্দ্রীয় ভাবে যাচাই করার প্রয়াস সুতার উপর ট্রাক চালানোর মতো ব্যাপার। তুলনায় অনেক কার্যকর পদ্ধতি হলো আঙ্গুলের ছাপ মিলিয়ে নেওয়া। এটি বর্তমানে বহুল-ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলোর একটি।

প্রতিটি মানুষের হাতের ছাপ ভিন্ন। এমনকি যমজ ভাই-বোনের হাতের ছাপও ভিন্ন হয়। এটি প্রতিটি মানুষেরই আছে, এবং এটি কোন পাসওয়ার্ডের মতো কষ্ট করে মুখস্তও রাখতে হবে না। কম্পিউটারে এই ভিন্নতাকে ধারণ করা হয় কো-অর্ডিনেট সিস্টেমের মাধ্যমে। পাঠক নিজের ডান হাতের তর্জনীর দিকে তাকালে দেখবেন, কোনো কোনো স্থানে হাতের দাগগুলো ভাগ হয়ে গেছে কাটা চামচের মতো (ফর্ক), কোথাও কোথাও দাগের সমাপ্তি ঘটেছে (টারমিনেশন), আর কোথাও কোথাও তৈরি হয়েছে পাহাড়চূড়া (মিনুশা পয়েন্ট)। মূলত এই তিনটি বিশেষত্বের অবস্থান দিয়েই গঠিত হয় একজন মানুষের ‘পরিচয়’।

এই তথ্য সংরক্ষণের জন্য একটি সাধারণ মেট্রিক্স যথেষ্ট। প্রান্তিক ভাবে বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই পদ্ধতিকে আরও শক্তিশালী করা সম্ভব। কেন্দ্রীয় সার্ভারেও নামের বিপরীতে একটি হাতের ছাপ সংরক্ষণ করা সহজতর। কেন্দ্র ও প্রান্ত উভয় ক্ষেত্রেই উচ্চতর প্রযুক্তি ব্যবহার করে পদ্ধতিটি শক্তিশালী করা সম্ভব। এই সামগ্রিক পরিবর্তন কোন ভাবেই তথ্য আদান-প্রদানের প্রক্রিয়াটি প্রভাবিত করবে না। পক্ষান্তরে, একটি ছবি কেন্দ্রীয় ভাবে যাচাই করার জন্য অনেক বেশি পরিমাণ তথ্য আদান-প্রদান করতে হয়। সাথে রয়েছে চেহারার বিভিন্ন অংশ খুঁজে বের করা, সেগুলোর আইগেন ভ্যালু নেওয়া, ইত্যাদি জটিলতা।

পরীক্ষায় দেখা গেছে, যান্ত্রিক ভাবে যাচাইকৃত ছবির ব্যর্থতার হার ২০ থেকে ৪০ ভাগ। তুলনায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করলে ব্যর্থতার হার কমে ২.৫% -এ নেমে আসে। এখনও পর্যন্ত জানা পদ্ধতির মধ্যে শুধুমাত্র ডিএনএ পরীক্ষা করেই এর চেয়ে সফল ভাবে পরিচয় যাচাই করা সম্ভব।

খুব সহসা না হলেও ২০২১ নাগাদ এই পদ্ধতি খুব সহজেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব বাংলাদেশে। জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির প্রাথমিক ধাপেই এ-ধরনের দিক-নির্দেশনা দেওয়া থাকলে সকল নাগরিকের হাতের ছাপ সংরক্ষিত থাকবে, যা ভবিষ্যতে অপরাধ দমনেও সাহায্য করবে ব্যাপক ভাবে।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ক্রেডিট কার্ড কিংবা পাসওয়ার্ডের ধারণার সাথে পরিচিত নয়। ব্যবহারকারীকে স্বয়ংক্রিয় ভাবে শনাক্ত করা তাই অনেক দুষ্কর। ফিঙ্গারপ্রিন্ট-ভিত্তিক পদ্ধতি ব্যবহারের অন্যতম সুবিধা হলো নিরক্ষর মানুষের প্রতিও এটি প্রযুক্তিবান্ধব। যুগ যুগ ধরে চলে আসা টিপসই প্রথার সাথে সবাই পরিচিত। স্রেফ আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে মানুষকে শনাক্ত করা গেলে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিভিন্ন রকম সুযোগসুবিধা দেওয়া সহজ হবে। নিরক্ষর কেউও খুব সহজে নিজের চাহিদার কথা জানাতে পারবেন।

প্রযুক্তির সুফল প্রান্তিক নাগরিকের কাছে পৌঁছে দিতে হলে তিনটি ধাপ প্রয়োজন – পরিচয়, শনাক্তকরণ, এবং সেবা। সেবা খাত আগে থেকেই আছে, তবে তা মূলত শহরকেন্দ্রিক। পরিচয় তৈরি করা হচ্ছে নির্বাচনের প্রয়োজনে। শনাক্তকরণের সেতুটি গড়ে দিলেই মানুষ সহজে বিদ্যমান সেবা পেতে পারে। তবে এর সবচেয়ে বড় সুফল হলো ভোক্তাকে চেনার সুবিধা, তাঁর (অনেক ক্ষেত্রেই সহজ ও সীমিত) চাহিদা সম্পর্কে অবগত হওয়া। এই সুফল পেলে সেবা খাতও অনেক এগিয়ে যাবে।

উদাহরণ হিসেবে সদ্য পাশ করা একজন কম্পিউটার/তড়িৎকৌশল প্রকৌশলীর দিকে তাকানো যায়। দেশের শীর্ষস্থানীয় এই ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ভবিষ্যৎ বলতে আছে বিদেশে চলে যাওয়া, মোবাইল কোম্পানিতে কাজ (এবং পাশাপাশি আইবিএ-তে এমবিএ) করা, নয়তো হাতে-গোনা কিছু আউটসোর্সিং কোম্পানিতে যোগ দিয়ে টুকটাক প্রোগ্রামিং করা। এঁদের যোগ্যতা ও সম্ভাবনা অনেক, কিন্তু এঁদের কাছে চাহিদা এটুকুই। এঁদের মাঝে মুষ্টিমেয় ক’জন মেটাচ্ছেন খুব উঁচু পর্যায়ের ভোক্তা/ক্রেতার দুরূহ কিছু চাহিদা। যদি এঁদের সবার কাছে কৃষক-মজুর-মুটেদের চাহিদা পৌঁছে দেওয়ার একটি পথ খুলে দেওয়া যায়, তবে তাঁরা খুব সহজেই তা পূরণ করতে পারেন। প্রকৌশলী থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সবাইই তখন উচ্চতর অবস্থান অর্জন করবেন। এভাবেই প্রথমত ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করে একটি বিশ্বস্ত শনাক্তকরণ পদ্ধতি তৈরি করা যায়, এবং তা বিবিধ ভাবে কাজে লাগিয়ে আধুনিকায়ন করা যায়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ-ধরনের বায়োমেট্রিক তথ্যসমৃদ্ধ চিপ ব্যবহার করেই ইলেক্ট্রনিক পাসপোর্ট তৈরি হয়। এই আধুনিক পাসপোর্টে একটি ডিজিটাল ছবি জুড়ে দেওয়া হয়। আগামী কিছু বছরের মধ্যে উন্নত বিশ্বে যাতায়াতের জন্য ইলেক্ট্রনিক পাসপোর্ট আবশ্যক হতে যাচ্ছে। অতএব, কোনো না কোনো পর্যায়ে বাংলাদেশের অনেক মানুষকেই নতুন করে পাসপোর্ট গ্রহণ করতে হবে। দেশব্যাপী কোনো প্রকল্প হাতে না নিলেও অন্তত এই নতুন পাসপোর্ট ইস্যুর সময় নিজস্ব একটি বায়োমেট্রিক ডেটাবেজ তৈরির দিকে নজর দেওয়া উচিত। অতঃপর সীমিত পরিসরে হলেও এর ব্যবহার ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। এভাবেই হাঁটি হাঁটি পা পা করে কিছু বছরের মধ্যে একটি ব্যাপক তথ্যভাণ্ডার গড়ে উঠবে।

No comments: